হার্ট অ্যাটাক কেন হয়, এখনো অনেকেই জানে না!
হার্ট অ্যাটাক কেন হয়, এখনো অনেকেই জানে না!
নূর আহমদ : শিক্ষক; কলামিস্ট; গবেষক
‘টেনশনে মানুষ হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়’ কথাটি আপনি কখন থেকে শুনে আসছেন, জানি না, তবে আমি শুনে আসছি ছোটবেলা থেকে। আমার বিশ্বাস, আপনিও আপনার ছোটবেলা থেকে কথাটি শুনে আসছেন। কারণ কথাটি শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ^ব্যাপী প্রচারিত হয়ে আসছে যুগের পর যুগ ধরে। আমাদের পরিচিত কেউ হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলে আমরা সবাই মনে করি, লোকটি নিশ্চয়ই টেনশন করতো বেশি বেশি, এই জন্যই সে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়েছে। এই ধারণাটা মিশে গেছে আমাদের মন-মগজে, আমাদের রক্ত-মাংসের সাথে। এই ধারণা বা বিশ্বাসটি আমাদের মন থেকে মুছে ফেলা খুবই কঠিন।
যারাই হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়, তারা যে প্রবলভাবে মানসিক চাপে ভুগতো, এটা কি সত্য? আমরা কি আমাদের পরিচিত সব হার্ট অ্যাটাক রোগীর খোঁজ নিয়ে দেখি? দেখি না। ‘কান নিয়েছে চিলে’র মতো যার-তার ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাকের জন্য দায়ী করে বসি টেনশনকে, যদিও সে আদৌ কোনো টেনশন করতো কিনা, তা একটিবারের জন্যও খোঁজ নিয়ে দেখি না। লোকটি বাস্তবে হয়তো তেমন একটা টেনশন করতো না, তবু লোকটিকে টেনশন করতো বলে নিজে নিজেই বিশ্বাস করে নিই!
বাস্তবে দেখা যায়, হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত অনেক রোগীরই বাস্তব জীবনে তেমন কোনো টেনশন থাকে না। কারো কারো থাকতে পারে। তাছাড়া টেনশনে আক্রান্ত যারা হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হন, তাদের হার্ট অ্যাটাক যে টেনশনের কারণেই, ধারণটি সঠিক নয়। টেসশন না করলেও সে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হতো।
আমাদেরকে আগে জানতে হবে, হার্ট অ্যাটাক কী কারণে হয়?
হার্ট অ্যাটাক হয় ঐ সব লোকের, যাদের শরীরে বাড়তি চর্বি-কোলেস্টেরল থাকে। মানুষের হার্টে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্থ হলেই মূলত মানুষ হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়, এই জন্যই হার্ট অ্যাটাককে হার্ট ব্লকেজও বলা হয়। হার্ট ব্লক্ড হয় কিভাবে? হার্টে চর্বি জমে গেলে হার্ট রক্ত সরবরাহ করতে বাধাগ্রস্থ হওয়াটাকেই হার্ট ব্লকেজ বলা হয়। এজন্য হার্ট ব্লকেজ হলে যারা চিকিৎসা পর্যন্ত বেঁচে থাকার সুযোগ পান, তাদের অনেকের হার্টে বাইপাস সার্জারী করা হয়। বাইপাস সার্জারী করে রক্ত সরবরাহের জন্য হার্টের মধ্যে বিকল্প ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। বিকল্প ব্যবস্থা করার পর হার্ট আগের মতো সহজে রক্ত সরবরাহ করতে পারে। এই কথার সত্যতা সম্পর্কে দুইটি রেফারেন্স উল্লেখ করতে হচ্ছে। বাংলাদেশ প্রতিদিনে ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে ‘‘হার্ট ব্লক যাবে চেনা যদি থাকে এনজিনা’’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে সিনিয়র কনসালটেন্ট ও কার্ডিওলজিস্ট ডা. এম শমশের আলী। তিনি নিবন্ধের শুরুতেই লিখেন, ‘‘হৃৎপিন্ড বা হার্টের রক্তনালিতে চর্বি জাতীয় পদার্থ জমে ব্লকের সৃষ্টি করে। সাধারণভাবে এটাকেই হার্ট ব্লক বলা হয়। হার্টের রক্তনালিতে ব্লক থাকার ফলে রক্তপ্রবাহ কমে যায়। এ অবস্থায় হৃৎপিন্ড তার চাহিদামতো রক্ত সরবরাহ না পাওয়ায় হার্টের কার্যক্রম দারুণভাবে ব্যাহত হতে থাকে।’’ [https://www.bd-pratidin.com/health/2018/09/13/360116]
‘‘হার্ট অ্যাটাক কাদের হয়, কী করবেন?’’ শিরোনামে আরেকটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় দৈনিক যুগান্তরে ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে। নিবন্ধটিতে প্রফেসর ডা. রাকিবুল ইসলাম লিটু লিখেন, ‘‘বিভিন্ন কারণে হার্টের রক্তনালীতে চর্বি ও রক্ত জমাট বেঁধে রক্তনালীতে ব্লক সৃষ্টি করে হার্টের কোষের মৃত্যু ঘটায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এই অবস্থাকে হার্ট এ্যাটাক বলে। যেমন ডিপ টিউবয়েলের পানি চৌবাচ্চায় জমা হয়ে নালা/ড্রেইন দিয়ে ধান ক্ষেতের পথে পানি যেতে বাধাপ্রাপ্ত হলে ধান মারা যায়-ওকে আমরা ধান এ্যাটাক বলি। ঠিক তেমনি হার্ট এ্যাটাকও তাই।’’ [https://www.jugantor.com/doctor-available/95223]
হার্ট ব্লকেজ বা হার্ট অ্যাটাক সম্পর্কে এরকম যত নিবন্ধ পড়বেন, যত ডাক্তারের সাথে আলোচনা করবেন, এই সত্যটাই জানা হবে আরো ভালোভাবে যে, হার্টে চর্বিজাতীয় পদার্থ জমা হতে হতে রক্তনালীর মধ্য দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হওয়ার পথকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে বন্ধ (ব্লক) করে দেওয়াকেই হার্টে ব্লক বা হার্ট অ্যাটাক বলা হয়ে থাকে। আপনি গুগলে ‘হার্ট ব্লক কিভাবে হয়’ লিখে খুঁজলেই এরকম অনেক নিবন্ধ পাবেন।
তাহলে বুঝা যাচ্ছে, হার্ট ব্লকেজ বা হার্ট অ্যাটাকের মূল কারণ হার্টে চর্বি জমে যাওয়া। যদি এটাই মূল কারণ হয়, তাহলে টেনশন হার্ট অ্যাটাকের মূল কারণ হবার কথা সত্যি নয়। যার জীবনে টেনশন নেই বা কম, তার শরীরে যদি চর্বি বেড়ে যায়, সে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হতেই পারে। অন্যদিকে যার জীবনে টেনশন বেশি, তার শরীরে যদি চর্বি তেমন না থাকে, তার হার্ট ব্লক্ড হবে কিভাবে? অসম্ভব।
এবার আরেকটা বিষয় দেখুন। যারা নিয়মিত কায়িক শ্রমের কাজ করে, কায়িক শ্রমই যাদের পেশা, যেমন রেলস্টেশনের কুলি, কৃষিক্ষেত্রের কৃষক, কামার, স’মিলের শ্রমিক এরা যতদিন হাড়ভাঙ্গা বা ঘামঝরানো পরিশ্রম করে, ততদিন হার্ট অ্যাটাক এদেরকে কোনোভাবে আক্রমণ করতে পারে না। ১০/১৫ বছর ধরে পায়েচালিত রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন, এমন কয়েকজন রিকশাঅলার খোঁজ নিয়ে দেখুন, তাদের হার্ট ব্লক হওয়া দূরে কথা, তাদের শরীরে উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসও নেই! এদের অনেকের বয়স দেখবেন পঞ্চাশেরও বেশি, তবু।
কেন? এর একমাত্র কারণ এদের শরীরে চর্বি জমতে পারে না। এবার বলুন, এদের কারো জীবনে কি টেনশন নেই? আপনি কি মনে করেন, ধনী ব্যক্তিদের চেয়ে এদের টেনশন কম? কখনোই নয়। তাহলে ধনী ব্যক্তিরা যখন হার্ট অ্যাটাকে মারা যাচ্ছে অহরহ, এরা কেন হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্তও হচ্ছে না? টেনশন এদেরকে হার্ট অ্যাটাকের দিকে নিয়ে যেতে পারে না কেন? কারণ টেনশন হার্ট অ্যাটাকের প্রত্যক্ষ কারণ নয়, বরং প্রত্যক্ষ কারণ শারীরিক পরিশ্রম না করে আরামে আরামে থাকা, মনের চাহিদামতো খাওয়া, শরীরে চর্বি বেড়ে যাওয়া।
একটা বিষয় জেনে রাখা দরকার, উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত লোকরাই একসময় হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়। কিন্ত যাদের প্রেসার লো, তারা কোনোভাবেই হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয় না, যতো টেনশনই করুক। কারণ তাদের শরীরে চর্বির পরিমান একেবারে কম থাকায় তাদের হার্ট ব্লক্ড হতে পারে না।
এটা ঠিক, টেনশনের সাথে হার্ট অ্যাটাকের সম্পর্ক আছে। টেনশনের সাথে হার্ট অ্যাটাকের সম্পর্কে হচ্ছে, যারা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত, তারা কোনো বিষয় নিয়ে টেনশন করলে তাদের রক্তচাপ বেড়ে গিয়ে হার্টে ব্লক দেখা দেয়। তবে উচ্চ রক্তচাপের রোগীরা টেনশন না করলেও নিয়মিত ঔষধ না খাওয়া, কায়িক শ্রম থেকে দূরে থাকা ইত্যাদি কোনো কারণে রক্তচাপ বেড়ে গিয়েও হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়। এজন্য দেখা যায়, তেমন কোনো টেনশন নেই, এমন অনেক মানুষও প্রায়ই হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়। তাই টেনশনকে হার্ট অ্যাটাকের প্রত্যক্ষ কারণ না বলে পরোক্ষ কারণ বলাই সমীচিন। হার্ট অ্যাটাকের মূল কারণ শরীরে চর্বি বেড়ে যাওয়া। আর শরীরে চর্বি বেড়ে যাওয়ার একটা প্রধান কারণ শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূূূরে থাকা বা আরামে আরামে থাকা।
তাই হার্ট অ্যাটাক থেকে বাঁচতে নিয়মিত অন্তত ৪০ মিনিট শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম করতে হবে, তাহলে শত টেনশন থাকলেও হার্ট অ্যাটাক কখনো আক্রমণ করতে পারবে না, যেভাবে শ্রমজীবি মানুষদেরকে আক্রমণ করতে পারে না।
0 Comments: