ডায়াবেটিস, হাই ব্লাড প্রেসার (উচ্চ রক্তচাপ) এবং হার্ট অ্যাটাক (হৃদরোগ) এই তিনটি রোগ থেকে নিরাপদ থাকার মাধ্যমে
‘কিভাবে ফিট থাকা যায়’
১. গত ২৫ বছরে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যে পরিবর্তনগুলো এসেছে এবং পরিবর্তনগুলোর ফলে সমাজে কী কী রোগ বৃদ্ধি পেয়েছে?
আমাদের যাদের বয়স এখন ৪০ বা তার চেয়ে বেশি, আমরা দেখেছি, গত ২৫ বছর আগে মানুষের জীবনে কতো না পরিশ্রমের কাজ ছিল! মানুষ অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোথাও যাবার সময় পায়ে হেঁটেই যেতো। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে শারীরিক পরিশ্রমের অনেক অনেক কাজ ছিল, মানুষকে বাধ্যগতভাবেই যেগুলো করতে হতো।
অধিকাংশ মানুষ কৃষিকাজের সাথে জড়িত ছিল বলে পুরুষদেরকে যেমন বছরের অধিকাংশ সবসময় বিভিন্ন রকম কৃষিকাজ করতে গিয়ে ফসলের জমিতে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে হতো, ওসব ফসল বাড়িতে তুলে আনার পর নারীদেরকেও সেগুলোর পেছনে আলাদাভাবে আরো অনেক পরিশ্রম করতে হতো। ঢেঁকিতে ধান ভাঙ্গানো সহ অসংখ্য শারীরিক শ্রমনির্ভর কাজে নারীরা জড়িত থাকতো।
কিন্তু বিগত প্রায় ২৫ বছর ধরে দেশের অধিকাংশ এলাকায় মানুষ ফসলের জমিতে কাজ করা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে, সময় নেই, জনবল নেই বা নগদ টাকা থাকায় বাজার থেকে কিনে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে বলে।
মানুষের যাতায়াতেও এসেছে আমূল পরিবর্তন। আগে রাস্তাঘাট ছিল কাঁচা। যানবাহনের ব্যবহার ছিল না। মানুষ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতো হেঁটে হেঁটে। অনেক দূরের পথও মানুষ তখন পায়ে হেঁটেই অতিক্রম করতো। কিছুই করার ছিল না।
এখন রাস্তাঘাট পাকা। যানবাহনও সহজলভ্য। পরিবহন এবং যাতায়াত ব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন ও উন্নতি আসার কারণে মানুষ এখন সামান্য দূরত্বও অতিক্রম করছে যানবাহনে চড়ে; হেঁটে যাওয়া, সাইকেলে যাওয়ার প্রবণতা একেবারে কমে গেছে। রিকশাঅলারা আগে পায়েচালিত রিকশা চালাতে গিয়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হতো, এখন মোটরচালিত রিকশা চলে আসায় সবাই পরিশ্রমসাধ্য রিকশা পরিত্যাগ করে আরামসাধ্য রিকশা চালাতে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছে।
এককথায় শারীরিক পরিশ্রম থেকে মানুষের জীবন গত প্রায় ২৫ বছর ধরে অনেক অনেক দূরে সরে গেছে, ভবিষ্যতে আরো বেশি দূর সরে যাবে।
এই পরিশ্রম না করার প্রবণতা মানুষের শরীরে মেদ—চর্বি—কোলেস্টেরল বৃদ্ধিতে সাহায্য করছে। আর শরীরে চর্বি বা কোলেস্টেরল বৃদ্ধি পেলে শরীরে দেখা দেয় প্রথমে উচ্চ রক্তচাপ (হাই ব্লাড প্রেশার), পরে সেই উচ্চ রক্তচাপ থেকে জন্ম নেয় ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ (হার্ট অ্যাটাক)। কখনো কখনো উচ্চ রক্তচাপের আগেই ডায়াবেটিস বা হার্ট অ্যাটাকে মানুষ আক্রান্ত হয়ে পড়ে।
শুধুই শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে সরে যাওয়া মানুষগুলোই এই রোগ তিনটিতে আক্রান্ত হচ্ছে। আগে মানুষ এই রোগগুলোতে আক্রান্ত হতো শেষ বয়সে। কিন্তু এখন অল্প বয়সেই অসংখ্য মানুষ এগুলোতে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে।
অবাক করা বিষয় হচ্ছে, এখনো যারা কোনো না কোনোভাবে শারীরিক পরিশ্রমের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে, দেখা যায় তারা ৬০—৭০ বছরের বেশি বয়স হয়ে যাবার পরও এই রোগগুলো থেকে সম্পূর্ণ সুরক্ষিত আছে। আমার পরিচিত এই রকম বেশ কয়েকজন আছেন।
বিষয়টা বাস্তবতার সাথে মিলিয়ে দেখতে পারেন আপনিও। দেখুন, আপনার পরিচিত যেই মানুষগুলো এখনো কোনো না কোনো শারীরিক পরিশ্রমের পেশায় নিয়োজিত, তারা কি এই সব রোগে আক্রান্ত হচ্ছে? দেখবেন এরকম ২০ জন মানুষের মধ্যে একজনও এই রোগগুলোর কোনোটিতে আক্রান্ত নয়। অন্যদিকে যারা এই রোগগুলোর কোনো না কোনোটিতে আক্রান্ত, তাদের খোঁজ নিন। দেখবেন, এই রোগগুলোতে আক্রান্ত হবার আগে তারা কেউই শারীরিক পরিশ্রমের কোনো পেশায় নিয়োজিত ছিল না বা নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করতো না।
এভাবে পর্যবেক্ষণ করলে আপনি নিশ্চিত হবেন (১) মানুষের জীবনে ঠিক কী কারণে এখন এই রোগগুলোর আক্রমণ বেড়ে গেছে? (২) কেনই বা আগে মানুষ এই রোগগুলোতে একেবারে কম আক্রান্ত হতো? (৩) আক্রান্ত হলেও শেষ বয়সে এসে আক্রান্ত হতো। (৪) এখনকার মতো কম বয়সে (৩০—৬০ বছর) বয়সে আক্রান্ত হতো না।
দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, এই রোগগুলোর কারণ নিয়ে এখনো বিশ্বব্যাপী মারাত্মক সব ভুল ধারণা ছড়িয়ে আছে। যার ফলে এই রোগগুলোর সত্যিকারের কারণ এখনো অনেক অনেক মানুষের নিকট অজানা। এখনো কোটি কোটি মানুষ বিশ্বাস করছে, এই রোগগুলো প্রতিরোধযোগ্য নয়; মানুষ শত চেষ্টা করেও এই রোগগুলো থেকে বাঁচতে পারবে না। এই বিশ্বাসের কারণ, রোগগুলোর কারণ সম্পর্কে এমন কিছু বিষয়কে দোষারোপ করা, যেগুলো শুনে মানুষ এই রোগগুলো থেকে নিরাপদ থাকার ব্যাপারে হতাশ হয়ে পড়ে। পরবর্তী লেখাগুলোতে সেই বিষয়ে আলোচনা করা হবে।
এই রোগগুলো থেকে এখনও যারা সুস্থ আছেন, তাদের নিকট এইটিই বার্তা: এই রোগগুলো থেকে নিরাপদ থাকতে চাইলে আপনি এখন থেকে নিয়মিত কায়িক শ্রম করুন। আপনি যতদিন নিয়মিত কায়িরক শ্রম করবেন, ততদিন এই রোগগুলোর কোনোটিই আপনাকে স্পর্শ করতে পারবে না কোনোভাবে।
পৃথিবীর বহু দেশের সচেতন মানুষ শারীরিক পরিশ্রমের পেশায় নিয়োজিত না থাকলেও অন্য কোনোভাবে শারীরিক পরিশ্রম করেন নিয়মিত। বেশিরভাগই জগিং করেন, অনেকে বিভিন্নভাবে ব্যায়াম করেন।
যারাই নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করে থাকেন, তারাই বেঁচে থাকেন এই রোগগুলো থেকে। আপনিও বাঁচুন রোগগুলো থেকে, নয়তো জীবন হবে অনেক অনেক কঠিন। ঠিকমতো খেতেও পারবেন না। পছন্দের অনেক খাবার পরিত্যাগ করতে হবে বা খেলেও খেতে হবে একেবারে স্বল্প পরিমাণে। অনেক খাবারের নাম হয়ে যাবে ‘বিষ’। ঔষধ—নির্ভর জীবন যাপন করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, জীবনে আর কখনো রোগগুলো থেকে মুক্তি পাবেন না, একবার যদি রোগগুলোর কোনোটি আপনাকে ধরে বসে। আপনাকে মৃত্যুর কাছে পৌঁছে দেয়ার আগে তারা আপনার পিছু ছাড়বে না।
২. অতিরিক্ত আরামই ব্যারামের কারণ
প্রকাশ: দৈনিক ইনকিলাব, প্রকাশের সময় : ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
একটা সময় ছিল মানুষ যখন আনুষ্ঠানিক কোনো ব্যায়াম করতো না বটে, তবে অনানুষ্ঠানিকভাবে মানুষের অনেক বেশি ব্যায়াম হয়ে যেতো। এখন অনেক মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হবার পর ডাক্তারের পরামর্শে নয়, বলতে গেলে ডাক্তারের নির্দেশে যে পরিমাণ ব্যায়াম করে থাকে, তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি ব্যায়াম হতো। কিভাবে? হ্যাঁ, পরিশ্রমের কাজ করে করে। মানুষ আগে বেশি পরিশ্রমী ছিল। তাছাড়া অনেক রকম পরিশ্রম করতে মানুষ বাধ্যও হতো। যেমন : কৃষিসংক্রান্ত নানারকম কাজ করা, হেঁটে হেঁটে দূরের পথ পাড়ি দেয়া, সাংসারিক বিভিন্ন রকম পরিশ্রমের কাজ করা, মহিলাদের ঢেঁকিতে বিভিন্ন কাজ করা, গৃহস্থলীর অনেক শ্রমসাধ্য কাজ করা ইত্যাদি। এক কথায় আগেকার দিনে মানুষের শারীরিক শ্রমের কাজ ছিল বেশি। মানুষ খেতোও বেশি, পরিশ্রমও করতো বেশি। কিন্তু এখন মানুষের পরিশ্রমের কাজ অনেক কমে গেছে। পরিশ্রমের কাজ কমে যাওয়ার পাশাপাশি মানুষ অলসও হয়ে গেছে। দূরের পথ পাড়ি দেয়ার জন্য মানুষ এখন হাঁটতে হয় না, হরেক রকম যানবাহন মানুষকে বসিয়ে বসিয়ে দ্রুত পৌঁছে দিচ্ছে গন্তব্যে। দূরের পথ নয়, সামান্য পথও মানুষ এখন হেঁটে যেতে চায় না।
কয়েকমাস আগে একদিন আমি ট্যাক্সিতে করে বাসায় ফিরছিলাম। আমার পাশে একটা সিট খালি ছিল। পথে একজন ট্যাক্সিতে উঠলো। এক কিলোমিটার নয়, আধা কিলোমিটার যেতে না যেতেই তার গন্তব্য এসে গেলো! কেনো, এ সামান্য পথ কি তিনি হেঁটে হেঁটে আসতে পারতেন না? এটা আমাদের আলসেমী বা আরামপ্রিয় হবার চরম বহিঃপ্রকাশ।
মহিলাদের এখন আর ঢেঁকিতে কাজ করতে হয় না, মেশিনেই সবকিছু হয়। আর ঢেঁকি তো ইতোমধ্যে যাদুঘরের আবশ্যকীয় উপাদানই হয়ে গেছে। জামাকাপড় এখন ধোয়া হয় ওয়াশিং মেশিনে। শুধু কাজ হচ্ছে বাজার থেকে কিনে আনবে আর গ্যাসের অটো চুলায় রান্না করে করে খাবে। বাজার থেকে আগে পুরুষরা বাজারের ব্যাগটাও হাতে বহন করে নিয়ে আসতো। কিছু পরিশ্রম হতো, ঘাম ঝরতো। আর এখন বাজারের ব্যাগ হাতে করে নিয়ে আসা দূরের কথা, অফিসের সামান্য পথও রিকশা বা গাড়িতে করে না গেলে প্রেষ্টিজ যেনো পুরোই পাংচার হয়ে যায়! যেসব বিল্ডিংয়ে লিফট আছে, সেসব বিল্ডিংয়েও মাত্র এক ফ্লোর উপরে বা নিচে যেতেও আমরা সিঁড়ি ব্যবহার না করে লিফট ব্যবহার করি!
পুরুষ—মহিলা সবাই পরিশ্রমের কাজ কমিয়ে দিয়ে আরামের জীবন বেছে নেয়ার এবং বসে বসে খাওয়ার পরিণতি আমরা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। বেশি বেশি মুটিয়ে যাচ্ছি আর অল্প বয়সেই শরীরে বাসা বাঁধছে বিপজ্জনক সব রোগ। যেমন : ডায়াবেটিস, হাই ব্লাড প্রেশার, হার্ট ব্লক বা হার্ট অ্যাটাক। রোগগুলোতে যারা ইতোমধ্যেই আক্রান্ত হয়েছেন, তারা জানেন জীবনটা তাদের কাছে কতো জটিল মনে হচ্ছে। চলাফেরায় সাবধান থাকতে হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে, খাওয়া—দাওয়ায় নানারকম বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে, পছন্দনীয় খাবার মনভরে খাওয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া সার্বক্ষণিক ডাক্তারের পরামর্শ নিতে আর ওষুধ খেয়ে যেতে হচ্ছে। এ এক বড় দুর্বিষহ জীবন।
আরামপ্রিয় হয়ে আমাদের সুস্থ—সবল জীবন এখন ব্যারামে ব্যারামে বিধ্বস্ত। ঘামঝরানো শ্রম ছেড়ে দিয়ে আমরা এখন ভয়াবহ সব রোগে জর্জরিত। আমাদের অনেকের এখনো হুঁশ হয়নি। আমরা অনেকে এখনো মনে করি ডায়াবেটিস হচ্ছে বংশানুক্রমিক রোগ। বংশের কারো থাকলে নিজের এ রোগ হবার সম্ভাবনা বেশি। আমাদের এ ধারণা কিভাবে সৃষ্টি হলো, বুঝতে কষ্ট হচ্ছে। আজ থেকে চল্লিশ—পঞ্চাশ বছর আগে শতকরা কয়জনের এ রোগ ছিলো, আর এখন শতকরা কয়জনের এ রোগ, তা একটু পরখ করলেই দেখা যাবে, উত্তরপুরুষদের এ রোগ বেশি; পূর্বপুরুষদের এ রোগ ছিলোই না বলতে গেলে। তাহলে উত্তরপুরুষদের কোত্থেকে এ রোগ ব্যাপকাকারে আক্রমণ করলো? শুধুমাত্র পরিশ্রম না করে বসে বসে খাওয়ার প্রবণতাই এ রোগ সৃষ্টি হবার জন্য প্রধানত দায়ী; বংশের কারো থাক বা না থাক।
পরিশ্রম না করলে যে হার্টের রোগ হবার সম্ভাবনাও বেশি, তা নিয়েও একটু কথা বলা যাক। আমরা জানি, সাইকেল চালানোতেও বেশ পরিশ্রম হয়। কিন্তু সাইকেল চালানোর উপকারিতা—অপকারিতা নিয়ে আমাদের মধ্যে অনেক অজ্ঞতা কাজ করে। আমরা অনেকেই মনে করি সাইকেল চালানো স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। অনেকেই মনে করি সাইকেল বেশি চালালে হার্টের সমস্যা হয় বা হার্ট দুর্বল হয়ে যায়। আমি ছোটবেলা থেকে অনেক মানুষের মুখেই এমন কথা শুনেছি। কখনো বিষয়টা নিয়ে ভালোভাবে চিন্তা করিনি। কয়েকমাস আগে একদিন আমি কর্মস্থল থেকে ফিরছিলাম। পথে আমার বন্ধু স্থানীয় এক লোকের সাথে দেখা হলো। কথায় কথায় তিনি আমাকে বললেন, ‘ভাই, সাইকেল না চালানোই ভালো। কারণ সাইকেল চালালে হার্টের সমস্যা হয়।’ তার কথা শুনে আমি সামান্য ভাবলাম। ভেবে তাকে বিনয়ের সাথে বললাম, ‘ভাই, সাইকেল চালানোর কারণে হার্টের সমস্যা হয়েছে, আপনি দেখেছেন, এমন মাত্র একটা লোক আমাকে দেখিয়ে দিন, বেশি নয়।’ আমার কথার কোনো সদুত্তর তিনি দিতে পারেননি। তাহলে তিনি কথাটি বললেন কেনো? তিনি বলেছেন, কারণ সবাই এমন কথাই বলে। কিন্তু এটার কোনো ভিত্তি নেই। আমাদের দেশে আমরা শুধু সাইকেল চালানোর অপকারিতার কথা বলে বেড়াই। চীন বা জাপানে মানুষ শুধু সাইকেল চালানোর উপকারিতার কথাই জানে। এজন্য তারা বেশি বেশি সাইকেল চালায়। ‘জাপান কাহিনী’ নামক একটা বইতে দেখলাম, জাপানে নাকি সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই সপ্তম শ্রেণি থেকে সকল শিক্ষার্থীকে সাইকেল চালিয়ে প্রতিষ্ঠানে আসতে হয়, তাদের বাবা যতো বড় ধনী হোক না কেনো। সাইকেল বেশি বেশি চালায় বলেই এসব দেশের লোক মুটিয়ে যায় না, এদের শারীরিক ফিটনেসও দীর্ঘদিন ঠিক থাকে, এদের গড় আয়ুও সঙ্গত কারণেই বেশি। আর আমরা সাইকেল চালানোকে নিরুৎসাহিত করি বলে বেশি বেশি মুটিয়ে যাচ্ছি, বিভিন্ন রোগে অল্প বয়সে আক্রান্ত হয়ে মারাও যাচ্ছি। আমাদের দেশে এখন তো রিকশাগুলোতে মটর লাগিয়ে চালানো হয়। কিন্তু এর আগে বছরের পর বছর মানুষ পায়ে চেপেই রিকশা চালাতো। অন্তত বিশ বছর এভাবে রিকশা চালিয়েছে, এমন লোকের হার্টের সমস্যা হবার ঘটনা নেই বললেই চলে। কোনো? কারণ রিকশা চালাতে যথেষ্ট ঘামঝরানো শ্রম হয়। এই ঘামঝরানো শ্রম আমরা যতো বেশি করবো, আমাদের হার্ট ভালো থাকার সম্ভাবনা ততো বৃদ্ধি পাবে।
হাই ব্লাড প্রেশারের অন্যতম কারণও আমার মনে হয় পরিশ্রম না করে বসে বসে খাওয়া। অধিকাংশ হাই ব্লাড প্রেশারের রোগীর মধ্যে এমন প্রবণতা লক্ষ্য করা। আর যেসব লোক হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে, তাদের ডায়াবেটিস, হার্ট উইকনেস যেমন খুব একটা হয় না, হাই ব্লাড প্রেশারও তেমন একটা হয় না। এজন্য যারা রোগগুলো থেকে এখনও মুক্ত আছেন, তাদের উচিত বেশি বেশি কায়িক শ্রমের কাজ করা। শ্রম মানুষের শরীরকে সুঠাম রাখে, রোগব্যাধি থেকে নিরাপদ রাখে। মনে রাখতে হবে, কায়িক শ্রম বলতে বুঝায় শরীর থেকে ঘাম বের হয় এমন কাজ করা। আপনি আপনার অফিসে বসে আছেন, বিদ্যুৎ নেই বলে আপনার শরীর থেকে ঘাম বের হচ্ছে, এটা নিশ্চয়ই কোনো পরিশ্রমের কাজ নয়! আপনি কিভাবে নিয়মিত পরিশ্রম করবেন, আপনিই ঠিক করে নিন। অফিস যদি দু’তিন কিলোমিটারের মধ্যে হয়, সম্ভব হলে প্রতিদিন হেঁটে হেঁটে যাতায়াত করুন, না হয় সাইকেল চালিয়ে। বাজারের ব্যাগটি অতিরিক্ত ওজন না হলে হাতে নিয়ে হেঁটে হেঁটেই বাসায় নিয়ে আসুন। মনে রাখবেন, প্রেষ্টিজ রক্ষা করা আপনার স্বাস্থ্য রক্ষার চেয়ে অধিক মূল্যবান নয়।
শেষে একটি সুখবর দিয়ে লেখা শেষ করছি। বসে বসে বেশি খেলে আপনি রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে শেষে খেতেই পারবেন না। আর পরিশ্রম করে বেশি বেশি খেলেও আপনার শরীরে বিপজ্জনক কোনো রোগ বাসা বাঁধবে না। আপনি খেয়ে যেতে পারবেন দীর্ঘদিন, নিশ্চিন্তে। সুতরাং বেশি বেশি খাওয়ার জন্য বেশি বেশি পরিশ্রম করুন! [https://www.dailyinqilab.com/article/38550]
৩. হার্ট অ্যাটাক, ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ ধেয়ে আসছে আমাদের সবার দিকে!
মানুষ এখন যেই রোগগুলোতে বেশি আক্রান্ত হয়, সেগুলোকে বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। কিছু রোগ চিকিৎসায় পুরো ভালো হয়ে যায়, কিছু রোগ একবার আক্রমণ করলে আর কখনো পুরোপুরি ভালো হয় না; কিছু রোগ মানুষকে সাময়িক কষ্ট দেয়, কিছু রোগ দীর্ঘ সময় ধরে কষ্ট দেয়; কিছু রোগে মৃত্যুহার কম, কিছু রোগে মৃত্যুহার বেশি; কিছু রোগ আকস্মিক মানুষের মৃত্যু ঘটায়, কিছু রোগ আকস্মিক মৃত্যু ঘটায় না; কিছু রোগের চিকিৎসা—ব্যয় বেশি, কিছু রোগের চিকিৎসা—ব্যয় কম।
যেই রোগগুলো সাময়িক কষ্ট দেয়, যেগুলোর পেছনে চিকিৎসা—ব্যয় কম, মানুষের আকস্মিক মৃত্যু ঘটায় না, যেগুলোতে মৃত্যুহার কম, সেগুলো দুই শ্রেণি: (১) অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষ যেগুলো থেকে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যায়, এরকম রোগগুলো মধ্যে রয়েছে ইনফ্লুয়েঞ্জা, নিউমোনিয়া, টাইফয়েড, মাথাব্যথা, মাইগ্রেন, কনজাংটিভাইটস, ডায়রিয়া, কলেরা, যক্ষ্মা, পক্স ইত্যাদি।
(২) যেগুলো সহজে ভালো হয় না। দীর্ঘদিন মানুষ রোগগুলোতে ভোগে, কষ্ট পায়। এরকম রোগগুলোর মধ্যে রয়েছে হাঁপানি, আর্থারাইটিস বা বাত, বিভিন্ন রকম চর্মরোগ ইত্যাদি।
এই রোগগুলো ব্যতীত যেই রোগগুলো রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ক্যান্সার, ব্রেইন স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট অ্যাটাক (হৃদরোগ), কিডনী রোগ ইত্যাদি। এই রোগগুলোর সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো, এগুলো প্রাণঘাতি; এগুলোর পেছনে চিকিৎসা ব্যয় বেশি; এগুলোতে মৃত্যুহার বেশি, এগুলোতে আক্রান্ত হলে মানুষ তৎক্ষণাৎ মৃত্যুবরণ না করলেও মৃত্যুকে এই রোগগুলোতে আক্রান্ত মানুষের আশপাশে ঘোরাঘুরি করছে বলেই মনে হয়। এই সাধারণ বৈশিষ্ট্য বাদ দিলে এই রোগ ৬টিকে প্রথমতঃ দুইটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়: (১) আকস্মিক মৃত্যু ঘটায়। যেমন: হার্ট অ্যাটাক এবং ব্রেইন স্ট্রোক। (২) আকস্মিক মৃত্যু ঘটায় না, তবে এগুলোতে আক্রান্ত হলে অধিকাংশ রোগী শেষে এগুলোতেই মারা যায়। যেমন: ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনী রোগ।
এই ৬টি রোগকে আরো দুই শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। (১) প্রতিরোধযোগ্য; যেগুলোর সুস্পষ্ট কারণ আছে। যেমন: উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক এবং কিডনী সমস্যা। (২) প্রতিরোধ—অযোগ্য; যেগুলোর কোনো কারণই পরিষ্কার নয়। যেমন: ক্যান্সার এবং ব্রেইন স্ট্রোক।
ক্যান্সার ও স্ট্রোক খুব কম ক্ষেত্রে হলেও উপযুক্ত চিকিৎসায় পুরোপুরি ভালো হয়ে গেলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলোতে আক্রান্ত রোগী অল্প কয়েক মাস বা অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই মারা যায়। স্ট্রোকে আক্রান্ত অধিকাংশ মানুষ পক্ষাঘাতে(প্যারালাইসিস) আক্রান্ত হয়। এই দু’টি রোগের সুনির্দিষ্ট কারণ এখনো পরিষ্কার নয় বলে এগুলো এখনো সম্পূর্ণ প্রতিরোধহীন রোগ বলে বিবেচিত। এসব রোগের যেসব কারণ আপনি—আমি জানি, নানাভাবে প্রচার করা হয়, সেসবের সাথে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। ধূমপায়ীরা এসব রোগে যেমন আক্রান্ত হয়, অধূমপায়ীরাও আক্রান্ত হয়, টেনশনে ভোগা মানুষ যেমন আক্রান্ত হয়, যাদের জীবনে তেমন কোনো টেনশন নেই, তারাও আক্রান্ত হয়, উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তরা যেমন আক্রান্ত হয়, যাদের উচ্চ রক্তচাপ নেই, তারাও আক্রান্ত হয়।
আর ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং উচ্চ রক্তচাপের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীরা রোগে আক্রান্ত হবার পরও চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রণের উপর নির্ভর করে অনেক দিন বেঁচে থাকার সুযোগ পায়, যদিও বেশ ধরাবাঁধা নিয়মের মধ্য দিয়ে বেশ কষ্টকর জীবন যাপন করতে হয়। কিন্তু হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত মানুষ অনেক সময় আক্রান্ত হবার সাথে সাথেই মারা যায়, আর আক্রান্ত হবার সাথে সাথে মারা না গেলেও শেষে আরো এক বা একাধিকবারের হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়। ক্যান্সার এবং স্ট্রোকের সাথে হার্ট অ্যাটাক, ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপের একটা প্রধান পার্থক্য হচ্ছে, ক্যান্সার এবং স্ট্রোক সম্পূর্ণ প্রতিরোধহীন রোগ, কিন্তু হার্ট অ্যাটাক, ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ এই তিনটি রোগ সম্পূর্ণ প্রতিরোধযোগ্য; সুনির্দিষ্ট কিছু কারণেই এই তিনটি রোগ মানুষকে আক্রমণ করে। কারণগুলো হচ্ছে, আরামে থাকা বা শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা, মুটিয়ে যাওয়া এবং মনমতো খাওয়া। মানুষ যদি এই কারণগুলো এড়িয়ে চলে, অন্তত ‘শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা’ এড়িয়ে চলে, মানুষ এই তিনটি রোগের কোনোটিতে আক্রান্ত হয় না। আরো একটি রোগ এই কারণের সাথে সম্পর্কিত। সেটি হচ্ছে কিডনী বিকলতা। সারা বিশ্বে কিডনী বিকলতায় যারা আক্রান্ত হয়, তাদের বেশির ভাগই উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিস রোগী। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ এবং অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস কিডনী বিকলতার একটি বড় কারণ। এজন্য উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীরা অনেক সময় কিডনী বিকল হয়ে মৃত্যুবরণ করে। তাই শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা শুধু উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগে আক্রান্ত হবার জন্য দায়ী নয়, কিডনী বিকলতার জন্যও সমানভাবে দায়ী।
এবার আমরা আমাদের অবস্থা বিবেচনা করি। আমরা দেখি, আমরা কি নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করি? আমাদের মধ্যে যারা (১) নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করে, যেমন: পেশাদারভাবে এমন সব কাজ করে, যেগুলোতে প্রচুর শারীরিক পরিশ্রম হয়; (২) যারা ক্রীড়াবিদ; (৩) যারা প্রতিরক্ষা বিভাগে চাকরি করার সুবাদে নিয়মিত ব্যায়াম করে, তারা যতদিন এভাবে শারীরিক পরিশ্রম করে, ততদিন এই তিনটি রোগ থেকে নিরাপদ থাকে। কিন্তু আমরা যারা কোনোভাবে শারীরিক পরিশ্রমের সাথে জড়িত নই, শারীরিক পরিশ্রম করলেও পরিমাণে খুব কম করি, আরামে আরামে থাকতে অভ্যস্থ হবার পাশাপাশি মনমতো খাই, তারা যে কোনো সময় এই তিনটি রোগের শিকারে পরিণত হবো। শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে দূরে থাকলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষ প্রথমে আক্রান্ত হয় উচ্চ রক্তচাপে, পরে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং কিডনী সমস্যায়। মাঝে মাঝে ভিন্নও হয়। আপনি দেখবেন, যারা এখন ডায়াবেটিস বা হৃদরোগে আক্রান্ত, তাদের তিনজনে অন্তত দুইজন মানুষ ডায়াবেটিস বা হৃদরোগে আক্রান্ত হবার আগে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত ছিল।
আমার কাছের এক বন্ধু মনির হোসেন। আমার সাথেই ২০০৯ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি শুরু করেছেন। বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলায়। চাকরির শুরুতে তাঁকে পোস্টিং দেয়া হয়েছিল তাঁর বাড়ি থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরের একটি স্কুলে। তিনি সেখানে সাইকেলে যাতায়াত করতেন। সেসময় তাঁর শরীরে এই তিনটি রোগের কোনোটিই ছিল না। একসময় তিনি বাড়ির পাশে অবস্থিত স্কুলে বদলি হয়ে চলে আসেন। বদলি হয়ে আসার কয়েক বছরের মধ্যেই তাঁর শরীরে দেখা দেয় উচ্চ রক্তচাপ। দুঃখজনকভাবে কিছুদিন আগে তিনি ডায়াবেটিসেও আক্রান্ত হয়ে পড়েন।
আমাদের বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কয়েক বছর আগে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হন। আমি তাঁকে মাঝে মাঝে শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম করার পরামর্শ দিতাম। কিন্তু তিনি আমার পরামর্শকে গুরুত্ব দেননি। তিনি গত কয়েক মাস আগে ডায়াবেটিসেও আক্রান্ত হয়ে পড়েন। আমার মা’কে আমার জন্মের পর থেকে দেখতাম সাংসারিক বিভিন্ন কাজে জড়িত থাকতেন সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। তিনি প্রায় ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এসব কোনো রোগে আক্রান্ত হননি। ৭—৮ বছর আগ থেকে তিনি সাংসারিক কাজ থেকে অনেকটা অবসরে চলে যান। এরপর তিনি প্রথমে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হন। এখন তিনি ডায়াবেটিসেও ভুগছেন। আমার বাবার অবস্থাও প্রায় একই। তবে তিনি উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হবার পর নিয়মিত উচ্চ রক্তচাপের ঔষধ সেবন করার কারণে তাঁর উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকার ফলে এখনো ডায়াবেটিস বা হৃদরোগে আক্রান্ত হননি।
যাতায়াতে মোটরসাইকেল ব্যবহার করেন, এরকম ১০ জন লোক খুঁজে নিন আপনার পরিচিত মানুষদের মধ্য থেকে, যারা বিগত ১৫ বছর ধরে মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন, দেখবেন তাদের অনেকেই উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত, অনেকে উচ্চ রক্তচাপের সাথে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ইত্যাদিতেও আক্রান্ত। কিন্তু দৈনিক অন্তত ৪০ মিনিট বাইসাইকেল চালান (বেশ ধীরগতিতে নয়), এমন ১০ জন লোকের খোঁজ নিন, যারা ১০ বছরের বেশি সময় ধরে বাইসাইকেল চালাচ্ছেন, দেখবেন তাদের কেউ এই তিনটি রোগের কোনোটিতেই আক্রান্ত নন।
একটি পরিসংখ্যান দেখা যাক। ‘বাংলাদেশ প্রতিদিনে’ ১১ মে ২০১৯ তারিখে ‘চারজনে তিনজন হৃদরোগ ঝুঁকিতে’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে (তৈরি করেছেন শামীম আহমেদ ও জয়শ্রী ভাদুড়ী) বলা হয়, ‘‘বাংলাদেশে প্রতি চারজন প্রাপ্তবয়সীর মধ্যে তিনজনের হৃদরোগ ঝুঁকি রয়েছে। হৃদরোগের অন্যতম কারণ উচ্চ রক্তচাপ। গত বছরের অক্টোবরে শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোয় অনুষ্ঠিত উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের ওপর এক নীতিনির্ধারণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এ তথ্য উঠে আসে। গ্রীষ্মের দাবদাহে বেড়েছে আক্রান্তের সংখ্যা। আশঙ্কাজনকহারে অল্পবয়সীরা হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে। সম্মেলনে উপস্থাপিত তথ্যে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ায় উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত প্রাপ্তবয়সী প্রতি চারজনের মধ্যে তিনজনের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের বাইরে এবং তার মধ্যে এক তৃতীয়াংশ ডায়াবেটিসে ভুগছে। ইউরোপীয়দের তুলনায় পাঁচ থেকে সাত বছর আগেই দক্ষিণ এশীয়দের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক, স্টে্রাক ও কিডনি রোগ দেখা দেয়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) গত বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৩৫ বছর কিংবা এর চেয়ে বেশি বয়সীর মধ্যে প্রতি তিনজনের একজন উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত, এর অর্ধেকই এ সম্পর্কে সচেতন নয়। ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ১৫০ কোটি মানুষ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হবে। তবে দক্ষিণ এশিয়ায় এর ক্ষতিকর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। এ অঞ্চলে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৪০ জনই উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। ১৯৭০ সালের পর উন্নত বিশ্বে মৃত্যুর হার কমে গেলেও বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায় হৃদরোগ। বর্তমান বিশ্বে এক তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যাচ্ছে হৃদরোগে। কিছুদিন আগ পর্যন্তও দেশে বয়স্কদের মধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা ছিল বেশি, কিন্তু গত কয়েক বছরে তরুণদের মধ্যে হৃদরোগের প্রবণতা ক্রমবর্ধমান।’’
আগে মানুষ বুড়ো বয়সেও আর কোনো শারীরিক পরিশ্রম না করলেও, দূরে কোথাও যাবার সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হেঁটে হেঁটেই যেতো। এজন্য মানুষ সহজে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, কিডনী বিকলতা এসবে আক্রান্ত হতো না।
কিন্তু এখন মানুষ অল্প বয়সেই শারীরিক পরিশ্রম ছেড়ে দেয়। ছাত্রজীবনে অনেকে আর কোনো উপায়ে পরিশ্রম না করলেও অন্তত বিভিন্ন খেলাধুলা করার ফলে কিছু পরিশ্রম করে। অন্য উপায়েও অনেকে শারীরিক পরিশ্রম করে। কিন্তু কর্মজীবনে আরামদায়ক বা শারীরিক পরিশ্রমহীন কোনো পেশায় যখন নিয়োজিত হয়ে যায়, তখন অধিকাংশ মানুষ সব রকম শারীরিক পরিশ্রমকে বিদায় জানানোর ফলে অল্প বয়সেই আক্রান্ত হয়ে পড়ে উচ্চ রক্তচাপে। আর হৃদরোগ এবং ডায়াবেটিসও উচ্চ রক্তচাপের পথ ধরে দ্রুত মানুষকে আক্রমণ করে বসে।
ক্যান্সার বা স্ট্রোকে কে আক্রান্ত হবে, কে আক্রান্ত হবে না, তা বুঝা না গেলেও উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগে কারা আক্রান্ত হবে, সহজেই বুঝা যায়। ক্যান্সার বা স্ট্রোকে আমাদের মধ্যে কে আক্রান্ত হবে, কে এগুলো থেকে বেঁচে যাবে, তার কোনো ঠিক—ঠিকানা না থাকলেও আমরা যদি আরামপ্রিয় জীবন বেছে নিই, শারীরিক পরিশ্রম ছেড়ে দিই, আমরা নিশ্চিতভাবে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ এই তিনটি রোগে আক্রান্ত হবোই। আমরা আমাদের পরিচিত ৪০ বছরের বেশি বয়সী মানুষদের দিকে তাকালেই দেখতে পাবো, তাদের অনেকেই এই তিনটি রোগের এক বা একাধিকটিতে আক্রান্ত হয়ে আছে, অনেকে মারাও গেছে ইতোমধ্যে।
বিগত ১০ বছরে আমাদের পরিচিত ‘৫০ বছরের বেশি বয়সে মারা যাওয়া’ ২০—৩০ জন মানুষের খোঁজ নিলে দেখা যাবে, তাদের বেশিরভাগই মারা গেছে ডায়াবেটিস বা হার্ট অ্যাটাকে; ক্যান্সার এবং স্ট্রোকে মারা গেছে এদের খুব অল্প সংখ্যক মানুষ।
পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমান বিশে^ মানবমৃত্যুর ৩১ শতাংশই হৃদরোগে। ‘বিশ্বে ৩১ ভাগ মৃত্যুর জন্য দায়ী হৃদরোগ’ শিরোনামে দৈনিক যুগান্তরে ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘‘বিশ্বে প্রতিবছর ১৭ দশমিক ৫ মিলিয়ন বা পৌনে দুই কোটি মানুষের মৃত্যু হয় হৃদরোগে। ৩০ থেকে ৭০ বছর বয়সী প্রতি ১০ জনে একজন এ রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারান। আতঙ্কের বিষয় হল— বিশ্বে ৩১ ভাগ মৃত্যুর জন্যই দায়ী হৃদরোগ। এছাড়া অল্প বয়সে মৃত্যুর ৮০ শতাংশ কারণও এ রোগ। এ তথ্য ওয়ার্ল্ড হার্ট ফেডারেশনের।’’
‘প্রতি বছর ডায়াবেটিসে মারা যাচ্ছে ৩৭ লাখ মানুষ’ শিরোনামে দৈনিক ইনকিলাবে ৮ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘‘বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। ৩৪ বছরে বিশ্বে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা অন্তত চারগুণ বেড়েছে। বর্তমানে প্রতি ১১ জন পূর্ণবয়স্ক মানুষের একজন এই রোগে আক্রান্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এক প্রতিবেদন এ তথ্য জানিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্ব এখন ডায়াবেটিসের ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের ঝুঁঁকিতে। ২০১৪ সালে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৪২২ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি, যা ১৯৮০—তে আক্রান্তের তুলনায় ৪ গুণ বেশি।’’
উপরে উল্লেখিত তিনটি প্রতিবেদন মতে, (১) বাংলাদেশে প্রতি চারজন প্রাপ্তবয়সীর মধ্যে তিনজনের হৃদরোগ ঝুঁকি রয়েছে। হৃদরোগের অন্যতম কারণ উচ্চ রক্তচাপ। (২) বিশ্বে ৩১ ভাগ মৃত্যুর জন্যই দায়ী হৃদরোগ। এবং (৩) বর্তমানে প্রতি ১১ জন পূর্ণবয়স্ক মানুষের একজন ডায়াবেটিসে রোগে আক্রান্ত।
ক্যান্সার এবং স্ট্রোকে মৃত্যুহার নয়, আক্রান্তের হারও হৃদরোগের ধারেকাছেও নেই। আর হৃদরোগের পর আর কোনো রোগে আক্রান্তের হার (প্রতি ১১ জনে ১ জন) ডায়াবেটিসে আক্রান্তের হারের ধারেকাছেও নেই। আর উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তরাই মূলত এই দু’টি রোগে আক্রান্ত হয়।
এটা নিশ্চিত, আমরা আর কোনো রোগে আক্রান্ত হই বা না হই, এই তিনটি রোগে আক্রান্ত হবোই যদি প্রতিরোধব্যবস্থা গ্রহণ না করি। এই রোগগুলোর কারণ নিয়ে অনেক ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে। সেগুলোয় কান না দিয়ে আমরা নিয়মিত অন্তত ৪০ মিনিট কঠোর শারীরিক পরিশ্রম করলে এই তিনটি রোগের কোনোটিই আমাদেরকে আক্রমণ করতে পারবে না। পাশপাশি আমরা কিডনী বিকল হওয়া থেকে বেঁচে যাবার সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পাবে।
Some people think they're being punished for
something they did or didn't do in the past. Most people wonder if they did
something to cause the cancer.
If you're having these feelings, you're not alone. Thoughts and beliefs like this are common for people with cancer. You need to know that cancer is not a punishment for your past actions. Try to not blame yourself or focus on looking for ways you might have prevented cancer. Cancer is not your fault, and there's almost never a way to find out what caused it. Instead, focus on taking good care of yourself now.''
১৬. ডায়াবেটিসের মোট কারণ ৩টি, মূল কারণ মাত্র ১টি
মহামারীর চেয়েও ভয়ঙ্কর এক রোগ ডায়াবেটিস
বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস উপলক্ষ্যে প্রথম আলোয় ১৪ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে ‘ডায়াবেটিস: প্রতিটি পরিবারের যুদ্ধ’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘প্রতিদিন সকালটা ফিলিস্তিনের শিশু আহমেদের শুরু হয় একটু পরই গুলির শব্দ হবে, এ শঙ্কা নিয়ে। আর অন্যদিকে ভারতের শিশু মালিনীর সকাল শুরু হয় অন্য রকম ভয় নিয়ে। তাকে ইনসুলিন নিতে হবে, চামড়া ভেদ করে রক্তাক্ত করে ইনসুলিন দেওয়া হবে; এ আতঙ্কে দিন কাটে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত এই শিশুর। যুদ্ধ, সহিংসতা আর হানাহানিতে মানুষের মৃত্যু যেমন দিন দিন পৃথিবীকে করে তুলছে ভয়ংকর; তেমনি পৃথিবীতে প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী ১০টি রোগ এ মুহূর্তে হয়ে উঠেছে আশঙ্কাজনক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পৃথিবীতে সবচেয়ে উদ্বেগজনক ১০টি স্বাস্থ্য সমস্যার মধ্যে অন্যতম ডায়াবেটিস। পৃথিবীতে এ মুহূর্তে ৪৫ কোটির অধিক লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। বাংলাদেশে প্রায় ৮০ লাখ লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।’
‘ডায়াবেটিসের ঝুঁকি সম্পর্কে যেসব জানা জরুরি’ শিরোনামে ১৩ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে ১৯৮০ সালে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় ১১ কোটি। ২০১৪ সালে সেটা বেড়ে হয় ৪২ কোটিরও বেশি। ১৯৮০ সালে ১৮ বছরের বেশি বয়সী মানুষের ডায়াবেটিস হওয়ার হার ছিল ৫ শতাংশেরও কম কিন্তু ২০১৪ সালের তাদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ।’
আরেকটা প্রতিবেদনের একটা অংশ উল্লেখ করা খুব সংগত মনে হচ্ছে। ‘ঘরে ঘরে ডায়াবেটিস’ শিরোনামে যা দৈনিক সমকালে ১৪ নভেম্বর ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘দেশে ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। শুধু বয়স্ক বা মধ্যবয়সী নয়, শিশুরাও এখন এই নীরব ঘাতকের শিকার হচ্ছে। শহর থেকে গ্রাম— সর্বত্র প্রায় সমান হারে ছড়িয়ে পড়ছে ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিস এখন প্রায় প্রতিটি ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে।’
সেখানে আরও বলা হয়, ‘দ্রুত নগরায়নের ফলে পরিবর্তিত জীবনযাপনের কারণে বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হারে বাড়ছে। আইডিএফের (ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিক ফেডারেশন) ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে বর্তমানে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ৪৩ কোটি। ১৯৮৫ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র তিন কোটি। গত আড়াই দশকে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১৩ গুণ বেড়েছে। সংস্থাটি দুই বছর পরপর আক্রান্ত মানুষের তথ্য প্রকাশ করে। তাদের ধারণা, এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা ৬৪ কোটিতে উন্নীত হবে।’ এ তথ্যগুলো আমাদেরকে ডায়াবেটিস সম্পর্কে সতর্ক হবার বার্তা দেয় নিঃসন্দেহে।
ডায়াবেটিসের কারণ সম্পর্কে বিভ্রান্তি
প্রথমে আমাদের জানা দরকার ডায়াবেটিস কেন হয়?
খুবই হতাশ হই, যখন দেখি ডায়াবেটিসের কারণ সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী মানুষকে সঠিক ধারণা দেয়ার পরিবর্তে ভুল ধারণা দেয়া হয় খুব বেশি। ডায়াবেটিস নিয়ে বিশ্বের নামকরা সব প্রতিষ্ঠান এ পর্যন্ত যত গবেষণা করেছে, কোনো গবেষণা ডায়াবেটিসের নির্ভেজাল কারণ খুঁজে বের করতে পারেনি। দু’একটা উদাহরণ দেখা যাক:
১৭ জানুয়ারি ২০১৯ তারিখের প্রথম আলোয় ‘গ্রামে ডায়াবেটিস সচেতনতা কম’ শিরোনামে গবেষণা—তথ্যভিত্তিক (গবেষণা তথ্যটি যুক্তরাজ্যভিত্তিক স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাবিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেট—এর) একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়, ‘গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর প্রায় তিনজনের একজন ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত অথবা রোগের ঝুঁকিতে আছেন। ধূমপান, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, অপ্রতুল কায়িক পরিশ্রম ডায়াবেটিস হওয়ার মূল কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম।’
এই অধ্যায়ের শুরুতে প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘ডায়াবেটিস: প্রতিটি পরিবারের যুদ্ধ’ শিরোনামের যে প্রতিবেদনের কথা বলা হয়েছে, সেখানে আরও বলা হয়, ‘ডায়াবেটিস রোগের সবচেয়ে বড় কারণ হলো অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন। খাদ্যাভ্যাসে অসচেতনতা, কম শারীরিক কর্মকান্ড, পরিবেশগত বিভিন্ন উপাদান এবং বংশগত বা কিছু কিছু ক্ষেত্রে জিনগত অস্বাভাবিকতা। বিশ্বের মোট ডায়াবেটিসের শতকরা ৯০ ভাগ টাইপ—২ জাতীয় ডায়াবেটিসে এবং বিশ্বে বর্তমানে ৩০ কোটির অধিক লোক এই প্রকার ডায়াবেটিসে ভুগছে।... তাহলে প্রশ্ন হলো ডায়াবেটিসের কি কোনো সমাধান নেই? অবশ্যই আছে। সুস্থ জীবনযাপন। অতিরিক্ত চিনি কিংবা চর্বিজাতীয় খাবার পরিহার করা, হাঁটা কিংবা ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সচল রাখা, অতিরিক্ত ওজন কমানোর চেষ্টা, ফাস্ট ফুড বা জাঙ্কফুড ও অতিরিক্ত মদপান পরিহার করা।’
বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত যে প্রতিবেদনের কথা এ অধ্যায়ের প্রথম পরিচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে আরও বলা হয়, ‘ডায়াবেটিস যদিও জেনেটিক এবং আপনার জীবন যাপনের স্টাইলের ওপর নির্ভরশীল তারপরেও আপনি চেষ্টা করলে রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পারেন।
সেজন্যে আপনাকে খাবার গ্রহণের বিষয়ে বিশেষভাবে সচেতন থাকতে হবে এবং আপনাকে হতে হবে অত্যন্ত সক্রিয় একজন মানুষ।
খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
প্রক্রিয়াজাত খাবার ও পানীয় এড়িয়ে চলতে হবে। মসৃণ শাদা আটার রুটির পরিবর্তে খেতে হবে ভুষিওয়ালা আটার রুটি। এটাই প্রথম ধাপ।
এড়িয়ে চলতে হবে হোয়াইট পাস্তা, প্যাস্টি্র, ফিজি ড্রিংকস, চিনি জাতীয় পানীয়, মিষ্টি ইত্যাদি।
আর স্বাস্থ্যকর খাবারের মধ্যে রয়েছে শাক সব্জি, ফল, বিন্স এবং মোটা দানার খাদ্য শস্য।
স্বাস্থ্যকর তেল, বাদাম খাওয়াও ভালো। ওমেগা থ্রি তেল আছে যেসব মাছে সেগুলো বেশি খেতে হবে। যেমন সারডিন, স্যামন এবং ম্যাকেরেল।
এক বেলা পেট ভরে না খেয়ে পরিমানে অল্প অল্প করে বিরতি দিয়ে খাওয়া দরকার।
শরীর চচ্চর্া বা ব্যায়াম করার মাধ্যমে রক্তে চিনির মাত্রা কমিয়ে রাখা সম্ভব।
চিকিৎসকরা বলছেন, প্রতি সপ্তাহে আড়াই ঘণ্টার মতো ব্যায়াম করা দরকার। তার মধ্যে দ্রুত হাঁটা এবং সিড়ি বেয়ে ওপরে ওঠাও রয়েছে।
শারীরিকভাবে থাকতে হবে সক্রিয়। ওজন কম রাখলেও চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। যদি ওজন কমাতে হয় তাহলে সেটা ধীরে ধীরে করতে হবে। সপ্তাহে আধা কেজি থেকে এক কেজি পর্যন্ত।
ধূমপান পরিহার করাও জরুরী। নজর রাখতে হবে কোলস্টেরলের মাত্রার ওপর। এর মাত্রা বেশি হলে হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।’ [https://www.bbc.com/bengali/news-46194839]
ডায়াবেটিসের কারণ এবং প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে আমি আরও অনেকগুলো প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিতে পারি, যেগুলোতে ডায়াবেটিসের আরও ভিন্ন ভিন্ন কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু অতিরিক্ত হয়ে যাবে বলে উল্লেখ করতে চাই না। শুধু এ তিনটি প্রতিবেদনেই ডায়াবেটিসের অনেকগুলো কারণ বলা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, যদি এতোগুলো কারণেই ডায়াবেটিস হয় এবং মানুষকে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করার জন্য এতোগুলো উপায় অবলম্বন করতে হয়, তাহলে কয়জনের ধৈর্যে কুলাবে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করার? শুধু এ কারণেই, আমার খুব শক্তভাবে মনে হয়, বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগের প্রকোপ কমছে না, বরং হু হু করে বাড়ছেই। মহামারীর চেয়েও ভয়াবহ মাত্রায় ডায়াবেটিস সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে। আমি এখানে ডায়াবেটিসের কারণ সম্পর্কে শুধু একটি ধারণা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করবো এবং ডায়াবেটিসের মূল কারণগুলো নিয়ে আলোচনা করবো। ডায়াবেটিসের কারণ বলে প্রচারিত সব কারণগুলোর স্বরূপ উন্মোচনের জন্য এই লেখার বিভিন্ন জায়গায় আরো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
এখানে প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘গ্রামে ডায়াবেটিস সচেতনতা কম’ শিরোনামের প্রতিবেদনে ডায়াবেটিসের তিনটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে, যার প্রথমটি হচ্ছে ধূমপান। বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, ‘ধূমপান পরিহার করাও জরুরী।’ আমি ডায়াবেটিস সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় আরো অনেক লেখায় পড়েছি, বলা হচ্ছে, ধূমপানও নাকি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার একটি অন্যতম কারণ।
আমার বড় দু’ভাই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত বেশ কয়েক বছর ধরে। আমার মেঝো ভাইয়ের স্ত্রীও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। আমাদের বিদ্যালয়ের ঝুনু রানী পাল নামক একজন মহিলা শিক্ষক অনেক বছর ধরে ডায়াবেটিসের সাথে যুদ্ধ করছেন। আমার শাশুড়িরও আছে ডায়াবেটিস। মাদ্রাসা শিক্ষিত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত আমার পরিচিত অনেক লোক আছেন, যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। আমার মেঝো ভাবীর বাবা—মাও অনেক বছর ধরে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এভাবে আমার প্রতিবেশী এবং আত্মীয়সহ কাছের এবং দূরের পরিচিত অনেক লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, যাদের সাথে ধূমপানের কোনো সম্পর্কই নেই। ধূমপান করা ছাড়াই তাদের তাহলে ডায়াবেটিস হলো কী করে?! বলতে পারেন, যাদের কথা এখানে বলা হয়েছে, তারা প্রত্যক্ষ ধূমপানের সাথে জড়িত না হলেও পরোক্ষ ধূমপানের শিকার। কিন্তু না, এদের কেউ পরোক্ষ ধূমপানের শিকারও নন। বরং একটা তথ্য জেনে সবাই অবাক হতে পারেন, আমার যে সহকর্মীর ডায়াবেটিস, তাঁর স্বামী নিয়মিত ধূমপান করেন, কিন্তু এখনো ডায়াবেটিস থেকে মুক্ত। যিনি ধূমপান করেন, তিনি যদি ডায়াবেটিস থেকে মুক্ত থাকেন, তাহলে তাঁর ধূমপানের পরোক্ষ শিকার কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবেন কিভাবে?!
‘বাংলাদেশে নারীদের মধ্যে ডায়াবেটিস কেন বাড়ছে?’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় বিবিসি বাংলায় ১৪ নভেম্বর ২০১৭ তারিখে। সেখানে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি বলছে, বর্তমানে ৩৫ লাখের বেশি নারী ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। সংস্থাটি বলছে, এ সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এর মধ্যে একটি বড় অংশের নারীরাই সন্তান জন্মদানের জন্য সক্ষম অবস্থায় (অর্থাৎ কম বয়সে) এ রোগে আক্রান্ত হন।’ প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘বারডেম হাসপাতালের চিকিৎসক মোঃ দেলোয়ার হোসেন বলছেন, সা¤প্রতিক বছরগুলোতে তারা দেখেছেন প্রতি দশ জন নারীর মধ্যে একজনের ডায়াবেটিস আছে। আর এজন্য এখনকার জীবনযাত্রাকেই সবচেয়ে বড় কারণ বলে তিনি মনে করেন।
‘মূল কারণ আমাদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন। কায়িক পরিশ্রম নাই, বসে থাকা হয় বেশি। আর নারীদের আক্রান্ত বেশি হবার কারণ, তারা সংসারের অনেক কাজ করেন, সংসার সামলানো, সন্তান প্রতিপালনসহ সব করার পরে নিজের দিকে নজর দেন না তারা। ডায়াবেটিস হলেও সেটার চিকিৎসায় নজর দেন না অনেকেই।’
এখানে বলা হয়েছে, বর্তমানে ৩৫ লাখের বেশি নারী ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। বাংলাদেশে যারা বসবাস করেন এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে যারা একটু ভালোভাবে জানেন, তারা জানেন, বাংলাদেশের নারীদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা নেই বললেই চলে। উপজাতীয়দের মধ্যে কোনো কোনো মহিলা ধূমপান করেন। সাম্প্রতিক সময়ে ভার্সিটি পড়–য়া কিছু কিছু তরুণীর মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু এখানে যে ৩৫ লাখ নারীর ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার কথা বলা হয়েছে, আমার মনে হয়, এদের মধ্যে ধূমপায়ীর সংখ্যা খুঁজতে গেলে সবোর্চ্চ এক হাজার জনও পাওয়া যাবে না। তাহলে এই লক্ষ লক্ষ নারী ধূমপান ছাড়া ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলেন কী করে?! নাকি সবার স্বামীই ধূমপায়ী বলেই ধূমপানের পরোক্ষ শিকার হয়ে এরা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন? এটাও সম্ভব নয়। কারণ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত অনেক মহিলার স্বামীও ধূমপান করেন না। বাংলাদেশে যারা ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করেছেন বলে ধর্মীয় চেতনা ধারণ করেন, তাঁরা ধূমপানকে রীতিমতো ঘৃণাই করেন, ধূমপান দূরের কথা। এ ধরনের ধর্মীয় ভাবধারার অসংখ্য মানুষও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তাহলে ধূমপানের সাথে সম্পর্ক না থাকার পরও এরা কেন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছেন?
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার সাথে ধূমপানের সম্পর্কের বিষয়টা নিয়ে যে কেউ একটু নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই দেখবেন, এর কোনো ভিত্তি নেই। ধূমপানের সাথে সত্যিই যদি ডায়াবেটিসের সম্পর্ক থাকতো, তাহলে বিশ্বব্যাপী শুধু ধূমপায়ীরাই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতেন, অধূমপায়ী কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত না হতেন। এখন তো দেখা যায় অনেক ১০—১৫ বছর বয়সী শিশু, যাদের সাথে এখনো ধূমপানের কোনো সম্পর্কই নেই, তারাও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। বিশ্বের যে কোনো দেশে নতুন করে বিষয়টা পর্যবেক্ষণ করলে এটাই শতভাগ সত্য প্রমাণিত হবে, ডায়াবেটিসের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ধূমপানের কোনো সম্পর্ক নেই। বিষয়টা শতভাগ অবাস্তব।
ডায়াবেটিসের প্রকৃত কারণ
গত চার বছরের বেশি সময় ধরে ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যান্সার ইত্যাদি রোগ নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। কারণ রোগগুলো সারাবিশ্বেই কোটি কোটি মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে, স্বাভাবিক জীবন বিপন্ন করছে। শুধু ডায়াবেটিসের কথাই বলছি। আমার আত্মীয় এবং পরিচিত অনেকেই রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে কঠিন জীবন যাপন করছে, অনেকে ইতোমধ্যে মারাও গেছে। আমাদের বাড়ির আমার এক জেঠাতো ভাই, নাম আবুল বাশার, ২০১৮ সালের ১৩ ডিসেম্বর ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা বৃদ্ধি পেয়ে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর কিছুদির পরই আরেক জেঠাতো ভাইয়ের স্ত্রী আকস্মিক ডায়াবেটিস বেড়ে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। আরো অনেক আত্মীয় ডায়াবেটিসে ভুগে কঠিন জীবন পার করছেন, যে কোনো সময় মারা যেতে পারেন।
ডায়াবেটিসের কারণ সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত অনেক ডাক্তারের লেখা ও অনেক গবেষণা প্রতিবেদনে এবং মানুষের মুখে অনেক রকম মন্তব্য পাওয়া যায়। মন্তব্যগুলোর সাথে বাস্তবতার মিল খুঁজতে গিয়ে আমি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হতাশ হয়েছি। দেখেছি, যে কারণগুলোকে ডায়াবেটিসের জন্য দায়ী করা হয়, বাস্তবতার সাথে তার অনেকগুলোরই মিল নেই।
ডায়াবেটিসের কারণ নিয়ে বিশ্বের অনেক বড় বড় গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা ফলাফল মাঝে মাঝে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। দুঃখজনক হচ্ছে, কোনো গবেষণা—ফলাফলেই ডায়াবেটিসের মূল কারণ কয়টি, তা চিহ্নিত করতে দেখা যায় না এবং ডায়াবেটিসের মোট কারণ কয়টি, তা—ও সুনির্দিষ্টভাবে খুঁজে বের করতে পারে না কোনো গবেষণা। একেক গবেষণায় একক কারণকে ডায়াবেটিসের জন্য দায়ী বলে উল্লেখ করা হয়। কিছু কারণ অনেক সময় মিলে যায়, কিছু কারণ আবার মিলে না। সবগুলো কারণ একত্র করলে মানুষ ডায়াবেটিস থেকে বাঁচার আশা বাদ দিয়ে ভাববে, এতোগুলো কারণ পরিহারের চেয়ে ডায়াবেটিসে ধুঁকে ধুঁকে মরাই বরং ভালো!
মাফ করবেন, আমি কোনো ডাক্তার নই, কোনো গবেষকও নই, তবু এমন মন্তব্য করে ফেললাম। কারণ এমন মন্তব্য করার মতো শক্তি আমার আছে। আমি যে মন্তব্য করেছি, তা খুব ভালোভাবে প্রমাণ করে দেখাতে পারবো বলেই মন্তব্য করার সাহস পেয়েছি।
আমি দেখেছি, ডায়াবেটিসের মূল কারণ মাত্র ১টি এবং ডায়াবেটিস সর্বমোট তিন কারণে হয়। ডায়াবেটিসের মূলতঃ যে কারণে হয়, মানুষ তা থেকে দূরে থাকতে পারলে মানুষকে ডায়াবেটিস আক্রমণ করতে পারবে খুব কম। আর ডায়াবেটিস মোট যে তিনটি কারণে হয়, সবগুলো এড়িয়ে চললে নিশ্চিতভাবে মানুষ ডায়াবেটিস থেকে রক্ষা করতে পারবে নিজের মূল্যবান জীবনকে।
আমি দীর্ঘদিন ধরে শুধু একটা বিষয় দেখেছি চরম সত্য হিসেবে, ডায়াবেটিস শুধু ঐসব মানুষের হয়, যারা শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকে বা করলেও পরিমাণে কম করে। পাশাপাশি যারা বেশি বেশি খায় বা মনের চাহিদামতো খায় বা ভোজনপ্রিয় এবং যারা মোটা শরীরের, তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় বেশি বেশি। এককথায় ডায়াবেটিসের মূল কারণ শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা এবং অন্য দু’কারণ হচ্ছে বেশি খাওয়া বা মনের চাহিদামতো খাওয়া এবং মুটিয়ে যাওয়া। এই তিনটি কারণ যার মধ্যে নেই, সে কখনো কোনোভাবে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় না। তবে যারা মোটা হওয়া সত্ত্বেও এবং বেশি বেশি খাওয়া সত্ত্বেও শারীরিক পরিশ্রম করে বেশি বেশি, তারাও খুব কমই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। আবার চিকন লোকও যখন শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকে, অনেক সময় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। তাই এতে কোনো সন্দেহ নেই, ডায়াবেটিসের মূল কারণ শারীরিক পরিশ্রম না করা বা কম করা। এককথায় পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম যারা করে. তারা কখনো ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় না। আমার এ বক্তব্যে পুরো আস্থা রাখার জন্য চার শ্রেণির লোকের দিকে লক্ষ্য করার অনুরোধ করছি।
১. বাংলাদেশের ঐসব ‘পায়েচালিত’ রিকশাচালক, যারা ১০ বছরের বেশি সময় ধরে (অনেকে ৩০—৪০ বছর বা তার চেয়েও বেশি সময় ধরে চালায়) রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এমন এক হাজার বা দশ হাজার রিকশাচালকের খোঁজ নিয়ে দেখুন, দেখবেন তারা কেউই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নন। এমনও দেখা যেতে পারে, তাদের অনেকের পিতামাতা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন বা কোনো সন্তান ইতোমধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। এমনও দেখা যাবে, তাদের অধিকাংশই ধূমপান করছেন, নয়তো ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার জন্য প্রচারিত অন্য কোনো কারণ অনেকের মধ্যে বিরাজমান, তবু তারা কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে না।
২. বিশ্বের সব দেশেই শ্রমজীবি মানুষ আছে। যারা মাটি কাটার কাজ করে বা ফসলের জমি কিংবা কারখানায় হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের কাজ করে, এককথায় সেসব শ্রমজীবি মানুষ, যারা শারীরিক শ্রমনির্ভর কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে, এমন শ্রম, যা এদেরকে মোটা হতে দেয় না। পনেরো—বিশ বছরের বেশি সময় ধরে যেসব শ্রমজীবি মানুষ এভাবে পরিশ্রম করছেন দিনের একটা বড় অংশ, তারা কেউ দেখবেন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নন।
৩. যেসব অ্যাথলেট বা ক্রীড়াবিদ পেশাগতভাবে শারীরিক শ্রমনির্ভর বিভিন্ন খেলা (যেমন: ফুটবল, ক্রিকেট, টেনিস, সাঁতার, ব্যাডমিন্টন ইত্যাদি) খেলে যাচ্ছেন ১০ বছরের বেশি সময় ধরে, তাদের খোঁজ নিয়ে দেখুন, দেখবেন ডায়াবেটিসে তারা কেউ আক্রান্ত নন। এরা অনেকে হয়তো ধূমপানও করেন, অনেকে হয়তো ফাস্টফুডেও আসক্ত, অনেকের বাবা—মা কারো হয়তো ডায়াবেটিস ছিল, তবু এরা ডায়াবেটিসের ছোবল থেকে মুক্ত।
৪. বিভিন্ন দেশের সামরিক বাহিনীতে যারা চাকরি করেন এবং বাধ্যগতভাবে রুটিনমাফিক নিয়মিত পর্যাপ্ত ব্যায়াম করেন, অতিরিক্ত ব্যায়ামের কারণে মোটা হতেও পারছেন না, তাদের কাউকেও দেখবেন না ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে।
এ চার শ্রেণির মানুষের ডায়াবেটিস না হওয়াটা প্রমাণ করে, ডায়াবেটিসের মূল কারণ শারীরিক শ্রম থেকে দূরে থাকা, অন্য কিছু নয়।
মানুষ যখন শারীরিক পরিশ্রম কম করে, মনের চাহিদামতো খায়, একসময় এসব কারণে মুটিয়ে যায়। আর মুটিয়ে গেলে শরীরে চর্বি বা কোলেস্টেরল বেড়ে যায়। কোলেস্টেরলের মধ্যেই জন্ম নেয় ডায়াবেটিস। অনেক মানুষ মোটা না হলেও নিয়মিত শারীরিক শারীরিক পরিশ্রম না করার কারণে শরীরে কোলেস্টেরল বেড়ে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে।
তিনটি কারণে মানুষের শরীরে কোলেস্টেরল বেড়ে যায়। প্রথম কারণ পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম না করা, দ্বিতীয় কারণ বেশি খাওয়া, তৃতীয় কারণ মুটিয়ে যাওয়া। যে তিনটি কারণে মানুষের শরীরে কোলেস্টেরল বেড়ে যায়, সেই তিনটি কারণেই মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। অর্থাৎ যে কোনো কারণে কোলেস্টেরল বেড়ে গেলে মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। তাই যেসব মানুষের শরীরে কোলেস্টেরল বাড়তে পারে না পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রমের কারণে, সেসব মানুষ ডায়াবেটিস থেকে নিরাপদ থাকে।
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত শতভাগ লোকের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য পাওয়া যাবে যে, সে পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম করে না। অনেকের মধ্যে এটা পাওয়া যাবে যে, তারা মোটা বা বেশি বেশি খায়। কিন্তু অন্য কোনো কারণ, যেগুলোকে ডায়াবেটিসের কারণ বলে প্রচার করা হয়, শতভাগ লোকের মধ্যে পাওয়া যাবে না। আমি ধূমপান এবং ডায়াবেটিসের সম্পর্ক নিয়ে আগেই বলেছি, ধূমপানকে তখনই ডায়াবেটিসের কারণ বলে বিশ্বাস করা যেতো, যখন দেখা যেতো ধূপায়ীরাই (সবাই না হলেও অনেকেই) শুধু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় এবং অধূমপায়ী কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় না। কথাটি প্রচারিত অন্য কারণগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যেমন বলা হয়, ডায়াবেটিস নাকি বংশগতভাবেও হয়। ডায়াবেটিসকে বংশগত রোগ তখনই বলা যাবে, যখন দেখা যাবে: ১. কারো পূর্বপুরুষ শুধু এক সিঁড়ি নয়, একাধিক সিঁড়ি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিল, ২. পিতা/মাতা কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, শুধু এমন লোকেরাই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় বেশি বেশি এবং ৩. পূর্বপুরুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নয়, এমন মানুষ খুব কমই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়।
ডায়াবেটিসকে বংশগত রোগ বলা সম্পর্কে এ লেখায় আরো অনেক আলোচনা আছে। এখানে আরো দু’একটা কথা না বললেই নয়। এ অধ্যায়ের শুরুতে ডায়াবেটিসের ভয়াবহতা সম্পর্কে অনেক পরিসংখ্যান উল্লেখ করা হয়েছে। একটি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ‘আইডিএফের ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে বর্তমানে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ৪৩ কোটি। ১৯৮৫ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র তিন কোটি। গত আড়াই দশকে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১৩ গুণ বেড়েছে। সংস্থাটি দুই বছর পরপর আক্রান্ত মানুষের তথ্য প্রকাশ করে। তাদের ধারণা, এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা ৬৪ কোটিতে উন্নীত হবে।’
দৈনিক যুগান্তরে ২৮ ফেব্রুয়াারি ২০১৮ তারিখে ‘ডায়াবেটিস সচেতনতা দিবস’ উপলক্ষ্যে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘এক জরীপ মতে বিশ্বে প্রতি সাত সেকেন্ডে একজন মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে এই রোগ এখন মহামারী রূপ নিচ্ছে। দেশে বর্তমানে ৮৪ লাখেরও বেশি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।
ডায়াবেটিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৪২ দশমিক ৫ কোটি। অথচ ১৯৮৫ সালে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ কোটি। এখনই এই রোগ প্রতিরোধ করা না গেলে ২০৩৫ সালের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ৫৯ কোটিতে পৌঁছানোর আশঙ্কা করা হচ্ছে।’
এই রকম পরিসংখ্যানগুলো কী নির্দেশ করে, তা আমরা সহজে বুঝতে পারি না বলে ডায়াবেটিসকে বংশগত বা জিনগত রোগ বলে নিজেদের সর্বনাশ করছি। এই রকম পরিসংখ্যানগুলো বলে— যত পেছনের সময়ে যাওয়া যায়, দেখা যায় তখন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা সমাজে তত কম ছিল। এভাবে যেতে যেতে এমন একটা সময় দেখা যাবে, তখন তেমন কারো ডায়াবেটিস ছিল না। যদি এক সময় পৃথিবীতে তেমন কারো ডায়াবেটিস না থাকে, তাহলে কোন্ সব পূর্বপুরুষ থেকে রোগটি আমাদেরকে সংক্রমিত করেছে? পূর্বপুরুষ কারো তো একসময় ডায়াবেটিস ছিলই না পরিসংখ্যান মতে!
ডায়াবেটিসকে জিনগত রোগ বলে আমরা নিজেদেরকে ধোঁকা দিচ্ছি। যখন দেখছি আমাদের বাবা—মা কারো রোগটি ছিল, তখন ভাবছি রোগটি তো আমার হওয়া অবশ্যম্ভাবী, তাহলে কী আর করার আছে! এটা ভেবে রোগটির নিকট আমরা অসহায় আত্মমসমর্পণ করছি। রোগটি সময় মতো আমাদের আক্রমণ করে বসছে। যারা ডায়াবেটিসকে জিনগত রোগ বলছে, তারা মানবজাতির সর্বনাশ করছে।
আমরা যদি দেখতাম, যত পেছনের সময়ে যাওয়া যায়, মানুষের জীবন তত কষ্টসাধ্য ছিল; মানুষ হেঁটে হেঁটেই তখন চলে যেতো অনেক দূরের গন্তব্যে, মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের অধিকাংশ কাজ করতে হতো শারীরিক শ্রমের বিনিময়ে; আর মানব সমাজে তখন থেকেই ডায়াবেটিসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে, যখন থেকে মানুষের শারীরিক পরিশ্রমের কাজ কমে যেতে শুরু করেছে, যখন থেকে মানুষ মেশিন—নির্ভর হয়ে পড়তে শুরু করেছে; যখন থেকে আরামপ্রিয়তা মানুষের মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে; যখন থেকে মানুষ দশ মাইল দূরের কথা, এক মাইল দূরে যাবার জন্যেও গাড়ি ব্যবহার করছে বা করতে পারছে; আমরা বুঝতাম, ডায়াবেটিস আগেকার কোনো ডায়াবেটিস রোগী থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত রোগ নয়, বরং ডায়াবেটিস আরামপ্রিয় মানুষের রোগ; আরামপ্রিয় মানুষের সংখ্যা সমাজে যত বাড়তে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যাও আনুপাতিকহারে তত বাড়ছে; আমরা খুব সহজে বুঝতাম, ডায়াবেটিস শুধু শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা মানুষদেরকেই আক্রমণ করে, পাশাপাশি যারা পরিমিত খায় না এবং মোটা, তাদেরকে।
টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসকে যারা বংশগত মনে করে, তারা ভাবে না, একসময় সমাজে তেমন কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতো না। পরে আরামপ্রিয় হয়ে যাবার পর থেকেই মানুষ রোগটিতে আক্রান্ত হতে শুরু করছে। এখন থেকে যদি বিশে^র সকল ডায়াবেটিসমুক্ত মানুষ শারীরিক পরিশ্রমে প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ সময় ব্যয় করার মাধ্যমে একযোগে রোগটি প্রতিহত করা শুরু করে, এদের সন্তানরা বা সামনের প্রজন্মের কেউ আর টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসেও আক্রান্ত হবে না। তাছাড়া পরিসংখ্যান মতে, টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা সমাজের মোট ডায়াবেটিস রোগীর দশ শতাংশ। এ অধ্যায়ের শুরুতেও প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘ডায়াবেটিস: প্রতিটি পরিবারের যুদ্ধ’ শিরোনামের প্রতিবেদন থেকে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্বের মোট ডায়াবেটিস রোগীর শতকরা ৯০ ভাগ টাইপ—২ জাতীয় ডায়াবেটিসে ভুগছে।
যদি শুধু এই দশ শতাংশ টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস রোগীকে বংশগত ডায়াবেটিস রোগী ধরে নেয়া হয়, তবু বাকি নব্বই শতাংশ টাইপ টু ডায়াবেটিস রোগীর বিবেচনায় টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা একেবারে নগণ্য। তাই রোগটিকে জিনগত না বলাই ভালো। রোগটিকে বংশগতভাবেও হয়, এমন রোগের কাতারে ফেললে যাদের বাবা—মা কারো ডায়াবেটিস, তারা আতঙ্কে জীবন কাটাবে এবং যাদের বাবা—মা কারো ডায়াবেটিস হয়নি, তারা নিশ্চিন্তে জীবন কাটাবে। উভয় শ্রেণিই একসময় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়বে কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ না করার ফলে।
ডায়াবেটিসের মূল কারণ সম্পর্কে কিছু প্রতিবেদনের বক্তব্য
ডায়াবেটিসের মূল কারণ যে শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা, কথাটির সমর্থনে কিছু আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করছি।
(১) ৭ এপ্রিল ২০১৬ তারিখের বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত ‘বিশ্ব ডায়াবেটিসের ''ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের'' ঝঁুকিতে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সারা বিশ্বে এখন প্রতি ১১ জনে একজন ব্যক্তি ডায়াবেটিস আক্রান্ত। ২০১৪ সালে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৪২২ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়ষ্ক ব্যক্তি, যা ১৯৮০—তে আক্রান্তের তুলনায় ৪ গুণ বেশি। ৭ই এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের প্রাক্কালে প্রকাশিত সংস্থাটির প্রথম গ্লোবাল রিপোর্টে বলা হয়েছে প্রতি বছর রক্তে উচ্চমাত্রার গ্লুকোজ বা ডায়াবেটিসের কারণে বিশ্বে মারা যাচ্ছে ৩৭ লক্ষ মানুষ।
২০১২ সালে ১৫ লাখ লোক প্রত্যক্ষভাবে ডায়াবেটিসের কারণে মারা যান।’
আরো বলা হয়, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে এখনই ''দৃঢ় পদক্ষেপ'' না নিলে এই সংখ্যা আরও বাড়বে।
এই রিপোর্টে টাইপ—১ এবং টাইপ—২ — দুধরনের ডায়াবেটিস আক্রান্তদের কথাই বলা হয়েছে। তবে এটাও বলা হয়েছে যে ধরনের ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে তারা টাইপ—২ ডায়াবেটিসের শিকার, যার মূল কারণ আস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন।’
(২) জার্মানির জনপ্রিয় সংবাদ মাধ্যম ডয়চে ভেলের (বাংলা) ওয়েবসাইটে ২১ এপ্রিল ২০১২ তারিখে প্রকাশিত ‘ভারতে ডায়বেটিসের প্রকোপ’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডাব্লিউএইচও’র তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ৩৪৬ মিলিয়ন মানুষ ডায়বেটিসে আক্রান্ত। ২০৩০ সাল নাগাদ গোটা বিশ্বে আনুমানিক ৭.৮ শতাংশ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। বর্তমানে চীন ও ভারতে দেখা যাচ্ছে এর প্রকোপ। নতুন সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতে ৫১ মিলিয়ন মানুষ ডায়বেটিসে ভুগছেন। আগামী ২০ বছরে এই সংখ্যা ১৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। দিল্লি, মুম্বই ও কলকাতার মতো বড় বড় শহরে ডায়াবেটিস রোগীরা একই ধরনের সমস্যার কথা বলেন চিকিৎসকের কাছে, যেমন অফিসে চেয়ারে বসেই কাজ করতে হয় অনেকটা সময়, খেলাধুলা ও স্বাস্থ্যকর খাবারের সুযোগ সুবিধাও কম। পুষ্টিকর খাদ্য দ্রব্য ও রান্নাবান্নার সময়ও পান না অনেকে। চারিদিকে, কোকাকোলা, পিৎসা ও বার্গারের মতো ফাস্টফুডের বিজ্ঞাপন। একটু স্বচ্ছল হলেই গাড়ি কেনার প্রবণতা। ঘরকন্নার সাহায্যে থাকে কাজের লোক। শারীরিক পরিশ্রমের পাল্লাটা অনেক কম ইত্যাদি ইত্যাদি। আর এসবই বহুমূত্র রোগের দিকে ঠেলে দেয় মানুষকে।’
(৩) ডয়চে ভেলের (বাংলা) ওয়েবসাইটে আরেকটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ১৩ অক্টোবর ২০১৫ তারিখে ‘‘ডায়াবেটিস ও ইনসুলিন’’ শিরোনামে। সেখানে বলা হয়, ‘সারা বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগীদের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে চলেছে। এর কারণ হল বেশি খাওয়া ও কম দৌড়ঝাঁপ বা হাঁটাচলা করা। যার ফলে ডায়াবেটিস আধুনিক জীবনযাত্রার সঙ্গী হয়ে উঠেছে। সারা বিশ্বে প্রায় ২৫ কোটি মানুষ ডায়াবেটিসে ভুগছেন। তবে খাওয়াদাওয়া ঠিক রাখলে আর নিয়মিত ব্যায়াম করলে রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।’
(৪) ভারত থেকে প্রকাশিত xiaomi.dailyhunt.in (শাওমী ডট ডেইলীহান্ট ডট আইএন) নামক অনলাইন পত্রিকায় ‘ইনসুলিনের অভাবে ভুগবে বিশ্ব’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বর্তমান বিশ্বের অন্যতম জীবনঘাতী রোগ বলা হয় ডায়াবেটিসকে। এই রোগের কারণে প্রতিবছর মারা যাচ্ছে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ। বিশ্বে বর্তমানে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ৪২ কোটি ৫০ লাখ। আর প্রতিবছরই আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হারে বেড়ে ২০৩০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা দাঁড়াবে ৫১ কোটি ১০ লাখে। তবে সেই হারে বাড়বে না এই রোগে আক্রান্তদের প্রয়োজনীয় জীবনরক্ষাকারী ওষুধ ইনসুলিনের সরবরাহ। ফলে ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের চার কোটির বেশি রোগী ইনসুলিন পাবেন না। এই অবস্থায় দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা ও ওশেনিয়া অঞ্চলে ভয়াবহ প্রভাবের আশঙ্কা করছেন গবেষকরা।
ল্যানসেট ডায়াবেটিস ও এন্ডোক্রায়োনোলজি জার্নালের এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।’
গবেষণা প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়, ‘গবেষণায় নেতৃত্বদানকারী স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক ডাক্তার সঞ্জয় বসু বলেন, ছোঁয়াচে নয় এমন রোগ বিশেষ করে ডায়াবেটিসের বিস্তার রোধে জাতিসংঘের নানা পদক্ষেপ সত্ত্বেও বর্তমানে চাহিদার তুলনায় ইনসুলিনের প্রাপ্যতা অনেক কম। আগামী ১২ বছরে বার্ধক্য, নগরায়ন, খাদ্যাভাস ও শারীরিক কাজকর্মের ধরনে নানা পরিবর্তনের কারণে গোটা বিশ্বেই টাইপ টু ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাবে।’
(৫) ‘ডায়েবেটিস থেকে সাবধান!’ শিরোনামে ডয়চে ভেলের ওয়েবসাইটে ২৭ মে ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলা হয়, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বাড়ার মূল কারণ, অতিরিক্ত ওজন।’ [https://www.dw.com/overlay/media/bn/38965147/41071625]
(৬) ভারতের কলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার পত্রিকায় ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে ‘নিয়মিত জীবনযাপন দূর করবে ডায়াবেটিস’ শিরোনামে একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারটি দিয়েছেন বোলপুরের চিকিৎসক প্রদীপ গঙ্গোপাধ্যায়। সাক্ষাৎকারের একটি অংশ এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে।
‘প্রশ্ন: ডায়াবেটিস কেন হয়?
উত্তর: হাইপারটেনশন, থাইরয়েড, হার্টের অসুখ, ফ্যাটি লিভার, আর্থারাইটিজের মতোই ডায়াবেটিস মূলত একটি ‘লাইফস্টাইল ডিজিজ’। জীবনশৈলীর কারণে যে অসুখগুলো হয় তার মধ্যে অন্যতম হল ডায়াবেটিস। এখন মানুষ কায়িক পরিশ্রম কম করে, অনিয়মিত খাওয়াদাওয়া করে। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনই এই ধরনের অসুখের মূলে। আগেকার দিনে ফ্রিজ, এসি, গাড়ি, কম্পিউটার, টিভি, মোবাইলের ব্যবহার কম ছিল। এখন মানুষ মাঠে খেলাধুলোর বদলে কম্পিউটারে গেমে মনোনিবেশ করে। সাইকেলের বদলে স্কুটি ব্যবহার করে। আগে সব ক্ষেত্রেই পরিশ্রম অনেক বেশি ছিল। বর্তমানে গাড়ি চড়া, না হাঁটা, রেস্তোরাঁতে খাওয়া সব দিক থেকে মানুষের জীবনশৈলী বদলেছে। মাছ, ভাত, শাক, পোস্তার জায়গায় খাবার হিসেবে এসেছে পাস্তা, পেস্টি্র, কোল্ড ড্রিংকস, আইসক্রিম, নুডলস যেগুলি মূলত হাই ক্যালোরির খাবার। এই সমস্ত খাবার বেশি করে খাওয়া এবং কম পরিশ্রম করার ফলে চাইল্ডহুড ওবেসিটি হচ্ছে। এই ওবেসিটিই হচ্ছে ভবিষ্যতে সুগার, প্রেশার, হার্টের অসুখের প্রবেশ পথ। আগেকার থেকে এখন মানুষের জীবনযাত্রা অনেক জটিল হয়েছে। বেড়েছে মানসিক চিন্তা। সমাজ, সংসার, কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপও ডায়াবেটিসের মূলে।’
এই ছয়টি নিবন্ধ—প্রতিবেদনের প্রথমটিতে ডায়াবেটিসের মূল কারণ বলা হয় আস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনকে, দ্বিতীয়টিতে ডায়াবেটিসের জন্য দায়ী বলে মনে করা হয় আরামপ্রিয় জীবনযাপন এবং শারীরিক পরিশ্রম কম করাকে, তৃতীয়টিতে ডায়াবেটিসের কারণ বলে মনে করা হয় বেশি খাওয়া, দৌড়ঝাঁপ বা হাঁটাচলা কম করা এবং নিয়মিত ব্যায়াম না করাকে, চতুর্থটিতে বার্ধক্য, নগরায়ন, খাদ্যাভাস ও শারীরিক কাজকর্মের ধরনে নানা পরিবর্তনের কারণে মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় বলে মনে করা হয়, পঞ্চমটিতে ডায়াবেটিসের মূল কারণ বলা হয় অতিরিক্ত ওজনকে, আর ষষ্ঠটিতে ডায়াবেটিসকে ‘লাইফস্টাইল ডিজিজ’ বলেই আখ্যা দেয়া হয়। লাইফস্টাইল হিসেবে বলা হয়, ‘এখন মানুষ কায়িক পরিশ্রম কম করে, অনিয়মিত খাওয়াদাওয়া করে। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনই এই ধরনের অসুখের মূলে। আগেকার দিনে ফ্রিজ, এসি, গাড়ি, কম্পিউটার, টিভি, মোবাইলের ব্যবহার কম ছিল। এখন মানুষ মাঠে খেলাধুলোর বদলে কম্পিউটারে গেমে মনোনিবেশ করে। সাইকেলের বদলে স্কুটি ব্যবহার করে। আগে সব ক্ষেত্রেই পরিশ্রম অনেক বেশি ছিল। বর্তমানে গাড়ি চড়া, না হাঁটা, রেস্তোরাঁতে খাওয়া সব দিক থেকে মানুষের জীবনশৈলী বদলেছে।’
এই প্রতিবেদনগুলোতে কিন্তু ডায়াবেটিসকে বংশগতভাবেও হয়, এমন রোগ বলা হয়নি; ডায়াবেটিসের সাথে ধূমপান, মদপান, চিনি/মিষ্টি/লবণ বেশি খাওয়ার সম্পর্ক আছে বলেও বলা হয়নি। তবে শুধু শেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ডায়াবেটিসের সাথে মানসিক চাপের সম্পর্কের কথা। শুধু একটা কথাই বলবো, এ অধ্যায়ে যে চার শ্রেণির ডায়াবেটিস থেকে মুক্ত থাকার কথা বলা হয়েছে, শারীরিক পরিশ্রমে যুক্ত থাকা ছাড়া জীবনের অন্য বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে এরা কি আর সব মানুষের মতো নয়? আর সব মানুষের মতো এদের জীবনেও হাসি—কান্না, সুখ—দুঃখের সাথে মানসিক চাপও নিশ্চয়ই আছে। তাহলে মানসিক চাপ এদেরকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত করতে পারছে না কেন? কারণ মানসিক চাপ কাউকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত করতে পারে তখন, যখন মানুষ পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম না করার ফলে শরীরে কোলেস্টেরল বৃদ্ধি পায়। যেসব মানুষের শরীরে কোলেস্টেরল বাড়তে পারে না, তারা শুধু ডায়াবেটিস নয়, হার্ট অ্যাটাক এবং উচ্চ রক্তচাপ থেকেও বেঁচে থাকে। তাই মানসিক চাপ ডায়াবেটিসসহ এ তিনটি রোগের প্রত্যক্ষ কারণ নয়। বরং এসব রোগের প্রত্যক্ষ কারণ শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা বা আরামপ্রিয় জীবন যাপন করা। আরামে থাকলেই মানুষকে রোগগুলো আক্রমণ করার সুযোগ পায়।
0 Comments: