কোন ধরনের মানুষ থেকে ডায়াবেটিস নিজেই দূরে থাকে?
কোন ধরনের মানুষ থেকে ডায়াবেটিস নিজেই দূরে থাকে?
নূর আহমদ : শিক্ষক; কলামিস্ট; গবেষক
ডায়াবেটিস রোগটির নাম আমি কখন, কত বছর বয়সে শুনেছি, মনে নেই। তবে ১৯৯৪-৯৫ সালের দিকে, আমার বয়স যখন ১৪-১৫ বছর, তখন আমার এক সহপাঠি ছিল আফসারুল আলম সিদ্দিকী সেলিম নামে, বেশ মেধাবী ছিল। সে মাঝে মাঝে তার বাবার কথা বলতো। বলতো, তার বাবার নাকি ডায়াবেটিস। তার বাবা কোনো একটা চাকরি করতেন। চাকরি থেকে তখন অবসরে ছিলেন। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত কোনো রোগী হিসেবে প্রথমে হয়তো তার কথাই জেনেছি। তার ডায়াবেটিসের কথা প্রথম আমার ওই ক্লাসমেটের মুখ থেকেই শুনেছি। আমাদের বংশের কারো, বা আমাদের কোনো আত্মীয়ের ডায়াবেটিসের কথা কানে আসেনি তখনও। এরপর ধীরে ধীরে ডায়াবেটিস রোগটির সাথে আরো ভালোভাবে পরিচিত হতে থাকি।
সর্বশেষ খবর, আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক কয়েকদিন আগে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। এর আগে গত তিন বছরের মধ্যে আমাদের বাড়ির দু’দুজন লোক ডায়াবেটিসের তীব্রতায় মারা গেছেন। একজনের নাম আবুল বাশার, আরেকজন আবুল বাশারের প্রয়াত বড় ভাইয়ের স্ত্রী। আরো কিছু খবর দেয়া যাক। ২০১৫ সালে আমার এক সহকর্মীর বড় ছেলেটি পঞ্চম থেকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠার কিছুদিনের মধ্যে তার ডায়াবেটিস দেখা দেয়। আমার ওই সহকর্মী বিষয়টা বলে অনেক সময় খুবই দুঃখ করতেন। বলতেন, ‘ছেলেটার সামনে সম্ভাবনাময় লম্বা জীবন। এতো অল্প বয়সেই ছেলেটা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়লো!’
বলে রাখছি, ছেলেটার বাবা-মা কেউই তখন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিল না। আর ছেলেটা শারীরিকভাবে কেমন ছিল, তা একটু পরেই আলোচনায় আসবে।
যাহোক, আমাদের বংশের বা আত্মীয়দের অনেকেই এখন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। আমার বড় ভাই এবং মেঝো ভাইও। তবে আমার বাবা এখনো আক্রান্ত নয়। আমার দু’ভাই আক্রান্ত হবার অনেক পর গত দু’তিন বছর ধরে আমার মায়ের ডায়াবেটিস লক্ষ্যণীয় হচ্ছে। তবে মাত্রায় কম। কয়েকদিন আগেও আমি মেপে দেখেছি।
এবার মূল কথায় আসছি। প্রশ্ন ছিল, কোন ধরনের মানুষ থেকে ডায়াবেটিস নিজেই দূরে থাকে? সত্যি বলতে কী, এই প্রশ্নের উত্তরে এখনো এমন মানুষ খুব কম পাওয়া যাবে, যারা নির্দিষ্টভাবে প্রশ্নটির উত্তর দিতে পারবেন। বেশির ভাগ মানুষই হিমশিম খাবেন। কারণ?
কারণটা আর কিছু নয়, ডায়াবেটিসের কারণ নিয়ে বিশ^ব্যাপী নানান বিভ্রান্তি।
এখনো এ সম্পর্কীয় কোনো নিবন্ধে, কোনো গবেষণাপত্রে, কোনো বিশেষজ্ঞের মুখে ডায়াবেটিসের নির্দিষ্ট কারণের কথা খুঁজে পাবেন না। একেক জায়গায় দেখবেন ডায়াবেটিসের একেক কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। অল্প কিছু কারণ সব জায়গায় মিললেও অধিকাংশ কারণ মিলে না। জেনে অবাক হবেন, ডায়াবেটিসের কারণ নিয়ে লিখিত নিবন্ধগুলোতে ডায়াবেটিসের কারণ সম্পর্কে এমন সব বিষয়ও উল্লেখ থাকে, যেগুলোর সাথে বাস্তবে ডায়াবেটিসের কোনো সম্পর্কই নেই। ভাসা ভাসা পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে এসব মন্তব্য করার কারণেই এই বিভ্রান্তি।
যেমন: বলা হয়, ডায়াবেটিস বংশগত কারণেও হয়ে থাকে। এখন যদি আপনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, আপনার পরিচিত কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছে, অথচ তার বাবা-মা কারো ডায়াবেটিস নেই। তখন আপনাকে ব্যাখ্যা করে বলা হবে, সবার ডায়াবেটিস বংশগত কারণে হয় না। অনেকের হয়, অনেকের আবার অন্য কারণে হয়।
একজন লোকের বাবা-মা কারো ডায়াবেটিস ছিল/আছে। সে ডাক্তারের কাছে গেলে ডাক্তার তাকে জিজ্ঞেস করে যখন জানতে পারে, তার বাবা/মা কারো ডায়াবেটিস ছিল/আছে, তখন ডাক্তার আর কিছু না ভেবে তাকে বলে বসে, আপনার ডায়াবেটিস বংশগত কারণেই হয়েছে। প্রশ্ন হলো, যেসব ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তির বাবা-মা কারো ডায়াবেটিস হয়নি, যদি বংশগত ছাড়া অন্য কারণে তাদের ডায়াবেটিস হয়ে থাকে, তাহলে যাদের বাবা-মা কারো ডায়াবেটিস ছিল/আছে, তারা ওই ‘অন্য কারণে’ কি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারে না? এই জটিল প্রশ্নের উত্তর দেয়া অনেকের জন্য কঠিন হবে।
অথচ ডায়াবেটিসের প্রকৃত কারণ সবার সামনে পরিষ্কার হলে এই জটিল প্রশ্নের উদ্ভবই হতো না।
বলা হয়, ধূমপানেও নাকি ডায়াবেটিস হয়। আমার দেখা অসংখ্য মানুষ আছে, ধূমপান করেন না, তবু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। আমার বড় ভগ্নিপতি, আমার বড় দু’ভাই ধূমপানের ধারেকাছেও যান না, তবু কেন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত? ধূমপান কোনো কোনো দিক দিয়ে ক্ষতিকর হতে পারে। কিন্তু একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর খোঁজ নিয়ে যখন দেখা যায়, তার মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার অন্য কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না, শুধু সে ধূমপান করে, তখন তার ডায়াবেটিসের জন্য ধূমপানকে দায়ী করে বসা কি ঠিক?
এভাবে ডায়াবেটিসের কারণ নিয়ে অনেক অনেক ধারণা সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। চিনি বেশি খেলে ডায়াবেটিস হয়, এই কথা শুনে শুনে অনেক মানুষ চিনি/মিষ্টান্ন খাওয়াই অনেক কমিয়ে দিয়েছে।
এবার চলুন, আমরা দেখি, সত্যিই ডায়াবেটিস কোনো কোনো মানুষ থেকে দূরে দূরে থাকে কিনা! আমরা যদি সমাজের মানুষগুলোকে দুই শ্রেণিতে বিভক্ত করি: একদিকে রাখি কায়িক শ্রমে নিযুক্ত মানুষদেরকে, অন্যদিকে রাখি আরামের পেশায় নিযুক্ত এবং আরামপ্রিয় মানুষদেরকে, পরিষ্কারভাবে দেখতে পাবো, ১০ বছরের বেশি সময় ধরে পেশাদারভাবে কায়িক শ্রমে নিযুক্ত মানুষগুলোর কেউই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নয়। এদের অনেকের বাবা-মা কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও, অনেকে নানা কারণে টেনশনে ভোগা সত্ত্বেও, এদের অধিকাংশই চিনি বা মিষ্টি জাতীয় খাবার বেশি খাওয়া সত্ত্বেও এমনকি এদের অধিকাংশই ধূমপানে আসক্ত হওয়া সত্ত্বেও।
অন্যদিকে আরামে থাকতে যারা পছন্দ করে, তাদের অনেকেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। বাকিরা হয়তো ওয়েটিং লিস্টে আছে। আরাম শুরু করেছে হয়তো বেশি দিন হয়নি। এই শ্রেণির মানুষকেই খুঁজে খুঁজে হামলা করছে ডায়াবেটিস। অথচ খোঁজ নিলে দেখবেন, এদের অনেকের বাবা-মা এখনো ডায়াবেটিস থেকে মুক্ত, অনেকের জীবনে টেনশনও তেমন একটা নেই, এদের অনেকে ধূমপানও করেন না!
তবু কেন এরা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়? কারণ এদের অধিকাংশই মোটা বলে এবং কোনো রকম শারীরিক পরিশ্রমের সাথে জড়িত নয় বলে এদের শরীরে বাড়তি চর্বি হয়ে গেছে, যে চর্বিগুলো এরা ক্ষয় করে না। যে চর্বিগুলো খাওয়ার কেউ নেই! আমার যে সহকর্মীর ছেলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠার পর ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলো, সেও মোটা ছিল। এছাড়া আমার পরিচিত যাদের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার কথা বলেছি, তারা সবাই মোটা। সবচেয়ে বড় কথা, এরা শারীরিক পরিশ্রমের কাজ থেকে দূরে ছিল। যার ফলে ডায়াবেটিস এদেরকে খুঁজে খুঁজে আক্রমণ করছে।
অন্যদিকে পেশাদার শ্রমজীবি বা কঠোর শারীরিক পরিশ্রমের সাথে জড়িত মানুষদেরকে ভয় করছে ডায়াবেটিস। কারণ তাদের কাছে গেলে না খেয়ে মরতে হবে। তাদের শরীরে যে বাড়তি চর্বি নেই!
এই শ্রেণির লোকগুলো থেকে ডায়াবেটিস নিজেই ১০০ হাতের বেশি দূরে থাকে। তাই আমাদের দরকার শারীরিক পরিশ্রম করে করে শরীরে বাড়তি চর্বি হতে না দেয়া। এনার্জি ক্ষয় করা। কারণ চর্বি বাড়তি হলেই ডায়াবেটিস হামলা করে বসতে পারে!
0 Comments: