Headlines
Loading...
কিভাবে ফিট থাকা যায় (বই)

কিভাবে ফিট থাকা যায় (বই)

ডায়াবেটিস, হাই ব্লাড প্রেসার (উচ্চ রক্তচাপ) এবং হার্ট অ্যাটাক (হৃদরোগ) এই তিনটি রোগ থেকে নিরাপদ থাকার মাধ্যমে

             ‘কিভাবে ফিট থাকা যায়’

 



সূচীপত্র
১. গত ২৫ বছরে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যে পরিবর্তনগুলো এসেছে এবং পরিবর্তনগুলোর ফলে সমাজে কী কী রোগ বৃদ্ধি পেয়েছে?
২. অতিরিক্ত আরামই ব্যারামের কারণ (দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত)
৩. হার্ট অ্যাটাক, ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ ধেয়ে আসছে আমাদের সবার দিকে!
৪. ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার ৯টি ভয়াবহ দিক
৫. ‘ডায়াবেটিস বড়লোকদের রোগ’ কথাটা কতটুকু সত্য?
৬. দৈনিক মাত্র একটি কাজ করুন, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকবেন
৭. মানুষের হার্ট দুর্বল হয় কখন?
৮. লো প্রেশার কোনো রোগ নয়, বরং সুস্থতার লক্ষণ
৯. বিপজ্জনক রোগগুলোর মধ্যে তিনটিই প্রতিরোধযোগ্য
১০. লবণ খেলে কি উচ্চ রক্তচাপ হয়?
১১. টেনশন আপনার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না, যদি শরীরে চর্বি জমতে না দেন
১২. বয়স বেশি হলে কি মানুষ এমনিতেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়?
১৩. রোগমুক্ত জীবনের জন্য হাঁটা (দৈনিক নয়াদিগন্তে প্রকাশিত)
১৪. টেনশনে মানুষ কী কী রোগে আক্রান্ত হয়?
১৫. মানুষ কখন বংশগতভাবে কোনো রোগে আক্রান্ত হয়? (দৈনিক নয়াদিগন্তে প্রকাশিত)
১৬. ডায়াবেটিসের মোট কারণ ৩টি, মূল কারণ মাত্র ১টি
১৭. ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং উচ্চ রক্তচাপ এই রোগ তিনটি একই সূত্রে গাঁথা
১৮. ডায়াবেটিসকে বংশগত রোগ বলে প্রচার করার ক্ষতি
১৯. চিনি—মিষ্টি খাওয়ার সাথে ডায়াবেটিস ও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হবার সম্পর্ক
২০. উচ্চ রক্তচাপের কারণ অজানা নয়
২১. ফিট থাকুন



১. গত ২৫ বছরে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যে পরিবর্তনগুলো এসেছে এবং পরিবর্তনগুলোর ফলে সমাজে কী কী রোগ বৃদ্ধি পেয়েছে?

আমাদের যাদের বয়স এখন ৪০ বা তার চেয়ে বেশি, আমরা দেখেছি, গত ২৫ বছর আগে মানুষের জীবনে কতো না পরিশ্রমের কাজ ছিল! মানুষ অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোথাও যাবার সময় পায়ে হেঁটেই যেতো। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে শারীরিক পরিশ্রমের অনেক অনেক কাজ ছিল, মানুষকে বাধ্যগতভাবেই যেগুলো করতে হতো।

অধিকাংশ মানুষ কৃষিকাজের সাথে জড়িত ছিল বলে পুরুষদেরকে যেমন বছরের অধিকাংশ সবসময় বিভিন্ন রকম কৃষিকাজ করতে গিয়ে ফসলের জমিতে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে হতো, ওসব ফসল বাড়িতে তুলে আনার পর নারীদেরকেও সেগুলোর পেছনে আলাদাভাবে আরো অনেক পরিশ্রম করতে হতো। ঢেঁকিতে ধান ভাঙ্গানো সহ অসংখ্য শারীরিক শ্রমনির্ভর কাজে নারীরা জড়িত থাকতো।

কিন্তু বিগত প্রায় ২৫ বছর ধরে দেশের অধিকাংশ এলাকায় মানুষ ফসলের জমিতে কাজ করা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে, সময় নেই, জনবল নেই বা নগদ টাকা থাকায় বাজার থেকে কিনে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে বলে।

মানুষের যাতায়াতেও এসেছে আমূল পরিবর্তন। আগে রাস্তাঘাট ছিল কাঁচা। যানবাহনের ব্যবহার ছিল না। মানুষ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতো হেঁটে হেঁটে। অনেক দূরের পথও মানুষ তখন পায়ে হেঁটেই অতিক্রম করতো। কিছুই করার ছিল না।

এখন রাস্তাঘাট পাকা। যানবাহনও সহজলভ্য। পরিবহন এবং যাতায়াত ব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন ও উন্নতি আসার কারণে মানুষ এখন সামান্য দূরত্বও অতিক্রম করছে যানবাহনে চড়ে; হেঁটে যাওয়া, সাইকেলে যাওয়ার প্রবণতা একেবারে কমে গেছে। রিকশাঅলারা আগে পায়েচালিত রিকশা চালাতে গিয়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হতো, এখন মোটরচালিত রিকশা চলে আসায় সবাই পরিশ্রমসাধ্য রিকশা পরিত্যাগ করে আরামসাধ্য রিকশা চালাতে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছে।

এককথায় শারীরিক পরিশ্রম থেকে মানুষের জীবন গত প্রায় ২৫ বছর ধরে অনেক অনেক দূরে সরে গেছে, ভবিষ্যতে আরো বেশি দূর সরে যাবে।

এই পরিশ্রম না করার প্রবণতা মানুষের শরীরে মেদ—চর্বি—কোলেস্টেরল বৃদ্ধিতে সাহায্য করছে। আর শরীরে চর্বি বা কোলেস্টেরল বৃদ্ধি পেলে শরীরে দেখা দেয় প্রথমে উচ্চ রক্তচাপ (হাই ব্লাড প্রেশার), পরে সেই উচ্চ রক্তচাপ থেকে জন্ম নেয় ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ (হার্ট অ্যাটাক)। কখনো কখনো উচ্চ রক্তচাপের আগেই ডায়াবেটিস বা হার্ট অ্যাটাকে মানুষ আক্রান্ত হয়ে পড়ে।

শুধুই শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে সরে যাওয়া মানুষগুলোই এই রোগ তিনটিতে আক্রান্ত হচ্ছে। আগে মানুষ এই রোগগুলোতে আক্রান্ত হতো শেষ বয়সে। কিন্তু এখন অল্প বয়সেই অসংখ্য মানুষ এগুলোতে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে।

অবাক করা বিষয় হচ্ছে, এখনো যারা কোনো না কোনোভাবে শারীরিক পরিশ্রমের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে, দেখা যায় তারা ৬০—৭০ বছরের বেশি বয়স হয়ে যাবার পরও এই রোগগুলো থেকে সম্পূর্ণ সুরক্ষিত আছে। আমার পরিচিত এই রকম বেশ কয়েকজন আছেন।

বিষয়টা বাস্তবতার সাথে মিলিয়ে দেখতে পারেন আপনিও। দেখুন, আপনার পরিচিত যেই মানুষগুলো এখনো কোনো না কোনো শারীরিক পরিশ্রমের পেশায় নিয়োজিত, তারা কি এই সব রোগে আক্রান্ত হচ্ছে? দেখবেন এরকম ২০ জন মানুষের মধ্যে একজনও এই রোগগুলোর কোনোটিতে আক্রান্ত নয়। অন্যদিকে যারা এই রোগগুলোর কোনো না কোনোটিতে আক্রান্ত, তাদের খোঁজ নিন। দেখবেন, এই রোগগুলোতে আক্রান্ত হবার আগে তারা কেউই শারীরিক পরিশ্রমের কোনো পেশায় নিয়োজিত ছিল না বা নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করতো না।

এভাবে পর্যবেক্ষণ করলে আপনি নিশ্চিত হবেন (১) মানুষের জীবনে ঠিক কী কারণে এখন এই রোগগুলোর আক্রমণ বেড়ে গেছে? (২) কেনই বা আগে মানুষ এই রোগগুলোতে একেবারে কম আক্রান্ত হতো? (৩) আক্রান্ত হলেও শেষ বয়সে এসে আক্রান্ত হতো। (৪) এখনকার মতো কম বয়সে (৩০—৬০ বছর) বয়সে আক্রান্ত হতো না।

দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, এই রোগগুলোর কারণ নিয়ে এখনো বিশ্বব্যাপী মারাত্মক সব ভুল ধারণা ছড়িয়ে আছে। যার ফলে এই রোগগুলোর সত্যিকারের কারণ এখনো অনেক অনেক মানুষের নিকট অজানা। এখনো কোটি কোটি মানুষ বিশ্বাস করছে, এই রোগগুলো প্রতিরোধযোগ্য নয়; মানুষ শত চেষ্টা করেও এই রোগগুলো থেকে বাঁচতে পারবে না। এই বিশ্বাসের কারণ, রোগগুলোর কারণ সম্পর্কে এমন কিছু বিষয়কে দোষারোপ করা, যেগুলো শুনে মানুষ এই রোগগুলো থেকে নিরাপদ থাকার ব্যাপারে হতাশ হয়ে পড়ে। পরবর্তী লেখাগুলোতে সেই বিষয়ে আলোচনা করা হবে।

এই রোগগুলো থেকে এখনও যারা সুস্থ আছেন, তাদের নিকট এইটিই বার্তা: এই রোগগুলো থেকে নিরাপদ থাকতে চাইলে আপনি এখন থেকে নিয়মিত কায়িক শ্রম করুন। আপনি যতদিন নিয়মিত কায়িরক শ্রম করবেন, ততদিন এই রোগগুলোর কোনোটিই আপনাকে স্পর্শ করতে পারবে না কোনোভাবে।

পৃথিবীর বহু দেশের সচেতন মানুষ শারীরিক পরিশ্রমের পেশায় নিয়োজিত না থাকলেও অন্য কোনোভাবে শারীরিক পরিশ্রম করেন নিয়মিত। বেশিরভাগই জগিং করেন, অনেকে বিভিন্নভাবে ব্যায়াম করেন।

যারাই নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করে থাকেন, তারাই বেঁচে থাকেন এই রোগগুলো থেকে। আপনিও বাঁচুন রোগগুলো থেকে, নয়তো জীবন হবে অনেক অনেক কঠিন। ঠিকমতো খেতেও পারবেন না। পছন্দের অনেক খাবার পরিত্যাগ করতে হবে বা খেলেও খেতে হবে একেবারে স্বল্প পরিমাণে। অনেক খাবারের নাম হয়ে যাবে ‘বিষ’। ঔষধ—নির্ভর জীবন যাপন করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, জীবনে আর কখনো রোগগুলো থেকে মুক্তি পাবেন না, একবার যদি রোগগুলোর কোনোটি আপনাকে ধরে বসে। আপনাকে মৃত্যুর কাছে পৌঁছে দেয়ার আগে তারা আপনার পিছু ছাড়বে না।


২. অতিরিক্ত আরামই ব্যারামের কারণ

প্রকাশ: দৈনিক ইনকিলাব, প্রকাশের সময় : ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

একটা সময় ছিল মানুষ যখন আনুষ্ঠানিক কোনো ব্যায়াম করতো না বটে, তবে অনানুষ্ঠানিকভাবে মানুষের অনেক বেশি ব্যায়াম হয়ে যেতো। এখন অনেক মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হবার পর ডাক্তারের পরামর্শে নয়, বলতে গেলে ডাক্তারের নির্দেশে যে পরিমাণ ব্যায়াম করে থাকে, তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি ব্যায়াম হতো। কিভাবে? হ্যাঁ, পরিশ্রমের কাজ করে করে। মানুষ আগে বেশি পরিশ্রমী ছিল। তাছাড়া অনেক রকম পরিশ্রম করতে মানুষ বাধ্যও হতো। যেমন : কৃষিসংক্রান্ত নানারকম কাজ করা, হেঁটে হেঁটে দূরের পথ পাড়ি দেয়া, সাংসারিক বিভিন্ন রকম পরিশ্রমের কাজ করা, মহিলাদের ঢেঁকিতে বিভিন্ন কাজ করা, গৃহস্থলীর অনেক শ্রমসাধ্য কাজ করা ইত্যাদি। এক কথায় আগেকার দিনে মানুষের শারীরিক শ্রমের কাজ ছিল বেশি। মানুষ খেতোও বেশি, পরিশ্রমও করতো বেশি। কিন্তু এখন মানুষের পরিশ্রমের কাজ অনেক কমে গেছে। পরিশ্রমের কাজ কমে যাওয়ার পাশাপাশি মানুষ অলসও হয়ে গেছে। দূরের পথ পাড়ি দেয়ার জন্য মানুষ এখন হাঁটতে হয় না, হরেক রকম যানবাহন মানুষকে বসিয়ে বসিয়ে দ্রুত পৌঁছে দিচ্ছে গন্তব্যে। দূরের পথ নয়, সামান্য পথও মানুষ এখন হেঁটে যেতে চায় না।

কয়েকমাস আগে একদিন আমি ট্যাক্সিতে করে বাসায় ফিরছিলাম। আমার পাশে একটা সিট খালি ছিল। পথে একজন ট্যাক্সিতে উঠলো। এক কিলোমিটার নয়, আধা কিলোমিটার যেতে না যেতেই তার গন্তব্য এসে গেলো! কেনো, এ সামান্য পথ কি তিনি হেঁটে হেঁটে আসতে পারতেন না? এটা আমাদের আলসেমী বা আরামপ্রিয় হবার চরম বহিঃপ্রকাশ।

মহিলাদের এখন আর ঢেঁকিতে কাজ করতে হয় না, মেশিনেই সবকিছু হয়। আর ঢেঁকি তো ইতোমধ্যে যাদুঘরের আবশ্যকীয় উপাদানই হয়ে গেছে। জামাকাপড় এখন ধোয়া হয় ওয়াশিং মেশিনে। শুধু কাজ হচ্ছে বাজার থেকে কিনে আনবে আর গ্যাসের অটো চুলায় রান্না করে করে খাবে। বাজার থেকে আগে পুরুষরা বাজারের ব্যাগটাও হাতে বহন করে নিয়ে আসতো। কিছু পরিশ্রম হতো, ঘাম ঝরতো। আর এখন বাজারের ব্যাগ হাতে করে নিয়ে আসা দূরের কথা, অফিসের সামান্য পথও রিকশা বা গাড়িতে করে না গেলে প্রেষ্টিজ যেনো পুরোই পাংচার হয়ে যায়! যেসব বিল্ডিংয়ে লিফট আছে, সেসব বিল্ডিংয়েও মাত্র এক ফ্লোর উপরে বা নিচে যেতেও আমরা সিঁড়ি ব্যবহার না করে লিফট ব্যবহার করি!

পুরুষ—মহিলা সবাই পরিশ্রমের কাজ কমিয়ে দিয়ে আরামের জীবন বেছে নেয়ার এবং বসে বসে খাওয়ার পরিণতি আমরা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। বেশি বেশি মুটিয়ে যাচ্ছি আর অল্প বয়সেই শরীরে বাসা বাঁধছে বিপজ্জনক সব রোগ। যেমন : ডায়াবেটিস, হাই ব্লাড প্রেশার, হার্ট ব্লক বা হার্ট অ্যাটাক। রোগগুলোতে যারা ইতোমধ্যেই আক্রান্ত হয়েছেন, তারা জানেন জীবনটা তাদের কাছে কতো জটিল মনে হচ্ছে। চলাফেরায় সাবধান থাকতে হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে, খাওয়া—দাওয়ায় নানারকম বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে, পছন্দনীয় খাবার মনভরে খাওয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া সার্বক্ষণিক ডাক্তারের পরামর্শ নিতে আর ওষুধ খেয়ে যেতে হচ্ছে। এ এক বড় দুর্বিষহ জীবন।

আরামপ্রিয় হয়ে আমাদের সুস্থ—সবল জীবন এখন ব্যারামে ব্যারামে বিধ্বস্ত। ঘামঝরানো শ্রম ছেড়ে দিয়ে আমরা এখন ভয়াবহ সব রোগে জর্জরিত। আমাদের অনেকের এখনো হুঁশ হয়নি। আমরা অনেকে এখনো মনে করি ডায়াবেটিস হচ্ছে বংশানুক্রমিক রোগ। বংশের কারো থাকলে নিজের এ রোগ হবার সম্ভাবনা বেশি। আমাদের এ ধারণা কিভাবে সৃষ্টি হলো, বুঝতে কষ্ট হচ্ছে। আজ থেকে চল্লিশ—পঞ্চাশ বছর আগে শতকরা কয়জনের এ রোগ ছিলো, আর এখন শতকরা কয়জনের এ রোগ, তা একটু পরখ করলেই দেখা যাবে, উত্তরপুরুষদের এ রোগ বেশি; পূর্বপুরুষদের এ রোগ ছিলোই না বলতে গেলে। তাহলে উত্তরপুরুষদের কোত্থেকে এ রোগ ব্যাপকাকারে আক্রমণ করলো? শুধুমাত্র পরিশ্রম না করে বসে বসে খাওয়ার প্রবণতাই এ রোগ সৃষ্টি হবার জন্য প্রধানত দায়ী; বংশের কারো থাক বা না থাক।

পরিশ্রম না করলে যে হার্টের রোগ হবার সম্ভাবনাও বেশি, তা নিয়েও একটু কথা বলা যাক। আমরা জানি, সাইকেল চালানোতেও বেশ পরিশ্রম হয়। কিন্তু সাইকেল চালানোর উপকারিতা—অপকারিতা নিয়ে আমাদের মধ্যে অনেক অজ্ঞতা কাজ করে। আমরা অনেকেই মনে করি সাইকেল চালানো স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। অনেকেই মনে করি সাইকেল বেশি চালালে হার্টের সমস্যা হয় বা হার্ট দুর্বল হয়ে যায়। আমি ছোটবেলা থেকে অনেক মানুষের মুখেই এমন কথা শুনেছি। কখনো বিষয়টা নিয়ে ভালোভাবে চিন্তা করিনি। কয়েকমাস আগে একদিন আমি কর্মস্থল থেকে ফিরছিলাম। পথে আমার বন্ধু স্থানীয় এক লোকের সাথে দেখা হলো। কথায় কথায় তিনি আমাকে বললেন, ‘ভাই, সাইকেল না চালানোই ভালো। কারণ সাইকেল চালালে হার্টের সমস্যা হয়।’ তার কথা শুনে আমি সামান্য ভাবলাম। ভেবে তাকে বিনয়ের সাথে বললাম, ‘ভাই, সাইকেল চালানোর কারণে হার্টের সমস্যা হয়েছে, আপনি দেখেছেন, এমন মাত্র একটা লোক আমাকে দেখিয়ে দিন, বেশি নয়।’ আমার কথার কোনো সদুত্তর তিনি দিতে পারেননি। তাহলে তিনি কথাটি বললেন কেনো? তিনি বলেছেন, কারণ সবাই এমন কথাই বলে। কিন্তু এটার কোনো ভিত্তি নেই। আমাদের দেশে আমরা শুধু সাইকেল চালানোর অপকারিতার কথা বলে বেড়াই। চীন বা জাপানে মানুষ শুধু সাইকেল চালানোর উপকারিতার কথাই জানে। এজন্য তারা বেশি বেশি সাইকেল চালায়। ‘জাপান কাহিনী’ নামক একটা বইতে দেখলাম, জাপানে নাকি সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই সপ্তম শ্রেণি থেকে সকল শিক্ষার্থীকে সাইকেল চালিয়ে প্রতিষ্ঠানে আসতে হয়, তাদের বাবা যতো বড় ধনী হোক না কেনো। সাইকেল বেশি বেশি চালায় বলেই এসব দেশের লোক মুটিয়ে যায় না, এদের শারীরিক ফিটনেসও দীর্ঘদিন ঠিক থাকে, এদের গড় আয়ুও সঙ্গত কারণেই বেশি। আর আমরা সাইকেল চালানোকে নিরুৎসাহিত করি বলে বেশি বেশি মুটিয়ে যাচ্ছি, বিভিন্ন রোগে অল্প বয়সে আক্রান্ত হয়ে মারাও যাচ্ছি। আমাদের দেশে এখন তো রিকশাগুলোতে মটর লাগিয়ে চালানো হয়। কিন্তু এর আগে বছরের পর বছর মানুষ পায়ে চেপেই রিকশা চালাতো। অন্তত বিশ বছর এভাবে রিকশা চালিয়েছে, এমন লোকের হার্টের সমস্যা হবার ঘটনা নেই বললেই চলে। কোনো? কারণ রিকশা চালাতে যথেষ্ট ঘামঝরানো শ্রম হয়। এই ঘামঝরানো শ্রম আমরা যতো বেশি করবো, আমাদের হার্ট ভালো থাকার সম্ভাবনা ততো বৃদ্ধি পাবে।

হাই ব্লাড প্রেশারের অন্যতম কারণও আমার মনে হয় পরিশ্রম না করে বসে বসে খাওয়া। অধিকাংশ হাই ব্লাড প্রেশারের রোগীর মধ্যে এমন প্রবণতা লক্ষ্য করা। আর যেসব লোক হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে, তাদের ডায়াবেটিস, হার্ট উইকনেস যেমন খুব একটা হয় না, হাই ব্লাড প্রেশারও তেমন একটা হয় না। এজন্য যারা রোগগুলো থেকে এখনও মুক্ত আছেন, তাদের উচিত বেশি বেশি কায়িক শ্রমের কাজ করা। শ্রম মানুষের শরীরকে সুঠাম রাখে, রোগব্যাধি থেকে নিরাপদ রাখে। মনে রাখতে হবে, কায়িক শ্রম বলতে বুঝায় শরীর থেকে ঘাম বের হয় এমন কাজ করা। আপনি আপনার অফিসে বসে আছেন, বিদ্যুৎ নেই বলে আপনার শরীর থেকে ঘাম বের হচ্ছে, এটা নিশ্চয়ই কোনো পরিশ্রমের কাজ নয়! আপনি কিভাবে নিয়মিত পরিশ্রম করবেন, আপনিই ঠিক করে নিন। অফিস যদি দু’তিন কিলোমিটারের মধ্যে হয়, সম্ভব হলে প্রতিদিন হেঁটে হেঁটে যাতায়াত করুন, না হয় সাইকেল চালিয়ে। বাজারের ব্যাগটি অতিরিক্ত ওজন না হলে হাতে নিয়ে হেঁটে হেঁটেই বাসায় নিয়ে আসুন। মনে রাখবেন, প্রেষ্টিজ রক্ষা করা আপনার স্বাস্থ্য রক্ষার চেয়ে অধিক মূল্যবান নয়।

শেষে একটি সুখবর দিয়ে লেখা শেষ করছি। বসে বসে বেশি খেলে আপনি রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে শেষে খেতেই পারবেন না। আর পরিশ্রম করে বেশি বেশি খেলেও আপনার শরীরে বিপজ্জনক কোনো রোগ বাসা বাঁধবে না। আপনি খেয়ে যেতে পারবেন দীর্ঘদিন, নিশ্চিন্তে। সুতরাং বেশি বেশি খাওয়ার জন্য বেশি বেশি পরিশ্রম করুন! [https://www.dailyinqilab.com/article/38550]



৩. হার্ট অ্যাটাক, ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ ধেয়ে আসছে আমাদের সবার দিকে!

মানুষ এখন যেই রোগগুলোতে বেশি আক্রান্ত হয়, সেগুলোকে বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। কিছু রোগ চিকিৎসায় পুরো ভালো হয়ে যায়, কিছু রোগ একবার আক্রমণ করলে আর কখনো পুরোপুরি ভালো হয় না; কিছু রোগ মানুষকে সাময়িক কষ্ট দেয়, কিছু রোগ দীর্ঘ সময় ধরে কষ্ট দেয়; কিছু রোগে মৃত্যুহার কম, কিছু রোগে মৃত্যুহার বেশি; কিছু রোগ আকস্মিক মানুষের মৃত্যু ঘটায়, কিছু রোগ আকস্মিক মৃত্যু ঘটায় না; কিছু রোগের চিকিৎসা—ব্যয় বেশি, কিছু রোগের চিকিৎসা—ব্যয় কম।

যেই রোগগুলো সাময়িক কষ্ট দেয়, যেগুলোর পেছনে চিকিৎসা—ব্যয় কম, মানুষের আকস্মিক মৃত্যু ঘটায় না, যেগুলোতে মৃত্যুহার কম, সেগুলো দুই শ্রেণি: (১) অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষ যেগুলো থেকে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যায়, এরকম রোগগুলো মধ্যে রয়েছে ইনফ্লুয়েঞ্জা, নিউমোনিয়া, টাইফয়েড, মাথাব্যথা, মাইগ্রেন, কনজাংটিভাইটস, ডায়রিয়া, কলেরা, যক্ষ্মা, পক্স ইত্যাদি।

(২) যেগুলো সহজে ভালো হয় না। দীর্ঘদিন মানুষ রোগগুলোতে ভোগে, কষ্ট পায়। এরকম রোগগুলোর মধ্যে রয়েছে হাঁপানি, আর্থারাইটিস বা বাত, বিভিন্ন রকম চর্মরোগ ইত্যাদি।

এই রোগগুলো ব্যতীত যেই রোগগুলো রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ক্যান্সার, ব্রেইন স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট অ্যাটাক (হৃদরোগ), কিডনী রোগ ইত্যাদি। এই রোগগুলোর সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো, এগুলো প্রাণঘাতি; এগুলোর পেছনে চিকিৎসা ব্যয় বেশি; এগুলোতে মৃত্যুহার বেশি, এগুলোতে আক্রান্ত হলে মানুষ তৎক্ষণাৎ মৃত্যুবরণ না করলেও মৃত্যুকে এই রোগগুলোতে আক্রান্ত মানুষের আশপাশে ঘোরাঘুরি করছে বলেই মনে হয়। এই সাধারণ বৈশিষ্ট্য বাদ দিলে এই রোগ ৬টিকে প্রথমতঃ দুইটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়: (১) আকস্মিক মৃত্যু ঘটায়। যেমন: হার্ট অ্যাটাক এবং ব্রেইন স্ট্রোক। (২) আকস্মিক মৃত্যু ঘটায় না, তবে এগুলোতে আক্রান্ত হলে অধিকাংশ রোগী শেষে এগুলোতেই মারা যায়। যেমন: ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনী রোগ।

এই ৬টি রোগকে আরো দুই শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। (১) প্রতিরোধযোগ্য; যেগুলোর সুস্পষ্ট কারণ আছে। যেমন: উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক এবং কিডনী সমস্যা। (২) প্রতিরোধ—অযোগ্য; যেগুলোর কোনো কারণই পরিষ্কার নয়। যেমন: ক্যান্সার এবং ব্রেইন স্ট্রোক।

ক্যান্সার ও স্ট্রোক খুব কম ক্ষেত্রে হলেও উপযুক্ত চিকিৎসায় পুরোপুরি ভালো হয়ে গেলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলোতে আক্রান্ত রোগী অল্প কয়েক মাস বা অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই মারা যায়। স্ট্রোকে আক্রান্ত অধিকাংশ মানুষ পক্ষাঘাতে(প্যারালাইসিস) আক্রান্ত হয়। এই দু’টি রোগের সুনির্দিষ্ট কারণ এখনো পরিষ্কার নয় বলে এগুলো এখনো সম্পূর্ণ প্রতিরোধহীন রোগ বলে বিবেচিত। এসব রোগের যেসব কারণ আপনি—আমি জানি, নানাভাবে প্রচার করা হয়, সেসবের সাথে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। ধূমপায়ীরা এসব রোগে যেমন আক্রান্ত হয়, অধূমপায়ীরাও আক্রান্ত হয়, টেনশনে ভোগা মানুষ যেমন আক্রান্ত হয়, যাদের জীবনে তেমন কোনো টেনশন নেই, তারাও আক্রান্ত হয়, উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তরা যেমন আক্রান্ত হয়, যাদের উচ্চ রক্তচাপ নেই, তারাও আক্রান্ত হয়।

আর ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং উচ্চ রক্তচাপের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীরা রোগে আক্রান্ত হবার পরও চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রণের উপর নির্ভর করে অনেক দিন বেঁচে থাকার সুযোগ পায়, যদিও বেশ ধরাবাঁধা নিয়মের মধ্য দিয়ে বেশ কষ্টকর জীবন যাপন করতে হয়। কিন্তু হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত মানুষ অনেক সময় আক্রান্ত হবার সাথে সাথেই মারা যায়, আর আক্রান্ত হবার সাথে সাথে মারা না গেলেও শেষে আরো এক বা একাধিকবারের হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়। ক্যান্সার এবং স্ট্রোকের সাথে হার্ট অ্যাটাক, ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপের একটা প্রধান পার্থক্য হচ্ছে, ক্যান্সার এবং স্ট্রোক সম্পূর্ণ প্রতিরোধহীন রোগ, কিন্তু হার্ট অ্যাটাক, ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ এই তিনটি রোগ সম্পূর্ণ প্রতিরোধযোগ্য; সুনির্দিষ্ট কিছু কারণেই এই তিনটি রোগ মানুষকে আক্রমণ করে। কারণগুলো হচ্ছে, আরামে থাকা বা শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা, মুটিয়ে যাওয়া এবং মনমতো খাওয়া। মানুষ যদি এই কারণগুলো এড়িয়ে চলে, অন্তত ‘শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা’ এড়িয়ে চলে, মানুষ এই তিনটি রোগের কোনোটিতে আক্রান্ত হয় না। আরো একটি রোগ এই কারণের সাথে সম্পর্কিত। সেটি হচ্ছে কিডনী বিকলতা। সারা বিশ্বে কিডনী বিকলতায় যারা আক্রান্ত হয়, তাদের বেশির ভাগই উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিস রোগী। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ এবং অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস কিডনী বিকলতার একটি বড় কারণ। এজন্য উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীরা অনেক সময় কিডনী বিকল হয়ে মৃত্যুবরণ করে। তাই শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা শুধু উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগে আক্রান্ত হবার জন্য দায়ী নয়, কিডনী বিকলতার জন্যও সমানভাবে দায়ী।

এবার আমরা আমাদের অবস্থা বিবেচনা করি। আমরা দেখি, আমরা কি নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করি? আমাদের মধ্যে যারা (১) নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করে, যেমন: পেশাদারভাবে এমন সব কাজ করে, যেগুলোতে প্রচুর শারীরিক পরিশ্রম হয়; (২) যারা ক্রীড়াবিদ; (৩) যারা প্রতিরক্ষা বিভাগে চাকরি করার সুবাদে নিয়মিত ব্যায়াম করে, তারা যতদিন এভাবে শারীরিক পরিশ্রম করে, ততদিন এই তিনটি রোগ থেকে নিরাপদ থাকে। কিন্তু আমরা যারা কোনোভাবে শারীরিক পরিশ্রমের সাথে জড়িত নই, শারীরিক পরিশ্রম করলেও পরিমাণে খুব কম করি, আরামে আরামে থাকতে অভ্যস্থ হবার পাশাপাশি মনমতো খাই, তারা যে কোনো সময় এই তিনটি রোগের শিকারে পরিণত হবো। শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে দূরে থাকলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষ প্রথমে আক্রান্ত হয় উচ্চ রক্তচাপে, পরে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং কিডনী সমস্যায়। মাঝে মাঝে ভিন্নও হয়। আপনি দেখবেন, যারা এখন ডায়াবেটিস বা হৃদরোগে আক্রান্ত, তাদের তিনজনে অন্তত দুইজন মানুষ ডায়াবেটিস বা হৃদরোগে আক্রান্ত হবার আগে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত ছিল।

আমার কাছের এক বন্ধু মনির হোসেন। আমার সাথেই ২০০৯ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি শুরু করেছেন। বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলায়। চাকরির শুরুতে তাঁকে পোস্টিং দেয়া হয়েছিল তাঁর বাড়ি থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরের একটি স্কুলে। তিনি সেখানে সাইকেলে যাতায়াত করতেন। সেসময় তাঁর শরীরে এই তিনটি রোগের কোনোটিই ছিল না। একসময় তিনি বাড়ির পাশে অবস্থিত স্কুলে বদলি হয়ে চলে আসেন। বদলি হয়ে আসার কয়েক বছরের মধ্যেই তাঁর শরীরে দেখা দেয় উচ্চ রক্তচাপ। দুঃখজনকভাবে কিছুদিন আগে তিনি ডায়াবেটিসেও আক্রান্ত হয়ে পড়েন।

আমাদের বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কয়েক বছর আগে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হন। আমি তাঁকে মাঝে মাঝে শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম করার পরামর্শ দিতাম। কিন্তু তিনি আমার পরামর্শকে গুরুত্ব দেননি। তিনি গত কয়েক মাস আগে ডায়াবেটিসেও আক্রান্ত হয়ে পড়েন। আমার মা’কে আমার জন্মের পর থেকে দেখতাম সাংসারিক বিভিন্ন কাজে জড়িত থাকতেন সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। তিনি প্রায় ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এসব কোনো রোগে আক্রান্ত হননি। ৭—৮ বছর আগ থেকে তিনি সাংসারিক কাজ থেকে অনেকটা অবসরে চলে যান। এরপর তিনি প্রথমে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হন। এখন তিনি ডায়াবেটিসেও ভুগছেন। আমার বাবার অবস্থাও প্রায় একই। তবে তিনি উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হবার পর নিয়মিত উচ্চ রক্তচাপের ঔষধ সেবন করার কারণে তাঁর উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকার ফলে এখনো ডায়াবেটিস বা হৃদরোগে আক্রান্ত হননি।

যাতায়াতে মোটরসাইকেল ব্যবহার করেন, এরকম ১০ জন লোক খুঁজে নিন আপনার পরিচিত মানুষদের মধ্য থেকে, যারা বিগত ১৫ বছর ধরে মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন, দেখবেন তাদের অনেকেই উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত, অনেকে উচ্চ রক্তচাপের সাথে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ইত্যাদিতেও আক্রান্ত। কিন্তু দৈনিক অন্তত ৪০ মিনিট বাইসাইকেল চালান (বেশ ধীরগতিতে নয়), এমন ১০ জন লোকের খোঁজ নিন, যারা ১০ বছরের বেশি সময় ধরে বাইসাইকেল চালাচ্ছেন, দেখবেন তাদের কেউ এই তিনটি রোগের কোনোটিতেই আক্রান্ত নন।

একটি পরিসংখ্যান দেখা যাক। ‘বাংলাদেশ প্রতিদিনে’ ১১ মে ২০১৯ তারিখে ‘চারজনে তিনজন হৃদরোগ ঝুঁকিতে’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে (তৈরি করেছেন শামীম আহমেদ ও জয়শ্রী ভাদুড়ী) বলা হয়, ‘‘বাংলাদেশে প্রতি চারজন প্রাপ্তবয়সীর মধ্যে তিনজনের হৃদরোগ ঝুঁকি রয়েছে। হৃদরোগের অন্যতম কারণ উচ্চ রক্তচাপ। গত বছরের অক্টোবরে শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোয় অনুষ্ঠিত উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের ওপর এক নীতিনির্ধারণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এ তথ্য উঠে আসে। গ্রীষ্মের দাবদাহে বেড়েছে আক্রান্তের সংখ্যা। আশঙ্কাজনকহারে অল্পবয়সীরা হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে। সম্মেলনে উপস্থাপিত তথ্যে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ায় উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত প্রাপ্তবয়সী প্রতি চারজনের মধ্যে তিনজনের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের বাইরে এবং তার মধ্যে এক তৃতীয়াংশ ডায়াবেটিসে ভুগছে। ইউরোপীয়দের তুলনায় পাঁচ থেকে সাত বছর আগেই দক্ষিণ এশীয়দের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক, স্টে্রাক ও কিডনি রোগ দেখা দেয়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) গত বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৩৫ বছর কিংবা এর চেয়ে বেশি বয়সীর মধ্যে প্রতি তিনজনের একজন উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত, এর অর্ধেকই এ সম্পর্কে সচেতন নয়। ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ১৫০ কোটি মানুষ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হবে। তবে দক্ষিণ এশিয়ায় এর ক্ষতিকর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। এ অঞ্চলে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৪০ জনই উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। ১৯৭০ সালের পর উন্নত বিশ্বে মৃত্যুর হার কমে গেলেও বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায় হৃদরোগ। বর্তমান বিশ্বে এক তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যাচ্ছে হৃদরোগে। কিছুদিন আগ পর্যন্তও দেশে বয়স্কদের মধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা ছিল বেশি, কিন্তু গত কয়েক বছরে তরুণদের মধ্যে হৃদরোগের প্রবণতা ক্রমবর্ধমান।’’

আগে মানুষ বুড়ো বয়সেও আর কোনো শারীরিক পরিশ্রম না করলেও, দূরে কোথাও যাবার সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হেঁটে হেঁটেই যেতো। এজন্য মানুষ সহজে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, কিডনী বিকলতা এসবে আক্রান্ত হতো না।

কিন্তু এখন মানুষ অল্প বয়সেই শারীরিক পরিশ্রম ছেড়ে দেয়। ছাত্রজীবনে অনেকে আর কোনো উপায়ে পরিশ্রম না করলেও অন্তত বিভিন্ন খেলাধুলা করার ফলে কিছু পরিশ্রম করে। অন্য উপায়েও অনেকে শারীরিক পরিশ্রম করে। কিন্তু কর্মজীবনে আরামদায়ক বা শারীরিক পরিশ্রমহীন কোনো পেশায় যখন নিয়োজিত হয়ে যায়, তখন অধিকাংশ মানুষ সব রকম শারীরিক পরিশ্রমকে বিদায় জানানোর ফলে অল্প বয়সেই আক্রান্ত হয়ে পড়ে উচ্চ রক্তচাপে। আর হৃদরোগ এবং ডায়াবেটিসও উচ্চ রক্তচাপের পথ ধরে দ্রুত মানুষকে আক্রমণ করে বসে।

ক্যান্সার বা স্ট্রোকে কে আক্রান্ত হবে, কে আক্রান্ত হবে না, তা বুঝা না গেলেও উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগে কারা আক্রান্ত হবে, সহজেই বুঝা যায়। ক্যান্সার বা স্ট্রোকে আমাদের মধ্যে কে আক্রান্ত হবে, কে এগুলো থেকে বেঁচে যাবে, তার কোনো ঠিক—ঠিকানা না থাকলেও আমরা যদি আরামপ্রিয় জীবন বেছে নিই, শারীরিক পরিশ্রম ছেড়ে দিই, আমরা নিশ্চিতভাবে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ এই তিনটি রোগে আক্রান্ত হবোই। আমরা আমাদের পরিচিত ৪০ বছরের বেশি বয়সী মানুষদের দিকে তাকালেই দেখতে পাবো, তাদের অনেকেই এই তিনটি রোগের এক বা একাধিকটিতে আক্রান্ত হয়ে আছে, অনেকে মারাও গেছে ইতোমধ্যে।

বিগত ১০ বছরে আমাদের পরিচিত ‘৫০ বছরের বেশি বয়সে মারা যাওয়া’ ২০—৩০ জন মানুষের খোঁজ নিলে দেখা যাবে, তাদের বেশিরভাগই মারা গেছে ডায়াবেটিস বা হার্ট অ্যাটাকে; ক্যান্সার এবং স্ট্রোকে মারা গেছে এদের খুব অল্প সংখ্যক মানুষ।

পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমান বিশে^ মানবমৃত্যুর ৩১ শতাংশই হৃদরোগে। ‘বিশ্বে ৩১ ভাগ মৃত্যুর জন্য দায়ী হৃদরোগ’ শিরোনামে দৈনিক যুগান্তরে ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘‘বিশ্বে প্রতিবছর ১৭ দশমিক ৫ মিলিয়ন বা পৌনে দুই কোটি মানুষের মৃত্যু হয় হৃদরোগে। ৩০ থেকে ৭০ বছর বয়সী প্রতি ১০ জনে একজন এ রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারান। আতঙ্কের বিষয় হল— বিশ্বে ৩১ ভাগ মৃত্যুর জন্যই দায়ী হৃদরোগ। এছাড়া অল্প বয়সে মৃত্যুর ৮০ শতাংশ কারণও এ রোগ। এ তথ্য ওয়ার্ল্ড হার্ট ফেডারেশনের।’’

‘প্রতি বছর ডায়াবেটিসে মারা যাচ্ছে ৩৭ লাখ মানুষ’ শিরোনামে দৈনিক ইনকিলাবে ৮ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘‘বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। ৩৪ বছরে বিশ্বে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা অন্তত চারগুণ বেড়েছে। বর্তমানে প্রতি ১১ জন পূর্ণবয়স্ক মানুষের একজন এই রোগে আক্রান্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এক প্রতিবেদন এ তথ্য জানিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্ব এখন ডায়াবেটিসের ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের ঝুঁঁকিতে। ২০১৪ সালে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৪২২ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি, যা ১৯৮০—তে আক্রান্তের তুলনায় ৪ গুণ বেশি।’’

উপরে উল্লেখিত তিনটি প্রতিবেদন মতে, (১) বাংলাদেশে প্রতি চারজন প্রাপ্তবয়সীর মধ্যে তিনজনের হৃদরোগ ঝুঁকি রয়েছে। হৃদরোগের অন্যতম কারণ উচ্চ রক্তচাপ। (২) বিশ্বে ৩১ ভাগ মৃত্যুর জন্যই দায়ী হৃদরোগ। এবং (৩) বর্তমানে প্রতি ১১ জন পূর্ণবয়স্ক মানুষের একজন ডায়াবেটিসে রোগে আক্রান্ত।

ক্যান্সার এবং স্ট্রোকে মৃত্যুহার নয়, আক্রান্তের হারও হৃদরোগের ধারেকাছেও নেই। আর হৃদরোগের পর আর কোনো রোগে আক্রান্তের হার (প্রতি ১১ জনে ১ জন) ডায়াবেটিসে আক্রান্তের হারের ধারেকাছেও নেই। আর উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তরাই মূলত এই দু’টি রোগে আক্রান্ত হয়।

এটা নিশ্চিত, আমরা আর কোনো রোগে আক্রান্ত হই বা না হই, এই তিনটি রোগে আক্রান্ত হবোই যদি প্রতিরোধব্যবস্থা গ্রহণ না করি। এই রোগগুলোর কারণ নিয়ে অনেক ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে। সেগুলোয় কান না দিয়ে আমরা নিয়মিত অন্তত ৪০ মিনিট কঠোর শারীরিক পরিশ্রম করলে এই তিনটি রোগের কোনোটিই আমাদেরকে আক্রমণ করতে পারবে না। পাশপাশি আমরা কিডনী বিকল হওয়া থেকে বেঁচে যাবার সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পাবে।



৪. ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার ৯টি ভয়াবহ দিক

ডায়াবেটিস কতটা ভয়াবহ রোগ, তা সবচেয়ে বেশি উপলব্ধি করতে পারেন কারা? সবচেয়ে বেশি উপলব্ধি করেন ডায়াবেটিসে আক্রান্তরা। কাঠের মধ্যে যেভাবে ঘুণ ধরার পর কাঠের মেয়াদ দ্রুত শেষ হয়ে যায়, মানুষের শরীরে ডায়াবেটিস হামলা করলেও মানুষের শরীর দ্রুত ধ্বংসের পথে চলে যায়। মানুষকে আর কোনো রোগ আক্রমণ না করলেও চলে। জীবন ধ্বংসের জন্য এই এক রোগই যথেষ্ট। এখনো পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর রোগ কোনটা জানেন? ক্যান্সার। একসময় বলা হতো, ‘ক্যান্সারের কোনো অ্যান্সার নেই’। এখনো পৃথিবীব্যাপী অগণিত মানুষ ক্যান্সারে মারা যায় প্রতি বছর, প্রতিক্ষণে।
ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে চিকিৎসার পেছনেও মানুষের লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয়ের পরও ক্যান্সার রোগী বেশিদিন বাঁচে না। কিছুদিন আগে বাংলাদেশের জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী এন্ড্রু কিশোর ক্যান্সারের চিকিৎসা গ্রহণের পরও পৃথিবী থেকে বিদায় নেন।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রোগ ক্যান্সারের চেয়েও একটা দিক থেকে ডায়াবেটিস বেশি মারাত্মক। ক্যান্সারে কেউ আক্রান্ত হলে যদি প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত হয়, তাহলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে উপযুক্ত চিকিৎসার ফলে ক্যান্সার পুরোপুরি ভালো হয়ে যায়। বাংলাদেশের কন্ঠশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন, ভারতের ক্রিকেটার যুবরাজ সিং, অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটার ম্যাথু ওয়েড এবং মাইকেল ক্লার্ক ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েও চিকিৎসাশেষে সুস্থ হয়ে যান। [https://www.binodon69.com/article/121073/]

কিন্তু ডায়াবেটিস এমন একটা রোগ, একবার কাউকে আক্রমণ করলে কোনো চিকিৎসায় ভালো হয় না, যত টাকাই খরচ করা হোক না কেন! রোগটি মানুষের পেছনে লাগলে মানুষকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে প্রাথমিক স্টেজ পার হবার পর ধরা খেলে মানুষ বেশি দিন বাঁচে না, মানুষকে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হয় না। আর ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে মানুষ দ্রুত মারা যায় না, মানুষকে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হয়। ডায়াবেটিসের আরো কিছু ভয়াবহ দিকের কথা জানা যাক।

এক.  ডায়াবেটিস বেড়ে গেলেও বিপদ, কমে গেলেও বিপদ

ডায়াবেটিস বেড়ে গেলেও বিপদ, কমে গেলেও বিপদ। মানুষ যখন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় বা ডায়াবেটিস যখন বেড়ে যায়, তখন শরীরে বিভিন্ন রকম খারাপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে শুরু করে। যেমন: মাথার ভেতরে জ¦ালাপোড়া করতে শুরু করে, পিপাসা বেশি বেশি লাগে, প্র¯্রাব বেশি বেশি হতে থাকে। ডায়াবেটিস দেখা দিলে বা আচমকা বেড়ে গেলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে অনেকের ডায়াবেটিস নীল (শূন্য) হয়ে গিয়েও তৎক্ষণাৎ রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কম গিয়ে তারা বিপদে পড়ে যান। এই সমস্যাকে হাইপোগ্লাইসেমিয়া বলে। সাধারণত ইনসুলিন বা মুখে সেবনযোগ্য ডায়াবেটিসের ওষুধের ডোজ বেশি হলে, খাবারে শর্করার পরিমাণ কম হলে, অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম করলে, সময়ের খাবার সময়ে না খেলে বা কোনো খাবার মিস করলে হাইপোগ্লাইসেমিয়া দেখা দিতে পারে। হাইপোগ্লাইসেমিয়া শুরুর লক্ষণগুলো হলো মাথা ঘোরা, শরীর ঘেমে যাওয়া, ক্ষুধা লাগা, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, অস্থিরতা, মাথাব্যথা, জোরে জোরে হৃদকম্পন হওয়া। অনেকের ঘুমের মধ্যে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে। এর লক্ষণগুলো হলো ঘামে বিছানার চাদর ভিজে যাওয়া, দুঃস্বপ্ন দেখা, দুর্বল লাগা, অস্থিরতা। যদি শুরুতে চিকিৎসা না করা হয় তাহলে আক্রান্ত ব্যক্তি মাংসপেশিতে দুর্বলতা অনুভব করেন, কথা জড়িয়ে যায়, ঘোর লাগে, খিঁচুনি হতে পারে, অচেতন হতে পারেন, এমনকি আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুও হতে পারে। [ডা. হুমায়ুন কবীর হিমু, এনটিভি অনলাইন ৩০ আগস্ট, ২০১৫; [https://www.ntvbd.com/health/19415]

দুই. ডায়াবেটিসে আক্রান্তরা চলাফেরায় বিশেষ সতর্ক থাকতে হয়

ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের শরীরে, বিশেষ করে পায়ে বা হাতে কোনো ক্ষত বা ঘা হলে তা সহজে শুকায় না। অনেক সময় ক্ষত বা ঘা না শুকিয়ে বিস্তার লাভ করার কারণে ওই অঙ্গ কেটেও ফেলতে হয়। এইজন্য ডায়াবেটিক রোগীরা প্রতিটা পদক্ষেপে সতর্ক থাকতে হয়। ডায়াবেটিসের রোগীর জীবন হয় খুবই কঠিন ও বিপদসঙ্কুল।

তিন. মনমতো খাওয়া যায় না

ডায়াবেটিসের রোগীদেরকে খাওয়া—দাওয়ায় কঠোর সংযম পালন করতে হয়। নিয়মের বাইরে খেলে বা নির্দিষ্ট কিছু খাবার খেলে ডায়াবেটিস চলে যায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে, শরীরে দেখা দেয় নানান জটিলতা। মজার এবং প্রিয় অনেক খাবার থেকে নিজেকে রাখতে হয় দূরে, বেশি বেশি বা মনমতো খাওয়াও যায় না, খেতে হয় বেছে বেছে এবং খুবই স্বল্প পরিমাণে। জীবনের অনেক মজা জীবনের মাঝপথে জীবনকে রেখে পালিয়ে যায়। জীবন হয়ে যায় জীবিত থেকেও মৃত মানুষের মতো, নিরামিষ।
চার. ডায়াবেটিস আরো কিছু রোগের কারণ 
অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থেকে কিছু গুরুতর রোগও দেখা দেয় শরীরে। ডায়াবেটিস ডেকে আনে আরো কয়েকটি রোগ। একটি হচ্ছে চোখের সমস্যা, দ্বিতীয়টি হচ্ছে কিডনী বিকল হয়ে যাওয়া। বিশ^ব্যাপী অনেক অনেক মানুষ ডায়াবেটিস দেখা দেয়ার পর যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ না করার ফলে কিডনী বিকল হয়ে মৃত্যুবরণ করে।
অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের ফলে সৃষ্টি হওয়া আরেকটা রোগের নাম হৃদরোগ। ‘‘ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ’’ শিরোনামে প্রথম আলোয় ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে একটি নিবন্ধ লেখেন অধ্যাপক এস এম মুস্তফা জামান। সেখানে বলা হয়, ‘‘গবেষণা বলছে ৭০ শতাংশ ডায়াবেটিসের রোগী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েই অকালে মৃত্যুবরণ করে থাকেন। ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ— এই দুটো পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।... এ দুটো সমস্যা পরস্পরের হাত ধরেই চলে। একটির ঝুঁকি কমালে অপরটির ঝুঁকিও কমে আসে।’’

বাংলাদেশ প্রতিদিনে ৬ এপ্রিল, ২০১৫ তারিখে ‘‘হৃদরোগ যখন ডায়াবেটিস রোগীর’’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লেখেন ডা. এম শমশের আলী। সেখানে বলা হয়, ‘‘ডায়াবেটিস রোগীর হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি শতভাগ। আপনি যদি হৃদরোগের ঝুঁকি এড়াতে চান তবে প্রথম অবস্থা থেকেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে আপনাকে বেশ তৎপর হতে হবে। ... এ ছাড়াও ডায়াবেটিসের জটিলতা হিসেবে উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরলের সমস্যা, ইনসুলিন প্রতিবন্ধকতা ও মেটাবলিক সিন্ড্রমের মতো অন্যান্য সমস্যা— যেগুলো হৃদরোগের সঙ্গে পরোক্ষভাবে সম্পর্কযুক্ত।’’ [https://www.bd-pratidin.com/health/2015/04/06/73119]

পাঁচ. সন্তান গর্ভধারণ এবং জন্মদানে বিপদ

ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষ সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রেও অনেক বিপদে পড়েন নিজেও, গর্ভের সন্তানও। ‘ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে জন্ম নিতে পারে অস্বাভাবিক শিশু’ শিরোনামে একুশে টেলিভিশনের ওয়েবসাইটে ৫ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস অ্যান্ড গাইনি বিভাগের মেডিক্যাল অফিসার ডা. লতিফা আক্তার বলেন, ‘‘চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে ডায়াবেটিস আগে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং পরে গর্ভধারণ করতে হবে। যদি ডায়াবেটিসের পরিমাণ ৬—এর নিচে হয় তবে বাচ্চা নিতে পারবেন। যদি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকে তবে শিশু অস্বাভাবিকভাবে জন্ম নেওয়ার আশঙ্কা থাকে।’’

ছয়. মানসিক অস্থিরতার একটি বড় কারণ ডায়াবেটিস

ডায়াবেটিস মানসিক অস্থিরতার কারণ। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের মন—মানসিকতা খুবই খারাপ থাকে। জীবন নিয়ে তারা একেবারে হতাশ হয়ে পড়েন। চলাফেরায় সতর্কতা, খাওয়া—দাওয়ায় সতর্কতা, নিয়মিত ঔষধ সেবন, রুটিন করে ডাক্তারের কাছে যাওয়া, চিকিৎসা—ব্যয়, রোগটিতে আক্রান্ত হবার কারণে আরো কিছু রোগে আক্রান্ত হওয়া, রোগটি থেকে কোনোভাবে মুক্ত হতে না পারা এবং ভবিষ্যৎ খুবই অন্ধকার দেখার ফলে অধিকাংশ সময় তাদের মানসিক অবস্থা থাকে খুবই খারাপ।

সাত. যৌনশক্তি কমে যায়

ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের যৌনশক্তিও কমে যায়। অল্প পরিশ্রমেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে বলে সঙ্গীকে তৃপ্তি দিতে পারে না এবং নিজেও তৃপ্তি লাভ করতে পারে না। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগী সামান্য পরিশ্রমেই হাঁফিয়ে উঠে। কোনো কাজে শক্তি পায় না। মানুষের স্বাভাবিক কর্মশক্তির মতো যৌনশক্তিও হারিয়ে ফেলতে শুরু করে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষ। বিশেষ করে পুরুষরা। ‘কীভাবে বুঝবেন ডায়াবেটিস হয়েছে আপনার?’ শিরোনামে দৈনিক মানবজমিনে ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়, ‘‘যে সমস্ত রোগে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত, ডায়াবেটিস হল তার মধ্যে একটি। প্রতি বছর অত্যন্ত দ্রুত গতিতে এই রোগ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে।...
ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের অসুস্থতা বাড়িয়ে তোলে। আসুন জেনে নেওয়া যাক, শরীরে সুগারের মাত্রা বেড়ে গেলে ঠিক কী কী লক্ষণ প্রকাশ পায় (মোট ১২টি) ...
২) খুব অল্পতেই হাঁপিয়ে ওঠা শরীরে সুগারের মাত্রা বৃদ্ধির লক্ষণ। সুগারের মাত্রা বেড়ে গেলে শরীরে জলের ঘাটতি হয়। আর ডিহাইড্রেশনের ফলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে।
১২) ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর যৌন অক্ষমতা তৈরি হয়। তিন—চতুর্থাংশ ক্ষেত্রে ডায়াবেটিক পুরুষরা সন্তানের জন্ম দিতে অক্ষম হন। [https://mzamin.com/article.php?mzamin=243042]

দৈনিক দেশ রূপান্তরে ২৮ নভেম্বর, ২০২২ তারিখে ‘ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ৬৩% পরুষ যৌন সমস্যায়’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘‘ডায়াবেটিসে আক্রান্ত পরুষ রোগীদের মধ্যে ৬৩ শতাংশের ইরেক্টাল ডিসফাংশন (পরুষত্বহীনতা) হয়ে যায়। পাশাপাশি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নারীদের ২৮ শতাংশ অ্যাসেক্সচুয়ালিটিতে (যৌন বিমুখ সমস্যা) ভোগেন। এ ছাড়া ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ৫০ বছরের বেশি পরুষ রোগীদের ৫০ শতাংশের প্রি—ইজাকুলেশন (দ্রুত বীর্যপাতজনিত সমস্যা) হয়ে থাকে।
সোমবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) যৌন সমস্যা ও রোগের চিকিৎসা নিয়ে ‘সাউথ এশিয়ান সোসাইটি ফর সেক্সচুয়াল মেডিসিন স্কুল বাংলাদেশ—২০২২’ শীর্ষক তিন দিনব্যাপী কর্মশালায় সমাপনী দিনে এসব তথ্য জানানো হয়। [https://www.deshrupantor.com/national/2022/11/28/394131]

আট. আরো কিছু বিপদ

ডায়াবেটিসের আরো কিছু স্বাস্থ্যগত ক্ষতিকর দিক হলো: রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, ওজন মাত্রাতিরিক্ত হ্রাস পাওয়া, শরীরে প্রচন্ড দুর্বলতা অনুভব করা, ঘন ঘন প্র¯্রাব, ক্ষুধা বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি।

নয়. ডায়াবেটিস একটি ব্যয়বহুল রোগ

ডায়াবেটিস রোগীর পেছনে প্রচুর টাকা ব্যয় করতে হয়। নিয়মিত ডাক্তারের কাছে যেতে এবং ঔষধের পেছনে টাকা খরচ করতে করতে অনেকে অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়। তাছাড়া যেসব ডায়াবেটিস রোগী ডায়াবেটিসের কারণে কিডনী বিকলতা সহ অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত হন, তাদের পেছনে আরো বেশি টাকা খরচ হয়। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত না হলে মানুষ এইসব বাড়তি খরচ থেকে বেঁচে থাকতে পারতো নিঃসন্দেহে।

আসুন আমরা ডায়াবেটিস থেকে নিজেদেরকে নিরাপদ রাখার প্রচেষ্টা শুরু করি। এখনই, আজ থেকেই। জীবনকে স্বাভাবিক রাখতে হলে, সুস্থতা ধরে রাখতে হলে ডায়াবেটিস প্রতিরোধে আমাদেরকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধের জন্য দৈনিক অন্তত ৪০ মিনিট কঠোর শারীরিক পরিশ্রম করে যেতে হবে। সেটা হতে পারে যে কোনো ব্যায়াম, কৃষি বা গৃহস্থালীর কাজকর্ম বা কায়িক শ্রমনির্ভর খেলাধুলা। তাহলে শুধু ডায়াবেটিস নয়, উচ্চ রক্তচাপ এবং হার্ট অ্যাটাক থেকেও আমরা রক্ষা পাবো, নিশ্চিতভাবে।

এই বিষয়ে ‘প্রি—ডায়াবেটিস চিকিৎসায় বছরে ব্যয় ১ লাখ কোটি’ একটি প্রতিবেদন দেখা যাক, যা প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে ২১ নভেম্বর ২০২২ তারিখে। সেখানে উল্লেখ করা হয়, ‘‘দেশে দুই কোটি মানুষ ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত ও আরও দুই কোটি মানুষ প্রি—ডায়াবেটিস রোগে ভুগছেন। এসব প্রি—ডায়াবেটিস রোগীদের যদি রোগ থেকে রক্ষা করা যায়, তা হলে বছরে ১ লাখ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে বলে জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ। সে হিসাবে বর্তমানে বছরে একজন প্রি—ডায়াবেটিস রোগীর চিকিৎসায় ব্যয় হয় ৫০ হাজার টাকা, যা মাসে ৪ হাজার টাকা।

গতকাল বিএসএমএমইউতে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে এমন তথ্য জানিয়ে উপাচার্য ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে খাদ্যাভ্যাস ও জীবনাচার নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে শরীরচর্চা, খাদ্যাভ্যাসের গুরুত্ব অপরিসীম। জিহ্বায় যা ভালো লাগে তার অধিকাংশ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাই খাদ্যাভ্যাস ও জীবনাচার নিয়ন্ত্রণ রাখলে ডায়াবেটিস প্রতিকারের পাশাপাশি প্রতিরোধও সম্ভব।
উপাচার্য আরও বলেন, অসংক্রামক রোগে মানুষের অনেক কষ্ট। তাই ডায়াবেটিস, ক্যানসার, হাইপারটেনশন, কার্ডিয়াক রোগ সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে ডায়াবেটিসের কারণে অনেক অঙ্গ আক্রান্ত হয়। তার মধ্যে প্যানক্রিয়াস, কিডনি, চক্ষু অন্যতম।

সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিএসএমএমইউয়ের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহাজাদা সেলিম, নেফ্রোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সৈয়দ ফজলুল সেলিম, অফথালমোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. তারিক রেজা আলী।
ডা. তারিক রেজা আলী বলেন, ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি সারা বিশ্বে ২০—৭৪ বৎসর বয়সী মানুষের দৃষ্টিশক্তি হ্রাসের অন্যতম প্রধান কারণ। এই রোগের প্রকোপ ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষের মধ্যে শতকরা ৩৪ দশমিক ৬ ভাগ।

ডা. শাহজাদা সেলিম বলেন, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে হৃদরোগ, স্টে্রাক, প্রজনন বিষয়ক নানা সমস্যা দেখা দেয়। ডায়াবেটিস রোগীর ৮০ শতাংশ মারা যায় হার্ট অ্যাটাকে। ডায়াবেটিস না থাকলে কিডনি রোগী অনেক কমে যেত। ডায়াবেটিসের কারণে চিকিৎসা ব্যয়ও অনেক বেড়ে যায়। ৬১ শতাংশ মানুষ মনে করে তাদের ডায়াবেটিস নেই, কিন্তু টেস্ট করলে দেখা যায় তাদের ডায়াবেটিসের মাত্রা এত বেশি যে ওষুধ বা ইনসুলিন শুরু করতে হয়। ডায়াবেটিস থেকে অন্য রোগ হওয়ার কারণে চিকিৎসা খরচ আরও বেড়ে যায়। ডায়াবেটিসে ব্যক্তির পাশাপাশি সরকারের ব্যয়ও বাড়ছে। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতের মোট ব্যয়ের ১০ শতাংশ ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় ব্যয় হয়।
[https://www.deshrupantor.com/news-print/2022/11/21/392789]


৫. ‘ডায়াবেটিস বড়লোকদের রোগ’ কথাটা কতটুকু সত্য?

একসময় কথাটা সত্য ছিল। একটা সময় ছিল, যখন ডায়াবেটিস শুধু দেখে দেখে বড়লোক বা পয়সাঅলাদেরকেই আক্রমণ করতো। তাদের উপর ডায়াবেটিসের আক্রোশ ছিল খুব বেশি। অন্যদিকে গরীব এবং খেটে খাওয়া মানুষদেরকে ডায়াবেটিস আক্রমণ করতো খুবই কম।
ডায়াবেটিসের আচরণে কেন এরকম বৈষম্য ছিল?
পয়সাঅলা হওয়াটা কি ডায়াবেটিসের অপছন্দ ছিল? পয়সাঅলারা কি ডায়াবেটিসের শত্রু ছিল?
না, বিষয়টা এমন নয়। বরং ডায়াবেটিসের আচরণ তখন যেমন ছিল, এখনো তেমন—ই আছে। এখনো তেমন—ই আছে বলেই ডায়াবেটিস এখন শুধু বড়লোকদেরকেই আক্রমণ করে না, অনেক গরীব মানুষকেও আক্রমণ করে।
এখন আমাদের জানতে হবে, ডায়াবেটিসের আচরণ কী?

ডায়াবেটিসের আচরণ হলো, দেখে দেখে শুধু বাড়তি চর্বিযুক্ত মানুষকে আক্রমণ করা বা আরামে থাকা মানুষকে আক্রমণ করা। মূলত ডায়াবেটিস কোনো মানুষের সাথে শত্রুতা করে না, বরং চর্বি—কোলেস্টেরলের প্রাচুর্যের মধ্যেই রোগটির জন্ম হয়। যেমন: যে কোনো মাটি যদি সূর্যের তাপ এবং পানি পায়, সেখানে কোনো না কোনো উদ্ভিদ জন্ম নেয়, এভাবেই যাদের শরীরে বাড়তি চর্বি—কোলেস্টেরল থাকে, তাদের শরীরে জন্ম নেয় ডায়াবেটিস।
পয়সাঅলা মানুষগুলো সাধারণত আরামের পেশায় নিযুক্ত থাকে আর মনমতো খায় বলেই তারা মুটিয়ে যায় এবং তাদের শরীরে বেড়ে যায় চর্বি—কোলেস্টেরল। তাই ডায়াবেটিস শুধু তাদেরকেই আক্রমণ করতো একসময়। তাই ডায়াবেটিসকে তখন ‘বড়লোকদের রোগ’ বলে মনে করা হতো। কিন্তু সময় এখন পাল্টেছে। এখন দরিদ্র মানুষরাও আরামপ্রিয় হয়ে গেছে। তাই ডায়াবেটিস শুধু বড়লোকদেরকে নয়, গরীবদেরকেও এখন ব্যাপকহারে আক্রমণ করছে।

ডায়াবেটিসের দোষ নেই, দোষ আমাদের। পৃথিবীর শুরু থেকে মানুষ কষ্টসহিষ্ণু ছিল। সময়ের ব্যবধানে মানুষ কষ্ট থেকে পরিত্রাণ পাবার উপায় খুঁজতে লাগলো এবং সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে আরামে থাকার অসংখ্য উপায় বের করে নিতে শুরু করলো। যখন থেকে মানুষ আরামের উপায় অবলম্বন করতে লাগলো, তখন থেকেই মানব সমাজে ডায়াবেটিসের প্রাদুর্ভাব দেখা  দিলো।
আপনি একটু ভেবে দেখলেই বুঝবেন, একসময় মানুষ প্রাত্যহিক জীবনের কার্যক্রম থেকে অবসর নিলে ডায়াবেটিসের শিকার হতো, যাকে মানুষ তখন বহুমুত্র রোগ বলতো। আর এখন কর্ম থেকে অবসরের অনেক আগেই, কম বয়সেই মানুষ ডায়াবেটিসের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।

বড়লোকদেরকে আগে আক্রমণ করতো বেশি, কিন্তু এখন গরীব মানুষের জীবন থেকেও শারীরিক পরিশ্রম উধাও হতে শুরু করেছে। আগে রিকশাচালকদেরকে চালাতে হতো পায়েচালিত রিকশা। এজন্য তারা কোনোভাবেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতো না। গরীব এবং খেটে খাওয়া মানুষরা আগে কৃষিক্ষেতে অনেক অনেক কাজ করতো। সমাজের অধিকাংশ মানুষই কম—বেশ কৃষিকাজের সাথে জড়িত ছিল। কিন্তু এখন মানুষ নগদ টাকা উপার্জনের পেছনে ছুটছে আর বাজার থেকে চাল—ডাল সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনে বসে বসে খাচ্ছে। ফলে ডায়াবেটিস এখন শুধু ধনীদেরকেই আক্রমণ করছে না, অনেক গরীব মানুষকেও আক্রমণ করছে। রিকশাঅলারা এখন চালাচ্ছে মোটরচালিত রিকশা। একেবারে অভাবী মানুষ ছাড়া কেউ কৃষিক্ষেতে কাজ করতে চায় না। তাছাড়া যাতায়াতেও এখন গাড়ি সহজলভ্য। হেঁটে হেঁটে কোথাও যাবার চিন্তা এখন মানুষের কল্পনাতেও আসে না। গৃহস্থালীর নানা কাজেও এখন ব্যবহৃত হচ্ছে প্রযুক্তি। এখন আর জামাকাপড় হাতে ধোয়ার প্রয়োজন হয় না, আছে ওয়াশিং মেশিন, ব্লেন্ডার, রাইস মিল। হাতে মাটিকাটাও এখন সেকেলে পদ্ধতিতে পরিণত হয়েছে। এখন মাটিকাটা, পুকুর বা খাল কাটায় ব্যবহৃত হচ্ছে মেশিন, যা একসময় কেউ কল্পনাও করেনি। বিল্ডিং নির্মাণ, কাঠের আসবাবপত্র তৈরিসহ মানুষের প্রায় প্রতিটি কাজে এখন এখন নানান মেশিন ব্যবহার করা হচ্ছে, যেগুলোর ব্যবহার মানুষকে শারীরিক পরিশ্রম থেকে মুক্তি দিয়েছে। এভাবে মানুষের শারীরিক পরিশ্রমের সুযোগ দিন দিন শুধু কমছেই।

তাই ডায়াবেটিস একসময় বড়লোকদের রোগ হলেও এখন কিন্তু এটা বড়লোকদের রোগ নয়, এখন এটা ধনী—গরীব নির্বিশেষে সবার রোগ। অবশ্য সবার রোগ না বলে এই রোগটিকে বলতে হবে, ‘আরামপ্রিয় মানুষের রোগ’ বা ‘আরামে থাকা মানুষের রোগ’।
আমাদের উচিত ডায়াবেটিসকে এখন আর বড়লোকদের রোগ না বলে ‘আরামে থাকা মানুষের রোগ’ বলে চিহ্নিত করা। ডায়াবেটিসকে এখন এভাবে চিহ্নিত না করলে ডায়াবেটিসের প্রকৃত রহস্যটি থেকে যাবে অন্ধকারে। মানুষ ডায়াবেটিসের প্রকৃত রহস্য না জেনে আক্রান্ত হবে ডায়াবেটিসে। জীবন হবে কঠিন থেকে কঠিনতরো।

ডায়াবেটিস থেকে সবাই সতর্ক হোন। সময় থাকতেই ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সিরিয়াস হোন। দৈনিক অন্তত ৪০ মিনিট শারীরিক পরিশ্রম করুন। ডায়াবেটিস আপনাকে কোনোভাবে আক্রমণ করতে পারবে না।


৬. দৈনিক মাত্র একটি কাজ করুন, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকবেন

আমি কোনো ডাক্তার নই। তবু নিজের প্রয়োজনে বিগত প্রায় পাঁচ বছর সময় ধরে ক্যান্সার, স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, ডায়াবেটিস এসব ভয়াবহ রোগের কারণ নিয়ে ভাবছি, বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ করছি ও অধ্যয়ন করছি, লিখছিও। আমার এই নিজের মতো করে পর্যবেক্ষণের ফলাফল একসময় পরিষ্কারভাবে সামনে আসতে শুরু করে। আমি এই রোগগুলোতে আক্রান্ত মানুষের খোঁজ নিতে গিয়ে দেখি— (১) হার্ট অ্যাটাক, ডায়াবেটিস এবং হাই ব্লাড প্রেশার এই তিনটি রোগের কারণ নির্দিষ্ট ও পরিষ্কার। (২) এই তিনটি রোগ একই ধরনের কারণে হয়, একই সূত্রে গাঁথা। (৩) এই তিনটি রোগের মধ্যে মানুষ অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রথমে আক্রান্ত হয় উচ্চ রক্তচাপে, পরে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা না হলে মানুষ কখনো হার্ট অ্যাটাক, কখনো ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। কখনো কখনো অনেকে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হবার আগেই ডায়াবেটিস বা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। (৪) এই তিনটি রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া মানুষের পক্ষে সম্ভব ও সহজ। এগুলো সম্পূর্ণ প্রতিরোধযোগ্য রোগ। (৫) ক্যান্সার এবং স্ট্রোকের কোনো কারণ স্পষ্ট নয়। ক্যান্সারের কারণ নিয়ে সমাজে এমনকি বিশ^ব্যাপী যেসব ধারণা ছড়িয়ে আছে, সবগুলো ভুয়া। ইনফেকশনে ক্যান্সার হয়, ধূমপানে ক্যান্সার হয়, স্থূলতার কারণে ক্যান্সার হয়, এটা খেলে ক্যান্সার হয়, ওটা খেলে ক্যান্সার হয়, এই সব কথা ভিত্তিহীন। এখানে শুধু দু’টি রেফারেন্স দিচ্ছি।

American Cancer Society'র অনলাইনে 'What is Cancer?' শিরোনামের একটি নিবন্ধের (হালনাগাদযোগ্য) 'Why did this happen to me?' উপশিরোনামে বলা হয়েছে, ''People with cancer often ask, ''What did I do wrong?'' or ''Why me?'' Doctors don't know for sure what causes cancer. When doctors can't give a cause, people may come up with their own ideas about why it happened.

Some people think they're being punished for something they did or didn't do in the past. Most people wonder if they did something to cause the cancer.

If you're having these feelings, you're not alone. Thoughts and beliefs like this are common for people with cancer. You need to know that cancer is not a punishment for your past actions. Try to not blame yourself or focus on looking for ways you might have prevented cancer. Cancer is not your fault, and there's almost never a way to find out what caused it. Instead, focus on taking good care of yourself now.''

[https://www.cancer.org/cancer/cancer-basics/what-is-cancer.html]

এখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, ''Doctors don't know for sure what causes cancer. When doctors can't give a cause, people may come up with their own ideas about why it happened.'' বলা হয়েছে, ''Cancer is not your fault, and there's almost never a way to find out what caused it.'' অবাক লাগে, তবু বিশ^্যাপী এটা—সেটাকে ক্যান্সারের কারণ বলে প্রচার করা হয় কিভাবে!

ফুসফুস ক্যান্সারের কারণ হিসেবে বিশেষভাবে ধূমপানকে দায়ী করা হয় বিশ^ব্যাপী। এবার দেখুন ফুসফুস ক্যান্সার সম্পর্কে চায়নার গুয়াংজৌ ক্যান্সার হসপিটালের মতামত।
চায়নার 'গুয়াংজৌ ক্যান্সার হসপিটালের' ওয়েবসাইটে (বাংলা) 'ফুসফুস ক্যান্সার' শিরোনামে একটা লেখায় দেখলাম একটা চাঞ্চল্যকর তথ্য।
সেখানে বলা হয়েছে, 'গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৯০% ক্ষেত্রেই ফুসফুস ক্যান্সার তাদের হয়, যারা ধূমপান করেন। তার মানে যারা ধূমপান করেন না তাদের কি এই ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা নেই? আসলে ব্যাপারটা এমন নয়। মডার্ন ক্যান্সার হসপিটাল গুয়াংজৌ দেখেছে যে, এখন পর্যন্ত ফুসফুস ক্যান্সারের প্রকৃত কারণ জানা যায়নি। সুতরাং ধূমপান—ই না, এর সাথে আরও তিনটি কারণ জড়িত থাকতে পারে— ১. বায়ু দূষণ, ২. অতিরিক্ত প্রেশার, ৩. পুষ্টির অভাব। এছাড়াও ভাইরাল ইনফেকশন, মাইকোটক্সিন, টিউবারকুলসিস, ইমিউন ডিসফাঙ্কশন, এন্ডওক্রাইন ডিজঅর্ডার এবং জেনেটিক কারণেও ফুসফুস ক্যান্সার হতে পারে।' [http://www.asiancancer.com/bengali/cancer-topics/lung-cancer]




এখানে বলা হয়েছে, ''মডার্ন ক্যান্সার হসপিটাল গুয়াংজৌ দেখেছে যে, এখন পর্যন্ত ফুসফুস ক্যান্সারের প্রকৃত কারণ জানা যায়নি।''
 
ব্রেইন স্ট্রোকের ক্ষেত্রে মানসিক টেনশনকে সামান্য দায়ী করার সুযোগ আছে। তবে বিষয়টা নিশ্চিত নয়। ‘‘ধূমপানে স্ট্রোক হয়’’ কথাটা লেখা থাকে সিগারেটের প্যাকেটেও। কিন্তু সরাসরি ধূমপান নয়, বরং পরোক্ষ ধূমপানের সাথেও সম্পর্কিত নয়, এমন অসংখ্য মানুষকেও স্ট্রোকে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। বিশেষ করে ওইসব মহিলা, যাদের স্বামী বা পরিবারের কেউই ধূমপান না করা সত্ত্বেও তারা স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে থাকেন।
এই কথাটা বললে কেউ কেউ বলে থাকেন, ‘ধূমপানই স্ট্রোকের কারণ নয়, স্ট্রোকের অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটি হচ্ছে ধূমপান’। যারা এমন কথা বলে থাকেন, তাদেরক যখন বলা হয়, ‘যদি স্ট্রোকের অনেক কারণের মধ্যে ধূমপান একটি হয়ে থাকে, তাহলে তো ধূমপান যারা করে, তাদের সবাই স্ট্রোকে আক্রান্ত হবার কথা। কিন্তু তেমন হয় না কেন? কেন ৩০—৪০ বছরের বেশি সময় ধরে ধূমপান করার পরও বিশ্বব্যাপী অসংখ্য মানুষ স্ট্রোক থেকে রেহাই পাচ্ছে?’ তখন এসব মানুষ একেবারে চুপ হয়ে যায়।
ধূমপানকে গিনিপিগ বা ‘বলির পাঁঠা’ না বানিয়ে স্ট্রোকের প্রকৃত কারণ নিয়ে নিবিড়ভাবে খোঁজ নিলে হয়তো একসময় সত্যিকারের কারণ সামনে চলে আসবে। কিন্তু ভুল কারণকে সত্যিকারের কারণ ধরে বসে থাকলে সত্যিকারের কারণটি আরো আরো মানুষকে স্ট্রোক তার শিকারে পরিণত করার সুযোগ পেয়ে যাবে।

আমার প্রায় পাঁচ বছরের ভাবনা, পর্যবেক্ষণ ও অধ্যয়নের উপর ভিত্তি করে একটি দীর্ঘ নিবন্ধ তৈরি করা হয়েছে, যা বই আকারে প্রকাশ করলে ২৫০ পৃষ্ঠার সমতুল্য একটি বই হবে। শিরোনাম: ‘‘দীর্ঘজীবন লাভের উপায়’’। এখনো বইটি বই আকারে প্রকাশ করা যায়নি। তবে ব্লগে প্রকাশ করা আছে। এই লিঙ্কে গিয়ে পড়া যাবে: https://waytogainlonglife.blogspot.com

বইটিতে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক এবং হাই ব্লাড প্রেশারের সত্যিকারের কারণ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। শুধু তা—ই নয়, এই রোগগুলোর কারণ নিয়ে ভুলভাবে প্রচারিত বিষয়গুলোকে ভ্রান্ত এবং ভিত্তিহীন প্রমাণ করা হয়েছে যুক্তি, উপযুক্ত রেফারেন্স এবং বাস্তবতা পর্যবেক্ষণমূলক অসংখ্য নিরীক্ষার মাধ্যমে।

বইটিতে রোগগুলো প্রতিরোধের উপায় নিয়েও বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। এই কথাটা ভালো করে বুঝিয়ে বলা হয়েছে, ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক এবং হাই ব্লাড প্রেশার এই তিনটি ভয়াবহ রোগ থেকে বাঁচতে হলে প্রতিদিন অন্তত ৪০ মিনিট শারীরিক পরিশ্রমের যে কোনো কাজ করতে হবে। তা হতে পারে কৃষিকাজসহ খেতখামারের যে কোনো কাজ; যে কোনো ব্যায়াম, জোরে জোরে হাঁটা, দৌড়া, সাঁতার কাটা, শারীরিক যে কোনো কসরত; ক্রীড়া যথা ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, ভলিবল ইত্যাদি।
যতদিন মানুষ এভাবে দৈনিক অন্তত ৪০ মিনিট শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করে যাবে, ততদিন মানুষকে তিনটি রোগ কোনোভাবে আক্রমণ করতে পারবে না। অন্য রোগগুলো আক্রমণ করতে পারুক বা না পারুক।
তাই দৈনিক অন্তত ৪০ মিনিট যে কোনো শারীরিক পরিশ্রমের কাজে সময় দেয়াটা অভ্যাসে পরিণত করুন, রোগগুলো থেকে বেঁচে যাবেন, নিশ্চিত।


৭. মানুষের হার্ট দুর্বল হয় কখন?

হার্ট দুর্বল হওয়ার কথা শুনেছেন নিশ্চয়ই। একবার দু’বার নয়, অনেকবার শুনেছেন, আমার বিশ^াস। কারণ আপনি যে দেশে বসবাস করছেন, আমিও সে দেশেই বসবাস করছি। একই দেশের আলো—বাতাস সে দেশের সবার গায়ে লাগবে কমবেশ, এটাই স্বাভাবিক। এই দেশে প্রচলিত প্রবাদগুলো আপনি যেভাবে শুনতে পান, আমিও শুনতে পাই। এই দেশের মানুষের ধ্যান—ধারণার সাথে আপনি যেমন পরিচিত, আমিও তেমনি পরিচিত।

শৈশব থেকে অনেক মানুষের মুখে হার্ট দুর্বল হয়ে যাবার কথা শুনেছি। তবে একটি কথা আছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই হার্ট দুর্বলতার সাথে সম্পর্কিত করা হয় সাইকেল চালানোকে। বলা হয়, সাইকেল চালালে নাকি হার্ট দুর্বল হয়ে যায়। আমাকেও এ পর্যন্ত বেশ কয়েকজন মানুষ সাইকেল চালাতে নিরুৎসাহিত করেছে এই বলে যে, সাইকেল চালালে নাকি হার্ট দুর্বল হয়ে যায়!

তবে সর্বশেষ যে লোকটির মুখে আমি হার্ট দুর্বল হয়ে যাবার কথা শুনেছি, তিনি কোহিনুর নামে আমার এক জেঠাতো বোনের স্বামী। আমাদের পাশের এলাকাতেই তাঁদের বাড়ি। প্রায়ই তাঁর সাথে দেখা হয়। সময় পেলে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁর সাথে মতবিনিময় করি।

আজ থেকে দু’তিন মাস আগে একদিন তাঁর সাথে এভাবে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছিল। তাঁর স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি বললেন, ‘‘আমার হার্ট বেশ দুর্বল। শরীর খুব দুর্বল লাগে। মাঝে মাঝে মাথা চক্কর দেয়ার উপক্রম হয়।’’
আমি তাঁকে কী বলেছিলাম জানেন? তা বলার আগে তাঁর সম্পর্কে কয়েকটি তথ্য জানিয়ে রাখি। তাঁর বয়স ৬৫ বছরের কাছাকাছি। আর এই বয়সেও তিনি কৃষিজমিতে কৃষিকাজ সহ সাংসারিক অনেক কাজে প্রচুর সময় দেন, শারীরিক পরিশ্রম করেন। যার ফলে তিনি এখনো উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক এই সবগুলো রোগ থেকে মুক্ত।

আমি তাঁকে প্রথমে জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘আপনার ব্লাড প্রেশার কি হাই?’’ তিনি বললেন, ‘‘না, আমার প্রেশার লো।’’
আমি বললাম, ‘‘আপনি নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করেন বলে আপনার শরীরে দুর্বলতা থাকতেই পারে। আমিও মাঝে মাঝে শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করতে গিয়ে মাথা চক্কর দেয়ার উপক্রম হয়, চার বছর আগে একবার অজ্ঞানও হয়ে গিয়েছি, এই বছরও একদিন প্রায় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। তাড়াতাড়ি পানি এবং শরবত পান করায় পুরো অজ্ঞান হইনি। আপনি নিয়মিত পরিশ্রম করায় এবং আপনার প্রেশার সব সময় লো থাকায় আপনার শরীরে দুর্বলতা দেখা দেয়। এটা কোনো রোগ যেমন নয়, এটা হার্টের দুর্বলতাও নয়। বরং আপনার জন্য ভালো খবর হচ্ছে, এটা আপনার হার্টের সুস্থতার লক্ষণ। আপনার শরীরে কোনো চর্বি নেই। যাদের শরীরে চর্বি বেড়ে যায়, তারা হার্ট ব্লক্ড হয়ে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়। আপনার তো হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হবার কোনো সম্ভাবনাই নেই আপাতত। আপনি শারীরিক পরিশ্রমের কাজ থেকে সহজে অবসর নেবেন না। অবসরে গেলেই আপনার শরীরে চর্বি বেড়ে যেতে পারে। আপনার হার্ট তখন দুর্বল হয়ে পড়বে রক্ত সরবরাহে অক্ষম হয়ে।’’
আমার কথাগুলো শুনে তিনি স্বস্তি পেলেন।

হ্যাঁ, প্রকৃতপক্ষে হার্ট তখন দুর্বল হয়ে পড়তে পারে, যখন হার্টে চর্বি জমে গিয়ে হার্ট রক্ত সরবরাহে অক্ষম হয়ে পড়ে। কিন্তু শরীর দুর্বল লাগা, বসা থেকে উঠলে মাথা ঘুরে যাওয়া এগুলো হার্ট দুর্বল হবার কারণে নয়, বরং হার্ট সবল হবার কারণে। এটা তাদের ক্ষেত্রে, যাদের প্রেশার লো। এই দুর্বলতা হার্টের দুর্বলতা নয়, বরং শরীরের দুর্বলতা। এই দুর্বলতার জন্য পর্যাপ্ত খাওয়া—দাওয়া করা দরকার, শারীরিক পরিশ্রমের আগে ক্ষুধা দূর করা দরকার এবং দুধ, গরুর মাংসসহ ভালো ভালো খাবার খাওয়া দরকার।
হার্ট দুর্বল হবার সাথে সাইকেল চালানোর সম্পর্কটাও এরকম সম্পূর্ণ বিপরীত চিন্তা।

সাইকেল চালালে হার্ট দুর্বল হয় না, বরং হার্ট শক্তিশালী থাকে। শরীর দুর্বল হতে পারে। সাইকেল চালানোসহ বিভিন্ন কায়িক শ্রম নিয়মিত করার কারণে যাদের শরীর দুর্বল থাকে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের হার্ট সবল থাকে। এটা একটা চিরন্তন সত্য। কারণ যাদের শরীরে চর্বি বেশি, তারা শারীরিকভাবে শক্তিশালী হলেও একসময় তাদেরকে আক্রমণ করে উচ্চ রক্তচাপ। এরপর তাদের অনেকে হার্টে রক্ত সরবরাহ বিঘ্নিত হবার কারণে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়।

যারা নিয়মিত সাইকেল চালান, তাদের শরীরে চর্বি জমতে পারে না। যার ফলে তাদের শরীর দুর্বল থাকতে পারে, কিন্তু চর্বি না থাকার কারণে তাদের হার্ট ব্লাড সরবরাহে সক্ষম ও শক্তিশালী থাকে।
আমার পরিচিত কিছু রিকশাচালক আছেন, যারা আগে কষ্টসাধ্য উপায়ে পায়েচালিত রিকশা চালাতেন। এখন চালাচ্ছেন অটোরিকশা। অটোরিকশা চালানোর পর পরই তারা মোটা হয়ে গেছেন। কারণ এখন কোনো শারীরিক পরিশ্রম নেই। এই লোকগুলো ধীরে ধীরে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং হার্ট অ্যাটাক এসব রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়বেন, সন্দেহ নেই। কেউ কেউ হয়েছেনও।

এটা আমাদের জানা কথা, পায়েচালিত রিকশা চালানো আর বাইসাইকেল চালানো একই রকম কাজ। যেভাবে পায়েচালিত রিকশা চালানোর কারণে মানুষের শরীরে চর্বি জমে না, মানুষের হার্ট সবল থাকে, একইভাবে বাইসাইকেল চালানোর ফলেও মানুষের শরীরে চর্বি জমতে পারে না এবং মানুষের হার্ট সবল থাকে, দুর্বল হবার প্রশ্নই আসে না।
আমাদের এলাকায় আমার সাথে বেশ পরিচিত ৬—৭ জন লোক আছেন, যাদের বয়স ৪০ থেকে ৬০ বছরের মতো। এরা মানুষের কায়িক শ্রমের কাজগুলো করে থাকেন দিনমজুর হিসেবে। এদের কেউই এই বয়সে এসেও হৃদরোগে (হার্ট অ্যাটাক) আক্রান্ত হননি; উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসেও নয়।
এদের হার্ট কি দুর্বল? মোটেই না। এদের হার্ট সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী। কারণ নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করার ফলে এদের হার্টে কোনো অবাঞ্চিত চর্বি জমতে পারে না বলে এদের হার্ট ঠিকঠাক মতো কাজ করতে পারে।

এককথায় মানুষের হার্ট দুর্বল তখন হয়, যখন মানুষ শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে দূরে থাকে, আরামে আরামে থাকে। হার্ট সবল রাখতে হলে মানুষকে শারীরিক পরিশ্রমের কাজে সময় দিতে হবে দৈনিক অন্তত ৪০ মিনিট। তাহলে হার্ট কখনো দুর্বল হবে না। এর ফলে শুধু হার্ট অ্যাটাক নয়, ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ থেকেও মানুষ নিরাপদ থাকবে; নিরাপদ থাকবে কিডনী বিকলতা এবং চোখের কিছু সমস্যা থেকেও।


৮. লো প্রেশার কোনো রোগ নয়, বরং সুস্থতার লক্ষণ

উচ্চ রক্তচাপ (হাই ব্লাড প্রেশার) নিয়ে বিশ^ব্যাপী যেমন অসংখ্য ভুল ধারণা প্রচলিত আছে, কম রক্তচাপ (লো প্রেশার) নিয়েও অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। যাদের প্রেশার লো, তাদের অধিকাংশই একে ‘রোগ’ মনে করেন। আতঙ্কে বা ভয়ে থাকেন প্রায় সময়। কেন ভয়ে থাকেন? ভয়ে থাকেন এজন্য, ডাক্তাররাও কম রক্তচাপকে ভয়ের কারণ বলে প্রচার করে থাকেন। যেমন:
‘লো প্রেশার হলে কী করবেন?’ শিরোনামে প্রথম আলোয় ১১ জানুয়ারী ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে চিকিৎসক মো. শরিফুল ইসলাম লিখেন, ‘‘আমাদের শরীরের জন্য উচ্চ রক্তচাপের মতো নিম্ন রক্তচাপ অর্থাৎ লো ব্লাড প্রেশারও ক্ষতিকর।’’ নিবন্ধটিতে আরো বলা হয়, ‘‘লো নাকি হাই প্রেশার কোনটি বেশি খারাপ? দুটোই খারাপ, তবে যখন প্রশ্ন করা হয় কোনটি বেশি খারাপ? নিঃসন্দেহে লো প্রেশার বা নিম্ন রক্তচাপ বেশি খারাপ। কারণ, হঠাৎ প্রেশার কমে গেলে বা কোনো কারণে প্রেশার কমে গেলে তাৎক্ষণিক শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যেমন কিডনি, মস্তিষ্ক ইত্যাদি নষ্ট হয়ে যেতে পারে এবং তাৎক্ষণিক মৃত্যুও হতে পারে। এ জন্যই ডায়রিয়ায় পানিশূন্যতা রোধে শিরায় স্যালাইন দেওয়া হয়। তবে উচ্চ রক্তচাপও দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে। তাই উচ্চ রক্তচাপও নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত।’’
এই নিবন্ধে একজন ডাক্তার নিজেই কম রক্তচাপকে শুধু ক্ষতিকর বলেননি, বরং উচ্চ রক্তচাপের চেয়েও বেশি ক্ষতিকর বলে মন্তব্য করেছেন। আরও বলেছেন, ‘‘হঠাৎ প্রেশার কমে গেলে বা কোনো কারণে প্রেশার কমে গেলে তাৎক্ষণিক শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যেমন কিডনি, মস্তিষ্ক ইত্যাদি নষ্ট হয়ে যেতে পারে এবং তাৎক্ষণিক মৃত্যুও হতে পারে।’’
জানি না, বাস্তবতার সাথে এসব কথার মিল তিনি গভীরভাবে যাচাই করে দেখেছেন কিনা! আমার বাবার ৭০ বছর বয়স পর্যন্ত প্রেশার লো ছিল নিয়মিত। তিনি প্রচুর শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করতেন নিয়মিতভাবে। তাঁর শরীর থেকে প্রচুর ঘাম ঝরতো কাজ করতে গিয়ে। তাঁর শরীরে চর্বি জমা হওয়ার সুযোগই হতো না।  কিন্তু গত ১০ বছর ধরে সব রকম কাজ থেকে অবসরে চলে যাবার পর থেকে তিনি এখন উচ্চ রক্তচাপের পাশাপাশি ডায়াবেটিসেও আক্রান্ত। আমার মায়েরও একই অবস্থা। তিনিও এখন সাংসারিক কাজ থেকে অবসরে আছেন এবং আমার বাবার মতো একইভাবে একই সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। উভয়কে এখন নিয়মিত উচ্চ রক্তচাপের ঔষধ গ্রহণ করতে হচ্ছে। শুধু তা—ই নয়, মাংসসহ অনেক পছন্দের খাবার এড়িয়ে চলতে হচ্ছে। অথচ যখন তাঁদের প্রেশার লো ছিল, তখন এভাবে কোনো খাবার থেকে নিজেদেরকে বঞ্চিত করতে হয়নি কখনো; কোনো খাবার খাওয়া নিয়ে বাছ—বিচার করতে হয়নি এবং নিয়মিত লো প্রেশার থাকার কারণে লো প্রেশার দূর করার জন্য একটিবারের জন্যও চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়নি এবং কখনো কোনো ঔষধও গ্রহণ করতে হয়নি। তাহলে এই ডাক্তারের বক্তব্য অনুযায়ী উচ্চ রক্তচাপের চেয়ে নিম্ন রক্তচাপ কিভাবে বেশি খারাপ এবং ক্ষতিকর??
আপনি বা আপনার পরিচিত যারা এখনো উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়নি, জন্মের পর থেকে এখনো যাদের প্রেশার লো, তাদেরকে এখনো লো প্রেশারের চিকিৎসার জন্য একটি বারের জন্যও ডাক্তারের কাছে যেতে হয়নি নিশ্চয়ই। অথচ দেখবেন, একজন হাই ব্লাড প্রেশারের রোগীকে কিছু দিন পর পর ডাক্তারের কাছে যেতে হয় এবং নিয়মিত ঔষধ গ্রহণ করতে হয়। নয়তো প্রেশার বেড়ে গিয়ে মানুষ অস্থির হয়ে উঠে, কখনো  কখনো হার্ট অ্যাটাকেও আক্রান্ত হয়ে পড়ে। জানি না, তবু লো প্রেশারকে হাই প্রেশারের চেয়ে খারাপ বলে প্রচার করার মানে কী?
আজ (৪ ডিসেম্বর ২০২০) বিকেলে আমাদের বাড়ির দক্ষিণ পাশের এক বাড়ির মোতালেব নামক একজন লোকের সাথে কিছুক্ষণ কথা হলো। আমি ব্যক্তিগত কৌতুহল থেকে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘আপনার প্রেশার কি হাই?’’ তিনি উত্তরে বললেন, ‘‘না, আমার প্রেশার লো।’’ আমি তাঁকে বললাম, ‘‘আপনার প্রেশার এখনো হাই হয়নি কেন জানেন? কারণ আপনি এখনো নিজের কৃষিক্ষেতে নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করেন। আপনার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট অনেক মানুষ এখনকার সময়ে অহরহ হাই প্রেশারে আক্রান্ত হচ্ছে। আপনি হাই প্রেশারে এখনও আক্রান্ত হননি শুধুই শারীরিক পরিশ্রমের সাথে যুক্ত থাকার কারণে।’’ তিনি আমার কথাগুলো শুনছিলেন। আমি এরপর তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘আপনার বয়স এখন কত?’’ তিনি বললেন, ‘‘আমার বয়স এখন ৬৮ বছর।’’ এই কথা বলার পর একটু থেমে তিনি আবার বললেন, ‘‘লো প্রেশারে আমি মরে যাই।’’ আমি বললাম, ‘‘কী হচ্ছে আপনার লো প্রেশারে?’’ তিনি বললেন, ‘‘শরীর দুর্বল লাগছে।...’’
আমি বুঝতে পারলাম, সমাজে ছড়িয়ে থাকা লো প্রেশার—ভীতিতে তিনিও প্রবলভাবে আক্রান্ত।
আমি নিজেও শৈশব কাল থেকে মানুষের মুখে মুখে লো প্রেশারকে একটি নেতিবাচক বিষয় বলেই জেনে আসছি। এখনো প্রায়ই দেখছি অনেক মানুষ নিজের লো প্রেশার নিয়ে নিজের দুশ্চিন্তার কথা প্রকাশ করে।
বিগত কয়েক বছর ধরে নিজের প্রয়োজনেই জটিল রোগগুলো নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে ও পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে হাই ব্লাড প্রেশার, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক এবং ডায়াবেটিস নিয়ে অনেক সত্য আমার সামনে চলে আসে। সেই সত্যগুলো অবলম্বন করে আমি লিখে যাচ্ছি। বেশ খারাপ সময় অপেক্ষা করছে। এই সত্যগুলো মানুষের সামনে না এলে মানুষ তিনটি বিশেষ রোগে এখনকার চেয়ে আরো ব্যাপকহারে আক্রান্ত হবে। রোগ তিনটি হচ্ছে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং হার্ট অ্যাটাক। ক্যান্সার এবং স্ট্রোকের ব্যাপারে এটা আমার নিকট পরিষ্কার হয়েছে, এই রোগ দুইটির কারণ নিয়ে যত কথাই প্রচার করা হোক না কেন, এগুলোর কারণ এখনো অপরিষ্কার। প্রচারিত কোনো কারণই সঠিক নয়।

উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং হার্ট অ্যাটাকের সঠিক কারণ এবং প্রতিরোধের উপায় আমার নিকট দিবালোকের ন্যায় পরিষ্কার হয়ে গেছে। আর লো প্রেশার সম্পর্কে এটাই আমার নিকট পরিষ্কার হয়েছে, লো প্রেশারকে ‘লো প্রেশার’ না বলে ‘নরম্যাল প্রেশার’ বলে প্রচার করলেই ভালো হতো। কারণ একজন মানুষের রক্তচাপ যখন বেড়ে যায়, তখন তাকে উচ্চ রক্তচাপ বলা হয়। কিন্তু উচ্চ রক্তচাপ যার নেই, তার রক্তচাপ কি তাহলে নিম্ন রক্তচাপ বা কম রক্তচাপ? মোটেই না। তার রক্তচাপ স্বাভাবিক রক্তচাপ। আমরা অহেতুক তার রক্তচাপকে লো প্রেশার বলে মানুষের মাথা নষ্ট করছি; মানুষকে আতঙ্কিত করছি। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, আমরা মানুষের স্বাভাবিক রক্তচাপকে শুধু লো প্রেশার বলেই ক্ষান্ত হইনা, বরং লো প্রেশারকে হাই ব্লাড প্রেশারের চেয়েও ক্ষতিকর বলে মানুষকে অহেতুক আতঙ্কিত করি।

এবার দেখি আরেকটি নিবন্ধ। ‘‘লো প্রেশার = হার্ট অ্যাটাক’’ শিরোনামে বাংলাদেশের প্রখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এম. শমসের আলী একটি নিবন্ধ লিখেন বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় ১৫ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে। সেখানে বলা হয়, ‘‘মানবদেহে রক্তচাপের একটি স্বাভাবিক মাত্রা আছে। তার ওপর ভিত্তি করেই উচ্চ রক্তচাপ (হাই ব্লাড প্রেশার) ও কম রক্তচাপ (লো ব্লাড প্রেশার) পরিমাপ করা হয়। রক্তচাপ একটি সুনির্দিষ্ট রেঞ্জের মধ্যে থাকে। রেঞ্জের উপরের মাপকে সিস্টলিক রক্তচাপ ও নিম্নের মাপকে ডায়োস্টলিক রক্তচাপ বলা হয়। এ মতে মানবদেহে স্বাভাবিক রক্তচাপ হলো ১৩০/৮০ মি.মি. থেকে ৯০/৬০ মি.মি. মানে সিস্টলিক ১৩০ থেকে ৯০ এর মাঝে এবং ডায়োস্টলিক ৮০ থেকে ৬০ এর মাঝে। যদি কারও এর চেয়ে বেশি মাত্রার রক্তচাপ থাকে তবে এই অবস্থাকে উচ্চ রক্তচাপ (হাই ব্লাড প্রেশার) বলা হয় এবং যদি কারও এর চেয়ে কম রক্তচাপ থাকে, তবে এই অবস্থাকে কম রক্তচাপ (লো ব্লাড প্রেশার) বলা হয়ে থাকে।’’ [https://www.bd-pratidin.com/health/2016/10/15/176977]

এই নিবন্ধে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে, ‘‘মানবদেহে স্বাভাবিক রক্তচাপ হলো ১৩০/৮০ মি.মি. থেকে ৯০/৬০ মি.মি. মানে সিস্টলিক ১৩০ থেকে ৯০ এর মাঝে এবং ডায়োস্টলিক ৮০ থেকে ৬০ এর মাঝে। যদি কারও এর চেয়ে বেশি মাত্রার রক্তচাপ থাকে তবে এই অবস্থাকে উচ্চ রক্তচাপ (হাই ব্লাড প্রেশার) বলা হয় এবং যদি কারও এর চেয়ে কম রক্তচাপ থাকে, তবে এই অবস্থাকে কম রক্তচাপ (লো ব্লাড প্রেশার) বলা হয়ে থাকে।’’ এখানে বলা হয়েছে, স্বাভাবিক রক্তচাপের চেয়ে বেশি হওয়াই হচ্ছে উচ্চ রক্তচাপ। এ থেকে সহজেই বুঝা যায়, যার উচ্চ রক্তচাপ নেই, তার শরীরে রক্তচাপ নিশ্চয়ই স্বাভাবিক। আমরা স্বাভাবিক রক্তচাপকে লো প্রেশার বলে মানুষকে শুধু আতঙ্কিতই করছি। এই নিবন্ধে যে শিরোনাম দেয়া হয়েছে, তা দেখে যে কোনো লো প্রেশারের রোগী আতঙ্কিত হতে পারে।

‘‘নিম্ন রক্তচাপ যখন সমস্যা’’ শিরোনামে ২৫ মার্চ, ২০১৮ তারিখের কালের কন্ঠে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়, যা লিখেছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী। তিনি সেখানে লিখেন, ‘‘কারো কারো ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে প্রেশার কম থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে তিনি যদি কোনো অসুবিধা অনুভব না করেন, তবে এটা তাঁর জন্য স্বাভাবিক। নিম্ন রক্তচাপ নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। যেহেতু এটা কোনো রোগ নয়, তাই এদের ক্ষেত্রে একে রোগ বানানো কিংবা চিকিৎসারও দরকার নেই। হাইপোটেনশন হলো অন্য রোগের প্রকাশ। কারো রক্তচাপ নিচের দিকে থাকলে তার বরং কার্ডিয়াক সমস্যা কম হয়।’’ [https://www.kalerkantho.com/print-edition/doctor-acen/2018/03/25/617361]
 
এই নিবন্ধে অধ্যাপক ডা. আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছেন, ‘‘কারো কারো ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে প্রেশার কম থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে তিনি যদি কোনো অসুবিধা অনুভব না করেন, তবে এটা তাঁর জন্য স্বাভাবিক।’’ এই কথা থেকে আমরা বুঝতে পারি স্বাভাবিকভাবে প্রেশার কম থাকাটাই স্বাভাবিক রক্তচাপ। তিনি আরো বলেন, ‘‘এটা কোনো রোগ নয়।’’ আরো বলেন, ‘‘কারো রক্তচাপ নিচের দিকে থাকলে তার বরং কার্ডিয়াক সমস্যা কম হয়।’’

কার্ডিয়াক বা হৃদরোগের সমস্যা হয় শুধু তাদের, যারা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ না করলে কখনো কোনো কারণে বেড়ে গিয়ে মানুষের হার্ট ব্লক্ড হয়ে যায়। কিন্তু যার রক্তচাপ স্বাভাবিক, তার হার্ট কিভাবে ব্লক্ড হবে? এজন্য দেখবেন, যারা হৃদরোগে ভুগছে, তাদের অধিকাংশই হৃদরোগে আক্রান্ত হবার আগে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়েছিল। উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়া ছাড়া খুব কম মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়। মূলত উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ এই তিনটি রোগ ঐ সব মানুষের হয়, যাদের শরীরে চর্বি বেশি এবং চর্বি নিয়ন্ত্রণে রাখার কোনো উপায় অবলম্বন করে না। যাদের শরীরে চর্বি নেই বা থাকলেও একেবারে কম, তারা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয় না, তাদের রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকে। শরীরে চর্বি বেশি নেই বলে তাদের হার্টও ব্লক্ড হয় না।

এখন আমাদের শুধু জানা দরকার, লো প্রেশার অন্য কোনো ক্ষতির কারণ কিনা? লো প্রেশার মানে যদি স্বাভাবিক রক্ত চলাচল হয়, তাহলে তা মানুষের কোনো ক্ষতি করবে কিভাবে? প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, ‘লো প্রেশারে আক্রান্ত মানুষ’ শুধু শারীরিকভাবেই একটু দুর্বল থাকতে পারেন। কখনো অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রমের সাথে যখন তীব্র ক্ষুধা বা পিপাসা যোগ হয়, শরীর থেকে কোনো দুর্ঘটনায় বা রোগে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়, তখন মানুষের রক্তচাপ স্বাভাবিকের চেয়ে কমে গিয়ে মানুষ তাৎক্ষণিক সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলতে পারে। এতটুকুই। এই সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলা থেকে বড় ধরনের কোনো সমস্যা দেখা দেয় না। যদি অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে রক্তচাপ কমে গিয়ে মানুষ মারা যায়, সেজন্য রক্তচাপ কমে যাওয়াকে দায়ী করার সুযোগ নেই; সেজন্য দায়ী অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ।

এই নিবন্ধে রেফারেন্স হিসেবে প্রথমে উল্লেখিত নিবন্ধে বলা হয়েছে, ‘‘হঠাৎ প্রেশার কমে গেলে বা কোনো কারণে প্রেশার কমে গেলে তাৎক্ষণিক শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যেমন কিডনি, মস্তিষ্ক ইত্যাদি নষ্ট হয়ে যেতে পারে এবং তাৎক্ষণিক মৃত্যুও হতে পারে।’’ এই ক্ষতিগুলোর সম্ভাবনা মোটেই নেই যদি অন্য কোনো কারণ ছাড়া এমনিতেই মানুষের রক্তচাপ কম থাকে। আপনি আপনার পরিচিত অন্তত ১০ জন মানুষের খোঁজ নিয়ে দেখুন, যারা কায়িক শ্রমের পেশায় নিয়োজিত, দেখবেন তারা ৫০—৬০ বছর বয়সে এসেও উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়নি এবং তারা কিডনী, মস্তিষ্ক নষ্ট হওয়া বা আকস্মিক মৃত্যুর মুখোমুখি হয়নি কখনো। শুধু হয়তো কখনো কখনো অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রমের কারণে রক্তচাপ স্বাভাবিকের চেয়ে নিচে নেমে যাওয়ার কারণে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছে। সেই জন্য কিন্তু রক্তচাপ কম হওয়াকে দায়ী না করে দায়ী করতে হবে প্রচুর ক্ষুধা নিয়ে অতিরিক্ত পরিশ্রম করাকে।

এই বিষয়ে নিশ্চিত থাকতে পারেন, লো প্রেশার থেকে মানুষ অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত হয় না, বরং হাই ব্লাড প্রেশার থেকেই মানুষ হার্ট অ্যাটাক এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। লো প্রেশার কোনো রোগের নাম হলে লো প্রেশার যাদের, তাদেরকে নিয়মিত ডাক্তারের কাছে যেতে হতো এবং লো প্রসার দূর করা বা নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়মিত ঔষধ গ্রহণ করতে হতো। কিন্তু কোনোটিই করতে হয় না। কারণ লো প্রেশার কোনো রোগ নয়, বরং রক্তচাপের স্বাভাবিক অবস্থা।
শুধু তা—ই নয়, লো প্রেশার বা স্বাভাবিক রক্তচাপ যাদের, তারা কখনো কোনোভাবে ডায়াবেটিস এবং হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয় না। তাই লো বা নরমাল প্রেশারকে আমরা আর ক্ষতিকর না ভেবে শরীরের জন্য আশীর্বাদ বা সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ হিসেবেই মনে করবো এবং লো প্রেশার ধরে রাখার চেষ্টা করবো। কারণ প্রেশার হাই হয়ে গেলেই বিপদ।


৯. বিপজ্জনক রোগগুলোর মধ্যে তিনটিই প্রতিরোধযোগ্য

মানুষের মৃত্যুর কারণগুলোকে মোটাদাগে ৫টি ভাগে ভাগ করা যায়। (১) দুর্ঘটনায় মৃত্যু (২) মানুষের হাতে মানুষের মৃত্যু (৩) কোনো প্রাণীর আক্রমণে মৃত্যু (৪) বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যু (৫) রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু।
মৃত্যুর এই পাঁচ ধরনের কারণের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু কোন কারণে, তা বলা মুশকিল। মৃত্যুর এই পাঁচটি কারণের মধ্যে সবচেয়ে কম মানুষ যেই কারণে মারা যায়, তা হলো বিভিন্ন প্রাণীর আক্রমণে মৃত্যু। মানুষের দীর্ঘজীবন লাভের সম্ভাবনা বৃদ্ধির জন্য মানবমৃত্যুর এই পাঁচটি কারণের মধ্যে প্রথম চারটি কারণ নিয়ে তেমন কাজ করা যাবে না। কারণ দুর্ঘটনা যে কোনোভাবেই ঘটতে পারে।  মালয়েশিয়ার একটি বিমান কয়েক বছর আগে আকাশে উড্ডয়নরত অবস্থায় যাত্রীসহ হারিয়ে যায়। এখনো সেই বিমানের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিনিয়ত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। মানুষের হাতে মানুষের মৃত্যু কমানোও কঠিন। পৃথিবীর শুরু থেকেই মানুষের হাতে মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে চলছে। এখনও মানুষ মানুষকে মারছে, মারছে নিষ্ঠুরভাবেও। ভবিষ্যতেও মারবে। মানুষ একটি যুদ্ধাংদেহি জাতি। নিজ হাতে আরেকজন মানুষকে হত্যা করে। কখনো কখনো একই সাথে হাজার মানুষকেও হত্যা করে। মানবজাতির শ্রেষ্ঠত্ব এখানে প্রবলভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। মানুষ মানুষকে মারার জন্য ‘আবিষ্কার’ও করছে প্রতিদিন নিত্যনতুন উপকরণ/অস্ত্র। অন্য কোনো প্রাণি স্বজাতিকে মারার জন্য এভাবে গবেষণা করে না, উপকরণের পর উপকরণ আবিষ্কার করে না; অস্ত্রবাণিজ্য তো দূরের কথা!

অন্যান্য প্রাণীর হাতে মানুষ আগে যেই হারে মারা যেতো, বিভিন্ন কারণে এখন সেই হার অনেক কমেছে। বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যু হচ্ছে মৃত্যুর সবচেয়ে অনিবার্য কারণ। একজন মানুষ আর কোনোভাবে মারা না গেলেও শেষে বার্ধক্যজনিত কারণে হলেও মারা যায়—ই। মানুষ মরণশীল, এই চিরসত্য যেমন এখনো চিরসত্যই, কোনোভাবেই এখনো কোনো একজন মানুষও যেমন কয়েকশত বছর ধরে বেঁচে থেকে এই চিরসত্য ভুল সাব্যস্ত করার সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারেনি, বার্ধক্যজনিত মৃত্যুও ঠিক এমনই।

মানুষ এখনো মৃত্যুকে জয় করতে পারেনি, তবে অনেক মানুষ তুলনামূলক বেশিদিন বেঁচে থাকার সুযোগ পায়। কেউ কেউ ভাগ্যবশত, কেউ কেউ নানা রকম চেষ্টার মাধ্যমে। দীর্ঘজীবন লাভের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করতে কিছু রোগের উপর কাজ করা যাবে। পৃথিবীতে মানুষ এখন যে রোগগুলোতে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে এবং মারা যাচ্ছে, সেই রোগগুলোর মধ্যে তিনটি রোগ সম্পূর্ণ প্রতিরোধযোগ্য। বর্তমান বিশ্বে মানবমৃত্যু সবচেয়ে বেশি হয় যেই রোগে, সেটি হচ্ছে হার্ট অ্যাটাক বা হৃদরোগ। এই রোগসহ উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস এই তিনটি রোগ সম্পূর্ন প্রতিরোধযোগ্য। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে এই তিনটি রোগ যে সম্পূর্ণ প্রতিরোধযোগ্য, তা এখনো অনেকের নিকট পরিষ্কার নয়। কারণ এই তিনটি রোগের কারণ সম্পর্কে এমন অনেক কথা বলা হয়, যেগুলো শুনে এই রোগগুলোকে প্রতিরোধহীন রোগ বলেই মনে হয়। বলা হয়, এগুলো বংশগত; বলা হয়, টেনশনের কারণে মানুষ এই রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়; বয়স বেড়ে গেলে মানুষ নাকি এমনিতেই, কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই এই রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়; খাদ্যে ভেজালের কারণেও নাকি মানুষ এগুলোতে আক্রান্ত হয়।

আমার ‘দীর্ঘজীবন লাভের উপায়’ শিরোনামের বইতে এই বিষয়গুলো নিয়ে আলাদাভাবে আলোচনা করা হয়েছে। সেগুলো পড়লে যে কেউ নিশ্চিত হবেন, এই রোগগুলোর সবচেয়ে বড় কারণ শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা। এখনো যেসব মানুষ নিয়মিত কায়িক শ্রম করেন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ ক্যান্সার, ব্রেইন স্ট্রোক ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হলেও কেউই এই তিনটি রোগে আক্রান্ত হয় না। আমার পরিচিত বেশ কয়েকজন মানুষ আছেন, যাদের বয়স ৬০ বছরের বেশি, তবু এই তিনটি রোগের কোনেটিতেই আক্রান্ত নন। কারণ তারা এখনো, এই বয়সেও নিয়মিত কায়িক শ্রমের কাজ করেন। বিশেষ করে কৃষিকাজ। অথচ তাদের চেয়ে অনেক অনেক কম বয়সী আমার পরিচিত এবং কাছের অনেক মানুষ এই রোগগুলোতে আক্রান্ত, শুধুই কায়িক শ্রম থেকে দূরে থাকার কারণে।

আগে মানুষকে বাধ্য হয়েই বেশি বেশি শারীরিক পরিশ্রম করতে হতো, যার ফলে তারা এই তিনটি রোগে সহজে আক্রান্ত হতো না। কিন্তু এখনকার মানুষ ৩০—৪০ বছর বয়স হয়ে গেলেই এই রোগগুলোর শিকারে পরিণত হয়, কারণ এখন মানুষের জীবনে আগের মতো ‘বাধ্যগতভাবে’ শারীরিক পরিশ্রম নেই বললেই চলে। মানুষ এখন ইচ্ছা করলেই আরামে আরামে জীবন কাটাতে পারে। যারাই শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকে, তারাই ব্যাপকহারে এই রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়।

এখনও মানুষ যদি নিয়মিত কায়িক শ্রম করে, মানুষ এখনও আগের মানুষের মতো দীর্ঘজীবন লাভের সুযোগ পাবে। আর কায়িক শ্রমের অভ্যাস না করলে পরবর্তী প্রজন্ম এই রোগগুলোতে আরো ব্যাপক হারে আক্রান্ত হবে। অন্য কিছু করে এই রোগগুলো থেকে নিরাপদ থাকতে পারবে না।
বাংলাদেশ প্রতিদিনে ১৩ ডিসেম্বর, ২০২০ তারিখে ‘২০ বছরে সবচেয়ে বেশি প্রাণ কেড়ে নিয়েছে যে ১০ রোগ!’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘‘২০০০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বেশি প্রাণ কেড়েছে ১০টি রোগ। এই রোগগুলো বিশ্বব্যাপী ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে, যা দিনদিন বেড়েই চলেছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা এই গবেষণায় করোনাভাইরাস স্থান পায়নি। কারণ সেসময় পর্যন্ত করোনা মহামারী রূপ নেয়নি।

গত ২০ বছরের গবেষণা করে শীর্ষ ১০ রোগের তালিকা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সেখানে দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয় হৃদরোগে। এছাড়া দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে স্টে্রাক। ২০০০ থেকে ২০১৯, গত দু’দশকে সারা পৃথিবীতে ছবিটা একই রকম রয়ে গিয়েছে।
মৃত্যুর প্রধান কয়েকটি কারণে বেশ কিছু পরিবর্তন হয়েছে গত ২০ বছরে। যেমন যক্ষ্মার মতো সংক্রামক রোগে মৃত্যুর হার অনেকটাই কমেছে। আফ্রিকা মহাদেশে মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ প্রবল পেটের অসুখ বা ডায়রিয়া। সেই মৃত্যুর হার উল্লেখজনকভাবে কমে গিয়েছে। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে পানীয় জলের সরবরাহ ও শৌচ ব্যবস্থায় উন্নতিই এর প্রধান কারণ বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

গত ২০ বছরে মৃত্যুর হার অনেক বেড়ে গিয়েছে কিডনির অসুখ ও ডায়াবেটিসে। ডায়াবেটিসকে ‘লাইফস্টাইলজনিত’ রোগ আখ্যা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।’’ [https://www.bd-pratidin.com/health-tips/2020/12/13/596949]

উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত মানুষরাই বেশি বেশি ডায়াবেটিস এবং হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়। আপনি দেখবেন আপনার পরিচিত অনেক মানুষ একই সাথে এই তিনটি রোগের সবগুলোতেই আক্রান্ত। শারীরিক পরিশ্রম থেকে যারা ১০ বছরের বেশি সময় ধরে দূরে, তাদের অধিকাংশই উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। অনেকে এই দুইটি রোগের পাশাপাশি হৃদরোগেও (হার্ট অ্যাটাক) আক্রান্ত। হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে অনেকে প্রথমবারেই মৃত্যুবরণ করেন। অনেকে দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এই তিনটি রোগে আক্রান্ত হবার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে কায়িক শ্রম থেকে দূরে থাকা। মানুষ নিয়মিত কায়িক শ্রম করলে এই তিনটি রোগ থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকে। যদি মানুষ এই তিনটি রোগ থেকে নিরাপদ থাকতে পারে, তাহলে মানুষের বেশি দিন বেঁচে থাকার সুযোগ অবশ্যই বৃদ্ধি পায়।

১০. লবণ খেলে কি উচ্চ রক্তচাপ হয়?

উচ্চ রক্তচাপ এখন এক মহা সমস্যার নাম। ৫০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের অধিকাংশই এখন উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হলে মানুষের জীবন অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে। যখন—তখন রক্তচাপ বেড়ে গিয়ে মানুষ অস্থির হয়ে পড়েন। অনেক সময় মানুষ মাথা চক্কর দিয়ে ঘুরে পড়ে যান। শরীরে দেখা দেয় অশান্তি। সবচেয়ে বড় কথা, উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত মানুষ উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ না করলে কয়েক বছরের মধ্যেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। আরো ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত মানুষরাই হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হন, ডাক্তারের কাছে নেয়ার আগেই। ভাগ্য সহায় থাকলে কেউ কেউ ডাক্তারের কাছে নেয়া পর্যন্ত বেঁচে থাকেন এবং চিকিৎসার সুযোগ পান। তবে হার্ট অ্যাটাকে একবার আক্রান্ত হলে মানুষ হৃদরোগী হয়ে যান বাকি জীবনের জন্য। এই ধরনের মানুষ অধিকাংশ ক্ষেত্রে নতুন করে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়েই মারা যান।
দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, এই বিষয়টা এখনো অনেক ডাক্তারের কাছেও পরিষ্কার নয় যে, উচ্চ রক্তচাপে যারা আক্রান্ত নয়, তারা ডায়াবেটিস এবং হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয় একেবারেই কম। উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত মানুষরাই এই দু’টি রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। এই বিষয় নিয়ে অন্য একটি নিবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

উচ্চ রক্তচাপের পরিণতি নিয়ে যেমন বিভ্রান্তি ছড়িয়ে আছে, উচ্চ রক্তচাপের কারণ নিয়েও নানা রকম বিভ্রান্তি ছড়িয়ে আছে। শুধু সাধারণ মানুষ নন, অনেক ডাক্তারও মনে করেন, উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হবার একটি প্রধান কারণ লবণ খাওয়া।

‘উচ্চ রক্তচাপে যে খাবার বিপজ্জনক’ শিরোনামে দৈনিক দেশ রূপান্তরে ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ তারিখে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদন অবলম্বনে। সেখানে বলা হয়, ‘‘উচ্চ রক্তচাপ থেকে সৃষ্টি হয় হৃদ্রোগ। ঠিক কী কারণে মানবদেহে এই সমস্যাটি দেখা দেয়, তা সঠিকভাবে আজও জানা যায়নি। বলা হয় জেনেটিক কিংবা খাদ্যাভ্যাসই এ জন্য দায়ী। উচ্চ রক্তচাপ একবার ধরা পড়লে ব্যক্তিকে নিয়মিত পরীক্ষার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। বিপদ এড়াতে বাদ দিতে হয় কিছু খাবার।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদন অবলম্বনে এমনই কিছু খাবারের তালিকা দেয়া হলো:

লবণ: উচ্চ রক্তচাপে লবণ মারাত্মক ক্ষতিকর। পাতে লবণ খাওয়াই যাবে না। লবণের হাই—সোডিয়াম লেভেল রক্তের চাপ বাড়িয়ে দেয়। হঠাৎ মৃত্যুঝুঁকি কমাতে হলে পাতে লবণ খাওয়া বাদ দিতেই হবে।’’ [https://www.deshrupantor.com/specially/2019/03/04/126991]

‘উচ্চ রক্তচাপে করণীয়’ শিরোনামে প্রথম আলোয় ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়, যা লিখেছেন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ। সেখানে বলা হয়, ‘‘উচ্চ রক্তচাপ প্রায় একটি স্থায়ী রোগ হিসেবে বিবেচিত। এর জন্য চিকিৎসা ও প্রতিরোধ দুটোই জরুরি। তা না হলে বিভিন্ন জটিলতা, এমনকি হঠাৎ করে মৃত্যুরও ঝুঁকি থাকে।
কী কী কারণে উচ্চ রক্তচাপ হয়?
অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ: খাবার লবণে সোডিয়াম থাকে, যা রক্তের জলীয় অংশ বাড়িয়ে দেয়। ফলে রক্তের আয়তন ও চাপ বেড়ে যায়।’’ [https://www.prothomalo.com/life/health]

এরকম আরো অনেক নিবন্ধ ও প্রতিবেদনে উচ্চ রক্তচাপের আক্রান্ত হবার জন্য লবণকে দায়ী করা হয়েছে। এবার এরকম আরেকটি প্রতিবেদন দেখা যাক।
‘উচ্চ রক্তচাপে অতিরিক্ত লবণ কি ক্ষতিকর’ শিরোনামে দৈনিক জনকন্ঠে ৫ নভেম্বর ২০১৯ তারিখে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। তৈরি করেন ডাঃ মোঃ তৌফিকুর রহমান। সেখানে বলা হয়, ‘‘জনাব কাদের ৬০ বছর বয়স উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন গত ৭ বছর ধরে। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য তিনি তিনটি রক্তচাপ কমানোর ওষুধ খান, কিন্তু তাতেও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে নেই। উনি জানান যে, খাবারের সঙ্গে অতিরিক্ত লবণ খাওয়া উনার অনেক দিনের অভ্যাস। উনাকে অতিরিক্ত লবণ পরিহার করার পরামর্শ দিলে উনি কিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে চান?
রোগী : রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে অতিরিক্ত লবণের ভূমিকা কি?
ডাঃ মোঃ তৌফিকুর রহমান: অতিরিক্ত লবণ খেলে লবণের সঙ্গে অতিরিক্ত পানি শরীরের রক্তের সঙ্গে যোগ হয়, ফলে রক্তের আয়তন বাড়ে যা রক্তচাপ বাড়াতে ভূমিকা রাখে।’’ [https://www.dailyjanakantha.com/details/article/458705]

জনাব কাদের খাবারের সঙ্গে অতিরিক্ত লবণ খাওয়া তাঁর অনেক দিনের অভ্যাস হওয়া সত্ত্বেও ৫৩ বছর বয়স পর্যন্ত উচ্চ রক্তচাপ থেকে নিরাপদ ছিলেন। এটা কিভাবে সম্ভব, যদি লবণ খেলে মানুষ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়? তিনি আরো আগে কেন উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হননি? ৫৩ বছর বয়স হওয়া পর্যন্ত লবণ কি তাঁর শরীরের নাগাল পায়নি?

আমার মা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়েছেন ৭—৮ বছর আগে, যখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৬০ বছরের মতো। তিনি এখনো খাবারের সাথে লবণ খান নিয়মিত। আমার বাবা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়েছেন তা—ও ৭—৮ বছর আগে, যখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৭১—৭২ বছরের মতো। তিনিও এখনো খাবারের সাথে লবণ খান নিয়মিত। আমার খুব কাছের এক বন্ধু মনির হোসেন। ৩ বছর আগে তিনি উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হন, যখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৩৬ বছরের মতো। তিনি একদিন আমাকে বললেন, ‘‘মানুষ বলে, লবণ খেলে নাকি উচ্চ রক্তচাপ হয়। আমি খাবারের সাথে লবণ খাই না, তবু কেন উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হলাম!’’
কেউ কি বলতে পারবেন, আমার বাবা—মায়ের লবণ খাওয়ার অভ্যাস থাকা সত্ত্বেও কেন তাঁরা অনেক বছর ধরে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হননি? আমার ওই বন্ধু লবণ না খাওয়া সত্ত্বেও কেন অল্প বয়সেই উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়ে পড়লেন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমি পরিষ্কারভাবে জানি। কিন্তু আপনাকে বিশ^াস করাতে হলে এই লেখা আরো বড় করতে হবে। উত্তরটা আপনিও বলতে পারবেন আপনাকে একটা এক্সপেরিমেন্ট দিলে।
আপনার পরিচিত রিকশাচালকদের মধ্যে কি এমন কেউ আছেন, যিনি এখনো পায়েচালিত রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন? যদি না থাকে, তাহলে কোনো বাজারে বা শহরে গিয়ে এমন কিছু রিকশাচালক খুঁজে নিন, যারা এখনো পায়েচালিত রিকশা চালাচ্ছেন; মোটরচালিত রিকশা চালাচ্ছেন না। এই রকম কিছু রিকশাচালককে জিজ্ঞেস করুন দুইটি প্রশ্ন: (১) আপনি কি উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত? (২) আপনি কি খাবারের সাথে লবণ খান?

এই প্রশ্ন দুইটির মধ্যে প্রথমটির উত্তরে প্রায় সবাই বলবে, তারা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত নয়। শেষটির উত্তরে তাদের অধিকাংশ অথবা সবাই বলবে, তারা খাবারের সাথে নিয়মিত লবণ খেয়ে থাকেন।
কেন এই রকম উত্তর হবে বলে আমি নিশ্চিভাবে বলে দিলাম? কারণ আমি গত কয়েক বছর উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক এই রোগগুলো এবং এগুলো আক্রান্ত অসংখ্য রোগীর উপর গভীর পর্যবেক্ষণের পর দেখেছি, এই রোগগুলোতে তারাই বেশি বেশি আক্রান্ত হয়, যারা আরামে থাকে, বেশি খায়, বেশি ঘুমায় এবং যাদের ওজন বেশি। অন্যদিকে যারা নিয়মিত হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের কাজ করে, তারা এই রোগগুলো থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকে, বয়স যত বেশিই হোক; ধূমপান করুক বা না করুক; খাবারের সাথে লবণ খাওয়ার অভ্যাস থাক বা না থাক; চিনি/মিষ্টি বেশি খাক বা কম খাক।

যে লোকগুলো নিয়মিত কায়িক শ্রম করে, তারা যত লবণই খাক না কেন, উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয় না। আমার বাবা—মা উচ্চ রক্তচাপে তখনই আক্রান্ত হয়েছেন, যখন শারীরিক পরিশ্রমের কাজ থেকে পুরো অবসরে চলে গেছেন। এমন যদি হতো, তারা আগে লবণ খেতেন না, পরে লবণ খাওয়া শুরু করার পর উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়েছেন, তাহলে লবণ খাওয়াকে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হবার কারণ বলে নিশ্চিত হওয়া যেতো। আমার ঐ বন্ধু আগে ১০ কিলোমিটার দূরের একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতো। নিয়মিত সাইকেলে যাতায়াত করতো। দৈনিক ২০ কিলোমিটার সাইক্লিং হতো। তখন তাঁর উচ্চ রক্তচাপ হয়নি ভুলেও। তখনও তিনি লবণ খেতেন না। কিন্তু পরে যখন তাঁর বাড়ির একেবারে কাছের এক স্কুলে বদলি হয়ে চলে আসেন, তখন তাঁর সাইক্লিং বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে তিনি উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। যদি এমন হতো, তিনি আগের বিদ্যালয়ে থাকাকালীন নিয়মিত সাইক্লিং করা সত্ত্বেও উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হতেন, তাহলে কায়িক শ্রমকে উচ্চ রক্তচাপের প্রতিরোধক বলার সুযোগ থাকতো না। যদি এমন হতো, তিনি আগে লবণ খেতেন না, পরে লবণ খাওয়া শুরুর পর উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হতেন, তাহলে লবণ খাওয়াকে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হবার কারণ বলে চিহ্নিত করার সুযোগ হতো।

আমার বিশ^াস, জনাব কাদেরও আগে কায়িক শ্রমে বেশি সময় দিতেন। পরে কায়িক শ্রমে সময় কমিয়ে দেয়ার কারণে তিনি উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। লবণ খেলে যদি মানুষ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হতো, তাহলে তিনি আরো আগেই উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়ে পড়তেন, সন্দেহ নেই।
আমি অনুরোধ করছি, আপনি আপনার পরিচিত ঐসব লোকের খোঁজ নিন, যারা ২০—৩০ বছরের বেশি সময় ধরে নিজের জমিতে বা পরের জমিতে কৃষিকাজ করে আসছে নিয়মিত, দেখবেন, (১) তারা কেউই উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত নন এবং (২) তাদের অধিকাংশই খাবারের সাথে লবণ খেয়ে থাকেন। এই দুইটি সত্য আপনার সামনে স্পষ্ট হলে আপনি নিশ্চিত হবেন, উচ্চ রক্তচাপের কারণ হিসেবে শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা ব্যতীত আর যা কিছু প্রচার করা হয়, সবই মনগড়া ও ভিত্তিহীন।

এখন প্রশ্ন হলো, লবণ খেলে মানুষ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়, এই ধারণা সমাজে কিভাবে সৃষ্টি হলো? একমাত্র কারণ হলো, উচ্চ রক্তচাপের কারণ নিয়ে এখনো নিবিড়ভাবে কোনো গবেষণা হয়নি বলেই একেক জন একেক কারণকে উচ্চ রক্তচাপের জন্য দায়ী বলে ভাবছেন। অনেক ডাক্তার এমনও মন্তব্য করেন, উচ্চ রক্তচাপের কোনো কারণ এখনো পরিষ্কার নয়। ‘উচ্চ রক্তচাপে করণীয়’ শিরোনামে দৈনিক যুগান্তরে ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, ‘‘৯০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের কোনো নির্দিষ্ট কারণ জানা যায় না, একে প্রাইমারি বা অ্যাসেন্সিয়াল রক্তচাপ বলে।’’ [https://www.jugantor.com/todays-paper/features/stay-well/18520]

আপনি শুধুই কায়িক শ্রম করা না করার সাথে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়া না হওয়ার সম্পর্ক নিয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে নিশ্চিত হবেন, উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হবার সাথে কায়িক শ্রম না করার সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি। সাথে আছে বেশি খাওয়া বা মনের চাহিদামতো খাওয়া, ওজন বেশি হওয়া ইত্যাদি। এই তিনটি কারণ ছাড়া যতো কারণকে উচ্চ রক্তচাপের জন্য দায়ী করা হয়, বাস্তবতার সাথে সেগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই, এগুলো সমাজে শুধু বিভ্রান্তিই ছড়াচ্ছে।

১১. টেনশন আপনার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না, যদি শরীরে চর্বি জমতে না দেন

টেনশন নিয়ে বর্তমান সময়ের মানুষ সত্যিই টেনশনে আছে। কারণ (১) বিগত কয়েক দশক ধরে মানুষ নতুন করে কিছু রোগে ব্যাপকহারে আক্রান্ত হতে শুরু করেছে এবং (২) নানা দিক থেকে প্রচার করা হচ্ছে, এই রোগগুলোতে আক্রান্ত হবার প্রধান কারণ টেনশন। এইজন্যই টেনশন নিয়ে মানুষ এখন অতিরিক্ত মাত্রায় টেনশনে আছে।
আমার পরিচিত অনেক মানুষের মুখে প্রায়ই শুনি, টেনশনে নাকি মানুষ হাই ব্লাড প্রেশারে এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। আর শৈশব কাল থেকে শুনে আসছি, শুধু টেনশনেই নাকি মানুষ হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়। শৈশব থেকে মানুষের মুখে শোনা হার্ট অ্যাটাকের এই কারণকে সঠিক বলেই মনে হতো। একটা সময় ছিল আমি নিজেও নিজের টেনশন নিয়ে টেনশন করতাম।
কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে টেনশন নিয়ে আমার কোনো টেনশন নেই। কারণ উপরে উল্লেখিত তিনটি রোগ হাই ব্লাড প্রেশার, ডায়াবেটিস এবং হার্ট অ্যাটাক নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে গভীরভাবে ভাবনা, অধ্যয়ন, পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা করতে গিয়ে আমার নিকট পরিষ্কার হয়, এই তিনটি রোগে আক্রান্ত হবার জন্য টেনশন কোনোভাবেই দায়ী নয়। টেনশনকে অকারণেই এই তিনটি রোগে আক্রান্ত হবার জন্য দায়ী করা হচ্ছে। তবে হ্যাঁ, যারা অন্য কারণে এই রোগগুলোতে আক্রান্ত, টেনশন করলে তাদের রোগগুলো তীব্র হতে পারে শুধু।

আমাদের এলাকায় আমার পরিচিত ৮—১০ জন লোক আছেন, যারা নিজের এবং অন্যের জমিতে কৃষিকাজ করে যাচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরে। এদের বয়স ৪৫ বছর থেকে ৭০ বছরের মধ্যে। এই লোকগুলোর মধ্যে অনেকের ব্যক্তিগত অনেক বিষয় নিয়ে নানান টেনশন আছে বলেও আমার জানা আছে। কিন্তু এদের কারো প্রেশার হাই নয়, এরা কেউ ডায়াবেটিসেও আক্রান্ত নয়, হৃদরোগেও (হার্ট অ্যাটাক) নয়। অথচ আমার পরিচিতজনদের মধ্যেই এই লোকগুলোর চেয়ে বয়সে অনেক ছোট অসংখ্য মানুষ এই তিনটি রোগের এক বা একাধিকটিতে আক্রান্ত আছেন।

তবে আমি কাউকে বলছি না, আমার পরিচিত এই লোকগুলো সম্পর্কে আমার দেয়া বক্তব্য বিশ^াস করতে। আমি সবাইকে অনুরোধ করছি, আপনি আপনার পরিচিত যারা শারীরিক শ্রমনির্ভর কোনো না কোনো কাজে কর্মরত আছে অনেক বছর ধরে, তাদেরকে চিহ্নিত করুন, তাদের খোঁজ নিন, আপনি অবাক হয়ে দেখবেন, তারা (১) কেউই উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ এই তিনটি রোগের কোনোটিতেই আক্রান্ত নন এবং (২) তাদের অনেকের জীবনে নানান টেনশন রয়েছে।

আজ থেকে ৪০—৫০ বছর আগে, মানুষের জীবনে অভাব বেশি ছিল। মানুষের জীবনে নানা রকম টেনশনও ছিল এখনকার চেয়ে বেশি মাত্রায়। কিন্তু তখন মানুষ এই তিনটি রোগে এখনকার চেয়ে অনেক কম হারে আক্রান্ত হতো। কেন? কারণ জীবনের পদে পদে তাদেরকে নানাভাবে শারীরিক পরিশ্রম করতে হতো, আরামে থাকার সুযোগ ছিল তাদের খুব কম। এখনকার মতো আরামের পেশা তখন খুব কম ছিল। মানুষ যা—ই খেতো, হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের কারণে সেগুলো থেকে আহরিত শক্তি খরচ হয়ে যেতো। মানুষের শরীরে চর্বি বৃদ্ধি পেতো খুবই কম। অধিকাংশ মানুষ নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করার কারণে এবং তাদের শরীরে বাড়তি চর্বি না হবার কারণে এই রোগগুলো তাদেরকে আক্রমণ করার সুযোগই পেতো না। কোনো কোনো মানুষ শেষ বয়সে সাংসারিক সব কাজ থেকে একেবারে অবসরে চলে গেলে এই রোগগুলোতে আক্রান্ত হতো।

কিন্তু এখন মানুষ অল্প বয়সেই আরামের জীবন যাপন করতে শুরু করে। অধিকাংশ মানুষের জন্য শারীরিক পরিশ্রম করাটা ঐচ্ছিক বিষয়ে পরিণত হয়ে গেছে। মানুষ আরামপ্রিয় হয়ে যাবার কারণে শারীরিক পরিশ্রমকে যথাসাধ্য অগ্রাহ্য করছে। বহুতল ভবনে উপরের ফ্লোরে উঠতে সিঁড়ির পরিবর্তে লিফট বা এস্কেলেটর ব্যবহার করছে। বাইসাইকেলের পরিবর্তে মোটরসাইকেল ব্যবহার করছে। সামান্য দূরত্বে অবস্থিত অফিসে হেঁটে না গিয়ে গাড়ি ব্যবহার করছে। বাজারের ব্যাগটি হাতে বহন করে বাসায় আনতে অনীহা পোষন করছে। কৃষিজমি থাকলেও সেগুলো ফেলে রাখছে অথবা সেগুলোতে নিজে কাজ না করে অন্য লোক দিয়ে কাজ করাচ্ছে। পায়েচালিত রিকশা বাদ দিয়ে মোটরচালিত রিকশা চালাচ্ছে। মানুষ মনমতো খেতে পারছে, খাচ্ছেও। শরীরে শক্তি জমা করছেই শুধু, কিন্তু সেগুলো খরচ করছে একেবারে কম।

আরামে জীবন যাপনের এই প্রবণতা মানুষের শরীরে চর্বির উপর চর্বি জমা করছে। যেগুলো ক্ষয়ের (বার্ণ) সুযোগ দিচ্ছে না। শরীরে এভাবে বছরের পর বছর ধরে চর্বি জমা হয়ে সেই চর্বির মধ্যেই জন্ম নিচ্ছে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ।

মানুষ এই বিষয়টা ভালোভাবে লক্ষ্য না করে ভাসা ভাসা পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে এই তিনটি রোগের জন্য অবাস্তব সব কারণকে দোষারোপ করছে। সেই কারণগুলোর একটি হচ্ছে টেনশন।
আপনার পরিচিত যেই লোকগুলো এখনো পায়েচালিত রিকশা চালায়, খোঁজ নিয়ে দেখুন তো, দেখবেন, তাদের অনেকের টেনশনের মাত্রা আপনার চেয়ে বেশি। তবু তারা এই তিনটি রোগের কোনোটিতেই আক্রান্ত হচ্ছে না। শুধু এরকম একটি পর্যবেক্ষণই আপনাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে, টেনশনে এসব কোনো রোগ হয় না, এসব রোগ হয় আরামপ্রিয় হবার কারণে, শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকার কারণে।

একজন লোকের জীবনে টেনশন খুব কম থাকলেও যদি সে আরামে থাকতে অভ্যস্থ হয়, সময়ের ব্যবধানে সে নিশ্চিতভাবে এসব রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে যারা শারীরিক পরিশ্রমের পেশায় নিয়োজিত, তাদের জীবনে টেনশনের অসংখ্য বিষয় থাকলেও তারা এসব রোগে কোনোভাবে আক্রান্ত হয় না, বয়স যতোই হোক না কেন।

টেনশনকে স্ট্রোকের জন্যও দায়ী করা হয়। আপনি আপনার পরিচিত টেনশনে ভোগা ১০ জন মানুষ খুঁজে নিন, দেখবেন তারা কেউই এখনো স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়নি। আপনার জীবনেও হয়তো অনেক টেনশন আছে। কিন্তু আপনি এই পর্যন্ত কয়বার স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন, নিজেকে জিজ্ঞেস করুন। আমি ২০০১ সাল থেকে বেশ কয়েক বছর কিছু বিষয় নিয়ে চরম টেনশনে ভুগেছি। আমার তো বেশ কয়েকবার স্ট্রোক হবার কথা! মূলত স্ট্রোকের কোনো কারণই এখনো পরিষ্কার নয়। একজন মানুষ টেনশন না করলেও স্ট্রোকে আক্রান্ত হতে পারে, টেনশন করলেও। তবে টেনশন কখনোই ভালো নয়। কারণ টেনশন মানুষের মনকে অস্থির করে রাখে। টেনশনে অনেকে আত্মহত্যাও করে বসে। তাই বলে টেনশনকে এমন সব রোগের পেছনে দায়ী বলে প্রচার করাটা কোনোভাবেই উচিত নয়, যেগুলো টেনশনে নয়, অন্য কারণে হয়। এভাবে যারা টেনশনকে দায়ী করে, তারা মানুষকে নতুন টেনশনে ফেলার জন্য অবশ্যই দায়ী।


১২. বয়স বেশি হলে কি মানুষ এমনিতেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়?

ডায়াবেটিসের কারণ নিয়ে বিশ^ব্যাপী অসংখ্য বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচারিত হচ্ছে। সেগুলোর একটি হলো বয়স বেশি হওয়া। বয়স বেশি হলে মানুষ নাকি এমনিতেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে, অন্য কোনো কারণ লাগে না। এমন তথ্য ডাক্তাররাই বেশি প্রচার করেন।
‘ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করবেন যেভাবে’ শিরোনামে দৈনিক যুগান্তরে ২৮ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে লেখক ডা. এ হাসনাত শাহীন বলেন, ‘‘ডায়াবেটিস যেহেতু অসংক্রামক ব্যাধি তাই এর সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ জানা যায়নি। তবে পারিবারিক ইতিহাস, অধিক মাত্রায় খাদ্যগ্রহণ, কায়িক শ্রমের ঘাটতি, শরীরের অতিরিক্ত ওজন, পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়স, রক্তে ক্ষতিকর চর্বি বেড়ে যাওয়া, গর্ভাবস্থা, অতিরিক্ত মানসিক চাপ, বিষন্নতা তথা সার্বিক জীবনযাপনের ধরনের সঙ্গে ডায়াবেটিসের যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া গিয়েছে।’’ [https://www.jugantor.com/lifestyle/12123]

‘নীরব ঘাতক ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে করণীয়’ শিরোনামে দৈনিক যুগান্তরে ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ তারিখে একটি নিবন্ধ লিখেন সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির চিফ কো—অর্ডিনেটর ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ। সেখানে বলা হয়, ‘‘যাদের বংশে রক্ত—সম্পর্কযুক্ত আত্মীয়স্বজনের ডায়াবেটিস আছে, যাদের ওজন খুব বেশি, যাদের বয়স ৪০—এর ওপর এবং যারা শরীরচর্চা করেন না— গাড়ি চড়েন এবং বসে থেকে অফিসের কাজকর্মে ব্যস্ত থাকেন, তাদের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।’’ [https://www.jugantor.com/lifestyle/149822]

এই রকম আরো অনেক নিবন্ধ—প্রতিবেদন আছে, যেগুলোতে দাবি করা হয়, বয়স বেশি হওয়াও নাকি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার একটি কারণ। ডাক্তাররাই যখন এমন বক্তব্য দিয়ে থাকেন, মানুষ বিশ^াস না করে, না মেনে যাবে কোথায়! কিন্তু এরকম মনগড়া বক্তব্য আমাদের কত ক্ষতি করছে, তা জানলে হতাশ হওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।
উপরের দু’টি নিবন্ধের একটিতে বলা হয়েছে, পঞ্চাশোর্ধ বয়স হওয়া ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার একটি কারণ, অন্যটিতে বলা হয়েছে, ৪০—এর ওপর হওয়া ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার একটি কারণ। কিন্তু কোন বক্তব্যটি সঠিক? কোন বক্তব্য সঠিক, কোন বক্তব্য সঠিক নয়, সেই বিতর্কে না গিয়ে আমরা এই সম্পর্কিত আরো দু’টি নিবন্ধ দেখি।
‘ডায়াবেটিস সম্পর্কে প্রচলিত কিছু ভুল ধারণা’ শিরোনামে দৈনিক যুগান্তরে ২১ নভেম্বর ২০২০ তারিখে প্রকাশিত নিবন্ধে লেখক ডা. ফাহিম আহমেদ রুপম বলেন, ‘‘ডায়াবেটিস সম্পর্কে প্রচলিত কিছু ভুল ধারণা রয়েছে। আসুন জেনে সেসব সম্পর্কে—
১. অনেকের ধারণা রয়েছে ডায়াবেটিস শুধু বৃদ্ধ বয়সে হয়। কিন্তু ডায়াবেটিস যে কোনো বয়সের মানুষের হতে পারে।
২. দীর্ঘদিন ডায়াবেটিসের ওষুধ খেলে বৃক্ক নষ্ট হয় বলে অনেকে মনে করেন। রক্ত পরীক্ষার ফলাফল স্বাভাবিক আসলে অসংখ্য ডায়াবেটিস রোগী এই রোগের জন্য দেয়া ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দেন।  এমনটি মোটেও ঠিক নয়। 
৩. আমরা মনে করি যারা মিষ্টি বেশি খায়, তাদেরই শুধু ডায়াবেটিস হয়। বর্তমান যুগের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা বিবেচনা করলে আমাদের প্রত্যেকেরই কম বেশি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়া ঝুঁকি আছে। আর ডায়াবেটিসের জন্য যে শুধু চিনিই দায়ী তা কখনই নয়।...’’ [https://www.jugantor.com/lifestyle/366846]
 
‘ডায়াবেটিসের ঝুঁকি সম্পর্কে যেসব জানা জরুরি’ শিরোনামে বিবিসি বাংলায় ১৩ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘‘সাধারণত মধ্যবয়সী বা বৃদ্ধ ব্যক্তিরা টাইপ টু ধরনের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। বয়স কম হওয়া সত্ত্বেও যাদের ওজন বেশি এবং যাদেরকে বেশিরভাগ সময় বসে বসে কাজ করতে হয় তাদেরও এই ধরনের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ’’ [https://www.bbc.com/bengali/news-46194839]

এই দু’টি নিবন্ধ—প্রতিবেদন নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করেছে নিশ্চয়ই। কারণ কেউ বলছেন, বয়স বেশি হওয়া ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার একটি কারণ, আবার কেউ বলছেন, ডায়াবেটিস যে কোনো বয়সের মানুষের হতে পারে। এবার কী করতে হবে? কোন ধরনের বক্তব্য মানতে হবে, বিশ^াস করতে হবে?

এই জটিল সমস্যার সমাধানের জন্য চলুন একটি পর্যবেক্ষণ হয়ে যাক। প্রথমে আমাদের পরিচিত এমন কিছু লোক খুঁজে বের করি, যারা ৩০—৩৫ বছর বয়সে এসেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। এরপর আমাদের পরিচিত এমন কিছু লোক খুঁজে বের করি, যারা ৬০—৭০ বছর বয়সেও ডায়াবেটিস থেকে মুক্ত। আমরা দেখতে পাবো, প্রথম শ্রেণির মানুষগুলো আরামের পেশায় নিয়োজিত আর পরের শ্রেণির মানুষগুলো শারীরিক পরিশ্রমের কোনো পেশায় নিয়োজিত। আমি নিজে সারাক্ষণ এই রকম পর্যবেক্ষণের উপর থাকি। এই পর্যবেক্ষণ আমাদের নিকট পরিষ্কার করবে (১) মানুষ শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে সরে গেলে, আরামে আরামে জীবন যাপনে অভ্যস্থ হয়ে গেলে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। বয়স বেশি বা কম হবার সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। ১০—১৫ বছর বয়সেও এখন অনেকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে শুধুই আরামে আরামে থাকার কারণে, বেশি খাওয়ার কারণে, স্থূল হয়ে যাবার কারণে। (২) মানুষ শারীরিক পরিশ্রমে লিপ্ত থাকলে, সারাক্ষণ আরামে আরামে না থাকলে বয়স বেশি হয়ে গেলেও ডায়াবেটিস মানুষকে স্পর্শ করতে পারে না। এই জন্যই শেষের শেষ প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘‘বয়স কম হওয়া সত্ত্বেও যাদের ওজন বেশি এবং যাদেরকে বেশিরভাগ সময় বসে বসে কাজ করতে হয় তাদেরও এই ধরনের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।’’ শেষের প্রথম নিবন্ধে বলা হয়, ‘‘ডায়াবেটিস যে কোনো বয়সের মানুষের হতে পারে।’’ এবং এটাই সত্যের একেবারে কাছাকাছি।

ডায়াবেটিসকে বয়সের সাথে সম্পর্কিত না করে সম্পর্কিত করতে হবে শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরের থাকার সাথে, তাহলেই মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার সঠিক কারণ এবং ডায়াবেটিস প্রতিরোধের সঠিক উপায় সম্পর্কে অবগত হবে, সচেতন হবে।


১৩. রোগমুক্ত জীবনের জন্য হাঁটা

প্রকাশ: দৈনিক নয়াদিগন্ত, প্রকাশের সময়: ২৯ জানুয়ারি ২০১৯

স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে একদিন আলোচনা প্রসঙ্গে ডায়াবেটিসের কথা ওঠে আসে। শিক্ষার্থীরা সবাই ডায়াবেটিস সম্পর্কে কমবেশি জানে। ১০ বছর বয়সী শিশুরাও ডায়াবেটিস সম্পর্কে অনেক কিছু জানে। কারণ, প্রায় প্রতিটি ঘরে কেউ না কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।
শুধু বাংলাদেশই নয়, সারাবিশ্বে এখন ডায়াবেটিসে লাখ লাখ আক্রান্ত হচ্ছে। ১৮ মার্চ ২০১৮ বিবিসি বাংলায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়Ñ ‘কাতারের মানুষের ওজন বেশি হয় কেন?’ শিরোনামে। সেখানে বলা হয়, ‘কাতারে প্রতি দশজনে সাতজনই স্থূলকায় এবং পাঁচজনে একজন ডায়াবেটিসে ভুগছেন।’
‘মধ্যপ্রাচ্যে মুটিয়ে যাচ্ছে মানুষ’ শিরোনামে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ২৭ মার্চ ২০১৫ প্রথম আলোয়। সেখানে বলা হয়, ‘গবেষকেরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ করে উপসাগরীয় অঞ্চল, যেমন—কুয়েত, সৌদি আরব, বাহরাইন, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে স্থূলতা ও ডায়াবেটিসের হার বেড়ে গেছে।
আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন (আইডিএফ) জানিয়েছে, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় তিন কোটি ৭০ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসের সমস্যায় ভুগছে, যা এ এলাকার মোট জনসংখ্যার নয় দশমিক সাত শতাংশ। অবশ্য ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রেই ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা হয় না। আইডিএফের বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আগামী দুই দশকে মধ্যপ্রাচ্যে ডায়াবেটিসের হার দ্বিগুণ হয়ে যাবে। পৃথিবীতে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারায় ডায়াবেটিসজনিত জটিলতায়।

আরেকটা রোগ এখন সমাজে আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হলো হার্ট অ্যাটাক বা হৃদরোগ। রোগটিতে এখন অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে।

পরিসংখ্যান মতে, বর্তমান বিশ্বে মানুষের মৃত্যুর ৩১ শতাংশই হচ্ছে হার্ট অ্যাটাক বা হৃদরোগে। ‘বছরে হৃদরোগে পৌনে দুই কোটি মানুষের মৃত্যু’ শিরোনামে দৈনিক যুগান্তরে ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বিশ্বে প্রতি বছর ১৭ দশমিক ৫ মিলিয়ন বা পৌনে দুই কোটি মানুষের মৃত্যু ঘটে হৃদরোগে। ৩০—৭০ বছর বয়সী মানুষের প্রতি ১০ জনে একজন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারায়। পৃথিবীর মোট মৃত্যুর ৩১ শতাংশ হয় হৃদরোগে। এ ছাড়া অল্প বয়সে মৃত্যুর ৮০ শতাংশ কারণও হৃদরোগ। এ তথ্য ওয়ার্ল্ড হার্ট ফেডারেশনের।’

আরেকটা মারাত্মক রোগ, যা মানুষের স্বাভাবিক জীবন বিপন্ন করছে, তা উচ্চ রক্তচাপ। রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে মানুষ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। ‘উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত ২৫ শতাংশ, বছরে মৃত্যু ৭০ লাখ মানুষের’ শিরোনামে ১৭ মে ২০১৫ দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘রোগের নাম উচ্চ রক্তচাপ। রোগটি আজ বিশ্বব্যাপী নীরব ঘাতক হিসেবে চিহ্নিত। উচ্চ রক্তচাপে হার্ট অ্যাটাক, ব্রেন স্ট্রোক, হৃদরোগ, কিডনি বিকল এবং অন্ধত্ববরণের শিকার হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিশ্বে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে শতকরা ২০ থেকে ২৫ শতাংশ আক্রান্ত হচ্ছে উচ্চ রক্তচাপে। সারা বিশ্বে প্রায় দেড় শ’ কোটি লোক উচ্চ রক্তচাপের শিকার এবং প্রতি বছর এ রোগে মারা যায় প্রায় ৭০ লাখ মানুষ।’

এই তিনটি রোগ একই সূত্রে গাঁথা। রোগ তিনটি সম্পর্কে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত ডাক্তারদের লেখায় অনেক কারণ উল্লেখ করা হয়। বলা হয় চর্বিজাতীয় খাবার বেশি খেলে, মিষ্টি বা চিনি বেশি খেলে রোগগুলো আক্রমণ করে, বংশগতভাবেও নাকি এগুলো অনেকের হয়ে থাকে, বয়স বাড়ার সাথেও রোগগুলোর সম্পর্ক রয়েছে, টেনশন করলেও রোগগুলোতে মানুষ আক্রান্ত হয়, ধূমপান বা মদপান করলেও রোগগুলো হয়। ফাস্টফুড বা জাঙ্কফুড বেশি খাওয়াও রোগগুলোতে আক্রান্ত হওয়ার একটা কারণ ইত্যাদি।

পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রমই মানুষকে এসব রোগ থেকে অনেকাংশে মুক্ত রাখতে পারে। যারা শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করেন, তারা রোগগুলোতে আক্রান্ত হচ্ছেন। যারা রোগগুলোতে আক্রান্ত, তাদের খোঁজ নিলে দেখা যাবে, রোগগুলোতে আক্রান্ত হওয়ার আগে তারা শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকতেন। আর ওই সব লোকই রোগগুলো থেকে নিরাপদ আছেন, যারা শারীরিক পরিশ্রমের কোনো না কোনো কাজ করেন।

প্রতিরক্ষা বাহিনীতে কর্মরত যারা নিয়মিত পর্যাপ্ত ব্যায়াম করেন, তারা সাধারণত এই তিনটি রোগে আক্রান্ত হন না। যারা রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন, তাদের খুব কমই এসব রোগে আক্রান্ত হন।

পাশ্চাত্যে যেসব মানুষ ফাস্টফুড বা জাঙ্কফুডে আসক্ত হয়ে রোগগুলোতে আক্রান্ত হচ্ছেন বলে মনে করা হয়, তারা শারীরিক পরিশ্রমের সাথে সম্পর্ক রাখেন না। আবার দেখা যায়, যারা ফাস্টফুড বা জাঙ্কফুড খাচ্ছেন, কিন্তু শারীরিক পরিশ্রমও করছেন, তারা এসব রোগ থেকে অনেকটাই নিরাপদ। সুতরাং রোগগুলোর প্রধান কারণ শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা বা পরিমাণে কম করা। শুধু শারীরিক পরিশ্রমই মানুষকে ভয়ঙ্কর এ রোগ তিনটি থেকে বহুলাংশে নিরাপদ রাখতে পারে।

আর কে না জানেন, শারীরিক পরিশ্রমের একটা উপায় হাঁটা। প্রতিদিন যে কোনোভাবে অন্তত এক ঘণ্টা হাঁটলে এসব রোগ থেকে বেঁচে থাকা যেতে পারে। যারা অন্য কোনো উপায়ে শারীরিক পরিশ্রম করতে পারেন, তারা বেশি বেশি না হাঁটলেও চলে। তবে অন্য কোনো উপায়ে শারীরিক পরিশ্রমের সুযোগ না থাকলে, হাঁটার কোনো বিকল্প নেই। হাঁটা একটি সহজ ব্যায়াম। এতে কোনো খরচও নেই, বিরক্তিও আসে কম, শুধু সময় খরচ হয়। বেশি বেশি হাঁটুন, রোগমুক্ত জীবন পেতে সহজ হবে। [নয়াদিগন্তের লিঙ্ক: https://www.dailynayadiganta.com/Muktokolom/384034]






১৪. টেনশনে মানুষ কী কী রোগে আক্রান্ত হয়?

টেনশনে অনেক রোগ হয় বলেই আমরা মনে করি। আমাদের কাছের কেউ কোনো বিষয় নিয়ে মানসিক অস্থিরতায় ভুগলে আমরা তাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে যাই। ভাবি, সে মারাত্মক কোনো রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে কিনা! মানসিক অস্থিরতায় ভোগা মানুষ নিজেও দুশ্চিন্তায় থাকেন, কখন কোনো রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। মানসিক অস্থিরতাকে সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয় ব্রেইন স্ট্রোকের জন্য। হার্ট অ্যাটাকের জন্যও মানসিক অস্থিরতাকে একচেটিয়াভাবে দায়ী করা হয়।
টেনশন বা মানসিক অস্থিরতাকে যারা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হবার জন্য দায়ী বলে মনে করেন, তারা নিচের ১৭ শ্রেণির মানুষের দিকে একবার লক্ষ্য করুন।

* যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামী, ফাঁসির আসামী, কোনো মামলায় অন্যায়ভাবে ফেঁসে যাওয়া নিরীহ মানুষ।* প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাশেষে চাকরির পেছনে ছোটা বেকার যুবক।
* শারীরিক বা মানসিক সমস্যাগ্রস্থ সন্তানের বাবা—মা বা অভিভাবক।
* নিরীহ বিধবা অথবা বয়স্ক মানুষ, যাকে দেখাশোনা করার মতো তেমন কেউ নেই।
* বিবাহ—বিচ্ছেদের শিকার নারী, যার অন্য কোথাও বিয়ে হচ্ছে না।
* বিবাহ—বিচ্ছেদের শিকার মধ্যবয়সী নারী, সন্তানের দিকে তাকিয়ে যে নারী পুণর্বিবাহে সম্মত নয়।
* অভাবী, ঋণগ্রস্থ বা সাংসারিক টানাপোড়েনে সর্বদা জর্জরিত মানুষ।
* মধ্যবয়সে, যখন চাকরিতে প্রবেশের বয়স থাকে না, তখন কোনো কারণে চাকরিচ্যুত মানুষ।
* ব্যবসায় লোকসান হয়ে বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুণ লেগে সর্বস্ব হারানো মানুষ; শেয়ারবাজারে দেউলিয়া হওয়া মানুষ।
* বেশি বেশি দাম্পত্য কলহে লিপ্ত দম্পতি।
* জায়গাজমি বিক্রয় করে বা ঋণ নিয়ে বিদেশ গিয়ে দুর্ভাগ্যবশত দেশে ফেরত আসা মুানষ।
* দুরারোগ্য বা অনিরাময়যোগ্য কোনো ব্যাধিতে (ক্যান্সার, পক্ষাঘাত ইত্যাদি) আক্রান্ত মানুষ।
* নিঃসন্তান, একমাত্র ছেলে বা সন্তানহারা দম্পতি, যাদের আর সন্তান গ্রহণের সুযোগ নেই।
* কন্যাদায়গ্রস্থ অভিভাবক, অনেক বয়স হয়ে যাবার পরও বিয়ে হচ্ছে না, এমন মেয়ে।
* মর্মান্তিক কোনো দুর্ঘটনায় পরিবারের একাধিক প্রিয়জনহারা মানুষ।
* কোনো দুর্ঘটনার শিকার হয়ে বা জন্মগতভাবে শারীরিক সমস্যাগ্রস্থ মানুষ।
* বড় ধরণের কোনো প্রতারণার শিকার হওয়া মানুষ; জায়গাজমি নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে সারাক্ষণ ঝগড়া—দ্বন্দে জড়িয়ে থাকা মানুষ।

এই ১৭ শ্রেণির মানুষ, যারা পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে এরকম কোনো সমস্যায় ভুগছেন, তাদের জীবনে টেনশনের মাত্রা কেমন, তা যারা এইরকম সমস্যায় ভুগছেন, তারা ছাড়া কেউ উপলব্ধি করতে পারবেন না। তবে যাদের আশেপাশে এমন মানুষ আছেন, তারা কিছুটা হলেও টের পান।

এই ১৭ শ্রেণির এক হাজার (১০০০) জন মানুষের খোঁজ নিলে দেখা যাবে, পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে এরা এভাবে নানা টেনশনে দিন কাটালেও এই এক হাজার জনের মধ্যে চার—পাঁচ জনের বেশি মানুষ ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হননি। হৃদরোগে (হার্ট অ্যাটাক) আক্রান্ত হবার সংখ্যাও খুব বেশি হবে না।
পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে টেনশনে থাকা সত্ত্বেও কেন ৯৫ শতাংশের বেশি মানুষ ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হননি? কারণ ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হবার জন্য টেনশন কোনোভাবেই দায়ী নয়। যদি দায়ী হতো তাহলে পাঁচ বছর ধরে ‘যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামী, ফাঁসির আসামী, কোনো মামলায় অন্যায়ভাবে ফেঁসে যাওয়া নিরীহ মানুষ’রা ব্রেইন স্ট্রোক থেকে কোনোভাবেই নিরাপদ থাকতো না। কারণ উপরে উল্লেখিত এই ১৭ শ্রেণির মধ্যে আর কেউ টেনশন না করলেও কমপক্ষে এই শ্রেণির মানুষ অবশ্যই টেনশনে টেনশনেই প্রতিটা দিন কাটায়। টেনশনে মানুষ ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হলে পাঁচ বছর নয়, কারাগারে যাওয়ার এক বছরের মধ্যেই এরা ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে পড়তো।

ঋণের দায়ে জর্জরিত বা অভাবে অভাবে দিন কাটানো অসংখ্য মানুষ আছেন আমাদের আশেপাশে, যারা বছরের পর বছর ধরে এভাবে অভাবে অভাবে দিন কাটানো সত্ত্বেও ব্রেইন স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হচ্ছেন না। অনেক মানুষ অভাবের তাড়নায় বা ঋন পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যার পথও বেছে নেন। এসব মানুষ আত্মহত্যার আগে নিশ্চিতভাবে ব্রেইন স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হতেন, যদি সত্যিই টেনশনে মানুষ এসব রোগে আক্রান্ত হতো। কিছুদিন আগে ঢাকার ব্যবসায়ী আবু মহসিন খান ১৬ মিনিটের বেশি সময় ধরে ফেসবুক লাইভে ব্যক্তিজীবনের হতাশার কথা বলে মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেন। তিনি নিশ্চয়ই অনেক আগ থেকেই নানা রকম হতাশায় ভুগছিলেন। এরকম হতাশাগ্রস্থ মানুষগুলো ব্রেইন স্ট্রোক এবং হার্ট অ্যাটাক থেকে নিরাপদ থেকে আত্মহত্যার সুযোগ পেতেন না, যদি সত্যিই টেনশনে মানুষ এসব রোগে আক্রান্ত হতো।

আমি একজন লোককে চিনি, যার দুই ছেলে। দুই ছেলের উভয়েই জন্মগতভাবে শারীরিক সমস্যাগ্রস্থ। সেই লোক এবং তার স্ত্রী এখনো ব্রেইন স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হননি। আপনিও দেখবেন আপনার পরিচিত যাদের কোনো সন্তান অনেক আগ থেকে শারীরিক বা মানসিক সমস্যাগ্রস্থ, তারা ব্রেইন স্ট্রোক আক্রান্ত হচ্ছেন না। অথচ এদেরকে নিয়ে এদের বাবা—মায়ের টেনশনের অন্ত নেই। আমার পরিচিত চার—পাঁচ জন লোক আছে মানসিক সমস্যাগ্রস্থ। অথচ তাদের বাবা—মা কেউ ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হননি এখনো! এটা সম্ভব হতো না যদি টেনশনে মানুষ সত্যিই ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হতো!

এই বিষয়গুলোর দিকে তাকালেই স্পষ্ট হবে, টেনশনের সাথে ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হবার কোনো সম্পর্ক নেই।

আপনার পরিচিত যেই লোকগুলো আছেন এই ১৭ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত, আপনি দেখবেন তারা কেউই এখনো ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়নি। অন্যদিকে বিগত ১০ বছরে আপনার পরিচিত যারা ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের মধ্যে এই ১৭ শ্রেণির অন্তভুুর্ক্ত হয়তো কেউ নেই।

মানুষের জীবনে টেনশন থাকেই। অনেকের জীবনে টেনশনের উপলক্ষ্য বেশি, অনেকের জীবনে কম। আমি আমার জীবনের প্রথম ২১ বছরে তেমন কোনো টেনশনে ছিলাম না। কিন্তু শেষ ২১ বছরে বিভিন্ন বিষয়ে এতো বেশি টেনশনে পড়েছি, যদি টেনশনে মানুষ সত্যিই ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হতো, তাহলে আমি এই পর্যন্ত বেশ কয়েকবার ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হতাম!

আমার পরিচিত যারা বিগত কয়েক বছরে ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন, তারা কেউই এই ১৭ শ্রেণির অন্তভুর্ক্ত নন। তাদের জীবনে হয়তো টেনশন ছিল। কিন্তু এমন গুরুতর কোনো টেনশনে কেউই ছিলেন না।

টেনশন একটা নন্দঘোষ। কেউ টেনশন না করা সত্ত্বেও যদি ব্রেইন স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়, তবু সবাই ধরে নেয় সে নিশ্চয়ই টেনশনে ছিল! বিগত কয়েক বছরে আমার পরিচিত অনেক মহিলা ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন। মহিলাদের জীবনে পুরুষদের তুলনায় টেনশন কম। তবু কেন মহিলারা ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন?

ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হবার জন্য ধূমপানকেও দায়ী করা হয়। ধূমপানের সাথে সরাসরি বা অসরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই, বাংলাদেশে এমন অসংখ্য মানুষ ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। বিশেষ করে মহিলারা এবং মাদ্রাসা—শিক্ষিত মানুষরা। ধূমপানে মানুষ ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হলে এই দুই শ্রেণির মানুষও কেন ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়? মহিলা এবং মাদ্রাসা—শিক্ষিত মানুষ ছাড়া অন্য মানুষদের মধ্যে যারা ধূমপান করেন না, তারাও ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। ধূমপানের সাথে ব্রেইন স্ট্রোকের সম্পর্ক এমনভাবে করা হয়, যেন ধূমপান করলে ব্রেইন স্ট্রোক থেকে বাঁচার কোনো সুযোগ—ই নেই। অথচ দেখা যায়, ৩০—৪০ বছর ধরে ধূমপান করেও ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়া ছাড়া অসংখ্য মানুষ পৃথিবী ত্যাগ করেন। এটা কিভাবে সম্ভব হতো, যদি ধূমপানে সত্যিই মানুষ ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হতো! অধূমপায়ী হাজার হাজার ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত মানুষের পাশাপাশি কিছু ধূমপায়ীকেও ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হতে দেখেই ধূমপানের ঘাড়ে ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হবার দোষটা চাপিয়ে দেয়া হয়। এমনভাবে দোষ চাপানো হয়, মনে হয় ধূমপান নামক জিনিসটা পৃথিবীতে না থাকলে শুধু ধূমপায়ীরা নয়, অধূমপায়ীরাও বে্্রইন স্ট্রোক নামক রোগটিতে আক্রান্ত হতো না! ধূমপানকে ব্রেইন স্ট্রোকের জন্য দায়ী করার সুযাগ থাকতো তখন, যখন দেখা যেতো কেবল ধূমপায়ীরাই ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়, অধূমপায়ী কেউ ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয় না।

মূলতঃ আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, যে যা—ই বলুক, ব্রেইন স্ট্রোকের কোনো কারণই এখনো পরিষ্কার নয়। আমরা অকারণে টেনশন এবং ধূমপানকে এই রোগটির জন্য দায়ী বলে মনে করছি। ‘যে কারণে ব্রেইন স্টে্রাক হয়’ শিরোনামে সময় নিউজের ওয়েবসাইটে ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলা হয়, ‘‘অধিক পরিমাণে লবন খাওয়া, চর্বি খাওয়া এবং রক্তে অতিমাত্রায় কোলেস্টেরলের উপস্থিতি অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিকস ও উচ্চ রক্তচাপ স্টে্রাকে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি করে। আমাদের দেশে স্টে্রাকে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে শতকরা ৬০—৭০ ভাগ রোগী অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপের জটিলতা হিসেবে স্টে্রাকে আক্রান্ত হয়ে থাকে। যদিও স্টে্রাকের সঠিক কারণ নির্ণয় করা এখনো সম্ভব হয়নি।’’

এখানে বলা হয়েছে, ‘স্টে্রাকের সঠিক কারণ নির্ণয় করা এখনো সম্ভব হয়নি।’ আশা করি ব্রেইন স্ট্রোকের কারণ নিয়ে মন্তব্য করতে আমরা একটু ভেবেচিন্তে কথা বলবো। নয়তো মানুষ বিভ্রান্ত হবে। অকারণে টেনশনকে ভয় করবে, কোনো বিষয়ে টেনশনে পড়লে মানুষ সব সময় ব্রেইন স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে পড়ার ভয়ে শঙ্কিত থাকবে। পাশাপাশি টেনশন বা ধূমপানকে এই—সেই রোগের কারণ বলে মন্তব্য করতেও আমরা তাড়াহুড়ো করবো না। এতে রোগগুলোর সত্যিকারের কারণ চুপিসারে আমাদের ক্ষতি করবে।
তবে এটা ঠিক, টেনশনে কিছু কিছু মানুষ হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়। সবাই নয়। কেন? যাদের শরীরে চর্বি বা কোলেস্টেরল বেশি, তারা টেনশন করলে তাদের রক্তচাপ বেড়ে গিয়ে তাদের হার্ট ব্লক্ড হয়ে তারা হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়। অন্যদিকে যারা নিয়মিত কায়িক শ্রমের সাথে সম্পর্ক রাখে, তাদের শরীরে চর্বি জমতে পারে না, তাদের প্রেশার সবসময় নরমাল থাকে বলে তাদের জীবনে যতো টেনশনই থাকুক, তারা হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয় না।

কিছুদিন আগে আমি একটি ফার্মেসিতে উপবিষ্ট ছিলাম। আমার পরিচিত একজন লোক এসেছেন তাঁর প্রেশার মাপতে। লোকটি ছিলেন নিয়মিত কায়িক শ্রমে নিযুক্ত একজন মানুষ। ফার্মাসিস্ট তার প্রেশার মাপতে গিয়ে আগাম বলে দিলেন, তার প্রেশার হবে লো। শেষে তা—ই হলো।

আমার বিগত কয়েক বছরের জীবনে আমি নানা টেনশনে দিন কাটিয়েছি। করোনার দুই বছর তো টেনশনে টেনশনেই ছিলাম। একবার শরীরে এলার্জিজাতীয় একটি সমস্যা দেখা দেয়ায় ডাক্তারের কাছে গেলাম। ডাক্তার প্রেশার মেপে দেখলেন আমার প্রেশার লো। আমাকে তিনি এটা—সেটা খাওয়ার পরামর্শ দিলেন। আমি তো জানি, আমি যা—ই খাই না কেন, আমার প্রেশার লো—ই থাকবে। কারণ আমি নিয়মিত কায়িক শ্রমের চেষ্টা করি। এজন্য আমার শরীরে চর্বি জমতে পারছে না।

জার্মানীর জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের (বাংলা) ওয়েবসাইটে ১৪.১০.২০১৭ তারিখে প্রকাশিত ‘ভারতে তরুণ প্রজন্মের পুরুষদের মধ্যে হৃদরোগ বিশ্বে সর্বাধিক’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সব হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ এ বিষয়ে একমত যে, নিয়মিত শরীরচর্চা এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস হৃদরোগ ঠেকানোর অন্যতম উপায়।’

সেখানে আরো বলা হয়, ‘তরুণ প্রজন্মের মধ্যে, অর্থাৎ তিরিশের আশপাশে যাঁদের বয়স, তাঁদের মধ্যে ইদানিং দেখা যাচ্ছে, হৃদরোগের হার ক্রমশই বাড়ছে। এর কারণ কী? হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ দেবব্রত রায় ডয়চে ভেলেকে এই প্রসঙ্গে বললেন, এর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো, লাইফ স্টাইল। কারণ, ছোট থেকেই বাচ্চারা খেলাধুলা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। বাড়ছে ফাস্ট ফুড খাওয়া। এরজন্য মোটা হচ্ছে। ওজন বাড়ছে কিশোর বয়স থেকেই। অল্প অল্প করে রক্তে বাড়ছে শর্করা, বাড়ছে কোলেস্টেরল। এর ফলে ধমনির দেওয়ালে কিছু কিছু খারাপ চর্বি জমা হয়। এবার রক্তে¯্রাতে যদি একটা ঘূর্ণন তৈরি হয়, তখন সেটা ফেটে গেলে তৈরি হয় জমাট বাঁধা একটা রক্তের ঢেলা। সেটা থেকেই হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা। তখন ২৫—৩০ বছর বয়সেই হয় হার্ট অ্যাটাক।’
 

সবশেষে মানসিক চাপের সাথে হার্ট অ্যাটাকের সম্পর্ক নিয়ে বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন উল্লেখ করছি। ১০ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখের বিবিসি বাংলায় ‘মানসিক চাপের সাথে হার্ট অ্যাটাকের সম্পর্ক নেই’ শিরোনামে গবেষণা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ‘একটা সময় মনে করা হতো মানসিক চাপ, অবসাদ কিংবা অসুখী হলে মানুষের মৃত্যু হয়। কারণ মানসিক চাপে থাকলে সেটি হৃদপিন্ডের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং হার্ট অ্যাটাক হয়।
কিন্তু যুক্তরাজ্যের চিকিৎসা বিষয়ক সাময়িকী ল্যানস্যাটে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হচ্ছে অতীতের এই ধারনা ভুল ছিল এবং সেটি মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে।
যুক্তরাজ্য এবং অস্টে্রলিয়ার গবেষকরা গত বারো বছর ধরে যৌথভাবে এই জরিপ চালিয়েছেন।
এই জরিপে উভয় দেশের ১০ লাখ নারীর মতামত নেয়া হয়েছে। এরপর সেটির ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গবেষণায় যে বিষয়টি দেখার চেষ্টা হয়েছে তা হলো— মানুষ কতটা সুখী? সুখী হলেই কি মানুষ বেশি দিন বাঁচে?
যাদের উপর এই গবেষণা চালানো হয়েছে তাদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল— তাদের স্বাস্থ্যগত অবস্থা কেমন? তারা কি সুখী? তাদের মানসিক চাপ কতটা আছে? ইত্যাদি প্রশ্ন।

এই গবেষণা দলের অন্যতম সদস্য এবং অস্টে্রলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক বলছেন, “মানুষ শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকলে অসুখী হয়। কিন্তু অসুখী হলে মানুষ মারা যায় না।” তিনি বলছেন মানুষের মৃত্যুর সাথে অসুখী হবার কোন সরাসরি সম্পর্ক পাওয়া যায়নি।
এই গবেষণা দলের আরেকজন সদস্য এবং যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার রিচার্ড পিটো বলেন, ১০ বছর ধরে গবেষণা চালানোর সময়টিতে তারা লক্ষ্য করেছেন যারা কম ধূমপান করেন তাদের কম বয়সে মারা যাবার সম্ভাবনা দ্বিগুণ।

আর যারা বেশি ধূমপান করেন তাদের কম বয়সে মারা যাবার সম্ভাবনা তিনগুণ। কিন্তু দশ বছর ধরে যারা মানসিক চাপে ভুগছেন কিংবা অসুখী রয়েছেন তারা মারা যাননি।
গবেষক মি: পিটো বলেন, “কিন্তু অনেকেই মনে করে মানসিক চাপে থাকলে কিংবা অসুখী হলে হার্ট এ্যাটাক হয়। এটা সত্য নয়। আসলে অনেক মানুষ এটা ভাবতে পছন্দ করে।”
তবে গবেষকরা বলছেন কেউ যদি শৈশবে অসুখী থাকে তাহলে সেটি তার উপর দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।’
 

 এই গবেষণা প্রতিবেদনে স্পষ্ট করে বলা হয়, ‘অনেকেই মনে করে মানসিক চাপে থাকলে কিংবা অসুখী হলে হার্ট এ্যাটাক হয়। এটা সত্য নয়। আসলে অনেক মানুষ এটা ভাবতে পছন্দ করে।’

হার্ট অ্যাটাকের জন্য মানসিক চাপ যে সরাসরি দায়ী নয়, অন্তত এ কথাটা বিশ্বাস করতে এ গবেষণা প্রতিবেদন সবাইকে সহায়তা করবে। আমরা নিজেরাও আমাদের আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলে পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারবো, সুখী মানুষরাই, বিশেষ করে যেসব সুখী মানুষ সুখে থাকার পাশাপাশি আরামে থাকতেও পছন্দ করে, তারাই বেশি হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়। আর যাদের জীবনে মানসিক অস্থিরতা বেশি, তাদের মধ্যে যারা শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে, শুধু তারাই হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়। অন্যদিকে মানসিক অস্থিরতায় দিন কাটানো সত্ত্বেও যারা নিয়মিত কায়িক শ্রম করে, তারা হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয় না। বিষয়টা হাজার বার যাচাই করা হলেও একই ফল মিলবে। আশা করি হার্ট অ্যাটাকের কারণ সম্পর্কে অনর্থক কোনো কিছুকে দোষারোপ করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা থেকে সবাই সতর্ক হবো।

১৫. মানুষ কখন বংশগতভাবে কোনো রোগে আক্রান্ত হয়?

প্রকাশ: দৈনিক নয়াদিগন্ত, প্রকাশের সময়: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২২

বংশগত রোগ নিয়ে অনেক ভুল ধারণায় আমরা বিশ্বাসী। অনেকেই মনে করেন, বাবা—মা বা পূর্বপুরুষরা যেসব রোগে আক্রান্ত ছিলেন, আমরা সেগুলোতে আক্রান্ত হবার অর্থই হলো আমাদের ওই রোগগুলো কেবলই বংশগত কারণে, অন্য কোনো কারণে নয়। কিন্তু এমন কি হতে পারে না, আমাদের পূর্বপুরুষ যেসব রোগে আক্রান্ত হয়েছেন, সেসব রোগে আমরাও আক্রান্ত হতে পারি, তাদের কাছ থেকে সংক্রমিত হওয়া ছাড়াই? বংশগতভাবে হওয়া—না হওয়ার এই বিষয়টা আমার মনে হয় আমরা কেউই এখনো ভেবে দেখেনি। আমাদের এই এক কেন্দ্রিক চিন্তাধারার বড় কারণ হচ্ছে, বিভিন্ন রোগের সঠিক কারণ সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা। রোগের কারণ সম্পর্কে সঠিক ধারণার অভাবেই আমরা অনেক রোগকে বংশগত বলে ভুল করি। বিভিন্ন গুরুতর রোগের প্রকৃত কারণ সম্পর্কে এখনো বিশ্বব্যাপী মারাত্মক অজ্ঞতা রয়ে গেছে।
আপনি জেনে অবাক হবেন, ধূমপানকে শুধু ক্যান্সার বা ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হবার জন্যেই দায়ী করা হয় না, বরং উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগে আক্রান্ত হবার জন্যেও ধূমপানকে দায়ী করা হয়। কিন্তু বাস্তবে কি এমন হচ্ছে? বাস্তবে দেখা যায়, যারা ধূমপান করেন, তারা যেমন এই সব রোগে আক্রান্ত হন, যারা কখনো ধূমপান করেন না, তারাও অহরহ এইসব রোগে আক্রান্ত হন। ধূমপান হচ্ছে বিশ্বব্যাপী একটা ‘নন্দঘোষ’ বা গিনিপিগ। যেকোনো ধূমপায়ী কোনো রোগে আক্রান্ত হলে, তাকে সিরিয়াসলি বলা হয়, আপনি শুধু ধূমপান করার কারণেই এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। অথচ দেখা যায়, ধূমপান করেন না, এমন অসংখ্য লোকও প্রতিনিয়ত রোগটিতে আক্রান্ত হচ্ছে। ধূমপানে যদি কোনো রোগ হতো, তাহলে কেবল ধূমপায়ীরাই সেই রোগে আক্রান্ত হতো, অধূমপায়ীরা কখনো সেই রোগে আক্রান্ত হতো না। কিন্তু এমন কোনো রোগে কি মানুষ আক্রান্ত হয়, যাতে কেবল ধূমপায়ীরাই আক্রান্ত হয়, অন্যরা নয়? নেই। আপনি—ই বলুন, অধূমপায়ীরা যেই কারণে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়, ধূমপায়ীরাও কি সেই একই কারণে ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে না? অধূমপায়ীরা যেই কারণে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়, ধূমপায়ীরাও কি সেই কারণেই হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হতে পারে না?
আমার পরিচিত ও কাছের অনেক মানুষকে দেখেছি হার্ট অ্যাটাকে (হৃদরোগ) আক্রান্ত হতে, যারা কখনোই ধূমপান করেন না। তারা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন শুধুই শরীরে চর্বি—কোলেস্টেরল বেড়ে যাবার কারণে। আর তাদের শরীরে চর্বি—কোলেস্টেরল বেড়ে যাবার প্রধান কারণ হচ্ছে তাঁরা শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকতেন বেশি। অথচ ধূমপায়ীরাও এই একই কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও তাদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার জন্য প্রথমেই ধূমপানকে দায়ী করা হয়।
এভাবে একতরফা কোনো কিছুকে বিভিন্ন রোগের কারণ বলে দায়ী করার ফলে কী হচ্ছে? রোগগুলোর সঠিক কারণ আমাদের দৃষ্টির বাইরে থেকে যাচ্ছে। যেভাবে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগের সঠিক কারণ এখনো অনেকের দৃষ্টির বাইরে রয়ে গেছে। এই রোগগুলোর জন্য শুধু ধূমপানকে নয় টেনশনকেও দায়ী করা হয়, বংশের কারো থাকাকেও দায়ী করা হয়। কিন্তু বংশের কারো থাকলে সন্তানরাও যে এই রোগে আক্রান্ত হবেই, তা কি অবশ্যম্ভাবী?
এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমাদেরকে আগে জানতে হবে, একটি রোগ কিভাবে বংশগতভাবে হতে পারে?
সন্তান জন্মের সময় এবং মাতৃদুগ্ধ পানের সময় বাবা—মা যেসব রোগে আক্রান্ত থাকেন, কেবল সেই সব রোগ সন্তানের শরীরে সংক্রমিত হতে পারে। এক্ষত্রেও কথা আছে। যেসব রোগ রক্তবাহিত, কেবল সেগুলো একজনের শরীর থেকে আরেকজনের শরীরে সংক্রমিত হতে পারে। যেমন: এলার্জি, ক্যান্সার, বাতব্যথা বা আর্থারাইটিস ইত্যাদি। কিন্তু সন্তান জন্মের সময় এবং মাতৃদুগ্ধ পান শেষ হবার পর বাবা—মা যদি কোনো রোগে আক্রান্ত হন, সেই রোগ সন্তানের শরীরে আপনা—আপনি সংক্রমিত হবার কোনো সুযোগ—ই নেই। তবে শুধু বাবা—মা যদি রোগটিতে আক্রান্ত অবস্থায় কখনো সন্তানকে রক্ত দিয়ে থাকেন, তখনই বাবা—মায়ের শরীর থেকে সন্তানের শরীরে সেই রোগ সংক্রমিত হতে পারে। রক্তদানের মাধ্যমে এই সংক্রমণকে কিন্তু বংশগত বলার সুযোগ নেই। কারণ যদি বাবা—মা কেউ তাদের সন্তানকে রক্ত না দিয়ে সেই রোগে আক্রান্ত অন্য কেউ তাদের সন্তানকে রক্ত দিতো, তাহলেও সন্তান সেই রোগে আক্রান্ত হতো।
কিন্তু বংশগতভাবে আক্রান্ত হবার এই মূল কারণটার দিকে লক্ষ্য না করে যেকোনো রোগকে বংশগত বলে আখ্যায়িত করার একটা মারাত্মক প্রবণতা চতুর্দিকে লক্ষ্য করা হয়। শুধু সাধারণ মানুষ নয়, ডাক্তাররাও মানুষের মধ্যে এই ভুল ধারণা ছড়িয়ে দিচ্ছে ব্যাপকহারে। কোনো ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ আক্রান্ত রোগী ডাক্তারের কাছে গেলে ডাক্তার অনেক সময় প্রশ্ন করেন, আপনার বাবা—মা কারো রোগটি ছিল কিনা? রোগী হ্যাঁ বললেই হলো। ডাক্তাররা তার রোগটিকে বংশগত বলে আখ্যায়িত করতে দু’বার ভাবেন না। কিন্তু রোগী হ্যাঁ বলার পর কোনো ডাক্তার কখনো রোগীকে এই পাল্টা প্রশ্নটি করেন না, ‘আপনার জন্মের সময় বা আপনি মাতৃদুগ্ধ পান করার সময় কি তারা রোগটিতে আক্রান্ত ছিলেন?’
এটা বংশগত রোগ সম্পর্কে মানুষের এক ভয়াবহ অজ্ঞতা। এই অজ্ঞতার একটি মারাত্মক ক্ষতিকর দিক রয়েছে। বাস্তবে বংশগত নয়, বরং সম্পূর্ণ প্রতিরোধযোগ্য (যেমন: ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগ), কিন্তু বংশগত বলে প্রচার করা হয়, এমন কোনো রোগে কারো বাবা—মা আক্রান্ত হলে সন্তানরা ভাবে, তাদের বাবা—মা যেহেতু রোগটিতে আক্রান্ত হয়েছে, আমরাও নিশ্চিভাবে রোগটিতে আক্রান্ত হবো। এটা ভেবে তারা রোগটি প্রতিরোধের কোনো চেষ্টা করে না। যার ফলে তারাও একসময় রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু রোগটি যে বংশগত নয়, বরং সম্পূর্ণ প্রতিরোধযোগ্য এটা জানলে তারা রোগটি প্রতিরোধের চেষ্টা করতো এবং প্রতিরোধ করতে সক্ষম হতো।
ডায়াবেটিস, হৃদরোগ বা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে এই ভুল বিশ্বাসগুলোর মূল কারণ হচ্ছে, এই রোগগুলোর মূল কারণ সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা। যে যা—ই বলে, আপনি নিশ্চিত থাকুন, এই রোগগুলোর মূল কারণ শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা। পেছনে ফিরে তাকালে আমরা দেখবো, আমাদের অনেকের বাবা—মাও এক সময় এই সব রোগে আক্রান্ত ছিলেন না। কিন্তু যখন থেকে তাঁরা শারীরিক পরিশ্রমের কাজকর্ম থেকে অবসরে চলে গেছেন, তখন থেকেই তারা রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়েছেন। আমরাও শারীরিক পরিশ্রম করছি না বলেই রোগগুলোতে আক্রান্ত হচ্ছি, সন্দেহ নেই। দেখবেন, যারা এখনো নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করছেন, তারা কেউই রোগগুলোতে আক্রান্ত হচ্ছেন না।
আমরা যদি বিশ্বাস করি, রোগগুলো বংশগত নয়, বরং শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকলেই রোগগুলো মানুষকে আক্রমণ করে এবং এই বিশ্বাস নিয়ে আমরা নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম করি, তাহলে রোগগুলো কোনোভাবেই আমাদেরকে আক্রমণ করার সুযোগ পাবে না।
[নয়াদিগন্তের লিঙ্ক: https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/689526]



 ১৬. ডায়াবেটিসের মোট কারণ ৩টি, মূল কারণ মাত্র ১টি


মহামারীর চেয়েও ভয়ঙ্কর এক রোগ ডায়াবেটিস

বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস উপলক্ষ্যে প্রথম আলোয় ১৪ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে ‘ডায়াবেটিস: প্রতিটি পরিবারের যুদ্ধ’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘প্রতিদিন সকালটা ফিলিস্তিনের শিশু আহমেদের শুরু হয় একটু পরই গুলির শব্দ হবে, এ শঙ্কা নিয়ে। আর অন্যদিকে ভারতের শিশু মালিনীর সকাল শুরু হয় অন্য রকম ভয় নিয়ে। তাকে ইনসুলিন নিতে হবে, চামড়া ভেদ করে রক্তাক্ত করে ইনসুলিন দেওয়া হবে; এ আতঙ্কে দিন কাটে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত এই শিশুর। যুদ্ধ, সহিংসতা আর হানাহানিতে মানুষের মৃত্যু যেমন দিন দিন পৃথিবীকে করে তুলছে ভয়ংকর; তেমনি পৃথিবীতে প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী ১০টি রোগ এ মুহূর্তে হয়ে উঠেছে আশঙ্কাজনক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পৃথিবীতে সবচেয়ে উদ্বেগজনক ১০টি স্বাস্থ্য সমস্যার মধ্যে অন্যতম ডায়াবেটিস। পৃথিবীতে এ মুহূর্তে ৪৫ কোটির অধিক লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। বাংলাদেশে প্রায় ৮০ লাখ লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।’

‘ডায়াবেটিসের ঝুঁকি সম্পর্কে যেসব জানা জরুরি’ শিরোনামে ১৩ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে ১৯৮০ সালে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় ১১ কোটি। ২০১৪ সালে সেটা বেড়ে হয় ৪২ কোটিরও বেশি। ১৯৮০ সালে ১৮ বছরের বেশি বয়সী মানুষের ডায়াবেটিস হওয়ার হার ছিল ৫ শতাংশেরও কম কিন্তু ২০১৪ সালের তাদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ।’

আরেকটা প্রতিবেদনের একটা অংশ উল্লেখ করা খুব সংগত মনে হচ্ছে। ‘ঘরে ঘরে ডায়াবেটিস’ শিরোনামে যা দৈনিক সমকালে ১৪ নভেম্বর ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘দেশে ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। শুধু বয়স্ক বা মধ্যবয়সী নয়, শিশুরাও এখন এই নীরব ঘাতকের শিকার হচ্ছে। শহর থেকে গ্রাম— সর্বত্র প্রায় সমান হারে ছড়িয়ে পড়ছে ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিস এখন প্রায় প্রতিটি ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে।’

সেখানে আরও বলা হয়, ‘দ্রুত নগরায়নের ফলে পরিবর্তিত জীবনযাপনের কারণে বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হারে বাড়ছে। আইডিএফের (ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিক ফেডারেশন) ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে বর্তমানে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ৪৩ কোটি। ১৯৮৫ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র তিন কোটি। গত আড়াই দশকে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১৩ গুণ বেড়েছে। সংস্থাটি দুই বছর পরপর আক্রান্ত মানুষের তথ্য প্রকাশ করে। তাদের ধারণা, এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা ৬৪ কোটিতে উন্নীত হবে।’ এ তথ্যগুলো আমাদেরকে ডায়াবেটিস সম্পর্কে সতর্ক হবার বার্তা দেয় নিঃসন্দেহে।


ডায়াবেটিসের কারণ সম্পর্কে বিভ্রান্তি


প্রথমে আমাদের জানা দরকার ডায়াবেটিস কেন হয়?

খুবই হতাশ হই, যখন দেখি ডায়াবেটিসের কারণ সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী মানুষকে সঠিক ধারণা দেয়ার পরিবর্তে ভুল ধারণা দেয়া হয় খুব বেশি। ডায়াবেটিস নিয়ে বিশ্বের নামকরা সব প্রতিষ্ঠান এ পর্যন্ত যত গবেষণা করেছে, কোনো গবেষণা ডায়াবেটিসের নির্ভেজাল কারণ খুঁজে বের করতে পারেনি।  দু’একটা উদাহরণ দেখা যাক:

১৭ জানুয়ারি ২০১৯ তারিখের প্রথম আলোয় ‘গ্রামে ডায়াবেটিস সচেতনতা কম’ শিরোনামে গবেষণা—তথ্যভিত্তিক (গবেষণা তথ্যটি যুক্তরাজ্যভিত্তিক স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাবিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেট—এর) একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়, ‘গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর প্রায় তিনজনের একজন ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত অথবা রোগের ঝুঁকিতে আছেন। ধূমপান, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, অপ্রতুল কায়িক পরিশ্রম ডায়াবেটিস হওয়ার মূল কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম।’

এই অধ্যায়ের শুরুতে প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘ডায়াবেটিস: প্রতিটি পরিবারের যুদ্ধ’ শিরোনামের যে প্রতিবেদনের কথা বলা হয়েছে, সেখানে আরও বলা হয়, ‘ডায়াবেটিস রোগের সবচেয়ে বড় কারণ হলো অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন। খাদ্যাভ্যাসে অসচেতনতা, কম শারীরিক কর্মকান্ড, পরিবেশগত বিভিন্ন উপাদান এবং বংশগত বা কিছু কিছু ক্ষেত্রে জিনগত অস্বাভাবিকতা। বিশ্বের মোট ডায়াবেটিসের শতকরা ৯০ ভাগ টাইপ—২ জাতীয় ডায়াবেটিসে এবং বিশ্বে বর্তমানে ৩০ কোটির অধিক লোক এই প্রকার ডায়াবেটিসে ভুগছে।... তাহলে প্রশ্ন হলো ডায়াবেটিসের কি কোনো সমাধান নেই? অবশ্যই আছে। সুস্থ জীবনযাপন। অতিরিক্ত চিনি কিংবা চর্বিজাতীয় খাবার পরিহার করা, হাঁটা কিংবা ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সচল রাখা, অতিরিক্ত ওজন কমানোর চেষ্টা, ফাস্ট ফুড বা জাঙ্কফুড ও অতিরিক্ত মদপান পরিহার করা।’

বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত যে প্রতিবেদনের কথা এ অধ্যায়ের প্রথম পরিচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে আরও বলা হয়, ‘ডায়াবেটিস যদিও জেনেটিক এবং আপনার জীবন যাপনের স্টাইলের ওপর নির্ভরশীল তারপরেও আপনি চেষ্টা করলে রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পারেন।

সেজন্যে আপনাকে খাবার গ্রহণের বিষয়ে বিশেষভাবে সচেতন থাকতে হবে এবং আপনাকে হতে হবে অত্যন্ত সক্রিয় একজন মানুষ।

খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

প্রক্রিয়াজাত খাবার ও পানীয় এড়িয়ে চলতে হবে। মসৃণ শাদা আটার রুটির পরিবর্তে খেতে হবে ভুষিওয়ালা আটার রুটি। এটাই প্রথম ধাপ।

এড়িয়ে চলতে হবে হোয়াইট পাস্তা, প্যাস্টি্র, ফিজি ড্রিংকস, চিনি জাতীয় পানীয়, মিষ্টি ইত্যাদি।

আর স্বাস্থ্যকর খাবারের মধ্যে রয়েছে শাক সব্জি, ফল, বিন্স এবং মোটা দানার খাদ্য শস্য।

স্বাস্থ্যকর তেল, বাদাম খাওয়াও ভালো। ওমেগা থ্রি তেল আছে যেসব মাছে সেগুলো বেশি খেতে হবে। যেমন সারডিন, স্যামন এবং ম্যাকেরেল।

এক বেলা পেট ভরে না খেয়ে পরিমানে অল্প অল্প করে বিরতি দিয়ে খাওয়া দরকার।

শরীর চচ্চর্া বা ব্যায়াম করার মাধ্যমে রক্তে চিনির মাত্রা কমিয়ে রাখা সম্ভব।

চিকিৎসকরা বলছেন, প্রতি সপ্তাহে আড়াই ঘণ্টার মতো ব্যায়াম করা দরকার। তার মধ্যে দ্রুত হাঁটা এবং সিড়ি বেয়ে ওপরে ওঠাও রয়েছে।

শারীরিকভাবে থাকতে হবে সক্রিয়। ওজন কম রাখলেও চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। যদি ওজন কমাতে হয় তাহলে সেটা ধীরে ধীরে করতে হবে। সপ্তাহে আধা কেজি থেকে এক কেজি পর্যন্ত।

ধূমপান পরিহার করাও জরুরী। নজর রাখতে হবে কোলস্টেরলের মাত্রার ওপর। এর মাত্রা বেশি হলে হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।’ [https://www.bbc.com/bengali/news-46194839]


ডায়াবেটিসের কারণ এবং প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে আমি আরও অনেকগুলো প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিতে পারি, যেগুলোতে ডায়াবেটিসের আরও ভিন্ন ভিন্ন কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু অতিরিক্ত হয়ে যাবে বলে উল্লেখ করতে চাই না। শুধু এ তিনটি প্রতিবেদনেই ডায়াবেটিসের অনেকগুলো কারণ বলা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, যদি এতোগুলো কারণেই ডায়াবেটিস হয় এবং মানুষকে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করার জন্য এতোগুলো উপায় অবলম্বন করতে হয়, তাহলে কয়জনের ধৈর্যে কুলাবে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করার? শুধু এ কারণেই, আমার খুব শক্তভাবে মনে হয়, বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগের প্রকোপ কমছে না, বরং হু হু করে বাড়ছেই। মহামারীর চেয়েও ভয়াবহ মাত্রায় ডায়াবেটিস সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে। আমি এখানে ডায়াবেটিসের কারণ সম্পর্কে শুধু একটি ধারণা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করবো এবং ডায়াবেটিসের মূল কারণগুলো নিয়ে আলোচনা করবো। ডায়াবেটিসের কারণ বলে প্রচারিত সব কারণগুলোর স্বরূপ উন্মোচনের জন্য এই লেখার বিভিন্ন জায়গায় আরো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

 এখানে প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘গ্রামে ডায়াবেটিস সচেতনতা কম’ শিরোনামের প্রতিবেদনে ডায়াবেটিসের তিনটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে, যার প্রথমটি হচ্ছে ধূমপান। বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, ‘ধূমপান পরিহার করাও জরুরী।’ আমি ডায়াবেটিস সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় আরো অনেক লেখায় পড়েছি, বলা হচ্ছে, ধূমপানও নাকি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার একটি অন্যতম কারণ।

আমার বড় দু’ভাই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত বেশ কয়েক বছর ধরে। আমার মেঝো ভাইয়ের স্ত্রীও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। আমাদের বিদ্যালয়ের ঝুনু রানী পাল নামক একজন মহিলা শিক্ষক অনেক বছর ধরে ডায়াবেটিসের সাথে যুদ্ধ করছেন। আমার শাশুড়িরও আছে ডায়াবেটিস। মাদ্রাসা শিক্ষিত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত আমার পরিচিত অনেক লোক আছেন, যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। আমার মেঝো ভাবীর বাবা—মাও অনেক বছর ধরে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এভাবে আমার প্রতিবেশী এবং আত্মীয়সহ কাছের এবং দূরের পরিচিত অনেক লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, যাদের সাথে ধূমপানের কোনো সম্পর্কই নেই। ধূমপান করা ছাড়াই তাদের তাহলে ডায়াবেটিস হলো কী করে?! বলতে পারেন, যাদের কথা এখানে বলা হয়েছে, তারা প্রত্যক্ষ ধূমপানের সাথে জড়িত না হলেও পরোক্ষ ধূমপানের শিকার। কিন্তু না, এদের কেউ পরোক্ষ ধূমপানের শিকারও নন। বরং একটা তথ্য জেনে সবাই অবাক হতে পারেন, আমার যে সহকর্মীর ডায়াবেটিস, তাঁর স্বামী নিয়মিত ধূমপান করেন, কিন্তু এখনো ডায়াবেটিস থেকে মুক্ত। যিনি ধূমপান করেন, তিনি যদি ডায়াবেটিস থেকে মুক্ত থাকেন, তাহলে তাঁর ধূমপানের পরোক্ষ শিকার কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবেন কিভাবে?!

‘বাংলাদেশে নারীদের মধ্যে ডায়াবেটিস কেন বাড়ছে?’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় বিবিসি বাংলায় ১৪ নভেম্বর ২০১৭ তারিখে। সেখানে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি বলছে, বর্তমানে ৩৫ লাখের বেশি নারী ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। সংস্থাটি বলছে, এ সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এর মধ্যে একটি বড় অংশের নারীরাই সন্তান জন্মদানের জন্য সক্ষম অবস্থায় (অর্থাৎ কম বয়সে) এ রোগে আক্রান্ত হন।’ প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘বারডেম হাসপাতালের চিকিৎসক মোঃ দেলোয়ার হোসেন বলছেন, সা¤প্রতিক বছরগুলোতে তারা দেখেছেন প্রতি দশ জন নারীর মধ্যে একজনের ডায়াবেটিস আছে। আর এজন্য এখনকার জীবনযাত্রাকেই সবচেয়ে বড় কারণ বলে তিনি মনে করেন।

‘মূল কারণ আমাদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন। কায়িক পরিশ্রম নাই, বসে থাকা হয় বেশি। আর নারীদের আক্রান্ত বেশি হবার কারণ, তারা সংসারের অনেক কাজ করেন, সংসার সামলানো, সন্তান প্রতিপালনসহ সব করার পরে নিজের দিকে নজর দেন না তারা। ডায়াবেটিস হলেও সেটার চিকিৎসায় নজর দেন না অনেকেই।’

এখানে বলা হয়েছে, বর্তমানে ৩৫ লাখের বেশি নারী ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। বাংলাদেশে যারা বসবাস করেন এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে যারা একটু ভালোভাবে জানেন, তারা জানেন, বাংলাদেশের নারীদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা নেই বললেই চলে। উপজাতীয়দের মধ্যে কোনো কোনো মহিলা ধূমপান করেন। সাম্প্রতিক সময়ে ভার্সিটি পড়–য়া কিছু কিছু তরুণীর মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু এখানে যে ৩৫ লাখ নারীর ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার কথা বলা হয়েছে, আমার মনে হয়, এদের মধ্যে ধূমপায়ীর সংখ্যা খুঁজতে গেলে সবোর্চ্চ এক হাজার জনও পাওয়া যাবে না। তাহলে এই লক্ষ লক্ষ নারী ধূমপান ছাড়া ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলেন কী করে?! নাকি সবার স্বামীই ধূমপায়ী বলেই ধূমপানের পরোক্ষ শিকার হয়ে এরা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন? এটাও সম্ভব নয়। কারণ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত অনেক মহিলার স্বামীও ধূমপান করেন না। বাংলাদেশে যারা ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করেছেন বলে ধর্মীয় চেতনা ধারণ করেন, তাঁরা ধূমপানকে রীতিমতো ঘৃণাই করেন, ধূমপান দূরের কথা। এ ধরনের ধর্মীয় ভাবধারার অসংখ্য মানুষও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তাহলে ধূমপানের সাথে সম্পর্ক না থাকার পরও এরা কেন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছেন?

ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার সাথে ধূমপানের সম্পর্কের বিষয়টা নিয়ে যে কেউ একটু নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই দেখবেন, এর কোনো ভিত্তি নেই। ধূমপানের সাথে সত্যিই যদি ডায়াবেটিসের সম্পর্ক থাকতো, তাহলে বিশ্বব্যাপী শুধু ধূমপায়ীরাই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতেন, অধূমপায়ী কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত না হতেন। এখন তো দেখা যায় অনেক ১০—১৫ বছর বয়সী শিশু, যাদের সাথে এখনো ধূমপানের কোনো সম্পর্কই নেই, তারাও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। বিশ্বের যে কোনো দেশে নতুন করে বিষয়টা পর্যবেক্ষণ করলে এটাই শতভাগ সত্য প্রমাণিত হবে, ডায়াবেটিসের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ধূমপানের কোনো সম্পর্ক নেই। বিষয়টা শতভাগ অবাস্তব।


ডায়াবেটিসের প্রকৃত কারণ

গত চার বছরের বেশি সময় ধরে ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যান্সার ইত্যাদি রোগ নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। কারণ রোগগুলো সারাবিশ্বেই কোটি কোটি মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে, স্বাভাবিক জীবন বিপন্ন করছে। শুধু ডায়াবেটিসের কথাই বলছি। আমার আত্মীয় এবং পরিচিত অনেকেই রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে কঠিন জীবন যাপন করছে, অনেকে ইতোমধ্যে মারাও গেছে। আমাদের বাড়ির আমার এক জেঠাতো ভাই, নাম আবুল বাশার, ২০১৮ সালের ১৩ ডিসেম্বর ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা বৃদ্ধি পেয়ে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর কিছুদির পরই আরেক জেঠাতো ভাইয়ের স্ত্রী আকস্মিক ডায়াবেটিস বেড়ে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। আরো অনেক আত্মীয় ডায়াবেটিসে ভুগে কঠিন জীবন পার করছেন, যে কোনো সময় মারা যেতে পারেন।

ডায়াবেটিসের কারণ সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত অনেক ডাক্তারের লেখা ও অনেক গবেষণা প্রতিবেদনে এবং মানুষের মুখে অনেক রকম মন্তব্য পাওয়া যায়। মন্তব্যগুলোর সাথে বাস্তবতার মিল খুঁজতে গিয়ে আমি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হতাশ হয়েছি। দেখেছি, যে কারণগুলোকে ডায়াবেটিসের জন্য দায়ী করা হয়, বাস্তবতার সাথে তার অনেকগুলোরই মিল নেই।

ডায়াবেটিসের কারণ নিয়ে বিশ্বের অনেক বড় বড় গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা ফলাফল মাঝে মাঝে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। দুঃখজনক হচ্ছে, কোনো গবেষণা—ফলাফলেই ডায়াবেটিসের মূল কারণ কয়টি, তা চিহ্নিত করতে দেখা যায় না এবং ডায়াবেটিসের মোট কারণ কয়টি, তা—ও সুনির্দিষ্টভাবে খুঁজে বের করতে পারে না কোনো গবেষণা। একেক গবেষণায় একক কারণকে ডায়াবেটিসের জন্য দায়ী বলে উল্লেখ করা হয়। কিছু কারণ অনেক সময় মিলে যায়, কিছু কারণ আবার মিলে না। সবগুলো কারণ একত্র করলে মানুষ ডায়াবেটিস থেকে বাঁচার আশা বাদ দিয়ে ভাববে, এতোগুলো কারণ পরিহারের চেয়ে ডায়াবেটিসে ধুঁকে ধুঁকে মরাই বরং ভালো!

মাফ করবেন, আমি কোনো ডাক্তার নই, কোনো গবেষকও নই, তবু এমন মন্তব্য করে ফেললাম। কারণ এমন মন্তব্য করার মতো শক্তি আমার আছে। আমি যে মন্তব্য করেছি, তা খুব ভালোভাবে প্রমাণ করে দেখাতে পারবো বলেই মন্তব্য করার সাহস পেয়েছি।

আমি দেখেছি, ডায়াবেটিসের মূল কারণ মাত্র ১টি এবং ডায়াবেটিস সর্বমোট তিন কারণে হয়। ডায়াবেটিসের মূলতঃ যে কারণে হয়, মানুষ তা থেকে দূরে থাকতে পারলে মানুষকে ডায়াবেটিস আক্রমণ করতে পারবে খুব কম। আর ডায়াবেটিস মোট যে তিনটি কারণে হয়, সবগুলো এড়িয়ে চললে নিশ্চিতভাবে মানুষ ডায়াবেটিস থেকে রক্ষা করতে পারবে নিজের মূল্যবান জীবনকে।

আমি দীর্ঘদিন ধরে শুধু একটা বিষয় দেখেছি চরম সত্য হিসেবে, ডায়াবেটিস শুধু ঐসব মানুষের হয়, যারা শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকে বা করলেও পরিমাণে কম করে। পাশাপাশি যারা বেশি বেশি খায় বা মনের চাহিদামতো খায় বা ভোজনপ্রিয় এবং যারা মোটা শরীরের, তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় বেশি বেশি। এককথায় ডায়াবেটিসের মূল কারণ শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা এবং অন্য দু’কারণ হচ্ছে বেশি খাওয়া বা মনের চাহিদামতো খাওয়া এবং মুটিয়ে যাওয়া। এই তিনটি কারণ যার মধ্যে নেই, সে কখনো কোনোভাবে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় না। তবে যারা মোটা হওয়া সত্ত্বেও এবং বেশি বেশি খাওয়া সত্ত্বেও শারীরিক পরিশ্রম করে বেশি বেশি, তারাও খুব কমই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। আবার চিকন লোকও যখন শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকে, অনেক সময় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। তাই এতে কোনো সন্দেহ নেই, ডায়াবেটিসের মূল কারণ শারীরিক পরিশ্রম না করা বা কম করা। এককথায় পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম যারা করে. তারা কখনো ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় না। আমার এ বক্তব্যে পুরো আস্থা রাখার জন্য চার শ্রেণির লোকের দিকে লক্ষ্য করার অনুরোধ করছি।


১. বাংলাদেশের ঐসব ‘পায়েচালিত’ রিকশাচালক, যারা ১০ বছরের বেশি সময় ধরে (অনেকে ৩০—৪০ বছর বা তার চেয়েও বেশি সময় ধরে চালায়) রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এমন এক হাজার বা দশ হাজার রিকশাচালকের খোঁজ নিয়ে দেখুন, দেখবেন তারা কেউই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নন। এমনও দেখা যেতে পারে, তাদের অনেকের পিতামাতা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন বা কোনো সন্তান ইতোমধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। এমনও দেখা যাবে, তাদের অধিকাংশই ধূমপান করছেন, নয়তো ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার জন্য প্রচারিত অন্য কোনো কারণ অনেকের মধ্যে বিরাজমান, তবু তারা কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে না।

২. বিশ্বের সব দেশেই শ্রমজীবি মানুষ আছে। যারা মাটি কাটার কাজ করে বা ফসলের জমি কিংবা কারখানায় হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের কাজ করে, এককথায় সেসব শ্রমজীবি মানুষ, যারা শারীরিক শ্রমনির্ভর কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে, এমন শ্রম, যা এদেরকে মোটা হতে দেয় না। পনেরো—বিশ বছরের বেশি সময় ধরে যেসব শ্রমজীবি মানুষ এভাবে পরিশ্রম করছেন দিনের একটা বড় অংশ, তারা কেউ দেখবেন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নন।

৩. যেসব অ্যাথলেট বা ক্রীড়াবিদ পেশাগতভাবে শারীরিক শ্রমনির্ভর বিভিন্ন খেলা (যেমন: ফুটবল, ক্রিকেট, টেনিস, সাঁতার, ব্যাডমিন্টন ইত্যাদি) খেলে যাচ্ছেন ১০ বছরের বেশি সময় ধরে, তাদের খোঁজ নিয়ে দেখুন, দেখবেন ডায়াবেটিসে তারা কেউ আক্রান্ত নন। এরা অনেকে হয়তো ধূমপানও করেন, অনেকে হয়তো ফাস্টফুডেও আসক্ত, অনেকের বাবা—মা কারো হয়তো ডায়াবেটিস ছিল, তবু এরা ডায়াবেটিসের ছোবল থেকে মুক্ত।

৪. বিভিন্ন দেশের সামরিক বাহিনীতে যারা চাকরি করেন এবং বাধ্যগতভাবে রুটিনমাফিক নিয়মিত পর্যাপ্ত ব্যায়াম করেন, অতিরিক্ত ব্যায়ামের কারণে মোটা হতেও পারছেন না, তাদের কাউকেও দেখবেন না ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে।

এ চার শ্রেণির মানুষের ডায়াবেটিস না হওয়াটা প্রমাণ করে, ডায়াবেটিসের মূল কারণ শারীরিক শ্রম থেকে দূরে থাকা, অন্য কিছু নয়।


মানুষ যখন শারীরিক পরিশ্রম কম করে, মনের চাহিদামতো খায়, একসময় এসব কারণে মুটিয়ে যায়। আর মুটিয়ে গেলে শরীরে চর্বি বা কোলেস্টেরল বেড়ে যায়। কোলেস্টেরলের মধ্যেই জন্ম নেয় ডায়াবেটিস। অনেক মানুষ মোটা না হলেও নিয়মিত শারীরিক শারীরিক পরিশ্রম না করার কারণে শরীরে কোলেস্টেরল বেড়ে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে।

তিনটি কারণে মানুষের শরীরে কোলেস্টেরল বেড়ে যায়। প্রথম কারণ পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম না করা, দ্বিতীয় কারণ বেশি খাওয়া, তৃতীয় কারণ মুটিয়ে যাওয়া। যে তিনটি কারণে মানুষের শরীরে কোলেস্টেরল বেড়ে যায়, সেই তিনটি কারণেই মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। অর্থাৎ যে কোনো কারণে কোলেস্টেরল বেড়ে গেলে মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। তাই যেসব মানুষের শরীরে কোলেস্টেরল বাড়তে পারে না পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রমের কারণে, সেসব মানুষ ডায়াবেটিস থেকে নিরাপদ থাকে।


ডায়াবেটিসে আক্রান্ত শতভাগ লোকের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য পাওয়া যাবে যে, সে পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম করে না। অনেকের মধ্যে এটা পাওয়া যাবে যে, তারা মোটা বা বেশি বেশি খায়। কিন্তু অন্য কোনো কারণ, যেগুলোকে ডায়াবেটিসের কারণ বলে প্রচার করা হয়, শতভাগ লোকের মধ্যে পাওয়া যাবে না। আমি ধূমপান এবং ডায়াবেটিসের সম্পর্ক নিয়ে আগেই বলেছি, ধূমপানকে তখনই ডায়াবেটিসের কারণ বলে বিশ্বাস করা যেতো, যখন দেখা যেতো ধূপায়ীরাই (সবাই না হলেও অনেকেই) শুধু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় এবং অধূমপায়ী কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় না। কথাটি প্রচারিত অন্য কারণগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যেমন বলা হয়, ডায়াবেটিস নাকি বংশগতভাবেও হয়। ডায়াবেটিসকে বংশগত রোগ তখনই বলা যাবে,  যখন দেখা যাবে: ১. কারো পূর্বপুরুষ শুধু এক সিঁড়ি নয়, একাধিক সিঁড়ি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিল, ২. পিতা/মাতা কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, শুধু এমন লোকেরাই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় বেশি বেশি এবং ৩. পূর্বপুরুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নয়, এমন মানুষ খুব কমই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়।

ডায়াবেটিসকে বংশগত রোগ বলা সম্পর্কে এ লেখায় আরো অনেক আলোচনা আছে। এখানে আরো দু’একটা কথা না বললেই নয়। এ অধ্যায়ের শুরুতে ডায়াবেটিসের ভয়াবহতা সম্পর্কে অনেক পরিসংখ্যান উল্লেখ করা হয়েছে। একটি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ‘আইডিএফের ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে বর্তমানে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ৪৩ কোটি। ১৯৮৫ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র তিন কোটি। গত আড়াই দশকে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১৩ গুণ বেড়েছে। সংস্থাটি দুই বছর পরপর আক্রান্ত মানুষের তথ্য প্রকাশ করে। তাদের ধারণা, এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা ৬৪ কোটিতে উন্নীত হবে।’

দৈনিক যুগান্তরে ২৮ ফেব্রুয়াারি ২০১৮ তারিখে ‘ডায়াবেটিস সচেতনতা দিবস’ উপলক্ষ্যে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘এক জরীপ মতে বিশ্বে প্রতি সাত সেকেন্ডে একজন মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে এই রোগ এখন মহামারী রূপ নিচ্ছে। দেশে বর্তমানে ৮৪ লাখেরও বেশি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।

ডায়াবেটিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৪২ দশমিক ৫ কোটি। অথচ ১৯৮৫ সালে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ কোটি। এখনই এই রোগ প্রতিরোধ করা না গেলে ২০৩৫ সালের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ৫৯ কোটিতে পৌঁছানোর আশঙ্কা করা হচ্ছে।’

এই রকম পরিসংখ্যানগুলো কী নির্দেশ করে, তা আমরা সহজে বুঝতে পারি না বলে ডায়াবেটিসকে বংশগত বা জিনগত রোগ বলে নিজেদের সর্বনাশ করছি। এই রকম পরিসংখ্যানগুলো বলে— যত পেছনের সময়ে যাওয়া যায়, দেখা যায় তখন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা সমাজে তত কম ছিল। এভাবে যেতে যেতে এমন একটা সময় দেখা যাবে, তখন তেমন কারো ডায়াবেটিস ছিল না। যদি এক সময় পৃথিবীতে তেমন কারো ডায়াবেটিস না থাকে, তাহলে কোন্ সব পূর্বপুরুষ থেকে রোগটি আমাদেরকে সংক্রমিত করেছে? পূর্বপুরুষ কারো তো একসময় ডায়াবেটিস ছিলই না পরিসংখ্যান মতে!

ডায়াবেটিসকে জিনগত রোগ বলে আমরা নিজেদেরকে ধোঁকা দিচ্ছি। যখন দেখছি আমাদের বাবা—মা কারো রোগটি ছিল, তখন ভাবছি রোগটি তো আমার হওয়া অবশ্যম্ভাবী, তাহলে কী আর করার আছে! এটা ভেবে রোগটির নিকট আমরা অসহায় আত্মমসমর্পণ করছি। রোগটি সময় মতো আমাদের আক্রমণ করে বসছে। যারা ডায়াবেটিসকে জিনগত রোগ বলছে, তারা মানবজাতির সর্বনাশ করছে।

আমরা যদি দেখতাম, যত পেছনের সময়ে যাওয়া যায়, মানুষের জীবন তত কষ্টসাধ্য ছিল; মানুষ হেঁটে হেঁটেই তখন চলে যেতো অনেক দূরের গন্তব্যে, মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের অধিকাংশ কাজ করতে হতো শারীরিক শ্রমের বিনিময়ে; আর মানব সমাজে তখন থেকেই ডায়াবেটিসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে, যখন থেকে মানুষের শারীরিক পরিশ্রমের কাজ কমে যেতে শুরু করেছে, যখন থেকে মানুষ মেশিন—নির্ভর হয়ে পড়তে শুরু করেছে; যখন থেকে আরামপ্রিয়তা মানুষের মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে; যখন থেকে মানুষ দশ মাইল দূরের কথা, এক মাইল দূরে যাবার জন্যেও গাড়ি ব্যবহার করছে বা করতে পারছে; আমরা বুঝতাম, ডায়াবেটিস আগেকার কোনো ডায়াবেটিস রোগী থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত রোগ নয়, বরং ডায়াবেটিস আরামপ্রিয় মানুষের রোগ; আরামপ্রিয় মানুষের সংখ্যা সমাজে যত বাড়তে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যাও আনুপাতিকহারে তত বাড়ছে; আমরা খুব সহজে বুঝতাম, ডায়াবেটিস শুধু শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা মানুষদেরকেই আক্রমণ করে, পাশাপাশি যারা পরিমিত খায় না এবং মোটা, তাদেরকে।

টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসকে যারা বংশগত মনে করে, তারা ভাবে না, একসময় সমাজে তেমন কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতো না। পরে আরামপ্রিয় হয়ে যাবার পর থেকেই মানুষ রোগটিতে আক্রান্ত হতে শুরু করছে। এখন থেকে যদি বিশে^র সকল ডায়াবেটিসমুক্ত মানুষ শারীরিক পরিশ্রমে প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ সময় ব্যয় করার মাধ্যমে একযোগে রোগটি প্রতিহত করা শুরু করে, এদের সন্তানরা বা সামনের প্রজন্মের কেউ আর টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসেও আক্রান্ত হবে না। তাছাড়া পরিসংখ্যান মতে, টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা সমাজের মোট ডায়াবেটিস রোগীর দশ শতাংশ। এ অধ্যায়ের শুরুতেও প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘ডায়াবেটিস: প্রতিটি পরিবারের যুদ্ধ’ শিরোনামের প্রতিবেদন থেকে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্বের মোট ডায়াবেটিস রোগীর শতকরা ৯০ ভাগ টাইপ—২ জাতীয় ডায়াবেটিসে ভুগছে।

যদি শুধু এই দশ শতাংশ টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস রোগীকে বংশগত ডায়াবেটিস রোগী ধরে নেয়া হয়, তবু বাকি নব্বই শতাংশ টাইপ টু ডায়াবেটিস রোগীর বিবেচনায় টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা একেবারে নগণ্য। তাই রোগটিকে জিনগত না বলাই ভালো। রোগটিকে বংশগতভাবেও হয়, এমন রোগের কাতারে ফেললে যাদের বাবা—মা কারো ডায়াবেটিস, তারা আতঙ্কে জীবন কাটাবে এবং যাদের বাবা—মা কারো ডায়াবেটিস হয়নি, তারা নিশ্চিন্তে জীবন কাটাবে। উভয় শ্রেণিই একসময় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়বে কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ না করার ফলে।


ডায়াবেটিসের মূল কারণ সম্পর্কে কিছু প্রতিবেদনের বক্তব্য


ডায়াবেটিসের মূল কারণ যে শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা, কথাটির সমর্থনে কিছু আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করছি।

(১) ৭ এপ্রিল ২০১৬ তারিখের বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত ‘বিশ্ব ডায়াবেটিসের ''ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের'' ঝঁুকিতে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সারা বিশ্বে এখন প্রতি ১১ জনে একজন ব্যক্তি ডায়াবেটিস আক্রান্ত। ২০১৪ সালে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৪২২ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়ষ্ক ব্যক্তি, যা ১৯৮০—তে আক্রান্তের তুলনায় ৪ গুণ বেশি। ৭ই এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের প্রাক্কালে প্রকাশিত সংস্থাটির প্রথম গ্লোবাল রিপোর্টে বলা হয়েছে প্রতি বছর রক্তে উচ্চমাত্রার গ্লুকোজ বা ডায়াবেটিসের কারণে বিশ্বে মারা যাচ্ছে ৩৭ লক্ষ মানুষ।

২০১২ সালে ১৫ লাখ লোক প্রত্যক্ষভাবে ডায়াবেটিসের কারণে মারা যান।’

আরো বলা হয়, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে এখনই ''দৃঢ় পদক্ষেপ'' না নিলে এই সংখ্যা আরও বাড়বে।

এই রিপোর্টে টাইপ—১ এবং টাইপ—২ — দুধরনের ডায়াবেটিস আক্রান্তদের কথাই বলা হয়েছে। তবে এটাও বলা হয়েছে যে ধরনের ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে তারা টাইপ—২ ডায়াবেটিসের শিকার, যার মূল কারণ আস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন।’

(২) জার্মানির জনপ্রিয় সংবাদ মাধ্যম ডয়চে ভেলের (বাংলা) ওয়েবসাইটে ২১ এপ্রিল ২০১২ তারিখে প্রকাশিত ‘ভারতে ডায়বেটিসের প্রকোপ’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডাব্লিউএইচও’র তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ৩৪৬ মিলিয়ন মানুষ ডায়বেটিসে আক্রান্ত। ২০৩০ সাল নাগাদ গোটা বিশ্বে আনুমানিক ৭.৮ শতাংশ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। বর্তমানে চীন ও ভারতে দেখা যাচ্ছে এর প্রকোপ। নতুন সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতে ৫১ মিলিয়ন মানুষ ডায়বেটিসে ভুগছেন। আগামী ২০ বছরে এই সংখ্যা ১৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। দিল্লি, মুম্বই ও কলকাতার মতো বড় বড় শহরে ডায়াবেটিস রোগীরা একই ধরনের সমস্যার কথা বলেন চিকিৎসকের কাছে, যেমন অফিসে চেয়ারে বসেই কাজ করতে হয় অনেকটা সময়, খেলাধুলা ও স্বাস্থ্যকর খাবারের সুযোগ সুবিধাও কম। পুষ্টিকর খাদ্য দ্রব্য ও রান্নাবান্নার সময়ও পান না অনেকে। চারিদিকে, কোকাকোলা, পিৎসা ও বার্গারের মতো ফাস্টফুডের বিজ্ঞাপন। একটু স্বচ্ছল হলেই গাড়ি কেনার প্রবণতা। ঘরকন্নার সাহায্যে থাকে কাজের লোক। শারীরিক পরিশ্রমের পাল্লাটা অনেক কম ইত্যাদি ইত্যাদি। আর এসবই বহুমূত্র রোগের দিকে ঠেলে দেয় মানুষকে।’

(৩) ডয়চে ভেলের (বাংলা) ওয়েবসাইটে আরেকটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ১৩ অক্টোবর ২০১৫ তারিখে ‘‘ডায়াবেটিস ও ইনসুলিন’’ শিরোনামে। সেখানে বলা হয়, ‘সারা বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগীদের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে চলেছে। এর কারণ হল বেশি খাওয়া ও কম দৌড়ঝাঁপ বা হাঁটাচলা করা। যার ফলে ডায়াবেটিস আধুনিক জীবনযাত্রার সঙ্গী হয়ে উঠেছে। সারা বিশ্বে প্রায় ২৫ কোটি মানুষ ডায়াবেটিসে ভুগছেন। তবে খাওয়াদাওয়া ঠিক রাখলে আর নিয়মিত ব্যায়াম করলে রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।’

(৪) ভারত থেকে প্রকাশিত xiaomi.dailyhunt.in (শাওমী ডট ডেইলীহান্ট ডট আইএন) নামক অনলাইন পত্রিকায় ‘ইনসুলিনের অভাবে ভুগবে বিশ্ব’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বর্তমান বিশ্বের অন্যতম জীবনঘাতী রোগ বলা হয় ডায়াবেটিসকে। এই রোগের কারণে প্রতিবছর মারা যাচ্ছে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ। বিশ্বে বর্তমানে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ৪২ কোটি ৫০ লাখ। আর প্রতিবছরই আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হারে বেড়ে ২০৩০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা দাঁড়াবে ৫১ কোটি ১০ লাখে। তবে সেই হারে বাড়বে না এই রোগে আক্রান্তদের প্রয়োজনীয় জীবনরক্ষাকারী ওষুধ ইনসুলিনের সরবরাহ। ফলে ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের চার কোটির বেশি রোগী ইনসুলিন পাবেন না। এই অবস্থায় দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা ও ওশেনিয়া অঞ্চলে ভয়াবহ প্রভাবের আশঙ্কা করছেন গবেষকরা।

ল্যানসেট ডায়াবেটিস ও এন্ডোক্রায়োনোলজি জার্নালের এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।’

গবেষণা প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়, ‘গবেষণায় নেতৃত্বদানকারী স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক ডাক্তার সঞ্জয় বসু বলেন, ছোঁয়াচে নয় এমন রোগ বিশেষ করে ডায়াবেটিসের বিস্তার রোধে জাতিসংঘের নানা পদক্ষেপ সত্ত্বেও বর্তমানে চাহিদার তুলনায় ইনসুলিনের প্রাপ্যতা অনেক কম। আগামী ১২ বছরে বার্ধক্য, নগরায়ন, খাদ্যাভাস ও শারীরিক কাজকর্মের ধরনে নানা পরিবর্তনের কারণে গোটা বিশ্বেই টাইপ টু ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাবে।’

(৫) ‘ডায়েবেটিস থেকে সাবধান!’ শিরোনামে ডয়চে ভেলের ওয়েবসাইটে ২৭ মে ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলা হয়, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বাড়ার মূল কারণ, অতিরিক্ত ওজন।’ [https://www.dw.com/overlay/media/bn/38965147/41071625]

(৬) ভারতের কলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার পত্রিকায় ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে ‘নিয়মিত জীবনযাপন দূর করবে ডায়াবেটিস’ শিরোনামে একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারটি দিয়েছেন বোলপুরের চিকিৎসক প্রদীপ গঙ্গোপাধ্যায়। সাক্ষাৎকারের একটি অংশ এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে।

‘প্রশ্ন: ডায়াবেটিস কেন হয়?

উত্তর: হাইপারটেনশন, থাইরয়েড, হার্টের অসুখ, ফ্যাটি লিভার, আর্থারাইটিজের মতোই ডায়াবেটিস মূলত একটি ‘লাইফস্টাইল ডিজিজ’। জীবনশৈলীর কারণে যে অসুখগুলো হয় তার মধ্যে অন্যতম হল ডায়াবেটিস। এখন মানুষ কায়িক পরিশ্রম কম করে, অনিয়মিত খাওয়াদাওয়া করে। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনই এই ধরনের অসুখের মূলে। আগেকার দিনে ফ্রিজ, এসি, গাড়ি, কম্পিউটার, টিভি, মোবাইলের ব্যবহার কম ছিল। এখন মানুষ মাঠে খেলাধুলোর বদলে কম্পিউটারে গেমে মনোনিবেশ করে। সাইকেলের বদলে স্কুটি ব্যবহার করে। আগে সব ক্ষেত্রেই পরিশ্রম অনেক বেশি ছিল। বর্তমানে গাড়ি চড়া, না হাঁটা, রেস্তোরাঁতে খাওয়া সব দিক থেকে মানুষের জীবনশৈলী বদলেছে। মাছ, ভাত, শাক, পোস্তার জায়গায় খাবার হিসেবে এসেছে পাস্তা, পেস্টি্র, কোল্ড ড্রিংকস, আইসক্রিম, নুডলস যেগুলি মূলত হাই ক্যালোরির খাবার। এই সমস্ত খাবার বেশি করে খাওয়া এবং কম পরিশ্রম করার ফলে চাইল্ডহুড ওবেসিটি হচ্ছে। এই ওবেসিটিই হচ্ছে ভবিষ্যতে সুগার, প্রেশার, হার্টের অসুখের প্রবেশ পথ। আগেকার থেকে এখন মানুষের জীবনযাত্রা অনেক জটিল হয়েছে। বেড়েছে মানসিক চিন্তা। সমাজ, সংসার, কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপও ডায়াবেটিসের মূলে।’

এই ছয়টি নিবন্ধ—প্রতিবেদনের প্রথমটিতে ডায়াবেটিসের মূল কারণ বলা হয় আস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনকে, দ্বিতীয়টিতে ডায়াবেটিসের জন্য দায়ী বলে মনে করা হয় আরামপ্রিয় জীবনযাপন এবং শারীরিক পরিশ্রম কম করাকে, তৃতীয়টিতে ডায়াবেটিসের কারণ বলে মনে করা হয় বেশি খাওয়া, দৌড়ঝাঁপ বা হাঁটাচলা কম করা এবং নিয়মিত ব্যায়াম না করাকে, চতুর্থটিতে বার্ধক্য, নগরায়ন, খাদ্যাভাস ও শারীরিক কাজকর্মের ধরনে নানা পরিবর্তনের কারণে মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় বলে মনে করা হয়, পঞ্চমটিতে ডায়াবেটিসের মূল কারণ বলা হয় অতিরিক্ত ওজনকে, আর ষষ্ঠটিতে ডায়াবেটিসকে ‘লাইফস্টাইল ডিজিজ’ বলেই আখ্যা দেয়া হয়। লাইফস্টাইল হিসেবে বলা হয়, ‘এখন মানুষ কায়িক পরিশ্রম কম করে, অনিয়মিত খাওয়াদাওয়া করে। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনই এই ধরনের অসুখের মূলে। আগেকার দিনে ফ্রিজ, এসি, গাড়ি, কম্পিউটার, টিভি, মোবাইলের ব্যবহার কম ছিল। এখন মানুষ মাঠে খেলাধুলোর বদলে কম্পিউটারে গেমে মনোনিবেশ করে। সাইকেলের বদলে স্কুটি ব্যবহার করে। আগে সব ক্ষেত্রেই পরিশ্রম অনেক বেশি ছিল। বর্তমানে গাড়ি চড়া, না হাঁটা, রেস্তোরাঁতে খাওয়া সব দিক থেকে মানুষের জীবনশৈলী বদলেছে।’

এই প্রতিবেদনগুলোতে কিন্তু ডায়াবেটিসকে বংশগতভাবেও হয়, এমন রোগ বলা হয়নি; ডায়াবেটিসের সাথে ধূমপান, মদপান, চিনি/মিষ্টি/লবণ বেশি খাওয়ার সম্পর্ক আছে বলেও বলা হয়নি। তবে শুধু শেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ডায়াবেটিসের সাথে মানসিক চাপের সম্পর্কের কথা। শুধু একটা কথাই বলবো, এ অধ্যায়ে যে চার শ্রেণির ডায়াবেটিস থেকে মুক্ত থাকার কথা বলা হয়েছে, শারীরিক পরিশ্রমে যুক্ত থাকা ছাড়া জীবনের অন্য বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে এরা কি আর সব মানুষের মতো নয়? আর সব মানুষের মতো এদের জীবনেও হাসি—কান্না, সুখ—দুঃখের সাথে মানসিক চাপও নিশ্চয়ই আছে। তাহলে মানসিক চাপ এদেরকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত করতে পারছে না কেন? কারণ মানসিক চাপ কাউকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত করতে পারে তখন, যখন মানুষ পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম না করার ফলে শরীরে কোলেস্টেরল বৃদ্ধি পায়। যেসব মানুষের শরীরে কোলেস্টেরল বাড়তে পারে না, তারা শুধু ডায়াবেটিস নয়, হার্ট অ্যাটাক এবং উচ্চ রক্তচাপ থেকেও বেঁচে থাকে। তাই মানসিক চাপ ডায়াবেটিসসহ এ তিনটি রোগের প্রত্যক্ষ কারণ নয়। বরং এসব রোগের প্রত্যক্ষ কারণ শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা বা আরামপ্রিয় জীবন যাপন করা। আরামে থাকলেই মানুষকে রোগগুলো আক্রমণ করার সুযোগ পায়।



১৭. ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং উচ্চ রক্তচাপ এই রোগ তিনটি একই সূত্রে গাঁথা

ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং উচ্চ রক্তচাপ এই রোগগুলোর একটার সাথে আরেকটার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। রোগগুলো একই সূত্রে গাঁথা। কাউকে এরকম একটা রোগ আক্রমণ করলে অন্য রোগগুলোও তাকে আক্রমণ করার সম্ভাবনা খুব বেড়ে যায় এবং আক্রমণ করেও প্রায়ই। কারণ একই ধরনের কারণে রোগগুলো মানুষকে আক্রমণ করে। যাদেরকে রোগগুলো আক্রমণ করে, খুঁজলে দেখা যায়, তাদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য এবং জীবনযাত্রা প্রায় একই। তাই রোগগুলো যে সমগোত্রীয়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে যারা এরকম কোনো একটি বা দু’টি রোগে আক্রান্ত হবার পর সেগুলো নিয়ন্ত্রণের যথাসাধ্য চেষ্টা করে, তাদেরকে সমগোত্রীয় অন্য কোনো রোগ সহজে আক্রমণ করতে পারে না। কিন্তু যারা অবহেলা করে, রোগ নিয়ন্ত্রণের তেমন চেষ্টা করে না, তাদেরকে খুব দ্রুত অন্য রোগগুলো আক্রমণ করে বসে। বিষয়টা ভালোভাবে বুঝতে হলে প্রথমে আমরা বাস্তবতার দিকে একটু চোখ বুলাই।

বাস্তবতা কী বলে?

এমন অসংখ্য মানুষ আমি দেখেছি আমার পরিচিতজনদের মধ্যে, যারা একই সাথে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ এবং ডায়াবেটিস এই তিনটি রোগেই আক্রান্ত। উদাহরণ দিতে চাই না। কারণ আমার দেয়া উদাহরণ শুধু আমার পরিচিতজনরাই যাচাই করে দেখার সুযোগ পাবে সহজে, অন্যরা নয়। তাই উদাহরণ খুঁজে নেয়ার দায়িত্ব সকলের উপর ছেড়ে দিচ্ছি। আপনার পরিচিত যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, দেখবেন তাদের অনেকে উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগ এই দু’টির একটি বা উভয়টিতেও আক্রান্ত, আবার যারা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত, তাদের অনেকে দেখবেন ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ এই দু’টি রোগের একটি বা উভয়টিতেও আক্রান্ত, আবার যারা হৃদরোগে আক্রান্ত, তাদের অনেককে দেখবেন উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস এই দু’টি রোগের একটি বা উভয়টিতেও আক্রান্ত। তবে হৃদরোগে অনেকে আক্রান্ত হবার পর বেশিদিন বেঁচে থাকতে পারে না বলে সমগোত্রীয় অন্য রোগে আক্রান্ত হবার সুযোগই পায় না বলে হৃদরোগে আক্রান্তদের মধ্যে এ জাতীয় অন্য রোগ দেখা যায় কম। আবার অনেক হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তি বাইপাস সার্জারী করে অনেকটা সুস্থ হয়ে যাবার কারণে বা নিয়মিত কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণের ঔষধ সেবন করার ফলে তাদেরকে সমজাতীয় অন্য রোগ আক্রমণ করতে সময় লেগে যায়। তবে হৃদরোগে আক্রান্ত অধিকাংশ ব্যক্তিকে দেখবেন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত না হলেও উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত।

অনেক মানুষ প্রথমে আক্রান্ত হয় উচ্চ রক্তচাপে, তা নিয়ন্ত্রণে ত্রুটি করলে অন্য দু’টি রোগের কোনো একটি বা উভয়টি তাকে একসময় আক্রমণ করে বসে। অনেককে প্রথমে আক্রমণ করে ডায়াবেটিস, তা নিয়ন্ত্রণ না করলে একসময় হৃদরোগ বা উচ্চ রক্তচাপ তাকে আক্রমণ করে বসে। অনেকে আবার প্রথমে আক্রান্ত হয় হৃদরোগে, তা নিয়ন্ত্রণে ত্রুটি করলে তাকে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস এই দু’টি রোগের একটি বা উভয়টি একসময় আক্রমণ করে বসে।

তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষ প্রথমে আক্রান্ত হয় উচ্চ রক্তচাপে। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ না করলে তাদেরকে ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ এই দু’টি রোগের কোনো একটি বা উভয়টি আক্রমণ করে। খুব কম লোক এমন পাওয়া যায়, যারা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হবার পর তা নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা না নেয়ার পরও ১০—১৫ বছর ধরে ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ এই দু’টি রোগের কোনো একটি বা উভয়টি থেকে নিরাপদ ছিলেন।
একটু খুঁজলেই আমাদের আশেপাশে এমন অসংখ্য লোক পাওয়া যাবে, যাদের কেউ এরকম দু’টি রোগে, কেউ আবার একই সাথে তিনটি রোগেই আক্রান্ত। এই রোগগুলোর কোনো একটিতে ১০ বছর ধরে আক্রান্ত এক হাজার রোগীর খেঁাজ নিলে দেখা যাবে তাদের অন্তত ৮০০ জন লোক এজাতীয় একাধিক রোগে আক্রান্ত। কারণ? কারণ হলো, রোগ তিনটির মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব রয়েছে।

রোগগুলোর কারণ সম্পর্কে কিছু মতামত

বিষয়টা আরো স্পষ্টভাবে বুঝার জন্য রোগগুলোর কারণ সম্পর্কে একটু আলোচনা করা যাক। রোগগুলোর কারণ সম্পর্কে আমি অনেক গবেষণা প্রতিবেদন এবং পত্রপত্রিকায় ডাক্তারের লেখা অনেক নিবন্ধ পড়েছি। অনেক মানুষের মুখেও রোগগুলোর কারণ সম্পর্কে অনেক কথা শোনা যায়। দুঃখজনক হচ্ছে, রোগগুলোতে আক্রান্ত হবার তিন—চারটি প্রকৃত কারণ ছাড়াও অনেকগুলো কারণকে গড়পড়তাভাবে রোগগুলোর জন্য দায়ী বলে প্রচার করা হয়। যেমন: পূর্বপুরুষদের কারো রোগগুলো থাকা, বয়স ৪৫ বা তার বেশি হওয়া, টেনশন বা মানসিক অস্থিরতা, ধূমপান, মদপান, চিনি বা মিষ্টিজাতীয় খাবার বেশি খাওয়া, লবণ খাওয়া, খাদ্যে ফরমালিন বা ভেজাল, অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম ইত্যাদি। দু’একটা নমুনা দেখা যাক:

৮ অক্টোবর ২০১৬ তারিখের দৈনিক আমাদের সময়ে ডা: এম শমশের আলী একটি নিবন্ধ লেখেন ‘হাই প্রেশার ও হৃদরোগ’ শিরোনামে। সেখানে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের কারণ সম্পর্কে বলা হয়, ‘যারা বেশি টেনশনের কাজ করেন, যাদের কাজের চাপ খুব বেশি, যারা কাজের চাপের জন্য শরীরের যত্ন নিতে পারেন না, ঠিকমতো খাওয়া—দাওয়া, বিশ্রাম বা ঘুমাতে পারেন না, তাদের উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। দুশ্চিন্তা, অবসন্ন, বংশগত প্রবণতা, অতিমাত্রায় ধূমপান ও মদ্যপান উচ্চ রক্তচাপের কারণ হিসেবে বিবেচিত। যারা খুব বেশি প্রতিযোগী মনোভাবাপন্ন, তাদেরও এ রোগে ভোগার আশঙ্কা রয়েছে। কায়িক শ্রমের অভাব বা অলস জীবনযাপন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, অতিমাত্রায় লবণ খাওয়ার অভ্যাস, শারীরিক ওজন বৃদ্ধি, ডায়াবেটিস ও রক্তে উচ্চ মাত্রায় কোলেস্টেরল উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।... অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ বিভিন্নভাবে হৃদরোগ সৃষ্টি করতে পারে এবং যাদের অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ আছে, তাদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা শতভাগ।’

১১ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখের বাংলাদেশ প্রতিদিনে ‘হৃদরোগের লক্ষণ ও তা থেকে বাঁচার উপায়’ শিরোনামে একটি লেখা প্রকাশিত হয়, যা লিখেছেন ঢাকার ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট, কার্ডিওলজিস্ট ও সিসিইউ ইনচার্জ ডা. মাহবুবর রহমান। সেখানে বলা হয়, ‘গবেষণায় দেখা যায়, পারিবারিক ইতিহাস ও জেনেটিক বৈশিষ্ট্যই হৃদরোগের ক্ষেত্রে প্রধান ও নিয়ন্ত্রণের অযোগ্য কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, নিয়ন্ত্রণযোগ্য কারণেই মানুষ আজকাল হৃদরোগে আক্রান্ত হন বেশি। এসব কারণের মধ্যে রয়েছে— উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ধূমপান, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, মানসিক চাপ এবং অতিরিক্ত ওজন।’

১৭ মে ২০১৮ তারিখের দৈনিক সমকালে ‘বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস’ উপলক্ষ্যে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ‘আজ বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস’ শিরোনামে। সেখানে বলা হয়, ‘এক গবেষণায় দেখা গেছে, ওজন বাড়লে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার হার দুই থেকে ছয়গুণ বেড়ে যায়। এ ছাড়া  অতিরিক্ত লবণ খাওয়া, ধূমপান, মদপানও উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টিতে দায়ী।’

এ লেখার ‘উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগের কারণ সম্পর্কে ভুল ধারণা’ শিরোনামের অধ্যায়ে  ‘উচ্চ রক্তচাপে করণীয়’ শিরোনামে ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখের দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত একটি লেখার অংশবিশেষ উল্লেখ করা হয়েছে। লেখাটিতে ‘৯০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের কোনো নির্দিষ্ট কারণ জানা যায় না’ বলা হলেও উচ্চ রক্তচাপের আশংকা বাড়ায়, এমন কিছু বিষয়ের উল্লেখ করা হয়। যথা: বংশানুক্রমিক, ধূমপান, অতিরিক্ত লবণ গ্রহন, অধিক ওজন ও অলস জীবনযাত্রা, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, অতিরিক্ত মদপান, ডায়াবেটিস ও অতিরিক্ত উৎকন্ঠা।

‘আপনি কি ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে আছেন?’ শিরোনামে একটি লেখা ছাপা হয় ৮ অক্টোবর ২০১৭ তারিখের প্রথম আলোয়। লিখেছেন ঢাকার বিআইএইচএস জেনারেল হাসপাতালের ডায়াবেটিস ও হরমোন বিশেষজ্ঞ ডা. এ হাসনাত শাহীন। আট ধরনের মানুষকে লেখাটিতে ডায়াবেটিসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করা হয়। যথা: ১. বয়স ৪৫ বা তার বেশি ২. স্থূল ব্যক্তি ৩. রক্ত—সম্পর্কীয় নিকটাত্মীয়ের ডায়াবেটিস থাকলে ৪. শারীরিক পরিশ্রমের ঘাটতি ৫. গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বা অধিক ওজনের সন্তান প্রসবের পূর্ব ইতিহাস ৬. পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম ৭. উচ্চ রক্তচাপ, স্টে্রাক বা হৃদরোগ এবং ৮. রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা বেশি এবং এইচডিএলের মাত্রা কম থাকলে।

‘ডায়াবেটিসের ঝুঁকি সম্পর্কে যেসব জানা জরুরি’ শিরোনামে বিবিসি বাংলায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ১৩ নভেম্বর ২০১৮। সেখানে ডায়াবেটিস প্রতিরোধের কিছু উপায় উল্লেখ করা হয়। ‘প্রতিরোধের উপায়’ আর ‘কারণ’ প্রকারান্তরে একই কথা। বলা হয়, ‘ডায়াবেটিস যদিও জেনেটিক এবং আপনার জীবন যাপনের স্টাইলের ওপর নির্ভরশীল তারপরেও আপনি চেষ্টা করলে রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পারেন। সেজন্যে আপনাকে খাবার গ্রহণের বিষয়ে বিশেষভাবে সচেতন থাকতে হবে এবং আপনাকে হতে হবে অত্যন্ত সক্রিয় একজন মানুষ। প্রক্রিয়াজাত খাবার ও পানীয় এড়িয়ে চলতে হবে। মসৃন শাদা আটার রুটির পরিবর্তে খেতে হবে ভুষিওয়ালা আটার রুটি। এটাই প্রথম ধাপ। এড়িয়ে চলতে হবে হোয়াইট পাস্তা, প্যাস্টি্র, ফিজি ড্রিংকস, চিনি জাতীয় পানীয়, মিষ্টি ইত্যাদি।

আর স্বাস্থ্যকর খাবারের মধ্যে রয়েছে শাক সব্জি, ফল, বিন্স এবং মোটা দানার খাদ্য শস্য। স্বাস্থ্যকর তেল, বাদাম খাওয়াও ভালো। ওমেগা থ্রি তেল আছে যেসব মাছে সেগুলো বেশি খেতে হবে। যেমন সারডিন, স্যামন এবং ম্যাকেরেল।

এক বেলা পেট ভরে না খেয়ে পরিমানে অল্প অল্প করে বিরতি দিয়ে খাওয়া দরকার।
শরীর চর্চা বা ব্যায়াম করার মাধ্যমে রক্তে চিনির মাত্রা কমিয়ে রাখা সম্ভব। চিকিৎসকরা বলছেন, প্রতি সপ্তাহে আড়াই ঘণ্টার মতো ব্যায়াম করা দরকার। তার মধ্যে দ্রুত হাঁটা এবং সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠাও  রয়েছে।
ওজন কম রাখলেও চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। যদি ওজন কমাতে হয় তাহলে সেটা ধীরে ধীরে করতে হবে। সপ্তাহে আধা কেজি থেকে এক কেজি পর্যন্ত।
ধূমপান পরিহার করাও জরুরী। নজর রাখতে হবে কোলস্টেরলের মাত্রার ওপর। এর মাত্রা বেশি হলে হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।’ [https://www.bbc.com/bengali/news-46194839]

উপরের প্রতিবেদনগুলোতে হার্ট অ্যাটাক, ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপের অনেকগুলো কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, কারণগুলোর মধ্যে কিছু আছে, তিনটি রোগের ক্ষেত্রেই যেগুলো অনিবার্যভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন: কায়িক শ্রমের অভাব বা অলস জীবনযাপন, শারীরিক ওজন বৃদ্ধি, রক্তে উচ্চ মাত্রায় কোলেস্টেরল, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি। যেহেতু রোগগুলো কিছু কমন বা সাধারণ কারণে হয়ে থাকে, তাই রোগগুলো অবশ্যই সমগোত্রীয়।
নির্দিষ্ট এ কারণগুলো ছাড়া অন্য যে কারণগুলোকে রোগগুলোর জন্য দায়ী করা হয়েছে, (যেমন: ধূমপান, মদপান, লবণ খাওয়া, চিনি/মিষ্টি খাওয়া, বয়স বেশি হওয়া, বংশের কারো থাকা ইত্যাদি) সেগুলো যে সত্যিই রোগগুলোর জন্য দায়ী নয়, তা শুধু এদিকে লক্ষ্য করলেই বুঝা যায়, সব নিবন্ধ/প্রতিবেদনে এগুলোকে রোগগুলোর জন্য দায়ী বলে উল্লেখ করা হয়নি। একেকটিকে একেক জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে। যদি এগুলো সত্যিই রোগগুলোর জন্য দায়ী হতো, তাহলে সব লেখায় এগুলোর প্রত্যেকটিকে অপরিহার্যভাবে উল্লেখ করা হতো।

মতামতগুলোর সাথে বাস্তবতার মিল কতটুকু?

এই নিবন্ধ/প্রতিবেদনগুলোতে উল্লেখিত কারণগুলোর কোনটি সত্যিকারের কারণ, আর কোনটি সত্যিকারের কারণ নয়, তা আমরা বাস্তবতার সাথে মিলিয়ে দেখলেও বুঝতে পারবো। বাস্তবতার সাথে মিলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, যেসব লোক দিনের বেশির ভাগ সময় শারীরিক পরিশ্রমেই কাটিয়ে দেয় বা রুটিনমাফিক দৈনিক দু’এক ঘন্টা ব্যায়াম করে, তারা ফাস্টফুডে আসক্ত হলেও, বয়স বেশি হলেও, ধূমপান করলেও, মাদকের সাথে সম্পর্ক রাখলেও, চিনি/মিষ্টান্ন/লবণ মনমতো খেলেও, এমনকি তাদের জীবনে অনেক মানসিক চাপ থাকলেও তাদের শরীরে কোলেস্টেরল বাড়তে পারে না বলে তারা রোগগুলো থেকে মুক্ত থাকে।

আর যেসব মানুষ পনেরো—বিশ বছর ধরে এমন পেশায় নিযুক্ত, যেখানে সারাক্ষণ বসে বসেই কাজ করতে হয়, ব্যায়ামে অভ্যস্ত নয়, এককথায় যাদের জীবনে শারীরিক পরিশ্রম তেমন নেই বা থাকলেও খুব কম, তারা ফাস্টফুড বা জাঙ্কফুড খাক বা না খাক, মিষ্টান্ন/চিনি/লবণ বেশি বা কম খাক, ধূমপান করুক বা না করুক, মদপান করুক বা না করুক, তাদের টেনশন কম থাক বা বেশি থাক বা না থাক, তাদের বাবা—মা এরকম রোগে আক্রান্ত হোক বা না হোক, তারা এসব রোগ থেকে রক্ষা পায় না। এমনকি, এরকম একটা রোগে আক্রান্ত হবার পরও যখন তাদের টনক না নড়ে, তা নিয়ন্ত্রণে একটু গড়িমসি বা অবহেলা করে, তখন এ জাতীয় অন্য রোগও তাকে পেয়ে বসে।

এক কথায় এটাই বাস্তব, শারীরিক পরিশ্রম যে যত বেশি করে, তার নিকট থেকে এসব রোগ তত বেশি দূরে থাকে আর শারীরিক পরিশ্রম থেকে যে যত বেশি দূরে থাকে, সে তত বেশি এসব রোগে আক্রান্ত হয়। রোগগুলোর সম্পর্ক শুধুই পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম করা বা না করার সাথে। মূলত এখানে এসেই রোগগুলো এক সূতোয় গেঁথে যায়।

রোগগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে কিছু মতামত

বিষয়টা আরো পরিষ্কারভাবে বুঝার জন্য বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে এই রোগ তিনটির মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে প্রকাশিত কিছু প্রতিবেদন ও নিবন্ধে বর্ণিত মতামত উল্লেখ করা হলো। আশা করি এগুলো পড়ার পর এটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ থাকবে না, রোগগুলো যে একই সূত্রে গাঁথা।

# প্রথমে ডায়াবেটিস থেকে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়া নিয়ে:

‘উচ্চ রক্তচাপের কারণ ও প্রতিকার’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় জার্মানির জনপ্রিয় সংবাদ মাধ্যম ডয়চে ভেলে বাংলার ওয়েবসাইটে ২৬ জুন ২০১৩ তারিখে, যা লিখেছেন নুরুননাহার সাত্তার। প্রতিবেদনটির ‘উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার কারণ অনেক’ শিরোনামের পরিচ্ছেদে বলা হয়, ‘উচ্চ রক্তচাপের ঠিক আসল কারণ কী তা সেভাবে প্রমাণ হয়নি। তবে অতিরিক্ত ওজন, স্টে্রস, বেশি মাত্রায় মদ্য পান, ধূমপান, ডায়েবেটিস—২ যাঁদের রয়েছে এবং বয়স— এসবই এর প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। তাছাড়া জেনেটিক কারণও রয়েছে। অর্থাৎ মা—বাবার ‘হাই প্রেশার’ থাকলে সন্তানদেরও হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।’

ডায়াবেটিসের সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপের সম্পর্কের বিষয়ে বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল এনটিভির নিয়মিত আয়োজন ‘স্বাস্থ্য প্রতিদিন’ অনুষ্ঠানের ২৯২৪ তম পর্বে কথা বলেন ঢাকার ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. এম এ রশীদ। এনটিভির ওয়েবসাইটে ১ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে অনুষ্ঠানটির ভিডিওসহ অনুষ্ঠানটির বিষয়বস্তু লিখিত আকারে ‘ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের সম্পর্ক কী?’ শিরোনামে প্রকাশ করা হয়। আলোচনায় অধ্যাপক ডা. এম এ রশীদ বলেন, ‘ডায়াবেটিসের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে উচ্চ রক্তচাপের। যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে, তাদের কিন্তু উচ্চ রক্তচাপের আশঙ্কা বেশি।’

ঢাকার বারডেম হাসপাতালের ল্যাবরেটরী সার্ভিসেসের পরিচালক অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরীর একটি লেখা প্রকাশিত হয় দৈনিক ইত্তেফাকে ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৩ তারিখে ‘ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ’ শিরোনামে। সেখানে তিনি বলেন, ‘যাদের ডায়াবেটিস নেই, তাদের তুলনায় যাদের ডায়াবেটিস আছে, তাদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ দেখা যায় বেশি। এমন দেখা যায়, পূর্ণবয়স্ক তিন জন ডায়াবেটিস রোগীর মধ্যে দুই জনেরই থাকে উচ্চ রক্তচাপ। ডায়াবেটিস থাকলে উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার ঝুঁকিও দ্বিগুণ। চিকিৎসা না হলে উচ্চ রক্তচাপ থেকে হতে পারে হার্ট এ্যাটাক ও স্টে্রাক।’

দৈনিক যুগান্তরে ২৮ জুলাই ২০১৮ তারিখে ‘ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ ও সহকারী অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম। সেখানে উল্লেখ করা হয়, ‘২০০৮ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্টে্রর ২০ বছরের বেশি বয়সী ডায়াবেটিস রোগীর ৭৩ শতাংশই উচ্চ রক্তচাপেও ভুগছিল।’

# এবার ডায়াবেটিস থেকে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া নিয়ে:

‘ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় প্রথম আলোয় ১৩ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে, যা লিখেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাকা) ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট অধ্যাপক এস এম মুস্তফা জামান। সেখানে তিনি বলেন, ‘গবেষণা বলছে ৭০ শতাংশ ডায়াবেটিসের রোগী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েই অকালে মৃত্যুবরণ করে থাকেন। ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ— এ দুটো পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। যে বিষয়গুলো ডায়াবেটিসের ঝুঁকি হিসেবে বিবেচিত, যেমন: অতি ওজন, ধূমপান, মন্দ খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা বা বংশগতি, এগুলো হৃদরোগেরও ঝুঁকি। তাই এ দুটো সমস্যা পরস্পরের হাত ধরেই চলে। একটির ঝুঁকি কমালে অপরটির ঝুঁকিও কমে আসে।’

‘ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের সম্পর্ক কী?’ শিরোনামে এনটিভির ওয়েবসাইটে ০১ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত যে ফিচারটির একটি অংশ একটু আগে উল্লেখ করা হয়, সে ফিচারটির আরেকটি অংশ এখানে উল্লেখ করতে হচ্ছে।

‘প্রশ্ন : ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ দুটোর মধ্যে সম্পৃক্ততা কোথায়?
উত্তর : বিষয়টি কিন্তু অত্যন্ত মূল্যবান। ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ দুটো রোগই কিন্তু প্রতিরোধযোগ্য।... ডায়াবেটিসের সঙ্গে হৃদরোগের ব্যাপক সম্পর্ক রয়েছে। যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে, তাদের হৃদরোগ হওয়ার আশঙ্কা বেশি।’
ফিচারটির দুটো বক্তব্য একত্র করলে যোগফল এই দাঁড়ায়, রোগ তিনটি একে অন্যের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত।

বাংলাদেশ প্রতিদিনে ৬ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে ‘হৃদরোগ যখন ডায়াবেটিস রোগীর’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. এম শমশের আলী। তিনি সেখানে বলেন, ‘ডায়াবেটিস রোগীর হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি শতভাগ। আপনি যদি হৃদরোগের ঝুঁকি এড়াতে চান তবে প্রথম অবস্থা থেকেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে আপনাকে বেশ তৎপর হতে হবে।’

# এবার উচ্চ রক্তচাপ থেকে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া নিয়ে:

‘উচ্চ রক্তচাপে কেন ওষুধ ব্যর্থ হয়’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় দৈনিক কালের কণ্ঠে ২৮ অক্টোবর ২০১৮ তারিখে। সেখানে বলা হয়, ‘সারা বিশ্বে মানুষের একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয় এখন হৃদরোগ। যদি আপনার উচ্চ রক্তচাপ থাকে তবে আপনাকে এই রোগের বিপদ সম্পর্কে নিশ্চয়ই চিকিৎসকরা সতর্ক করেছেন।

উচ্চ রক্তচাপে রক্তনালীর বেষ্টনীর বিরুদ্ধে রক্তের চাপ খুব বেশি হয়। ফলে হৃদযন্ত্র এবং রক্তনালীকে বাড়তি কাজ করতে হয়। এতে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে।’

বাংলাদেশ প্রতিদিনে ১৯ মে ২০১৮ তারিখে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় ‘উচ্চ রক্তচাপ : নীরব ঘাতক’ শিরোনামে, যা লিখেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের অধ্যাপক ও ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘দিন দিন উচ্চ রক্তচাপ মানুষের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রিত না থাকলে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ চারটি অঙ্গে মারাত্মক ধরনের জটিলতা হতে পারে। যেমন— হৃৎপিন্ড, কিডনি, মস্তিষ্ক ও চোখ। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ থেকে হৃদযন্ত্রের মাংসপেশি দুর্বল হয়ে যেতে পারে। ফলে হৃদযন্ত্র রক্ত পাম্প করতে পারে না এবং এই অবস্থাকে বলা হয় হার্ট ফেইলিওর।’

# এবার উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে:

জার্মানীর জনপ্রিয় সংবাদ মাধ্যম ডয়চে ভেলের ওয়েবসাইটে ‘হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ চিনুন, জীবন বাঁচান’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ১৫ আগস্ট ২০১৪ তারিখে, যা তৈরি করেন নুরুননাহার সাত্তার । সেখানে ‘হার্ট অ্যাটাকের কারণ বা ঝুঁকিগুলো কী?’ শিরোনামের পরিচ্ছেদে বলা হয়, ‘অতিরিক্ত ওজন, উচ্চ রক্তচাপ, ধূমপান, মদ্যপান, স্টে্রস বা মানসিক চাপ, কম হাঁটা—চলা, ডায়বেটিস ইত্যাদি।’ [https://www.dw.com/overlay/media/bn/17856309/40942842]

‘হার্টের অসুখ প্রতিরোধ করা যায়’ শিরোনামে দৈনিক কালের কন্ঠে ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় ‘বিশ্ব হার্ট দিবস’ উপলক্ষ্যে, যা লিখেছেন এম এইচ শমরিতা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের (ঢাকা) হৃদরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ। সেখানে বলা হয়, ‘বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, জীবনযাত্রা যত আধুনিক হচ্ছে হার্টের অসুখে আক্রান্তের হার তত বাড়ছে।’ নিবন্ধটির শেষদিকে হৃদরোগ প্রতিরোধের জন্য যে বিষয়গুলো মেনে চলার কথা বলা হয়, সেগুলোর একটি হচ্ছে— ‘উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস থাকলে তা অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।’

‘ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ’ শিরোনামে একটি লেখা দৈনিক নয়াদিগন্তে প্রকাশিত হয় ৯ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে, যা লিখেন, ডা. হাফিজা লুনা। তাতে বলা হয়, ‘ডায়াবেটিস রোগীরা অধিকহারে ও তীব্রতরভাবে হৃদরোগের শিকার হয়।...যাদের ডায়াবেটিস টাইপ—২ হয়েছে, তাদের উচ্চ রক্তচাপে ভোগার সমূহ সম্ভাবনা আছে। একই সাথে রক্তের লিপিডের অস্বাভাবিকতা, দৈহিক স্থূলতা ইত্যাদিও ২ থেকে ৪ গুণ হারে বৃদ্ধি পায়। সর্বোপরি হৃদরোগ সামগ্রিকভাবে কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আমাদের দেশের টাইপ—২ ডায়াবেটিস রোগীদের ৭০ শতাংশ উচ্চ রক্তচাপ, ৯৭ শতাংশ রক্তে লিপিডের অস্বাভাবিকতা ও ৮০ শতাংশ দৈহিক ওজনজনিত সমস্যায় ভোগেন। এসব রোগ একই সূত্রে বাঁধা— এমনো মতামত দেয়া হয়। এরূপ চক্রকে মেটাবলিক সিনড্রোম বলে।’


১৮. ডায়াবেটিসকে বংশগত রোগ বলে প্রচার করার ক্ষতি


ঘরে ঘরে এখন মানুষের ডায়াবেটিস, আগে এমনটা ছিল না

ডায়াবেটিস কেন হয়, সে সম্পর্কে আমাদের ধারণায় বড় ধরনের ভুল রয়েছে। ডায়াবেটিসের কারণ সম্পর্কে অনেককেই বলতে শুনি এবং পত্রপত্রিকায় ডায়াবেটিস সম্পর্কে অনেক নিবন্ধে অনেক ডাক্তারকে লেখতে দেখি, বংশগত কারণেও নাকি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়।
খুব গভীরভাবে দেখেছি, ডায়াবেটিস সম্পর্কে এমন বিশ্বাস বা বক্তব্যের কোনো বাস্তবতা নেই। একটা সময় ছিল, সমাজের পাঁচ শতাংশ মানুষেরও ডায়াবেটিস ছিল না। ডায়াবেটিস নামক কোনো রোগের সাথে মানুষের তেমন পরিচয়ও ছিল না। মানুষ শারীরিক পরিশ্রমের বিভিন্ন কাজের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকতো। আর তখন মানুষের দৈনন্দিন কাজকর্মের প্রায় সবগুলোতে কায়িক শ্রম ছিল। কায়িক শ্রম ছিল না, এমন কাজ তখন তেমন ছিলই না। মানুষ তখন একেবারে শেষ বয়সে যখন কাজকর্ম থেকে পুরো অবসরে চলে যেতো, তখন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতো। যে সমাজে এক সময় ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা হাতে গোনা যেতো, সেই সমাজে এখন ডায়াবেটিসের এতো ছড়াছড়ি কেন? অবস্থা এমন পযার্য়ের দিকে যাচ্ছে, অল্প ক’বছর পর হয়তো ৪০—৫০ বছরের বেশি বয়সী ডায়াবেটিসহীন মানুষ খুঁজে বের করাও কষ্টকর হয়ে পড়তে পারে। এখন শুধু বয়স্করা নয়, মধ্যবয়সী এবং তরুণরা নয়, শিশুরাও এখন বিশ^ব্যাপী ব্যাপকহারে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে শুরু করেছে।

আমার এক আত্মীয়ের পরিবারে পাঁচ—পাঁচজন লোক ডায়াবেটিস রোগী! আমার এক সহকমীর্র চার বোনের মধ্যে তিনজনই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত! আমার এক বন্ধু আছে মামুন নামে। সে বললো, তাদের পরিবারে সে ব্যতীত তার বাবা—মা, ভাই—বোন (মোট ৭ জন) সবাই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছে! আমার বিশ্বাস, এরকম একই পরিবারে একাধিক মানুষের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার অনেক ঘটনা অনেকের জানা থাকতে পারে।

‘মহামারী রূপ নিচ্ছে ডায়াবেটিস’ শিরোনামে বিডি জার্নালে ১৪ নভেম্বর ২০১৯ তারিখে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়, ‘ডায়াবেটিস মহামারী রূপ নিচ্ছে। দ্রুত নগরায়ণের ফলে পরিবর্তিত জীবনযাপনের কারণে বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হারে বাড়ছে। আইডিএফের (আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ফেডারেশন) ২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে বর্তমানে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা সাড়ে ৪২ কোটি। ১৯৮৫ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র তিন কোটি। গত আড়াই দশকে ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১৩ গুণ বেড়েছে।’ [https://www.bd-journal.com/health/95095]


চল্লিশ—পঞ্চাশ বছর আগেও ডায়াবেটিস রোগী ছিল সমাজে দুর্লভ, আর এখন ঘরে ঘরে মানুষের ডায়াবেটিস, এটাই বাস্তবতা। যদি আগে অধিকাংশ মানুষের ডায়াবেটিস থাকতো, তাহলেই এখন বলা যেতো, ডায়াবেটিস বংশগত কারণে হয়ে থাকে। বিশে^র প্রায় সব দেশে এমন লক্ষ লক্ষ পরিবারে এখন অনেকের ডায়াবেটিস, যেসব পরিবারে আগে কারো ডায়াবেটিস ছিল না। তাহলে রোগটি কিভাবে বংশগত হলো? আমার বাবা—মা, দাদা—দাদী বা নানা—নানী কারোই ডায়াবেটিস ছিল না, অথচ আমার দু’ভাই ইতোমধ্যে ডায়াবেটিসের শিকার হয়ে গেছেন কিভাবে!

বর্তমানে ৩৫ থেকে ৫০/৫৫ বছর বয়সী অনেক ডায়াবেটিস রোগীর পূর্বপুরুষেরও ডায়াবেটিস দেখেই ডাক্তাররা এবং সাধারণ মানুষ মনে করে বসে ডায়াবেটিস বংশগত রোগ। কিন্তু এদিকে লক্ষ্য করে না, বর্তমানে ৬০ বছরের বেশি বয়সী যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, তাদের অধিকাংশেরই বাবা—মা বা পূর্বপুরুষ কারো ডায়াবেটিস ছিল না। ৩৫ বছরের বেশি বয়সী যারা এখন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, তাদের অনেকের পূর্বপুরুষের ডায়াবেটিস আছে দেখেই রোগটিকে বংশগত মনে করা যে ভুল, তা প্রমাণিত হবে বর্তমানে ৬০ বছরের বেশি বয়সী যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, তাদের অধিকাংশেরই বাবা—মা বা পূর্বপুরুষের যে ডায়াবেটিস ছিল না, সেদিকে লক্ষ্য করলে।

‘মহামারী রূপ নিচ্ছে ডায়াবেটিস’ শিরোনামের প্রতিবেদন থেকেই স্পষ্ট, যত পেছনে যাওয়া যায়, দেখা যাবে তখন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা তত কম ছিল। আইডিএফের হিসাব মতেই, ১৯৮৫ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পৃথিবীতে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৩ গুণ বেড়েছে। শুধু এই পরিসংখ্যান থেকেই প্রমাণিত হয়, ডায়াবেটিস কোনো বংশগত রোগ নয়। কারণ এখন এমন অনেক মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, যাদের পূর্বপুরুষরা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিল না। 

এককথায় ডায়াবেটিসের কারণ যাদের নিকট পরিষ্কার, তারা কখনো ডায়াবেটিসকে বংশগত বলে বিশ্বাস করতে পারেন না। ডায়াবেটিসের কারণ নিয়ে শুরুতেই কিছুটা আলোচনা করা হয়েছে। আবারও আলোচনা করা হবে একটু পর। আমরা এখন দেখি, ডায়াবেটিসকে বংশগত রোগ বলে প্রচার করায় কী ক্ষতি হচ্ছে?

প্রথম ক্ষতি

ডায়াবেটিসের সত্যিকারের কারণ সম্পর্কে যাদের তেমন কোনো ধারণা নেই, তারাই এই রোগটির গায়ে বংশগত রোগের লেবেল লাগিয়ে দিচ্ছেন। এটা ঠিক নয়। ভুল ধারণাটি এখনই দূর করা না গেলে ৫০—৬০ বছর পর মানুষের এই ধারণা দূর করা খুবই কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ এখন তো মানুষ অহরহ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। ৫০—৬০ বছর পর তখনকার প্রজন্মের কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে যখন সে দেখবে, তার পূর্বপুরুষরাও গণহারে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিল, তখন সে নিশ্চিতভাবে রোগটিকে বংশগত রোগ মনে করবে। তখন এ ধারণা ভুল প্রমাণ করা অনেকটা অসম্ভব হয়ে যাবে।

দ্বিতীয় ক্ষতি

ডায়াবেটিসকে বংশগত রোগ বলার কারণে কমপক্ষে দুই শ্রেণির মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়— (১) যাদের এখনো রোগটি হয়নি, তারা যখন জানে রোগটি বংশগত, তখন দেখে নিজেদের বাবা—মা কারো রোগটি হয়েছে কিনা। যদি দেখে হয়নি, তখন তারা রোগটিতে আক্রান্ত হওয়া থেকে নিশ্চিন্ত থাকে, রোগটি প্রতিরোধের কোনো চেষ্টা করে না। এভাবে একসময় তারা রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে, সত্যিকারার্থে যে কারণে মানুষ রোগটিতে আক্রান্ত হয়, সেই কারণেই। (২) যেসব লোকের বাবা—মা কেউ রোগটিতে ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়ে গেছে, তারা যখন জানে, রোগটি বংশগত, তখন তাদের মনে একটা আতঙ্ক সৃষ্টি হয়, কখন তারা আবার রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে বসে! রোগটিতে আক্রান্ত হবার জন্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারা অপেক্ষা করতে থাকে। তাদের মনে সব সময় এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করে। এই আতঙ্ক তাদের মন থেকে কোনোভাবে দূর করা যায় না এবং তারা মনে করে, রোগটি থেকে তাদের বেঁচে থাকার কোনো সুযোগ নেই। তাই তারা রোগটি প্রতিরোধের কোনো চেষ্টাই করে না। কারণ রোগটি যে বংশগত! এভাবে একসময় তারাও রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। এই দু’রকম ঘটনা এখন সমাজে ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে শুধুই রোগটিকে বংশগত বলে অপপ্রচারের কারণে।

মানুষ কখন বংশতভাবে কোনো রোগে আক্রান্ত হয়?

সন্তান গর্ভধারণের সময় থেকে শুরু করে মাতৃদুগ্ধ পানের সময় পর্যন্ত এই নির্দিষ্ট সময়ে বাবা—মা যেসব রোগে আক্রান্ত থাকেন, কেবল সেই সব রোগ সন্তানের শরীরে সংক্রমিত হতে পারে। এক্ষত্রেও কথা আছে। যেসব রোগ রক্তবাহিত, কেবল সেগুলো একজনের শরীর থেকে আরেকজনের শরীরে সংক্রমিত হতে পারে। যেমন: এলার্জি, ক্যান্সার, বাতব্যথা বা আর্থারাইটিস ইত্যাদি। কিন্তু সন্তান গর্ভধারণের সময় থেকে শুরু করে মাতৃদুগ্ধ পানের সময় পর্যন্ত এই নির্দিষ্ট সময়ের পর বাবা—মা যদি কোনো রোগে আক্রান্ত হন, সেই রোগ সন্তানের শরীরে আপনা—আপনি সংক্রমিত হবার কোনো সুযোগ—ই নেই। তবে শুধু বাবা—মা যদি রোগটিতে আক্রান্ত অবস্থায় কখনো সন্তানকে রক্ত দিয়ে থাকেন, তখনই বাবা—মায়ের শরীর থেকে সন্তানের শরীরে সেই রোগ সংক্রমিত হতে পারে। রক্তদানের মাধ্যমে এই সংক্রমণকে কিন্তু বংশগত বলার সুযোগ নেই। কারণ যদি বাবা—মা কেউ তাদের সন্তানকে রক্ত না দিয়ে সেই রোগে আক্রান্ত অন্য কেউ তাদের সন্তানকে রক্ত দিতো, তাহলেও সন্তান সেই রোগে আক্রান্ত হতো।
আমার বয়স যখন ৩০ আর আমার বাবার বয়স যখন ৭০ বছর, তখন তিনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন। আমার জন্মের ৩০ বছর পর আমার বাবা যেই রোগে আক্রান্ত হলেন, সেই রোগ যদি আমার শরীরে সংক্রমিত হতে পারে, তাহলে সমাজের যে কারো যে কোনো রোগ আমার শরীরে সংক্রমিত হতে পারবে। বংশগত রোগ নিয়ে এ এক চরম মূর্খতা।

ডায়াবেটিসের কারণ নিয়ে একটি সমীক্ষা

ডায়াবেটিসকে যারা বংশগত ভাবতে বা বিশ্বাস করতে পছন্দ করেন, তাদেরকে একটি সমীক্ষা চালানোর অনুরোধ করবো। এখনো ঢাকা শহরে অসংখ্য রিকশাচালক পাবেন, যারা ‘পায়েচালিত’ রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। আপনি এরকম রিকশাচালকদের সাক্ষাৎকার নিন। তাদেরকে প্রথমে প্রশ্ন করুন— (১) আপনি কি ২০ বছরের বেশি সময় ধরে রিকশা চালাচ্ছেন? যদি ‘না’ বলে, তাহলে তাদেরকে বাদ দিন। যারা ‘হ্যাঁ’ বলবে, তাদেরকে পাল্টা প্রশ্ন করুন— (২) আপনি কি এই ২০ বছর রিকশা চালানোর মাঝে কোনো বিরতি দিয়েছেন? যদি ‘হ্যাঁ’ বলে, তাহলে তাদেরকে বাদ দিন। আর যদি ‘না’ বলে, তাদেরকে প্রশ্ন করুন, (৩) আপনি কি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত?

প্রথম প্রশ্নের উত্তরে ‘হ্যাঁ’ এবং দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে ‘না’ উত্তর প্রদানকারী ১০০ জনকে তৃতীয় প্রশ্নটি করলে দেখবেন, তাদের সবাই ‘না’ উত্তর দিচ্ছে। ২০ বছর বা তার চেয়ে বেশি সময় ধরে ‘নিয়মিত’ বা ‘বিরতিহীন’ভাবে ‘পায়েচালিত রিকশা যারা চালান, তাদের কাউকে পাবেন না, যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।
ডায়াবেটিস বংশগত কারণে হয় কিনা এবং ডায়াবেটিসর প্রকৃত কারণ কী, এই দুইটি বিষয় যাচাইয়ের জন্য এই রকম একটা সমীক্ষা চালানোই যথেষ্ট। শুধু পায়েচালিত রিকশাচালক নয়, কায়িক শ্রমনির্ভর যে কোনো পেশায় নিযুক্ত মানুষদের উপর সমীক্ষা চালালেই একই রকম ফল বের হয়ে আসবে।

এরকম সমীক্ষা সহজেই প্রমাণ করবে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার মূল কারণ কায়িক শ্রম থেকে দূরে থাকা। একজন লোকের জন্মের সময় তার বাবা—মা কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিল না। তার জন্মের অনেক বছর পর তার বাবা—মা কেউ রোগটিতে আক্রান্ত হয়েছেন কায়িক শ্রম থেকে দূরে সরে যাবার কারণে। সেই রোগটি তাকেও আক্রমণ  করতে পারে সে—ও যদি কায়িক শ্রম থেকে দূরে সরে যায় উভয়ে একই কারণে রোগটিতে আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও দুঃখজনকভাবে আমরা সন্তানের রোগটিকে বংশগত বলে আখ্যা দিচ্ছি।

কোনো রোগের সঠিক কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা না করে রোগটি রোগীর বাবা/মা কারো থাকার কথা জেনেই রোগটিকে বংশগত বলে ফেলা যে ক্ষতিকর, ডাক্তাররা তা বুঝতে পারলে কখনোই এভাবে মন্তব্য করতেন না।

ডায়াবেটিসকে বংশগত রোগ বলে প্রচার করে আমরা শুধু ভুল করছি না, পুরো মানবজাতির মারাত্মক ক্ষতিও করে যাচ্ছি। বংশগত রোগ মনে করার কারণে আমরা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়াকে নিয়তির উপরই ছেড়ে দিয়ে ডায়াবেটিস প্রতিরোধের কোনো চেষ্টা করছি না। অথচ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার প্রকৃত কারণটা আমাদের সামনে স্পষ্ট হলে তথা বেশি বেশি খাওয়া, মুটিয়ে যাওয়া এবং পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রমহীন থাকার কারণে ডায়াবেটিস হয়, এই সত্যটা আমাদের উপলব্ধিতে এলে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা আমাদের পক্ষে সহজ ও সম্ভব হতো।

১৯. চিনি—মিষ্টি খাওয়ার সাথে ডায়াবেটিস ও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হবার সম্পর্ক

ডায়াবেটিসের ভয় সমাজে যত বৃদ্ধি পাচ্ছে, তত মিষ্টিজাতীয় খাবার বা চিনি খাওয়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। কাশেম নামে আমার এক বন্ধু আছে, তার সাথে চা খেতে গেলে দেখি, সে সবসময় চিনি কম দিয়ে চা দেয়ার জন্য বলে। একদিন তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন আপনি চিনি কম খাচ্ছেন?’ তিনি বললেন, ‘চিনি বেশি খেলে ডায়াবেটিস হয়, এজন্য।’ আমার সহকর্মী এবং পরিচিত অনেক মানুষকে দেখি, চিনি থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেন। হোটেলে বা চায়ের দোকানে দেখা যায়, অনেক মানুষ চিনি—ছাড়া চা দিতে বলেন। যারা চিনি—ছাড়া চা দিতে বলেন, তারা সবাই যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, তা নয়, অনেকে ডায়াবেটিস থেকে নিরাপদ থাকার জন্যও চিনি—ছাড়া চা খান।

‘চিনি বা মিষ্টিজাতীয় খাবার বেশি খেলে ডায়াবেটিস হয়’, এই ধারণাটা বিশ^ব্যাপী দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে। ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সচেতনতার অংশ হিসেবে মানুষ চিনি বা মিষ্টিজাতীয় খাবারকে বয়কট করতে শুরু করেছে।

‘চিনি বা মিষ্টি বেশি খেলে ডায়াবেটিস হয়’ এই ধারণাটা সমাজে কিভাবে ছড়িয়েছে?

ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষ চিনি—মিষ্টি খেলে তাদের ডায়াবেটিস বেড়ে যায়, এটা সত্য। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষরা চিনি—মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস বেড়ে যায়— এটা দেখে মানুষ ভাবতে শুরু করেছে, যেহেতু চিনি—মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস রোগীর ডায়াবেটিস বেড়ে যায়, তাই এগুলো না খেলে হয়তো ডায়াবেটিস হবে না। এভাবেই হয়তো চিনি—মিষ্টি খাওয়ার সাথে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার সম্পর্কটা তৈরি হয়েছে।

তবে সাধারণ মানুষের এই মনগড়া ধারণার পাশাপাশি ধারণাটি সমাজে ছড়ানো হচ্ছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও।

আপনি কি কখনো চিনিকে ‘নীরব ঘাতক’ বা ‘সাদা বিষ’ বলতে শুনেননি বা কোথাও পড়েননি? আমি  শৈশবকাল থেকেই চিনিকে নীরব ঘাতক বলার কথা শুনে আসছি। এখনো মাঝে মাঝে চিনির বিরুদ্ধে অনেক নিবন্ধ বা প্রতিবেদন পত্রিকায় চোখে পড়ে। কিছু নিবন্ধ—প্রতিবেদন দেখা যাক।

‘কেন সাদা চিনি এড়িয়ে চলবেন?’ শিরোনামে প্রথম আলোয় ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে ডা. তানজিনা হোসেন (সহকারী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি ও মেটাবলিজম বিভাগ, গ্রীন লাইফ মেডিকেল কলেজ) লিখিত একটি নিবন্ধে বলা হয়, ‘‘...গ্লুকোজ থেকে আমরা প্রয়োজনীয় শক্তি সংগ্রহ করি। সাদা চিনি কিন্তু তা নয়। সাদা চিনি হলো সুক্রোজ, যা ভাঙার প্রয়োজন হয় না, দ্রুত রক্তে মিশে যায় এবং রক্তে চিনির পরিমাণ দ্রুত বাড়িয়ে দেয়। আমাদের মেটাবলিক সিস্টেম এই চিনিকে সামলে উঠতে পারে না এ কারণে যে, আদিকালে কোনো চিনি ছিল না, শর্করার উৎস ছিল শস্য বা ফলমূল আর এই জন্যে মেটাবলিক সিস্টেম সেভাবে গড়ে ওঠেনি আমাদের শরীরে। তো এই বাড়তি চিনি তখন একধরনের চর্বি (ট্রাইগ্লিসারাইড) হিসেবে শরীরে জমা হতে থাকে। তাই সাদা চিনি খেলে কেবল ওজন এবং শর্করা বাড়ে তা—ই নয়, চর্বিও বাড়ে। ফলে দেখা দেয় স্থূলতা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ফ্যাটি লিভারসহ অনেক কিছু।...’’

‘চিনির ক্ষতিকর দিক’ শিরোনামে দৈনিক ইত্তেফাকে ৭ ডিসেম্বর, ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে ডা. সঞ্চিতা বর্মন লিখেন, ‘‘বাঙালি খাদ্য তালিকায় ও রান্নায় খাবারকে আরো মুখরোচক করতে চিনির ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। চিনির পাশাপাশি মিষ্টি, মিষ্টি পানীয় ও মিষ্টি ফলেরও জুড়ি নেই। কিন্তু খাবারে এই অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার গ্রহণ হতে পারে জীবনের জন্য ক্ষতিকর। 

গবেষণায় দেখা গেছে, যারা খাবারে অতিরিক্ত চিনি বা মিষ্টি জাতীয় পানীয় বেশি খায় তাদেরই হৃদরোগ, ডায়াবেটিস টাইপ ২, উচ্চ রক্তচাপ, ওবেসিটি বা স্থূল দেহ এবং বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। অতিরিক্ত চিনি গ্রহণ শরীরের মেটাবলিজম প্রক্রিয়াকেও বিঘ্ন ঘটায়।’’

‘‘তামাকের মতই ক্ষতিকর চিনি, দাবি ব্রিটিশ গবেষকের!’’ শিরোনামে বাংলাদেশ প্রতিদিনে ২৯ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘‘মিষ্টি খাবার মানেই চিনি। অথচ এই চিনিই কিনা তামাকের মতো ক্ষতিকর। এমন অবিশ্বাস্য তথ্যই দিয়েছেন যুক্তরাজ্যের ইউনির্ভাসিটি অব লিভারপুলের গবেষক সায়মন ক্যাপওয়েল। চিনিকে নতুন তামাক হিসেবেও আখ্যা দিয়েছেন তিনি।...

চিনির ক্ষতিকারক প্রভাব মানুষের স্থূলতা, বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি ও মৃত্যুর হার বৃদ্ধির পেছনে দায়ী।...

এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, বিশ্বব্যাপী স্থূলতা, ডায়াবেটিস ও হৃদরোগে মৃত্যুর পেছনে মূল ভূমিকা চিনির। উলফসন ইন্সটিটিউট অব প্রিভেনটিভ মেডিসিনের গবেষক গ্রাহাম ম্যাকগ্রেগর বলেন, এখনই বিশ্বব্যাপী চিনির ক্ষতিকর দিক নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।’’

‘‘প্রতিবছর শুধুমাত্র অতিরিক্ত চিনি খেয়েই মৃত্যু ৩.৫ কোটি মানুষের’’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় দৈনিক যুগান্তরে ২৪ অক্টোবর ২০২০ তারিখে। সেখানে বলা হয়, ‘‘ বিশ্বে সংক্রামক রোগে যত মানুষ আক্রান্ত হন, তার চেয়ে ঢের বেশি মানুষ অসুস্থ হন চিনির বিষক্রিয়ায়। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, অতিরিক্ত চিনি খাওয়ার ফলে নানা রোগে প্রতি বছর প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ মারা যান। খবর দ্যা নেচার পত্রিকার।

চিনিতে আছে পুষ্টিহীন ক্যালোরি। যা খেলে ওজন বাড়ে। ডায়াবিটিস থাকলে বাড়ে তার প্রকোপ। এ ছাড়াও মাত্রাতিরিক্ত খেলে হার্ট ও লিভারে ইনফেকশন হয়, হরমোনের মাত্রা ওঠানামা করে, কোলেস্টেরল ট্রাইগ্লিসারাইড বাড়ে, বাড়ে ক্যানসারের আশঙ্কাও।

প্রকাশিত রিপোর্টে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন অতিরিক্ত চিনি খাওয়ার ফলে নানা রোগে প্রতি বছর প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ মারা যান। সংক্রামক রোগে যত মানুষ আক্রান্ত হন, তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ অসুস্থ হন চিনির বিষক্রিয়ায়।’’
এই প্রতিবেদনগুলোয় স্থূলতা, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপের কারণ হিসেবে অতিরিক্ত চিনি বা মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়াকে দায়ী করা হয়েছে। কিছু কিছু গবেষণাও নাকি এমনই বলছে! এমনকি বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্ধৃতি দিয়েও বলা হয়েছে, ‘‘বিশ্বব্যাপী স্থূলতা, ডায়াবেটিস ও হৃদরোগে মৃত্যুর পেছনে মূল ভূমিকা চিনির।’’ এতোকিছুর পরও চিনিকে মানুষ ভয় না করে পারে?

এবার আমরা আরো কিছু নিবন্ধ—প্রতিবেদন দেখি।

‘‘ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সচেতন হোন’’ শিরোনামে দৈনিক যুগান্তরে ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ তারিখে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ (সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির চিফ কো—অর্ডিনেটর) লিখেন, ‘‘ডায়াবেটিস ছোঁয়াচে বা সংক্রামক রোগ নয়। বেশি মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস হয়, এ ধারণা ঠিক নয়। খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা ও ওষুধ এ রোগ নিয়ন্ত্রণের উপায়।’’

‘‘মিষ্টি কি আসলেই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর?’’ শিরোনামে বিবিসি বাংলায় ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘‘বলা হয়, যারা বেশি মিষ্টি খায় তাদের টাইপ—টু ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি।

চিনি, শর্করাা, সুগার — যে নামেই ডাকুন, গত কয়েক দশকে বিজ্ঞানী আর ডাক্তারদের ক্রমাগত সতর্কবার্তার ফলে এটা হয়ে দাঁড়িয়েছে জনস্বাস্থ্যের এক নম্বর শত্রু।
সরকার এর ওপর কর বসাচ্ছে। স্কুল আর হাসপাতালগুলো খাদ্যতালিকা থেকে একে বাদ দিয়ে দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন: আমাদের খাবার থেকে চিনি সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে দিতে।

আমরা সবসময়ই শুনছি, যারা বেশি মিষ্টি খায় তাদের টাইপ—টু ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি।
কিন্তু এর বিপরীতেও একটা কথা আছে। আসলে এসব স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য শর্করাই যে দায়ী — তা হয়তো না—ও হতে পারে।
ঠিক কিভাবে আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে এই শর্করা — তা বের করতে গিয়ে কিন্তু বিজ্ঞানীরা দেখছেন, এটা প্রমাণ করা খুব কঠিন। বিশেষ করে যখন তা উচ্চমাত্রার ক্যালরি সমৃদ্ধ খাদ্যের সাথে খাওয়া না হচ্ছে।

গত পাঁচ বছরে একাধিক গবেষণার ফল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কোন এক দিনের খাবারে যদি ১৫০ গ্রামের বেশি ফ্রুকটোজ থাকে, তাহলে তা উচ্চ রক্তচাপ বা কোলেস্টেরলের মতো সমস্যার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

কিন্তু গবেষকরা আরো বলেছেন যে, এটা তখনই ঘটে, যখন আপনি উচ্চ ক্যালরিসমৃদ্ধ খাবারের সাথে উচ্চমাত্রায় শর্করাসমৃদ্ধ খাবার খাচ্ছেন। তারা আরো বলছেন, শুধু সুগারের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয় এটা বলা যায় না।

তা ছাড়া, বিজ্ঞানীরা আরো বলছেন যে, কোন একটি খাবারকে সমস্যার মূল কারণ বলে চিহ্নিত করারও অনেক বিপদ আছে — কারণ এর ফলে এমন হতে পারে মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় কোন খাবার হয়তো আপনি খাওয়া বন্ধ করে দিলেন।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, উচ্চ মাত্রার ফ্রুকটোজ সমৃদ্ধ কর্ন সিরাপ বা বাড়তি চিনিওয়ালা পানীয়, জুস ড্রিংক, মধূ বা সাদা চিনি এগুেলো হৃদযন্ত্রের সমস্যা তৈরি করতে পারে, কারণ তা ধমনীর ভেতর ট্রাইগ্লিসারাইড জাতীয় চর্বি জমাতে ভুমিকা রাখে।

বিভিন্ন জরিপে এই বাড়তি যোগ করা চিনিসমৃদ্ধ খাবার বা পানীয়ের সাথে হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার সম্পর্ক দেখা গেছে।

কিন্তু সুগারের কারণেই যে হৃদরোগ বা ডায়াবেটিস হয় — এটা স্পষ্ট করে বলার উপায় এখনো নেই। লুজান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লুক টাপি বলছেন, অতিরিক্ত ক্যালরিই ডায়াবেটিস, স্থূলতা এবং উচ্চ রক্তচাপের কারণ এবং সুগার সেই উচ্চ ক্যালরিসমৃদ্ধ খাবারের একটা অংশ মাত্র।
এমন দেখা গেছে, যারা এ্যাথলেট বা ক্রীড়াবিদ — তারা বেশি শর্করা খেলেও শারীরিক পরিশ্রম বেশি করছেন বলে তা হজম হয়ে যাচ্ছে — কোন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে না।’’

এই দু’টি প্রতিবেদনে চিনি বা মিষ্টির ক্ষতিকর প্রভাবের কথা অনেকটা নাকচ করে দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি কোন্ ধরনের মতামত বিশ^াস করবেন? ‘চিনি বা মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস হয়’ এর পক্ষে আরো অনেক রেফারেন্স যেমন উল্লেখ করা যাবে, ‘এগুলো খেলে ডায়াবেটিস হয় না’, এই কথার পক্ষেও আরো অনেক রেফারেন্স উল্লেখ করা যাবে। কিন্তু আপনি বা আমি কোন্ ধরনের মতামতকে বিশ^াস করবো? তবে এই সত্যটা আমাদের নিকট স্পষ্ট, এই বিষয় নিয়ে যারা ভাবছে, গবেষণা করছে বা মতামত প্রদান করছে, তারা আমাদেরকে বিভ্রান্ত করছে। তারা একমত হয়ে সবাই মিলে আমাদেরকে একই রকম মতামত দিলে আমরা বিভ্রান্ত হতাম না।

চলুন, আমরা তাদের সৃষ্টি করা বিভ্রান্তিতে না পড়ে নিজেরাই যাচাই করে দেখি, কোন্ মতামতটি সঠিক এবং বাস্তবসম্মত? চিনি বা মিষ্টি খাওয়া কি ক্ষতিকর, নাকি ক্ষতিকর নয়? চিনি বা মিষ্টি বেশি খেলে কি মানুষ ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়, নাকি হয় না?

যাচাই করার জন্য আমরা দ্বিতীয় প্রকারের দু’টি রেফারেন্সের শেষটি থেকে একটি তথ্য সামনে নিয়ে আসতে পারি। বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত প্রতিবেদনটির এক পর্যায়ে বলা হয়েছে, ‘‘যারা এ্যাথলেট বা ক্রীড়াবিদ — তারা বেশি শর্করা খেলেও শারীরিক পরিশ্রম বেশি করছেন বলে তা হজম হয়ে যাচ্ছে — কোন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে না।’’

এ্যাথলেট বা ক্রীড়াবিদদের প্রতি আমরা কি কখনো লক্ষ্য করেছি? যদি আমরা পেশাদার এ্যাথলেট বা ক্রীড়াবিদদের খোঁজ নিই, আমরা দেখতে পাবো, ১০ বছরের বেশি সময় ধরে যারা পেশাদারভাবে বিভিন্ন ক্রীড়ায় অংশগ্রহণ করছেন, তাদের কেউই ডায়াবেটিস দূরের কথা, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগেও আক্রান্ত নয়। এর কারণ কী? এরা সবাই কি চিনি বা মিষ্টান্ন থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকে? এরা কি শর্করাজাতীয় খাবার মোটেই খায় না বা খুব কম খায়?

সবই খায়। কিন্তু তবু ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগে আক্রান্ত হয় না কেন? উত্তরটা প্রতিবেদনেই দেয়া হয়েছে, ‘‘তারা বেশি শর্করা খেলেও শারীরিক পরিশ্রম বেশি করছেন বলে তা হজম হয়ে যাচ্ছে — কোন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে না’’। এটাই চিরন্তন সত্য কথা, এটাই বাস্তবতা। এই বাস্তবতার কাছে চিনি—মিষ্টি বিরোধী সব বক্তব্য এবং গবেষণা ফলাফল ভুয়া প্রমাণিত হবে।

এ্যাথলেট বা ক্রীড়াবিদদের খোঁজ নেয়াটা সবার পক্ষে সহজ নয়। আমরা তাদের পরিবর্তে খোঁজ নিতে পারি ঐসব শ্রমজীবি লোকের, যারা পেশাদারভাবে কায়িক শ্রমনির্ভর কোনো না কোনো কাজ করে যাচ্ছেন ১৫—২০ বছরের বেশি সময় ধরে। সবাই নিজের আশেপাশে এই ধরনের অনেক লোক এখনো খুঁজে পাবেন। আমার পরিচিত বেশ কয়েকজন লোক আছেন, যারা পেশা হিসেবে শারীরিক পরিশ্রমের বিভিন্ন কাজ (যেমন: কৃষিকাজ, স’মিলের কাজ, গাছকাটার কাজ, ইটভাটার কাজ, মাটিকাটার কাজ) করে থাকেন। এদের অনেকের অর্ধেক বয়সী অসংখ্য মানুষ যখন অহরহ ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন, তখন এরা ৫০—৬০ বছর বয়সে এসেও এই রোগগুলো থেকে নিরাপদ! তারা সবাই কি চিনি—মিষ্টি এগিয়ে চলে? চলে না। তবু তারা এই রোগগুলোতে কেন আক্রান্ত হয় না? উত্তর সেই একটাই— ‘‘তারা বেশি শর্করা খেলেও শারীরিক পরিশ্রম বেশি করছেন বলে তা হজম হয়ে যাচ্ছে — কোন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে না’’। পর্যাপ্ত কায়িক শ্রম তাদের শরীেও চর্বি—কোলেস্টেরল জমতে দেয় না বলেই তারা এইসব রোগ থেকে নিরাপদ থাকছে।

মোটরচালিত রিকশার প্রচলনের পরও এখনো অনেক মানুষ পায়েচালিত রিকশা চালায়। ঢাকা শহরে আপনি এখনো পায়েচালিত রিকশা চালক পাবেন। আপনি এরকম ১০০ জন রিকশাচালকের খোঁজ নিন, যারা  ১৫—২০ বছর ধরে কোনো বিরতি না দিয়ে পায়েচালিত রিকশা চালাচ্ছেন, দেখবেন এরা কেউই ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগে আক্রান্ত নন। কারণ কী? এরা কি মিষ্টি—চিনি থেকে সব সময় দূরে থাকে?

কারণ তা—ই, যা বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এ্যাথলেট হোক, শ্রমজীবি মানুষ হোক, এরা নিয়মিত কঠোর শারীরিক পরিশ্রম করার ফলে এদের শরীরে কোনো প্রকার চর্বি জমতে পারে না, বৃদ্ধি পাওয়া দূরের কথা; যা খায়, তা কঠোর শারীরিক পরিশ্রম করার ফলে হজম হয়ে যায়, তাই এরা উচ্চ রক্তচাপেও আক্রান্ত হয় না, ডায়াবেটিসেও না, হৃদরোগেও না, যতদিন এরা এসব কাজ নিয়মিত করে থাকে। এদের অনেকেই চিনি বা মিষ্টি খেয়ে থাকেন নিয়মিত, এদের অনেকেই ধূমপানও করে থাকেন, এদের অনেকের বাবা—মা কেউ না কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিল/আছে, তবুও এরা এই তিনটি রোগের কোনোটিতেই আক্রান্ত হয় না। কারণ এই তিনটি রোগ সমাজের ঐ সমস্ত লোককে বেছে বেছে আক্রমণ করে, যাদের শরীরে চর্বির পরিমাণ বেশি, যারা শারীরিক পরিশ্রম এড়িয়ে আরামে আরামে থাকতে পছন্দ করে। মানুষ চিনি বা মিষ্টান্ন বেশি কি কম খায়, নাকি মোটেই খায় না, তা কখনো বিবেচনায় রাখে না ডায়াবেটিসসহ এই তিনটি রোগ।

মানুষ চিনি—মিষ্টি না খেলেও যদি বেশি বেশি খাবার খায়, মনের পছন্দমতো খায় আর শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকে, তখন মানুষের শরীরে চর্বি—কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেড়ে যাবেই। চিনি বা মিষ্টি খাওয়া বা না খাওয়ার সাথে শরীরে চর্বি বৃদ্ধি পাবার কোনো সম্পর্ক নেই। চিনি বা মিষ্টি পুরোপুরি বর্জন করার পরও মানুষ যদি শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকে, যদি এনার্জি সঞ্চয়ের পর তা খরচ (বার্ণ) না করে, মানুষের শরীরে চর্বি—কোলেস্টেরল বেড়ে যাবেই; মানুষ ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হবেই।

হ্যঁা, ডায়াবেটিসে কেউ আক্রান্ত হয়ে গেলে যদি চিনি বা মিষ্টিজাতীয় খাবার খায়, তখন ডায়াবেটিস বেড়ে যায়। যেমন গরুর মাংস খাওয়া এলার্জির কোনো কারণ নয়। কিন্তু কারো এলার্জি হয়ে গেলে সে গরুর মাংস খেলে এলার্জি বেড়ে যায়।
‘ডায়াবেটিস নিয়ে যত ভুল’ শিরোনামে বাংলাদেশের জনপ্রিয় টেলিভিশন চ্যানেল এনটিভির ওয়েবসাইটে একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয় ১৪ নভেম্বর ২০১৫ তারিখে। সাক্ষাৎকারটিতে ডা. আবু সাঈদ শিমুল (রেজিস্ট্রার,  ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘চিনি খেলে কখনো ডায়াবেটিস হয় না; তবে ডায়াবেটিস হয়ে গেলে অবশ্যই চিনি কম খেতে হবে বা একেবারে খাওয়া যাবে না।’’ 

বিষয়টা আশা করি সবার নিকট পরিষ্কার হয়ে গেছে। ‘চিনি বা মিষ্টি খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’, এমন মতামত যারা প্রকাশ করে, তারা বাস্তবতা থেকে অনেক অনেক দূরে। ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার সাথেও চিনি—মিষ্টির খাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ ক্যান্সারের কোনো কারণই এখনো পরিষ্কার হয়নি। যে যা—ই বলুক, ক্যান্সারের কোনো কারণ এখনও প্রমাণিত নয়। ক্যান্সারের যে কারণগুলো বেশি প্রচারিত, সেগুলোর সাথে বাস্তবতার দূরতম সম্পর্কও নেই। এই বিষয়ে ভিন্ন লেখায় আলোচনা করা হবে।

ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হার্ট অ্যাটাক এই রোগগুলোর জন্য চিনি—মিষ্টি খাওয়া মোটেই দায়ী নয়, দায়ী হচ্ছে আরামপ্রিয় জীবন যাপন করা, শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা। এই রোগগুলো থেকে নিরাপদ থাকতে হলে চিনি বা মিষ্টি খাওয়াকে নয়, বরং অলস বা আরামপ্রিয় জীবন যাপনকে ‘না’ বলতে হবে। নিয়মিত অন্তত ৪০ মিনিট শারীরিক পরিশ্রম করলে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হার্ট অ্যাটাক কোনোভাবে আমাদেরকে আক্রমণ করতে পারবে না। এতে কোনো সন্দেহ নেই।


২০. উচ্চ রক্তচাপের কারণ অজানা নয়

উচ্চ রক্তচাপ এখন একটা আতঙ্কের নাম। প্রতিটা সচেতন মানুষ এখন এই রোগ সম্পর্কে অবগত। বয়স ৫০ বছরের বেশি হয়েছে, আমাদের পরিচিত এমন মানুষগুলোর খোঁজ নিলে প্রতি ৫ জনে অন্তত ২ জন মানুষ পাওয়া যাবে, যারা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। অথচ বিগত ৩০—৪০ বছর আগে পরিস্থিতি এমন ছিল না। তখন প্রতি ৫ জনে অন্তত ১ জন উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত রোগী খুঁজে পেতেও কষ্ট হতো। কারণ কী? কী কারণে এখন মানুষ আগের তুলনায় অধিক হারে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হচ্ছে?

আপনি উচ্চ রক্তচাপ সম্পর্কে কোনো নিবন্ধ বা প্রতিবেদন পড়লে (অবশ্যই কোনো ডাক্তার কর্তৃক লিখিত) খুঁজে পেতে কষ্ট হবে ঠিক কী কারণে মানুষ এখন আগের চেয়ে বেশি হারে রোগটিতে আক্রান্ত হচ্ছে? আমরা প্রথমে এরকম দু’টি নিবন্ধ দেখি।

‘‘নীরব ঘাতক রোগ হাইপারটেনশন’’ শিরোনামে দৈনিক নয়াদিগন্তে ২০ অক্টোবর ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে ডা: রফিক আহমেদ লিখেন, ‘‘উচ্চ রক্তচাপ কেন হয়? ৯০—১০০ জনের কারণ জানা যায় না। ৫—১০ জনের কারণ জানা যায়।’’ [https://www.dailynayadiganta.com/health/358497]


‘‘উচ্চ রক্তচাপে করণীয়’’ শিরোনামে প্রথম আলোয় ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বাংলাদেশের স্বনামধন্য ডাক্তার অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ লিখেন, ‘‘কী কী কারণে উচ্চ রক্তচাপ হয়? ৯০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের কোনো নির্দিষ্ট কারণ জানা যায় না, একে প্রাইমারি বা অ্যাসেনশিয়াল রক্তচাপ বলে।’’
ডাক্তার ছাড়া সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা কথা বেশ প্রচলিত, টেনশন করলে নাকি মানুষ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়। অনেকে বলে থাকেন, আগে খাদ্যে ভেজাল ছিল না, এখন খাদ্যে ভেজালের কারণে মানুষ এসব রোগে বেশি বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। কাঁচা লবণ খাওয়াকেও উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হবার একটি গুরুতর কারণ বলে মনে করে সমাজের অনেক মানুষ।

উচ্চ রক্তচাপের কারণ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচলিত ধারণাগুলো সঠিক, নাকি ভুল; ডাক্তারদের ‘‘অধিকাংশ ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের কারণ জানা যায় না’’ বক্তব্যটি সঠিক, নাকি ভুল, তা নিয়ে কোনো মন্তব্য না করে আমরা যদি বাস্তবতা পর্যবেক্ষন করি, ফলাফল কী দাঁড়ায়, একটু দেখি।
আমরা যদি আমাদের পরিচিত উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত ১০ জন মানুষের খোঁজ নিই, তাদের মধ্যে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য দেখতে পাবো। (১) তারা সবাই কোনো না কোনো আরামের পেশায় নিয়োজিত। শারীরিক পরিশ্রমের কাজের সাথে তাদের তেমন একটা সম্পর্ক নেই। (২) শারীরিকভাবে তাদের অধিকাংশ মানুষই স্থূল বা মোটা। (৩) তাদের অধিকাংশই অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল হবার কারণে তাদের খাওয়া—দাওয়ার মান ভালো। (৪) সমাজের অন্য অনেকের তুলনায় তাদের জীবনে টেনশন কম।

এবার উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত নয়, ৫০ বছরের বেশি বয়সী এমন ১০ জন লোকের খোঁজ নিলে দেখতে পাবো, (১) তাদের অধিকাংশই শারীরিক পরিশ্রমনির্ভর কোনো না কোনো পেশায় নিয়োজিত। কেউ কেউ শারীরিক পরিশ্রমনির্ভর পেশায় নিযুক্ত না হলেও ফসলের জমিতে কৃষিকাজ করে বা অন্য কোনোভাবে নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রমে সাথে সম্পৃক্ত। (২) তাদের অধিকাংশই চিকন। (৩) অর্থনৈকিভাবে সচ্ছল না হবার কারণে তাদের খাওয়া—দাওয়া বেশ ভালো মানের নয়। (৪) প্রায় সবাই কাঁচা লবণ খায়। (৫) অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হবার কারণে বা সাংসারিক টানাপোড়েনের কারণে এদের অধিকাংশকেই প্রায়ই টেনশনে থাকতে হয়।

খুব নিবিড়ভাবে বিষয়টা পর্যবেক্ষণ করলে এটা সুস্পষ্ট হবে যে কারো সামনে, যারা আরামে থাকতে অভ্যস্থ, যারা শারীরিকভাবে মোটা, যারা মনমতো খেতে পারে, যাদের জীবনে টেনশন কম, তারাই অধিকহারে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়। অন্যদিকে যারা কোনো না কোনোভাবে শারীরিক পরিশ্রমের সাথে জড়িত, শারীরিকভাবে বেশ মোটা নয়, যারা মনমতো খেতে পারে না, যারা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হবার কারণে টেনশনে থাকে প্রায় সময়, তারা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয় কম, কাঁচা লবণ খাওয়া সত্ত্বেও।
আরো সুনির্দিষ্টভাবে বিষয়টা যাচাই করলে পরিষ্কার হবে, যারা শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করে, তারাই উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয় অধিকহারে। কারণ শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকলে মানুষের শরীরে চর্বি—কোলেস্টেরল বেড়ে যায়। শরীরে চর্বি—কোলেস্টেরল বেড়ে যাওয়া থেকেই মানুষ উচ্চ রক্তচাপের শিকারে পরিণত হয়। পক্ষান্তরে, যারা শারীরিক পরিশ্রমের সাথে জড়িত, তাদের শরীরে চর্বি বৃদ্ধি পেতে পারে না। শরীরে চর্বি না থাকায় তাদের উচ্চ রক্তচাপ আক্রমণ করতে পারে না, তারা টেনশন করা সত্ত্বেও, কাঁচা লবণ খাওয়া সত্ত্বেও।

যারা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত, তারা টেনশন করলে তাদের রক্তচাপ তাৎক্ষণিতভাবে বেড়ে যায়। কিন্তু যারা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত নয়, তারা টেনশন করলেও তাদের রক্তচাপ বৃদ্ধি পায় না। এজন্য দেখা যায়, পেশাদারভাবে যারা প্রচুর শারীরিক পরিশ্রম করে, তাদের অনেকেই অর্থনৈতিকভাবে বেশ দুর্বল হবার কারণে সাংসারিক জীবন নিয়ে প্রচুর টেনশনে থাকা সত্ত্বেও তাদের রক্তচাপ বৃদ্ধি পায় না।

আমার পরিচিত বেশ কয়েকজন লোক আছেন, যারা এই প্রকৃতির। বয়স অনেক হয়ে গেছে, এখনো তারা উচ্চ রক্তচাপ থেকে মুক্ত। অথচ তাদের চেয়ে অনেক কম বয়সী মানুষ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়ে জীবনের সাথে লড়াই করে যাচ্ছে। তারা শুধু উচ্চ রক্তচাপেই আক্রান্ত নন, তাদের অনেকে একই সাথে ডায়াবেটিসেও আক্রান্ত, অনেকে উচ্চ রক্তচাপের সাথে ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ তিনটি রোগেই আক্রান্ত হয়ে বেশ কঠিন জীবন যাপন করছে।

আশা করি এই আলোচনার পর এই কথা বলার সুযোগ থাকবে না, উচ্চ রক্তচাপের কারণ অজানা বা বেশির ভাগ উচ্চ রক্তচাপের কারণ অজানা। আমরা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পাই না বলেই এসব কথা বলতে হয়। নিবিড়ভাবে পর্যবেকক্ষণ করলে উচ্চ রক্তচাপের কারণ সবার নিকট পরিষ্কার হবে।


২১. ফিট থাকার উপায়

আপনি দেখবেন আপনার পরিচিত এবং কাছের অসংখ্য মানুষ এখন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগ (হার্ট অ্যাটাক) এই তিনটি রোগের একটি বা একাধিকটিতে আক্রান্ত। এমনকি আপনার পরিজন বা কাছের যেই মানুষগুলো বিগত কয়েক বছরে মৃত্যুবরণ করেছেন, তাদের অনেকেই এই রোগগুলোর কোনো না কোনোটিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। আমরা এখনো অনেকেই জানি না, মানুষ কেন এই রোগগুলোতে এখন ব্যাপকহারে আক্রান্ত হচ্ছে। মানুষ এই রোগগুলোতে আক্রান্ত হয় শুধুই শরীরে চর্বি বৃদ্ধি পাবার কারণে। আর শরীরে চর্বি বৃদ্ধি পাবার সবচেয়ে বড় কারণ শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা। দৈনন্দিন জীবনে আমরা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি আরামপ্রিয় হয়ে গিয়েছি। আমাদের অনেকের জীবনে শারীরিক পরিশ্রমের কাজ তেমন নেই বললেই চলে। শুধু এজন্যই এই রোগগুলোর দাপট বেড়ে গেছে। এই রোগগুলো থেকে বাঁচতে হলে তাই কায়িক পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই।

মানুুষ বেশি খেলেও, চিনি—মিষ্টি বা শর্করা জাতীয় খাবার বেশি খেলেও যদি নিয়মিত কায়িক শ্রম করে, মানুষের শরীরে চর্বি বৃদ্ধি পেতে পারে না। তাছাড়া মানুষের পূর্বপুরুষ এইসব রোগে আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও মানুষ যদি নিয়মিত কায়িক শ্রম করে, তাহলে মানুষ এই রোগগুলো থেকে নিরাপদ থাকে। পূর্বপুরুষরা এইসব রোগে আক্রান্ত না থাকলেও মানুষ যদি কায়িক শ্রম থেকে দূরে থাকে, মানুষ এই রোগগুলো থেকে রক্ষা পায় না।

তাই যারা এখনো এই রোগগুলোতে আক্রান্ত হননি, আপনার পূর্বপুরুষরা এগুলোতে আক্রান্ত ছিল কিনা, তা না দেখে আপনি দেখুন আপনি নিয়মিত কায়িক শ্রম করছেন কিনা। আপনি মনের চাহিদামতো খেতে পারেন, মিষ্টি বা শর্করা জাতীয় যে কোনো খাবারে আপনার আগ্রহ থাকলে আপনি খেতে পারেন, কোনো ক্ষতি হবে না যদি আপনি নিয়মিত কায়িক শ্রম করে থাকেন। এই রোগগুলোতে আক্রান্ত হতে না চাইলে আপনাকে কায়িক শ্রম করতেই হবে। নিয়মিত কায়িক শ্রম করলে, দৈনিক অন্তত ৪০ মিনিট করে কায়িক শ্রম করলে আপনি এই রোগগুলোর আক্রমণ থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকবেন।

কায়িক শ্রমের বিভিন্ন কাজে যারা পেশাদারভাবে বা আবশ্যকীয়ভাবে জড়িত, তারা যতোদিন জড়িত থাকেন, ততদিন অন্য কোনোভাবে কায়িক শ্রম না করলেও সমস্যা নেই। আপনি দেখবেন এথলেটরা (ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, ভলিবল, টেনিস এই রকম কায়িক শ্রমনির্ভর খেলাগুলো যারা পেশাদারভাবে খেলে থাকেন), যারা ১০ বছরের বেশি সময় ধরে পেশাদারভাবে এই সব খেলা খেলে আসছেন, তারা কেউই এই রোগগুলোতে আক্রান্ত নন। কেন আক্রান্ত হবেন? তারা এনার্জি আর্ন করার পাশাপাশি এনার্জি বার্নও করে থাকেন নিয়মিত। তাদের পূর্বপুরুষরা এই রোগগুলোতে আক্রান্ত হলেও তারা এগুলোতে আক্রান্ত হন না নিয়মিত এনার্জি বার্ন করার কারণে। তারা শর্করা ইচ্ছেমতো খেলেও ক্ষতি হয় না। তারা চিনি, মিষ্টান্ন বেশি খেলেও তাদের ক্ষতির কোনো আশঙ্কা নেই।

কিন্তু যারা এরকম কোনো পেশায় জড়িত নন, তারা অন্য উপায়ে কায়িক শ্রম করতে পারেন। অন্য উপায়ে কায়িক শ্রমের মধ্যে সবচেয়ে সেরা উপায় জোরে জোরে হাঁটা। প্রতিদিন কমপক্ষে ৪০ মিনিট নিয়ম করে হাঁটুন।
কায়িক শ্রম সপ্তাহে ২ দিনের বেশি বাদ দেয়া এবং একটানা ২ মাসের বেশি বন্ধ রাখা উচিত নয়। খালি পেটে কখনোই কায়িক শ্রম করা ঠিক নয়। কায়িক শ্রমের আগে কিছু না কিছু খেয়ে নিন অথবা কমপক্ষে দু’এক গ্লাস পানি পান করে নিন। নয়তো হিতে বিপরীত হতে পারে।

যেসব কায়িক শ্রমে অধিক পরিশ্রম, সেগুলো দৈনিক ২০ মিনিট করাই যথেষ্ট। যেমন: দৌড়, দড়িলাফ, ফুটবল খেলা ইত্যাদি। আর যেসব কায়িক শ্রমে তুলনামূলক কম পরিশ্রম, সেগুলো দৈনিক ৪০ মিনিটের কম করে লাভ নেই। যেমন: জোরে জোরে হাঁটা, মধ্যম গতিতে সাইকেল চালানো ইত্যাদি।

অনেকে ওজন কমানোর জন্য উঠেপড়ে লেগে যায়। খাওয়া—দাওয়া কন্ট্রোল করে, ব্যায়াম করে। এটা করতে গিয়ে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ে। মনে রাখবেন আপনি যদি নিয়মিত পর্যাপ্ত ঘামঝরানো কায়িক শ্রম করেন, আপনার ওজন না কমলেও সমস্যা নেই। নিয়মিত কায়িক শ্রম আপনার শরীরের চর্বিকে নিয়ন্ত্রণ করবে। ফলে রোগগুলো আপনার নাগাল পাবে না। অনেক মোটা মানুষ আছে, যারা কায়িক শ্রমে লিপ্ত থাকার কারণে এই রোগগুলোতে আক্রান্ত হয় না। হ্যাঁ, ওজন কমাতে পারলে ভালো। চিকন মানুষের বয়স বুঝা কষ্টকর। চিকন মানুষ দেখতেও সুন্দর। বাঁচেও অপেক্ষাকৃত বেশি দিন।
ফিট থাকার সবচেয়ে সেরা উপায় নিয়মিত কায়িক শ্রম করা। এনার্জি আর্ন করার পাশাপাশি বার্ন করলে আপনি এই সব রোগ থেকে পুরোপুরি নিরাপদ থাকবেন। এনার্জি শুধু আর্ন করা ক্ষতিকর। এটা—সেটাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। ফিট থাকার আরো একটি উপায় হচ্ছে কম কম খাওয়া। যদি কেউ কায়িক শ্রম না করে কম খাওয়ার অভ্যাস করতে পারে, সেও এই রোগগুলো থেকে নিরাপদ থাকতে পারবে। মাঝে মাঝে দু’একবেলায় বেশি খেলেও অসুবিধা নেই। অনেকে শর্করা জাতীয় খাবার থেকে দূরে থাকেন। আপনি যদি শর্করা জাতীয় খাবার কম কম খান, অসুবিধা নেই।

তবে আমি মনে করি, যদি নিয়মিত কায়িক শ্রম করতে পারেন, আপনি কম কম খাওয়ারও দরকার নেই, শর্করা জাতীয় বা মিষ্টান্ন খাবার বর্জনেরও দরকার নেই। নিয়মিত পর্যাপ্ত কায়িক শ্রম (ফিজিক্যাল এক্টিভিটির মাধ্যমে এনার্জি বার্ন) করুন, আপনি অনেক অনেক দিক থেকে লাভবান হবেন। যথা: মারাত্মক এই রোগগুলো থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকবেন, মনমতো যে কোনো খাবার খেতে পারবেন, রোগগুলোতে আক্রান্ত মানুষকে চিকিৎসার পেছনে যে ব্যয় করতে হয়, সেই ব্যয় থেকেও বাঁচবেন, সর্বোপরি সুন্দর এই পৃথিবীতে আপনার বেশি দিন বেেঁচ থাকার সম্ভাবনা অনেক বৃদ্ধি পাবে। তাই নিয়মিত কায়িক শ্রম করুন, ফিট থাকুন।


নূর আহমদ : শিক্ষক; কলামিস্ট ও ফিটনেস বিষয়ক গবেষক।


Occupation: Teaching, Hobbies: Writing

0 Comments: