Headlines
Loading...
ডায়াবেটিস কোনো বংশগত রোগ নয়

ডায়াবেটিস কোনো বংশগত রোগ নয়

ডায়াবেটিস কি কোনো বংশগত রোগ? যাচাই করতে পারেন দুই পদ্ধতিতে...

নূর আহমদ : শিক্ষক; কলামিস্ট; গবেষক

‘ডায়াবেটিস একটি বংশগত রোগ’ এই ধারণা বা বিশ্বাসটি সমাজে এমন ধারণা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এমন ধারণা বা বিশ্বাসের কথা শুনে আমরা অনেকে আতঙ্কিত হচ্ছি, অনেকে আবার খুশিও হচ্ছি। যাদের বাবা-মা কারো ডায়াবেটিস ছিল বা আছে, তারা আতঙ্কিত হচ্ছি, হাল ছেড়ে দিচ্ছি এই ভেবে যে, আমিও যে-কোনো সময় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারি, ডায়াবেটিস থেকে রক্ষা পাবার আমার কোনো উপায় নেই!

অন্যদিকে যাদের বাবা-মা কারো ডায়াবেটিস ছিল না বা নেই, তারা খুশিতে গদগদ হয়ে ভাবছি, আমি তাহলে ডায়াবেটিস থেকে নিরাপদ! ডায়াবেটিস নিয়ে আমাকে মোটেই ভাবতে হবে না!

ডায়াবেটিস সম্পর্কে এই ধারণা আমাদের কতই না ক্ষতি করছে, তা বুঝতে পারলে যে কেউ আঁতকে উঠবেন, সন্দেহ নেই।

চলুন দুই পদ্ধতিতে আমরা বিশ্লেষণ করে দেখি, ডায়াবেটিস সত্যিই বংশগতভাবে হয় কিনা!

পদ্ধতি-১:

ধরুন, আমার বাবা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন তখন, যখন তাঁর বয়স ৭০ বছর, আমার বয়স ৩৫ বছর। আমি স্বভাবতই তখন ভাবতে পারি, আমার বাবা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন, আমিও নিশ্চিতভাবে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবো, কারণ সবাই বলে, যেহেতু সবাই বলে ‘ডায়াবেটিস বংশগতভাবেও হতে পারে’।

এবার আপনি বলুন, আমার জন্মের সময় যেই রোগ আমার বাবার শরীরে ছিল না, আমার জন্মের ৩৫ বছর পর আমার বাবা যে রোগে আক্রান্ত হলেন, সেই রোগ আমার শরীরে কিভাবে সংক্রমিত হবে?? বায়ুর মাধ্যমে?

বংশগতভাবে ঐসব রোগ সন্তানের শরীরে সংক্রমিত হতে পারে, সন্তান জন্মের সময় যেসব রোগ বাবা-মা কারো শরীরে বিদ্যমান থাকে। এটাই বংশগত রোগের সত্যিকারের বৈশিষ্ট্য।

কিন্তু ডায়াবেটিস রোগ নিয়ে কোনো রোগী যখন চিকিৎসকের কাছে যায়, তখন চিকিৎসক বেশির ভাগ সময় রোগীকে জিজ্ঞেস করেন, ‘‘আপনার বাবা-মা কারো কি ডায়াবেটিস ছিল?’’ রোগী ‘হ্যাঁ’  উত্তর দেয়ামাত্র চিকিৎসক দেরি না করে মন্তব্য করেন, ‘‘আপনি বংশগতভাবেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন।’’

ডাক্তার কখনো রোগীকে জিজ্ঞেস করেন না, ‘‘আপনার জন্মের সময় আপনার বাবা-মা কারো কি ডায়াবেটিস ছিল?’’ এই প্রশ্নের উত্তরে রোগী ‘হ্যাঁ’ বললে সেই রোগীর ডায়াবেটিসকেই বংশগত বলে মন্তব্য করার সুযোগ থাকতো।

দুঃখের বিষয়, ডায়াবেটিস নিয়ে এমন কোনো গভীর পর্যবেক্ষণ ছাড়াই ডায়াবেটিসকে বংশগত রোগ বলে বিশ^ব্যাপী  প্রচার করা হয়। এই ধারণা আমাদের অনেক ক্ষতি করছে। বলা যায়, এই ধারণার ফলেই আমরা অনেকে ডায়াবেটিসের নিকট নিজেদেরকে সঁপে দিচ্ছি।

যাদের বাবা-মা কারো ডায়াবেটিস ছিল বা আছে, তারা ভাবছেন, তারা নিশ্চিতভাবে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবেন। তাই তারা ডায়াবেটিস থেকে আত্মরক্ষার কোনো উপায় অবলম্বনকে অর্থহীন মনে করে বসে থাকার কারণে একসময় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন।

আন্যদিকে যাদের বাবা-মা কারো ডায়াবেটিস ছিল না বা নেই, তারা ভাবছেন, ডায়াবেটিস তাদেরকে কখনো আক্রমণ করবে না। এটা ভেবে তারা ডায়াবেটিস থেকে রক্ষা পাবার কোনো উপায় অবলম্বন না করার ফলে একসময় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন। খুবই দুঃখজনক।

‘‘ডায়াবেটিস বংশগত রোগ’’ এই ধারণার ফলে উভয় শ্রেণি এভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন।

পদ্ধতি-২:

আমরা যদি একটু পেছনে যাই, দেখতে পাবো, আমাদের যাদের বাবা-মা কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন বা আছেন, তাদের অনেকের বাবা-মা কারোই ডায়াবেটিস ছিল না। তার মানে আমাদের বাবা-মা কারো ডায়াবেটিস থাকলেও আমাদের অনেকের দাদা-দাদী বা নানা-নানী কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়া ছাড়াই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন।

এবার প্রথম প্রশ্ন:

ডায়াবেটিস যদি বংশগত রোগই হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের অনেকের দাদা-দাদী বা নানা-নানী কারো ডায়াবেটিস না থাকা সত্ত্বেও আমাদের বাবা-মা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলেন কেন? কেন?

দ্বিতীয় প্রশ্ন:

যদি আমাদের দাদা-দাদী বা নানা-নানী কারো ডায়াবেটিস না থাকা সত্ত্বেও আমাদের বাবা-মা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারেন, তাহলে আমাদের বাবা-মা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত না হলেও আমরা কি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারি না?

অবশ্যই আমরা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারি আমাদের বাবা-মা কারো ডায়াবেটিস না থাকলেও, যেভাবে আমাদের অনেকের দাদা-দাদী বা নানা-নানীর ডায়াবেটিস না থাকা সত্ত্বেও আমাদের বাবা-মা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন।

এর প্রধান কারণ ডায়াবেটিস মূলত কোনো বংশগত রোগ নয়, এটি নিতান্তই আরামে থাকা মানুষের রোগ। যারাই আরামে থাকে, তাদেরকেই রোগটি আক্রমণ করে বসে।

এজন্য দেখা যায়, আমাদের দাদা-দাদী বা নানা-নানীর সময়ে মানুষ আরামে থাকতো খুবই কম, মানুষের জীবন ছিল শারীরিক পরিশ্রমে ভরপুর, আট-দশ মাইল পথও তাদেরকে পায়ে হেঁটে যেতে হতো, তাই তখন মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতো খুবই কম। আর আমাদের বাবা-মা যখন সাংসারিক কাজ থেকে অবসরে চলে যেতেন, তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়তেন। আমাদের সময়ে এসে শারীরিক পরিশ্রম অনেক অনেক কমে গেছে। তাই এখন আমরা বেশি বেশি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছি।

আপনি দেখবেন, এখনো সমাজের ঐ সমস্ত মানুষের কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নয়, যারা অনেক বছর ধরে শারীরিক পরিশ্রমের কাজে জড়িত।

আমার পরিচিত অনেক মানুষ আছেন, যারা মানুষের কায়িক শ্রমের কাজগুলো করে দেন দিনমজুর হিসেবে। আমার পরিচিত এরকম ৭/৮ জন মানুষ আছেন আমাদের এলাকায়, যাদের কেউই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নন, উচ্চ রক্তচাপেও আক্রান্ত নন, হৃদরোগে তো নয়ই।

আপনিও দেখুন, আপনার কাছেই, এলাকায় এমন খেটে খাওয়া মানুষগুলোর কেউ ৫০-৬০ বছর বয়সে এসেও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নন।

অন্যদিকে ৩৫/৪০ বছর বয়সী অনেককে দেখতে পাবেন, যারা আরামের পেশায় নিয়োজিত, তাদের অনেকেই ইতোমধ্যে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ এসবের কোনো না কোনোটিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন।

তাই ডায়াবেটিসকে বংশগত রোগ না ভেবে ভাবতে শুরু করুন, এটি আরামে থাকা মানুষের রোগ। মানুষ যে বয়সেই আরামে থাকতে শুরু করে, সেই বয়সেই ডায়াবেটিসের রোষানলের শিকার হয়।

ডায়াবেটিস থেকে রক্ষা পেতে দৈনিক অন্তত ৪০ মিনিট শারীরিক পরিশ্রমের যে কোনো কাজ বা ব্যায়াম করুন, ডায়াবেটিস থেকে বেঁচে থাকবেন, সন্দেহ নেই, শুধু আপনার বাবা-মা নয়, বরং আপনার চৌদ্দ গোষ্ঠীর ডায়াবেটিস থাকা সত্ত্বেও!

Occupation: Teaching, Hobbies: Writing

0 Comments: