দীর্ঘজীবন লাভের উপায় (পর্ব-১) : মানুষ দিন দিন কায়িক শ্রমবিমুখ হচ্ছে
ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক এবং উচ্চ রক্তচাপের প্রকৃত কারণ এবং প্রতিরোধের উপায় জানার মাধ্যমে
সূচীপত্র
১. নিজেকে নিয়ে ভাবনা
২. মানুষ দিন দিন কায়িক শ্রমবিমুখ হচ্ছে
৩. বাড়ছে মোটা হবার প্রবণতাও
৪. আরামে থাকা এবং মোটা হবার ভয়াবহ পরিণতি
৫. উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগের কারণ সম্পর্কে ভুল ধারণা
৬. ডায়াবেটিসের কারণ সম্পর্কে ভুল ধারণা
৭. কিছু ব্যতিক্রম
৮. মানুষের গড় আয়ু আরো বৃদ্ধি পাবে, যদি...
৯. দীর্ঘজীবি হতে হলে...
১০. হার্ট অ্যাটাক, ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপের প্রতিষেধক
১১. ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং উচ্চ রক্তচাপ এই রোগ তিনটি একই সূত্রে গাঁথা
১২. ডায়াবেটিসের মোট কারণ ৩টি, মূল কারণ মাত্র ১টি
১৩. ডায়াবেটিসের মতো অন্য রোগ দু’টিরও মূল কারণ ১টি, মোট কারণ ৩টি
১৪. চর্বি/কোলেস্টেরল অতিরিক্ত হওয়াটাই ‘বিষ’
১৫. শারীরিক পরিশ্রমকে ‘না’ নয়
১৬. পরিশ্রমের সুযোগ না থাকলে আছে ব্যায়াম
১৭. খেলাধুলা করতে পারলে আরো ভালো
১৮. মোটা হতে নয়, চিকন থাকতে/হতে চেষ্টা করুন!
১৯. ওজন কমাতে হলে...
২০. দৈনন্দিন রুটিনে ব্যায়ামের জন্য সময় রাখুন
২১. ঘরেও করতে পারেন জিমের ব্যায়াম
২২. বিনা খরচে ব্যায়াম
২৩. মনমতো খাওয়া যাবে, যদি...
২৪. সুস্থ থাকতেই সুস্থতার যত্ন নেয়া উচিত
২৫. আরামদায়ক প্রযুক্তি যথাসম্ভব এড়িয়ে চলা উচিত
২৬. শিশুদেরকে খেলতে দিন
২৭. উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগে আক্রান্তদের জন্য কিছু পরামর্শ
২৮. মহিলাদের জন্য কিছু বিশেষ পরামর্শ
২৯. ব্যায়াম সম্পর্কে কিছু পরামর্শ
৩০. হার্টের জন্য উপকারী আলাদা কোনো খাবার নেই
৩১. ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের সাথে চিনি ও লবণের সম্পর্ক
৩২. ধূমপান নয়, বরং মদপান ক্ষতিকর
৩৩. খাদ্যে ভেজালের কারণে কি ডায়াবেটিস হয়?
৩৪. সাইক্লিং সম্পর্কে ভুল ধারণা
৩৫. শ্রেষ্ঠ এক ব্যায়ামের নাম হাঁটা
৩৬. টেনশনে কি হার্ট অ্যাটাক হয়?
৩৭. রোগগুলো বয়স বাড়ার সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং...
৩৮. ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগ এগুলো বংশগত ভাবে হয় না
৩৯. ডাক্তারের সব পরামর্শ কি সঠিক?
৪০. হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ যেসব কারণে, ক্যান্সার ও স্ট্রোক সেসব কারণে নয়
৪১. লেখাটির মূল বক্তব্য এবং দু’টি কথা
৪২. লেখাটি কার জন্য?
অধ্যায়-১
নিজেকে নিয়ে ভাবনা
১৯৯৩ সালের ২৭ অক্টোবর আমার বড় বোনের বিয়ে হয়। আমার বোনের বিয়ের পরদিন বিয়ে করেন তাঁর একমাত্র দেবর। আমার ভগ্নিপতি এবং তাঁর সেই ছোট ভাই, উভয়ে মোটা এবং ভারী শরীরের ছিলেন। বিয়ের মাত্র ২৪ বছর যেতে না যেতেই, ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে আমার বোনের ওই দেবর মারা যান। মৃত্যুর সময়ও তিনি বেশ মোটা ছিলেন, আমরা যাকে বলি ‘স্বাস্থ্যবান’। তবে এই স্বাস্থ্যবান (!) শরীর নিয়ে বাহ্যিক দৃষ্টিতে তিনি কোনো অপমৃত্যুর শিকার হননি। কোনো দুর্ঘটনায়ও তিনি মারা যাননি; মারা গেছেন কিছু রোগে ধুঁকে ধুঁকে। মৃত্যুর আগে বেশ কয়েক বছর তাঁর ডায়াবেটিস ছিল, হৃদরোগেও আক্রান্ত ছিলেন। উচ্চ রক্তচাপও ছিল। ডায়াবেটিসের কারণে শেষ ক’বছর তিনি চোখেও কম দেখতেন। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমানে তিনি বিয়ের আগ থেকেই কর্মরত ছিলেন। মৃত্যুর চার-পাঁচদিন আগে দেশে এলেন বেশ অসুস্থবোধ করায়, ডাক্তার দেখাতে। দেশে এসে একটু স্থির হয়ে ডাক্তারের কাছে যাবেন যাবেন, এমন অবস্থায় একদিন বুকে ব্যথা উঠায় হাসপাতালে নেয়ার পথে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ব্যক্তিগত জীবনে একজন সুখী মানুষ ছিলেন। একমাত্র ছেলেকে কাজে লাগিয়েছেন, মনের মতো করে বাড়ি তৈরি করেছেন মৃত্যুর বছরখানেক আগে। টেনশনে হার্ট ব্লক্ড হয়ে মারা যাবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তাঁর এ মৃত্যু বাহ্যিক দৃষ্টিতে কোনো অপমৃত্যু না হলেও আমার মনে হয়, এটা অবশ্যই একটা অপমৃত্যু ছিল। কিভাবে এটা একটা অপমৃত্যু, তা এক বা দু’বাক্যে প্রমাণের চেষ্টা না করে আমার এ লেখার পুরোটা দিয়ে প্রমাণের চেষ্টা করবো।
আমার ভগ্নিপতিও অনেক বছর ধরে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত ছিলেন। ধীরে ধীরে ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগেও আক্রান্ত হন। বছর দুয়েক আগে হার্ট ব্লক্ড হয়ে মারা যেতে বসেছিলেন। ভাগ্যের সহায়তায় চিকিৎসা পর্যন্ত বেঁচেছিলেন। রিং বসানো হয়েছে। তিনিও কর্মসূত্রে ১৯৮২ সাল থেকে ৩৬ বছর মধ্যপ্রাচ্যে কাটিয়ে শারীরিক অবস্থার মারাত্মক অবনতি দেখে দেশে ফিরে এসেছেন কয়েক মাস আগে (ফেব্রুয়ারি’১৮)। হৃদরোগের কারণে এখন হাঁটতেও পারছেন না ঠিকমতো। জানি না, রুগ্ন এই শরীর নিয়ে ঔষধের ওপর নির্ভরশীল হয়ে আর কতদিন বেঁচে থাকার ভাগ্য হয়! উল্লেখ্য, তাঁরা মোট আট ভাই। এ আট জনের মধ্যে তিন জনই মারা গেছেন হার্ট অ্যাটাক করে। যে তিন জন হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন, তাঁরা সবাই মোটা ছিলেন। আর তাঁদের যে বোন এখন জীবিত আছেন, তিনিও হৃদরোগ, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে বেশ কষ্টে জীবন কাটাচ্ছেন।
আমার বড় ভাইয়ের বয়স ৪৬ বছর। পেশাগত কারণে একসময় অনেকটা আরামে ছিলেন। শরীরও বেড়ে গিয়েছিল। হঠাৎ দেখা দিল ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার দু’একবছর পর অনিবার্য কারণে পেশা পরিবর্তন করার পর তাঁকে বেছে নিতে হয় এমন পেশা, যা ছিল শারীরিক পরিশ্রম নির্ভর। নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করতে হওয়ায় একসময় তাঁর ওজনও কমে যায়, ডায়াবেটিসও প্রায় পালিয়ে যায়।
আমার মেঝো ভাইয়ের বয়স এখন ৪০। শৈশব থেকেই হালকা-পাতলা গড়নের ছিলেন। ১৯-২০ বছর বয়সে পড়ালেখার সুবাদে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র ভিন্ন পরিবেশে চলে যাওয়ায় খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের ফলে তাঁর শরীর বেড়ে যেতে শুরু করে। বয়স যখন ত্রিশ-বত্রিশ, তখন তাঁর শরীরে দেখা দেয় উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস। তিনি বিয়ে করেন ২০০৯ সালে। আমার ভাবী বিয়ের পর ধীরে ধীরে মোটা হতে শুরু করেন। তিনিও এখন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ডায়াবেটিস ইদানিং এতো বেড়ে গেছে, ইনসুলিন নেয়া ছাড়া চলে না।
আমার বুঝজ্ঞান হওয়ার পর থেকে আমার মা-কে দেখছি শারীরিকভাবে বেশ হালকা। সাংসারিক কাজে ডুবে থাকতেন সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত। আমাদের গৃহস্থালীর কাজ খুব বেশি ছিল। আমরা ছিলাম গ্রামের একটি খাঁটি কৃষক পরিবার। বিগত পাঁচ-ছয় বছর আগ থেকে আমাদের সাংসারিক কাজকর্ম অনেকটা কমে যাওয়ায় আমার মায়ের ওজন কিছুটা বাড়তে শুরু করে এবং শরীরে তিনি উচ্চ রক্তচাপের উপস্থিতিও টের পেতে শুরু করেন। গরুর মাংস তাঁর খুব প্রিয় ছিল। কিন্তু এখন মনমতো খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হচ্ছে।
আমার বাবার বয়স এখন ৭৮ বছর (২০১৮ সালে)। আমাদের পার্শ্ববর্তী বাজারে তাঁর পোশাকের ব্যবসা ছিল। অবসর সময়গুলোতে তিনি আমাদের জমিতে বিভিন্ন রকম ফসল ফলাতে গিয়ে অনেক শারীরিক পরিশ্রম করতেন। কাজ করতে গিয়ে তাঁর শরীর থেকে প্রচুর ঘাম বের হতো। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ কোনো কিছুই তাঁর ছিল না। কষ্ট পেতেন বাতজনিক সমস্যায়। পাঁচ-ছয় বছর আগে শরীরে বাত-ব্যথা হঠাৎ করে মারাত্মক আকার ধারণের পর তিনি সব কাজ থেকে অবসরে চলে যান। আমাদের ফসলের জমিগুলো এখন অনাবাদী পড়ে থাকে। পরিশ্রমের কোনো কাজই করতে হয় না বলে আমার বাবার ওজন একটু বেড়ে গেছে, উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিতেও তেমন একটা দেরি করেনি।
আমার আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, সহকর্মী-বন্ধু এবং পরিচিতজনদের মধ্যে অসংখ্য মানুষ ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগে আক্রান্ত। প্রায়ই নতুন করে অনেক লোকের এসব রোগে আক্রান্ত হবার কথা, এসব রোগে আকস্মিক মারা যাবার কথা কানে আসে। এসব রোগের ভয়াবহতা আমাকে প্রায়ই ভাবিয়ে তোলে। আমি অনেক সময় দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়ি। কারণ এ রোগগুলো মানুষের জীবনের স্বাভাবিকত্ব নষ্ট করে দেয়। মানুষ মনমতো এবং পছন্দের অনেক খাবার খেতে পারে না। রোগগুলোর কোনোটিতে আক্রান্ত হবার পর ঔষধ-নির্ভর হয়ে কাটাতে হয় বাকি জীবন। নিয়মতান্ত্রিক খাওয়া-দাওয়া, ঔষধ গ্রহণ বা চালচলনের একটু হেরফের হলেই রোগগুলো মারাত্মক রূপ ধারণ করে মানুষকে মৃত্যুর কাছাকাছি নিয়ে যায়, অনেক সময় তাৎক্ষণিক মেরেও ফেলে।রক্তচাপ বেড়ে অনেকে মাঝেমধ্যে অচেতন হয়ে পড়ে, অনেকে রক্তচাপের অতিরিক্ততায় হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে কোনো সতর্কতা সংকেত ছাড়াই মৃত্যুমুখেও ঢলে পড়ে। অনেক ডায়াবেটিস রোগী নিয়মতান্ত্রিক চলাফেলায় একটু এদিক সেদিক হলেই ডায়াবেটিস বেড়ে বা কমে গিয়ে অস্থিরতায় ছটফট শুরু করে, অনেকে তাৎক্ষণিক মারাও যায়। সবচেয়ে বড় কথা, এসব রোগে আক্রান্ত হয়ে অনেকে আকস্মিক মারা যায়, বাকিরা আকস্মিক মারা না গেলেও এসব রোগে ধুঁকে ধুঁকে শেষে এসব রোগেই মারা যায়।
আমার আত্মীয়-স্বজন বা পরিচিতজনদের মধ্যে অসংখ্য মানুষ এসব রোগে আক্রান্ত হয়ে জীবন হারিয়েছেন। শুধু কি আমার আত্মীয়-স্বজন আর পরিচিত মানুষরাই এসব রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন? না, বরং প্রতিদিন, প্রতিক্ষণে বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ মানুষ এসব রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালে প্রাণ হারাচ্ছেন বা রোগজর্জরিত হতাশাগ্রস্থ জীবনে প্রবেশ করছেন। একসময় এসব রোগ শুধু বয়স্কদেরকেই বেশি বেশি আক্রমণ করতো, কিন্তু বিগত কয়েক দশক ধরে এসব রোগ বয়স্কদের পাশাপাশি তরুণদেরকেই শুধু নয়, শিশুদেরকেও ব্যাপকাকারে আক্রমণ করতে শুরু করেছে। পৃথিবীর কোটি কোটি শিশু-যুবকও এখন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগে আক্রান্ত।
পরিচিত বা আত্মীয়দের কেউ মারা গেলে খোঁজ নিয়ে দেখি কোন্ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন? উত্তরে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয় এসব কোনো রোগের নাম। এসব দেখে প্রায়ই আমার মনে দুশ্চিন্তা উঁকি মারে, এসব রোগ কি আমাকেও আক্রমণ করার জন্য ধেয়ে আসছে? আমিও কি এসব রোগের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে যাচ্ছি? প্রশ্ন জাগে, কেন মানুষ এসব রোগে আক্রান্ত হয়? উত্তর খুঁজতে ব্যাকুল হয়ে উঠি। পত্রপত্রিকায় এসব রোগ সম্পর্কে নিবন্ধ বা প্রতিবেদনগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ি। কারা এসব রোগ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে, তা-ও লক্ষ্য করি। যারা এসব রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, তাদের জীবন নিয়ে ভাবি।
পড়তে পারেন: ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার মোট কারণ মাত্র ৩টি!
মাঝে মাঝে অবাক হই এটা দেখে, সমাজের কিছু লোকের বয়স ৬০-৭০ বছর বা তার চেয়েও বেশি, তবু শরীরে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা হৃদরোগের মতো কোনো রোগ নেই! ক্ষেত-খামারে দিব্যি কাজ করে যাচ্ছেন বা রিকশা/সাইকেল চালাচ্ছেন নিয়মিত। এরা কেন এ বয়সে এসেও সুস্থ-সবল? আমি কোন্ দলে হতে যাচ্ছি? এমন সব কথা ভাবতে ভাবতে, মানুষ কেন এসব রোগে আক্রান্ত হয় বা কোন্ ধরনের মানুষ আক্রান্ত হয়, তা নিয়ে খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে করতে একসময় কিছু সমীকরণ আমার সামনে এসে মিলতে শুরু করে। সেসব সমীকরণ নিয়েই এ লেখার প্রচেষ্টা।
অধ্যায়-২
মানুষ দিন দিন কায়িক শ্রমবিমুখ হচ্ছে
১. বেশিদিন আগের কথা নয়, পঁচিশ-ত্রিশ বছর আগেও দেখেছি, মানুষ গ্রামে থাকতো বেশি। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ ছিল কৃষিজীবি। নিজেদের জমিতে মানুষ নিজেরাই ধান, গম, ডাল, মরিচ, শাক-সবজিসহ বিভিন্ন রকম ফল-ফসল উৎপন্ন করে নিজেদের প্রয়োজন মেটাতো। বাড়তি উৎপন্ন হলে বাজারেও বিক্রি করতো। মানুষ নিজেদের জমিতে নিজেরা কাজ করতে আনন্দবোধ করতো। বিভিন্ন ফসল ফলাতে গিয়ে ক্ষেত-খামারে মানুষ কতোই না ব্যস্ত সময় কাটাতো। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম আর ঘাম ঝরানো কাজ করতো। আমি নিজেও আমার বাবার সাথে আমাদের জমিতে অনেক কাজ করেছি। মনে আছে, প্রতি শুক্রবার বিদ্যালয় যেদিন বন্ধ থাকতো, বাবা আমাদেরকে সাথে করে ক্ষেতে নিয়ে যেতেন। বাবার সাথে আমরাও অনেক কাজ করতাম আমাদের সাধ্যমতো। কাজ করতে গিয়ে বাবার ঘাম ঝরার দৃশ্য এখনো মনের চোখে আমি পরিষ্কার দেখতে পাই। সেই সময় এখন নেই। অনেক পেছনে চলে গেছে। জমিতে কাজ করার ঐতিহ্যেও এখন ভাটা পড়েছে। আমাদের সেইসব জমি এখন অকেজো পড়ে আছে। বাবা এখন কাজ করতে পারছেন না অসুস্থতার কারণে। বাত-ব্যাথায় আক্রান্ত হয়ে তিনি এখন অবসর জীবন যাপন করছেন। এ অবসরের ফাঁকে তিনি ইতোমধ্যে উচ্চ রক্তচাপেও আক্রান্ত হয়ে গেছেন।
ফসলের যে জমিগুলোতে দেখতাম বছরে কমপক্ষে দু’বার ধান চাষ হচ্ছে, অন্যান্য শস্য-সবজিও চাষ হচ্ছে; সবসময় মানুষকে দেখতাম ফসলের জমিগুলোতে ঘাম ঝরাচ্ছে, সেগুলো এখন বছরের পর বছর পড়ে থাকে অনাবাদী। কেউ খবরও যেন নিচ্ছে না অথবা খবর নেয়ার কেউ নেই!
মানুষ এখন ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় গ্রামকে বয়কট করা শুরু করেছে। শহরের দিকে চলে যাচ্ছে শুধু। নগদ টাকার পেছনে ছুটছে। সভ্যতা পাল্টে যাচ্ছে। নগরসভ্যতা মানুষকে গ্রাস করেছে। গ্রামের সেইসব ফসলের জমিতে মানুষের পরিশ্রমের সময়গুলো কাটছে এখন আরামে আরামে। চাকরি, ব্যবসা আর আরামের সব পেশায় নিয়োজিত থেকে মানুষ নগদ টাকা দিয়ে বাজার থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে বসে বসে খাচ্ছে। কৃষিকাজের সাথে আগে যখন প্রায় শতভাগ মানুষ জড়িত ছিল, এখন ত্রিশ কি চল্লিশ শতাংশ মানুষ মাত্র কৃষিকাজের সাথে জড়িত। মানুষ যে পরিশ্রমবিমুখ হচ্ছে, তা উপলব্ধি করার জন্য এ বিষয়টা লক্ষ্য করাই যথেষ্ট।
মহিলাদের কায়িক শ্রমও কমে যাচ্ছে
পুরুষদের পাশাপাশি মহিলারাও আগে গৃহস্থালির অনেক হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের কাজ করতো। ধান ভাঙ্গাতে, চালের গুঁড়া, মরিচ-হলুদের গুঁড়া করতে গিয়ে প্রায়শই ‘ঢেঁকি’ ব্যবহার করতে হতো। ঢেঁকি, কাঠের বড় গুঁড়ি দিয়ে তৈরি একটি যন্ত্র, যা ধান ভেঙ্গে চাল করা বা আতপ চাল ভেঙ্গে চালের গুঁড়ো করা ইত্যাদি কাজে ব্যবহার করা হয়। পৃথিবীর সব দেশে ঢেঁকির ব্যবহার আছে/ছিল কিনা, জানি না। তবে বাংলাদেশে ঢেঁকির কথা আমরা অনেকেই ভুলে যেতে বসেছি। কারণ ব্যবহার নেই। রাইস মিল এখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঢেঁকির কাজগুলো করে দিচ্ছে। বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম তো ঢেঁকি চেনে না। ঢেঁকির কথা বললে ওরা এখন ‘গুগলে’ খুঁজে দেখতে হয়। যে ঢেঁকি ছিল প্রায় প্রতিটা পরিবারের আবশ্যকীয় উপকরণ, সভ্যতার বিবর্তনে সেই ঢেঁকি এখন উধাও! ঢেঁকির কাজ কতো যে পরিশ্রমের ছিল, যারা ঢেঁকিতে কাজ করেছেন, তারা তা ভালোভাবে উপলব্ধি করেন। ঢেঁকির সাথে মহিলাদের দূরত্ব সৃষ্টির অনেকগুলো কারণ রয়েছে- ১. যে কাজগুলো ঢেঁকিতে করতে হতো, সেগুলোর প্রায়গুলোই এখন মেশিনে করা যাচ্ছে, ২. মানুষ এখন ফসলের জমির সাথে সম্পর্ক কমিয়ে বাজার থেকে ‘রেডিমেড’ চাল, মরিচ-হলুদের গুঁড়া, গুঁড়ামশলা ইত্যাদি কিনে খাওয়ার দিকে ঝুঁকছে, ৩. গ্রাম ছেড়ে শহরমুখী হবার প্রবণতা বাড়ছে।
ঢেঁকিতে কাজ করা ছাড়াও পুরুষরা যখন নিজেদের জমিতে নানারকম ফসল ফলাতো, সেসব ফসল মাঠ থেকে ঘরে সংরক্ষণ করা বা খাওয়ার জন্য উপযোগি করা পর্যন্ত মহিলাদেরও অনেক পরিশ্রম করতে হতো। যখন থেকে পুরুষরা মাঠে ফসল কাজ ছেড়ে দিয়েছে বা কমিয়ে ফেলেছে, তখন থেকে মহিলাদের শারীরিক শ্রমও অনেক কমে গেছে। অনেক গৃহিণী নিঃশ্বাস ফেলার সময় পর্যন্ত পেতো না গৃহস্থালীর এসব কাজ সামলাতে সামলাতে। গ্রামের মহিলাদের পরিশ্রমের সেসব দিন তো এখন তেমন একটা নেই-ই। তারাও এখন শহুরে মহিলাদের সাথে পাল্লা দিয়ে আরামে আরামে থাকার চেষ্টা করে। টিভি দেখে, স্মার্টফোনে চোখ রেখে কাটিয়ে দেয় ঘন্টার পর ঘন্টা, এখানে ওখানে বেড়াতে যায়, শপিংয়ে যায় মন চাইলেই।
আর শহুরে মহিলাদের পরিশ্রমের কাজ খুঁজে বের করা দিন দিন দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে। বাসার সামান্য পরিচ্ছন্নতার কাজও তারা নিজ হাতে একটু কষ্ট করে করতে চায় না। কাজের লোক দিয়ে করাতে পেরেই খুশি। তাদের হাতের টুকটাক শ্রমসাধ্য কাজগুলোও হাত থেকে কেড়ে নিয়ে প্রযুক্তি এখন নিজ দায়িত্বে করে দিচ্ছে। তারা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছে আর উপভোগ করছে প্রযুক্তির কারিশমা। তাদের আরামকে আরো নিশ্ছিদ্র করতে প্রযুক্তি তাদের উপহার দিয়েছে ওয়াশিং মেশিন, ব্লেন্ডার, রুটি মেকার, ওভেন ইত্যাদি। আরামপ্রিয় মানুষ আরামের উপকরণগুলোকে আশীর্বাদ হিসেবে গ্রহণ করবে, এটাই স্বাভাবিক। আরাম-বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দেয়ার মধ্যেই আজকাল সবাই সুখ খোঁজে।
যাতায়াতেও কষ্ট কমে গেছে অনেক
যাতায়াতের ক্ষেত্রেও মানুষের কষ্ট এখন অনেক কমে গেছে। এক-দু’মাইল নয়, চার-পাঁচ মাইলও নয়, দশ-বিশ মাইল পথও মানুষ একসময় হেঁটে হেঁটেই চলে যেতো প্রয়োজনে, ত্রিশ-চল্লিশ বছর বা তারও আগে। রাস্তাঘাটের অবস্থা ছিল খারাপ, পাকা তো ছিলই না, তদুপরি গাড়ির প্রচলনও ছিল না অথবা প্রচলন থাকলেও দুষ্প্রাপ্য ছিল। পনেরো-বিশ মাইলের মতো দূরের কোনো বাজার কি শহর, স্কুল-কলেজ বা আত্মীয়ের বাড়ি সবখানে মানুষ অধিকাংশ সময় হেঁটে হেঁটে চলে যেতো। এর সবচেয়ে বড় কারণ, পরিস্থিতি। হেঁটে যাওয়া ছাড়া যাবার আর তেমন কোনো সহজ বিকল্প ছিল না। এমন অনেক বয়ষ্ক লোক এখনও পাওয়া যাবে, যানবাহন সহজলভ্য ছিল না বলে যারা পনেরো-বিশ মাইল দূরের নিজ জেলা শহরে জরুরী প্রয়োজনে একসময় হেঁটে হেঁটেই চলে যেতেন!
আর এখন? রাস্তাঘাট প্রায় সবগুলোই পাকা, গাড়িও একেবারে সহজলভ্য, ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারেও এখন অনেকেই অভ্যস্ত, এসবের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে গেছে মানুষের আরামপ্রিয়তাও। তাই পনেরো-বিশ মাইল পথ হেঁটে যাওয়া তো এখন অকল্পনীয়, চার-পাঁচ মাইলও নয়, এমনকি মাত্র এক মাইল পথও মানুষ হেঁটে যেতে চায় না। সভ্যতার কী আমূল পরিবর্তন! এমন ঘটনার মুখোমুখিও প্রায়ই হই, অনেকে কোনো তাড়া নেই তবু আধা-মাইল পথ যেতেও ট্যাক্সিতে উঠে বসে! এদের কাজটাকে ভুল বলা যাবে না। কারণ রাস্তায় গাড়িপ্রবাহ থাকতে হেঁটে হেঁটে কষ্ট করে যাবার কী প্রয়োজন? প্রেস্টিজের একটা ব্যাপারও অনেক সময় হয়তো কাজ করে!
আরামদায়ক প্রযুক্তির জয়জয়কার
বিজ্ঞানের যত উন্নতি হচ্ছে, মানুষের কষ্ট তত কমে যাচ্ছে। বিজ্ঞান নিজেই একসময় মানুষকে পরিশ্রমের সব প্রযুক্তি উপহার দিতো। ঢেঁকি, বাইসাইকেল, ধান মাড়াইয়ের মেশিন, ডাল ভাঙ্গার যাঁতা, পায়ে চালিত রিকশা এসবই প্রযুক্তি। তবে এগুলো ছিল পরিশ্রমসাধ্য প্রযুক্তি। এটা অবশ্য ঠিক, বিভিন্ন কাজে পা এবং হাতের সরাসরি ব্যবহারের বিকল্প হিসেবেই প্রযুক্তিগুলোর আবির্ভাব। বিজ্ঞান বসে নেই। আগের কষ্টসাধ্য প্রযুক্তিগুলোর স্থলে বিজ্ঞান আরামদায়ক প্রযুক্তি উপহার দিতে শুরু করেছে বিগত কয়েক দশক ধরে। ঢেঁকির পরিবর্তে এনেছে রাইসমিল; স্থির রাইসমিলের পরিবর্তে এনছে চলমান রাইসমিল; সাইকেলের পরিবর্তে এনেছে মোটরসাইকেল; ধান মাড়াইয়ের জন্য পায়েচালিত মেশিনের পরিবর্তে এনেছে স্বয়ংক্রিয় মেশিন; পায়ে চালিত রিকশার জায়গায় এনেছে মোটরচালিত রিকশা (অবশ্য পায়েচালিত রিকশার ব্যবহার এখনো সীমিত পরিসরে হলেও আছে); গাড়ি এখন সুইচ টিপ দিলেই স্টার্ট হয়ে যায়; জামাকাপড় আগে মানুষ হাতে ধুয়ে পরিষ্কার করতো, এখন ধোয় ওয়াশিং মেশিনে কোনো শারীরিক কষ্ট ছাড়াই; ব্লেন্ডারেই এখন এমন সব কাজ মানুষ সেরে ফেলে, যেগুলো করতে আগে মানুষকে অনেক ঘাম ঝরাতে হতো; যুগ যুগ ধরে যে নৌকা চালাতে হতো বৈঠা দিয়ে, তা এখন চলে ইঞ্জিনের সাহায্যে শারীরিক কষ্ট ছাড়াই। এভাবে বিজ্ঞানও মানুষকে শারীরিক কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। দিন যতই যাচ্ছে, মানুষ শারীরিক কষ্টের কাজ থেকে দূরে সরে হয়ে যাচ্ছে আরামপ্রিয়; বিলাসী এবং আধুনিক থেকে সর্বাধুনিক!
>> দ্বিতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
0 Comments: