ডেঙ্গু এবং চিকুনগুনিয়ার জন্য এডিস মশা কি সত্যিই দায়ী?
ডেঙ্গু এবং চিকুনগুনিয়া জ্বরের জন্য এডিস মশা কি সত্যিই দায়ী?
নূর আহমদ
দেশে এখন ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। বিগত কয়েক বছরও মানুষ ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ায় ব্যাপকহারে আক্রান্ত হয়েছিল, অনেক মানুষ মৃত্যুমুখেও পতিত হয়েছিল। ঢাকাসহ সারা দেশের মানুষ এখন ভয়াবহ ডেঙ্গুফোবিয়ায় আক্রান্ত। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া এই দু’টি জ্বরের জন্য এডিস নামক একটি মশাকে দায়ী করা হচ্ছে। কিন্তু এখনো কারো মুখে এমন প্রশ্ন শুনিনি, সত্যিই এডিস মশা কি এই দু’টি জ্বরের জন্য দায়ী? এই লেখা যারা পড়ছেন, তাদের নিকট এই প্রশ্ন শুধু নতুন নয়, অবাক করাও!
এই লেখায় প্রচলিত ধারণার বাইরে গিয়ে একটু নেড়েচেড়ে দেখার চেষ্টা করা হবে, ডেঙ্গু এবং চিকুনগুনিয়া জ্বরের জন্য এডিস মশা কি সত্যিই দায়ী?
‘শিশুর যখন ডেঙ্গু’ শিরোনামে প্রথম আলোয় একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় ৩১ জুলাই ২০১৯ তারিখে, যা লিখেছেন অধ্যাপক ডা. আবিদ হোসেন মোল্লা (শিশুবিশেষজ্ঞ, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল)। সেখানে তিনি লিখেন, ‘এখন এ দেশে সবচেয়ে আলোচিত আতঙ্কের নাম ডেঙ্গু। এটা ভাইরাসজনিত রোগ, যা এডিস মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু আক্রান্ত মানুষের শরীর থেকে অন্য মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। প্রবেশ করার ৪ থেকে ১০ দিন পর রোগের উপসর্গ দেখা যায়।’
‘ডেঙ্গু ঠেকাতে সচেতন হোন’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় প্রথম আলোয় ৩১ জুলাই ২০১৯ তারিখে, যা লিখেছেন রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. গুলজার হোসেন। তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গুর ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষের দেহে ছড়ায় মশার মাধ্যমে। মশাই এই রোগের একমাত্র বাহক। ডেঙ্গু ভাইরাস যে বিশেষ মশার মাধ্যমে ছড়ায়, তার নামও সবাই জানে— এডিস মশা।’
এই দু’জন চিকিৎসকের লেখা থেকে বুঝা যায়, সরাসরি এডিস মশার কামড়ে কারো ডেঙ্গু জ্বর হয় না। বরং এডিস মশা শুধু ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত একজনের শরীর থেকে আরেকজনের শরীরে জ¦রটির ভাইরাস বহন করে নিয়ে যায়।
আরো দু’টি প্রতিবেদন দেখা যাক।
‘ডেঙ্গু নিয়ে উদ্বেগে মানুষ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় প্রথম আলোয় ৩১ জুলাই ২০১৯ তারিখে। সেখানে বলা হয়, ‘চার দিন আগে চমেক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন চন্দনাইশের জিয়া উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আমি ঢাকায় যাইনি। আমার কর্মস্থল বোয়ালখালী। চট্টগ্রাম শহরেও আসিনি। তবু আমি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলাম।’
তাঁর পাশের শয্যায় শুয়ে আছেন কলেজছাত্র আসাদুজ্জামান। তিনিও বোয়ালখালীর বাইরে কোথাও যাননি। তবু আক্রান্ত হয়েছেন ডেঙ্গুতে। সীতাকুন্ডের আবদুল্লাহ আল নোমান ভর্তি হয়েছেন পাঁচ দিন আগে। তিনিও ঢাকায় যাননি।’
‘চট্টগ্রামে ডেঙ্গু রোগী কমার লক্ষণ নেই’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় প্রথম আলোয় ১৬ আগস্ট ২০১৯ তারিখে (প্রিন্ট ভার্সন)। সেখানে উল্লেখ করা হয়, ‘চট্টগ্রামের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাধীন রোগীদের মধ্যে বেশিরভাগই চট্টগ্রামের আশপাশের জেলা ও উপজেলার। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের মধ্যে মাত্র ১১ জন ঢাকায় বাস করেন কিংবা সম্প্রতি ঢাকা সফর করেছেন। বাকি ১০০ জনই চট্টগ্রামের আশপাশের জেলা ও উপজেলার। এ ছাড়া অন্য হাসপাতালগুলোতে ভর্তি থাকা ৬৫ জনের প্রায় সবাই চট্টগ্রামের।’
এই দু’টি প্রতিবেদন থেকে বুঝা যায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত কেউ নেই, এমন এলাকায়ও মানুষ নতুন করে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়। ২০১৯ সালে ঢাকা শহরের মানুষ প্রথম ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতে শুরু করেছে। কিন্তু যারা ঢাকায় বসবাস করে না বা সম্প্রতি ঢাকা সফর করেনি, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের এমন অসংখ্য মানুষও ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে।
‘হাসপাতালগুলো যেন মশার চারণভূমি’ শিরোনামে প্রথম আলোয় ১৭ আগস্ট ২০১৯ তারিখে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে উল্লেখ করা হয়, ‘কীটতত্ত্ববিদ মঞ্জুর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুগদার মতো হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গুর ভাইরাসবাহী এডিস মশা বেশি। এরা ডেঙ্গুর রোগীর রক্ত খাচ্ছে, আর অন্যদের শরীরে তা ছড়াচ্ছে। চিকিৎসক ও নার্সরা আক্রান্ত হওয়া তার জ্বলন্ত প্রমাণ।’
এই কীটতত্ত্ববিদের কথায় স্পষ্ট বুঝা যায়, যে কোনো এডিস মশা কামড় দিলেই মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয় না, বরং কারো কোনোভাবে ডেঙ্গু জ্বর হলে যদি তাকে এডিস মশা কামড় দেয়, তখন ওই এডিস মশা ডেঙ্গুর ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে এবং এরপর যদি ওই এডিস মশা কোনো সুস্থ মানুষকে কামড় দেয়, তখন ওই সুস্থ মানুষটিও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। তার মানে ‘ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়া’র জন্য মূলত এডিস মশা দায়ী নয়, বরং ‘ডেঙ্গু জ্বর ছড়ানো’র জন্যই শুধু এডিস মশা দায়ী।
বিবিসি বাংলার ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনেও এমন কথা বলা হয়।
‘ডেঙ্গু জ্বর: এডিস মশা সম্পর্কে যেসব তথ্য জেনে রাখা ভাল’ শিরোনামে বিবিসি বাংলার ওয়েবসাইটে ৩০ জুলাই ২০১৯ তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের ‘এডিস মশা একবার কামড়ালেই কী ডেঙ্গু হয়?’ উপশিরোনামে বলা হয়, ‘এডিস মশা কামড়ালে যে মানুষের ডেঙ্গুজ্বর হবেই, বিষয়টি এমন নয় বলে জানান ডা. আখতারুজ্জামান।
পরিবেশে উপস্থিত ভাইরাস এডিস মশার মধ্যে সংক্রমিত হলে সেই মশার কামড়ে ডেঙ্গু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
"এডিস মশা ভাইরাস সংক্রমিত থাকা অবস্থায় মানুষকে কামড়ালে সুস্থ মানুষের ডেঙ্গু হতে পারে।"
ভাইরাসের কারণে হওয়া জ্বরে আক্রান্ত থাকা ব্যক্তিকে এডিস মশা কামড়ালেও মশার মধ্যে ভাইরাস সংক্রমণ হওয়ার সুযোগ থাকে বলে জানান মি. আখতারুজ্জামান।
"এডিস মশার একটা বিষয় হলো, তারা সাধারণত একাধিক ব্যক্তিকে কামড়ায়। তাই ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির শরীর থেকে এডিস মশার মধ্যে ভাইরাস সংক্রমণ হওয়ার পর ঐ মশার কামড়ে ডেঙ্গু হয়।"
এডিস মশাকে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার জন্য এমনভাবে দায়ী করা হচ্ছে, মনে হচ্ছে, এডিস মশার কামড় ছাড়া কেউ ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে না। যদি তা—ই হয়, তাহলে যেসব মানুষ গত কয়েক মাসেও ঢাকা যায়নি, তারা কিভাবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলো? যেহেতু কীটতত্ত্ববিদ এবং চিকিৎসক প্রায় সবাই স্বীকার করেন যে, এডিস মশা শুধু এই জ্বর দু’টির বাহক, এই জ্বর দু’টিতে আক্রান্ত মানুষকে কামড় দেয়ার পর অন্য মানুষকে কামড় দিলেই ‘পরে কামড় দেয়া’ মানুষও এই জর¡ দু’টিতে আক্রান্ত হয়, তাই এই জ্বর দু’টির জন্য এডিস মশাকে সরাসরি দায়ী করার সুযোগ নেই। তবু জানি না, কী কারণে সবাই এই জ্বর দু’টির জন্য এডিস মশাকে সরাসরি দায়ী করছে? কেউ খুঁজছে না, প্রথম মানুষ, যাকে কামড় দেয়ার পর এডিস মশা এই রোগের বাহক হয়ে যায়, সে কোত্থেকে এই জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে?
যদি ‘ডেঙ্গু নিয়ে উদ্বেগে মানুষ’ শিরোনামে প্রথম আলোয় প্রকাশিত ডাক্তারের নিবন্ধে বর্ণিত কথা এবং ‘হাসপাতালগুলো যেন মশার চারণভূমি’ প্রতিবেদনে উল্লেখিত কীটতত্ত্ববিদ মঞ্জুর চৌধুরীর কথা সত্য হয়, তাহলে এডিস মশাকে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার জন্য সরাসরি দায়ী করার সুযোগ থাকে না।
জাল টাকার অস্তিত্ব সম্পর্কে সবাই জানি। জাল টাকা যারা তৈরি করে, তারা সেই টাকা বাজারে ছাড়ার পর কেউ যদি না জেনে কারো কাছ থেকে সেই টাকা পেয়ে আরেকজনকে সেই টাকা দিতে যায়, তার জন্য কি এই লোক দায়ী হবে? দায়ী তো হবে তারা, যারা জাল টাকা উৎপাদন করেছে। এভাবে এডিস মশা যেহেতু ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত এক শরীর থেকে অন্য শরীরে জ্বরটি বহন করে নিয়ে যায় শুধু, সেক্ষেত্রে জ্বর দু’টির জন্য এডিস মশাকে দায়ী করা ঠিক হবে না।
জ্বর দু’টির জন্য দায়ী করতে হবে তাকে, যা জ্বর দু’টি মানুষের শরীরে সৃষ্টি করে। কিন্তু জ্বর দু’টি কোত্থেকে, কিভাবে মানুষের শরীরে প্রথমে জন্ম নেয়, তা কি এখনো কেউ খুঁজে বের করতে পেরেছে?
‘ডেঙ্গুর লক্ষণ ও প্রতিরোধ’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় বাংলাদেশের জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল এনটিভির ওয়েবসাইটে ২৭ জুলাই ২০১৯ তারিখে। সেখানে ডেঙ্গুর লক্ষণ সম্পর্কে বলা হয়, ‘এ জ্বর অনেক ক্ষেত্রে কম হতে পারে, আবার বেশিও হতে পারে। দেখা যায়, জ্বর তিন—চার দিন পর ভালো হয়ে যায়। তবে এরপর প্লাটিলেট কম হতে থাকে। এরপর মাঝখানে একটি বিরতি দিয়ে আবার জ্বর আসে। এই জ্বরের সঙ্গে প্রচন্ড মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা এবং চোখের পেছনে ব্যথা করবে। জ্বর সাধারণত দুই দিন থাকার পর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় র্যাশ দেখা যায়।’
বিবিসি বাংলায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ‘ডেঙ্গু জ্বর সম্পর্কে ১০টি তথ্য জেনে নিন’ শিরোনামে ২৬ জুলাই ২০১৯ তারিখে। সেখানে ডেঙ্গুর লক্ষণ সম্পর্কে বলা হয়, ‘সাধারণভাবে ডেঙ্গুর লক্ষণ হচ্ছে জ্বর। ১০১ ডিগ্রি থেকে ১০২ ডিগ্রি তাপমাত্রা থাকতে পারে। জ্বর একটানা থাকতে পারে, আবার ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে দেবার পর আবারো জ্বর আসতে পারে। এর সাথে শরীরে ব্যথা মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা এবং চামড়ায় লালচে দাগ (র্যাশ) হতে পারে। তবে এগুলো না থাকলেও ডেঙ্গু হতে পারে।’
উইকিপিডিয়ায় (বাংলা) বলা হয়, ‘সাধারণভাবে, ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্তরা হয় উপসর্গবিহীন (৮০%) অথবা সাধারণ জ্বরের মত সামান্য উপসর্গ। বাকিদের রোগ হয় আরো জটিল (৫%), এবং স্বল্প অনুপাতে এটি প্রাণঘাতী হয়।’
‘চিকুনগুনিয়া সংকট : বর্ষার আগে ভরসা কতটা?’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় বিবিসি বাংলায় ২১ মে ২০১৮ তারিখে। সেখানে বলা হয়, ‘বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, চিকুনগুনিয়া রোগের প্রথমদিন থেকেই রোগীর অনেক বেশি তাপমাত্রায় জ্বর ওঠে। একই সাথে প্রচন্ড মাথা ব্যথা, শরীর ব্যথা, বিশেষ করে হাড়ের জয়েন্টে ব্যথা হয়। কারো কারো শরীরে র্যাশ ওঠে।
জ্বর ভালো হলেও রোগটি অনেকদিন ধরে রোগীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়।’
জ্বর দু’টির লক্ষণ সম্পর্কে এই চারটি তথ্য ভালোভাবে লক্ষ্য করলে এটা সহজেই মনে হবে, জ্বর দু’টি একই। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে জ্বরটিকে একেক বছর একেক নামে প্রচার করা হয় শুধু। প্লাটিলেট কমে যাবার সাথেও এই জ্বর দু’টোর সম্পর্ক করা উচিত নয়। কারণ পরীক্ষায় ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়া পজিটিভ না হওয়া মানুষেরও প্লাটিলেট অনেক সময় কম থাকে। সাধারণ জ্বরের সব লক্ষণের সাথে এই জ্বর দুটোর লক্ষণ পুরোপুরি মিলে যায়। যদি সাধারণ জ্বরের লক্ষণের সাথে এই দুটো জ্বরের লক্ষণের কোনো মিল না থাকতো এবং এডিস মশার কামড় খাওয়াটা চোখে দেখার পর এই জ্বরগুলোতে আক্রান্ত হয়েছে, এমন কথা প্রায় সব রোগী সাক্ষ্য দিতো, তাহলেই সুনিশ্চিতভাবে এই জ্বর দুটোর সাথে এডিস মশাকে সম্পর্কিত করার সুযোগ থাকতো।
এই বিষয়ে গভীরভাবে বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ ও সঠিক পন্থায় গবেষণা করার জন্য কীটতত্ত্ববিদ, চিকিৎসক ও গবেষকদের নিকট বিনীত অনুরোধ।
নূর আহমদ
ফিটনেস বিষয়ক গবেষক ও লেখক
0 Comments: