Headlines
Loading...
লবণ খাওয়ার সাথে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হবার কোনো সম্পর্ক নেই

লবণ খাওয়ার সাথে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হবার কোনো সম্পর্ক নেই

লবণের সাথে উচ্চ রক্তচাপের সম্পর্ক

নূর আহমদ : শিক্ষক; কলামিস্ট ও গবেষক

লবণের সাথে এবার উচ্চ রক্তচাপের সম্পর্ক নিয়ে কথা। উচ্চ রক্তচাপের একটা কারণ নাকি লবণ খাওয়া, বিশেষ করে কাঁচা লবণ। লবণ খেলে উচ্চ রক্তচাপ হয় বা যাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে, তাদের রোগ বৃদ্ধি পায়, কথাটি অনেক চিকিৎসকও বলে থাকেন।

বাংলা উইকিপিডিয়ায় ‘উচ্চ রক্তচাপ’ শিরোনামে পরিচিতিমূলক নিবন্ধে উচ্চ রক্তচাপের কারণ সম্পর্কে বলা হয়, ‘যে সকল কারণ উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে সেগুলো হল: বেশী লবণ গ্রহণ, অতিরিক্ত মেদ, কাজের চাপ, মদ্যপান, পরিবারের আকার, অতিরিক্ত আওয়াজ এবং ঘিঞ্জি পরিবেশে থাকা। উচ্চমাত্রার লবণের ব্যবহার এর মধ্যে সবচেয়ে বেশী মনযোগ আকর্ষণ করেছে। ধারণা করা হয় প্রায় শতকরা ৬০ ভাগ রোগী লবণের ব্যবহার দ্বারা প্রভাবিত হন।’

আমার মনে হয় লবণ এবং উচ্চ রক্তচাপের সম্পর্ক নিয়ে প্রচলিত ধারণাটি সম্পর্কে নতুন করে ভাবা দরকার।

একটি বাস্তব ঘটনা উল্লেখ করছি। গত ১৮ জানুয়ারি ২০১৮ আমাদের পার্শ্ববর্তী বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের এক মতবিনিময় সভায় দুপুরের খাবার খেতে বসলাম। আমরা এক টেবিলে বসলাম ছয়জন। আমার ডানপাশে একজন প্রবীণ শিক্ষক বসলেন। তাঁর সাথে আগেরও পরিচয় ছিল। তবু সেদিন দেখা হওয়ায় তাঁর শারীরিক খোঁজখবর নিলাম। জিজ্ঞেস করলাম,  উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিস আছে কিনা শরীরে। বললেন, ‘এসব এখনো নেই।’ এরপর খাওয়া শুরু হতেই আমাদের টেবিলে উপবিষ্ট একজন শিক্ষক লবণ খুঁজতে শুরু করলেন, ভুলক্রমে লবণ তখনও পরিবেশন করা হয়নি বলে। এমন ঘটনা প্রায়ই দেখি। অনেক লোক খাওয়ার সব রকম আইটেম সামনে আসার পরও শুধু লবণের অনুপস্থিতিতে খাওয়া আরম্ভ করতে পারেন না। দেখলাম আমাদের ওই শিক্ষকও একই দলের। লবণ নেই বলে তিনি খাওয়া আরম্ভ করতে পারছেন না। তিনি তাড়াতাড়ি লবণ আনতে বলায় লবণ এনে দেয়ার পর তিনি খাওয়া শুরু করলেন। এরই মধ্যে আমার বামে যিনি বসেছেন, তিনি বললেন, ‘খাওয়ার সময় আমার লবণ লাগে না। আমি কাঁচা লবণ খাই না। কাঁচা লবণ খেলে উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয়।’ তাঁর কথা বলার পরপরই পাশের আরেকজন শিক্ষক বলে উঠলেন, ‘লবণ খেলে ডায়াবেটিসও হয়।’ আমি এসব শুনে যারা এসব বলছেন, তাঁদেরকে কিছুই না বলে আমার ডানপাশের ওই শিক্ষককে জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্যার, আপনি কি খাবারের সাথে লবণ খান?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ আমি তখন ওই দুই শিক্ষককে উদ্দেশ্য করে বললাম, ‘এই স্যারকে একটু আগে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, তাঁর উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিস কিছুই নেই। এখন দেখছি তিনি নিয়মিত খাবারের সাথে লবণও খান। তবু দেখুন, তাঁর এসব রোগ নেই!’

আমার ডানপাশের ওই শিক্ষক ছাড়াও আমি এমন অসংখ্য লোক দেখেছি, যারা লবণ ছাড়া খেতেই পারেন না, শারীরিক পরিশ্রমের কাজও করেন, কিন্তু উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত নন। একটা বিষয় লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, যেসব লোক ঘামঝরানো কাজে বেশি সময় কাটান, তারা খাবারের সাথে যতো লবণই খান, যতো চিনির তৈরি খাবারই খান, তারা কখনো উচ্চ রক্তচাপে ভোগেন না। আবার যেসব লোক ঘামঝরানো কোনো কাজের সাথে জড়িত নন, শরীর মেদ-চর্বি আর কোলেস্টেরলে ভরপুর, তারা লবণ বা চিনি খাওয়া থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকলেও উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন। লবণ বা চিনি বর্জন তাদেরকে এসব রোগ থেকে রক্ষা করতে পারে না। এতে কী প্রমাণিত হয়? অবশ্যই এটা প্রমাণিত হয়, লবণের সাথে উচ্চ রক্তচাপের সম্পর্ক নেই, সম্পর্ক হচ্ছে কায়িক শ্রমহীনতার সাথে, চর্বি-কোলেস্টেরলের সাথে।

আমার খুব কাছের এক বন্ধু, মনির হোসেন, আগস্ট মাসের (২০১৮) মাঝামাঝি সময়ে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হলো হঠাৎ করে। বয়স ৩৬ এর মতো। তাকে দেখতে গেলাম। কথায় কথায় সে বললো, ‘অনেকে মনে করে, লবণ খেলে উচ্চ রক্তচাপ হয়। আমি ২০ বছর ধরে খাবারের সাথে লবণ খাই না, তবুও তো দেখি আমি উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়ে গেলাম!’

লবণ খেলে উচ্চ রক্তচাপ হয়, এমন কথা সাধারণ মানুষের নয়, ডাক্তারদেরও। ‘লবণ খেলে উচ্চ রক্তচাপ হয়’, শুধু এ কথা নয়, লবণ ও উচ্চ রক্তচাপ সম্পর্কে ডাক্তাররা এমন কথাও বলেন, যা উদ্ভট এবং রীতিমত হাস্যকর। ২ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখের দৈনিক যুগান্তরের ‘সুস্থ থাকুন’ পাতায় ‘লবণ ও উচ্চ রক্তচাপ’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ ছাপা হয়, যা লিখেছেন জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের (ঢাকা) সহযোগী অধ্যাপক, মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মো. তৌফিকুর রহমান। লেখাটিতে তিনি বলেন, ‘অতিরিক্ত লবণ খেলে লবণের সঙ্গে অতিরিক্ত পানি শরীরের রক্তের সঙ্গে যোগ হয়, ফলে রক্তের আয়তন বাড়ে, যা রক্তচাপ বাড়াতে ভূমিকা রাখে।’

লবণ এমন একটা খাদ্যদ্রব্য, যা অতিরিক্ত খাওয়া যায় না। যেহেতু লবণ ‘অতিরিক্ত’ খেলে মানুষ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হতে পারে আর লবণ ‘অতিরিক্ত’ খাওয়াও যায় না, তাই লবণের কারণে কখনো কারো উচ্চ রক্তচাপ হয়েছে বলা যাবে না। অতিরিক্ত খাওয়া মানে যদি নিয়মিত সব খাবারের সাথে লবণ খাওয়া বুঝানো হয়, তাহলে কথাটি সত্য হতে পারে। কিন্তু লবণ অতিরিক্ত হলে কেন উচ্চ রক্তচাপ হয়, তার যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, তা সম্পূর্ণ হাস্যকর।
বলা হয়েছে, অতিরিক্ত লবণ খেলে শরীরের রক্তের সঙ্গে অতিরিক্ত পানি যোগ হয়, ফলে রক্তের আয়তন বাড়ে, যা রক্তচাপ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। এ কথা বলে কিন্তু অতিরিক্ত লবণ খাওয়া নয়, বরং রক্তের সাথে অতিরিক্ত পানি যোগ হওয়াকে উচ্চ রক্তচাপের জন্য দায়ী করা হয়েছে। একজন লোক যদি লবণ খাওয়া সম্পূর্ণ পরিহার করে বেশি বেশি পানি পান করে, এই কথা মতে তারও উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে! তাহলে লবণের কী দোষ! দোষ তো বেশি বেশি বা অতিরিক্ত পানি শরীরে প্রবেশ করানো! আর অতিরিক্ত পানি পান করলে উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে এ পর্যন্ত কোনো গবেষণায় মনে হয় এমন কথা প্রমাণিত হয়নি!

উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হবার পর লবণ খেলে উচ্চ রক্তচাপ বেড়ে যায় বলেও অনেকে মনে করেন। বিষয়টা প্রমাণ করা কিন্তু কঠিন। কারণ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হলে নিয়মিত ঔষধ সেবন করতে হয়। ঔষধ নিয়মিত সেবন না করলে উচ্চ রক্তচাপ আপনা আপনিই বেড়ে যায়। ‘উচ্চ রক্তচাপে করণীয়’ শিরোনামে একটি নিবন্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডীন ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, ‘উচ্চ রক্তচাপ সারে না, একে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এর জন্য নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হবে। অনেক রোগী কিছুদিন ওষুধ খাওয়ার পর রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এলে ওষুধ বন্ধ করে দেন। মনে করেন রক্তচাপ ভালো হয়ে গেছে, কাজেই ওষুধ খাওয়ার দরকার কী? এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। কোনোক্রমেই চিকিৎসকের নির্দেশ ছাড়া ওষুধ সেবন বন্ধ করা যাবে না।’ [প্রথম আলো, ১৮ মে ২০১৬]

সুতরাং একজন উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত লোক যদি নিয়মিত ঔষধ সেবন না করেন আর খাবারের সাথে লবণ খান, তার উচ্চ রক্তচাপ বেড়ে যাবার জন্যে কি লবণকে দোষারোপ করা যাবে? অন্যদিকে একজন লোক যদি উচ্চ রক্তচাপের ঔষধ নিয়মিত সেবন করার পাশাপাশি খাবারের সাথে লবণও খান, তার তো উচ্চ রক্তচাপ বৃদ্ধি পাবে না। সেক্ষেত্রেও তো নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না লবণ খেলেও উচ্চ রক্তচাপ বাড়ে না! সুতরাং উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত রোগীরা লবণ খেলে ক্ষতি হয়, এমন কথা কেউ জোর দিয়ে বলতে পারবে না। এক্ষেত্রে নীরব থাকাই উত্তম। তবে যেহেতু দেখা যায় উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত রোগীরা ফিজিক্যাল এক্টিভিটি বাড়ালে রোগের মাত্রা কমে, কিন্তু ঔষধ না খেয়ে শুধু লবণ খাওয়া ছেড়ে দিলে রোগের মাত্রা কমে না, বরং বাড়ে, তাই লবণ খাওয়া-না খাওয়ার সাথে রোগটির বাড়া-কমাকে সম্পর্কিত না করে ফিজিক্যাল এক্টিভিটি করা-না করার সাথে রোগটির বাড়া-কমাকে সম্পর্কিত করাই সঙ্গত।

প্রথম আলোর সাথে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্র অধুনায় ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত ‘নুনের নোনতা বিষয়’ শিরোনামে একটি লেখায় লেখক নীরব মাহমুদ উল্লেখ করেন, ‘একসময় মনে করা হতো লবণ তাৎক্ষণিক উচ্চ রক্তচাপ তৈরি করে। বিষয়টি মোটেও ঠিক নয়। প্রায় ৬ হাজার রোগীর ওপর চালানো একটি গবষেণা প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়েছে, নিয়মিত লবণ গ্রহণ উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না।’

প্রকৃতপক্ষে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগের কারণ নিয়ে আমরা অনেকেই বিভ্রান্তিতে থাকি বলে একেক সময় একেকটাকে এগুলোতে আক্রান্ত হবার জন্য দায়ী করে বসি। বাস্তবতার সাথে মিলিয়ে দেখি না। বাস্তবতার সাথে মিলিয়ে দেখলে আমরা এসব রোগে আক্রান্ত হবার প্রকৃত কারণ সম্পর্কে যেমন ধারণা পেতাম, পাশাপাশি এসব রোগ থেকে আত্মরক্ষার উপায়ও খুঁজে পেতাম। আশা করি যারা এতোদিন এসব রোগের প্রকৃত কারণ সম্পর্কে বিভ্রান্তিতে ছিলেন, লেখাটি পড়ে তাদের বিভ্রান্তি দূর হবে এবং এ লেখায় তারা এসব রোগ থেকে মুক্ত থাকা এবং একই সাথে দীর্ঘজীবন লাভের উপায় খুঁজে পেয়ে উপকৃত হবেন।

Occupation: Teaching, Hobbies: Writing

0 Comments: