মোটা বা স্থূল হবার সবচেয়ে বড় ক্ষতি
মোটা বা স্থূল হবার সবচেয়ে বড় ক্ষতি
নূর আহমদ
অধিকাংশ চিকন মানুষদের মধ্যে মোটা হবার একটা আগ্রহ কাজ করে। মানুষ মোটা হতে চায় কেন? সাধারণত যে কারণগুলোর জন্য চিকন মানুষ মোটা হতে চায়, যেগুলো হতে পারে এরকম: (১) অনেক মানুষ মনে করতে পারে মোটা মানুষের শরীরে শক্তি বেশি। এই জন্য চিকন মানুষের চেয়ে মোটা মানুষকে বিভিন্ন চাকরিতে বা কাজে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। (২) মোটা হলে মানুষকে তুলনামূলক বেশি স্মার্ট দেখায়, তবে অতিরিক্ত মোটা হলে নয়। (৩) মোটা মানুষকে দেখতে সুখী মনে হয়। (৪) মোটা মানুষকে যে কোনো মজলিশে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। পক্ষান্তরে চিকন সমাজে অনেক সময় গুরুত্ব পায় কম। (৫) চিকন মানুষকে মনে করা হয় অভাবী বা সারাক্ষণ টেনশনে ভোগা মানুষ হিসেবে।
কেন মানুষ চিকন থেকে মোটা হতে চায়, আমি গুগলে খুঁজে দেখেছি, এ সম্পর্কে তেমন কোনো নিবন্ধ বা প্রতিবেদন নেই। এখানে যে ৫টি উদ্দেশ্য উল্লেখ করা হলো, এগুলোর সাথে বাস্তবের মিল থাকার সম্ভাবনা বেশি। তবে মানুষ ভেদে মোটা হতে চাওয়ার ভিন্ন উদ্দেশ্যও থাকতে পারে।
উদ্দেশ্য যা—ই হোক, অধিকাংশ চিকন মানুষের মনে মোটা হবার একটা আকাক্সক্ষা কাজ করে। অনেক চিকন মানুষ মোটা হবার অনেক প্রচেষ্টার পরও মোটা হতে পারে না। অনেকে কোনো চেষ্টা না করেও ভিন্ন পরিবেশে যাবার পর, বিশেষ করে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের পর মোটা হয়ে যায়। অনেক পুরুষ চাকরিতে প্রবেশের পর বা উপার্জনের ভালো কোনো উপায় খুঁজে পাবার পর মোটা হয়ে যায়। অনেকে শারীরিক পরিশ্রমের পেশা থেকে আরামের পেশায় চলে যাবার পর মোটা হয়ে যায়। অনেক মেয়ে বিয়ের পর মোটা হয়ে যায়। কারণ তখন টেনশন কম থাকে, জীবন আগের চেয়ে সুখী হয়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেক মানুষ নিজের প্রচেষ্টায়, যেমন বেশি বেশি খাবার খেয়ে বা ভিটামিনযুক্ত খাবার খেয়ে মোটা হয়ে যায়।
কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, মোটা হবার কী জ¦ালা, তা মানুষ চিকন থাকলে বুঝতে পারে না, মোটা হবার পর হাড়ে হাড়ে টের পায়। মোটা হলে মানুষের স্বাভাবিক চলাফেরায় কষ্ট হয়; একটু বেশি পরিশ্রমের কাজ করতে গিয়ে বা একটু জোরে হাঁটতে গিয়ে, সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে গিয়ে মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়ে, হাঁফিয়ে উঠে; বেশি মোটা হয়ে গেলে মানুষকে বিদঘুটে দেখায়; মেয়েরা বেশি মোটা হলে বিয়ের সময় ছেলেদের পছন্দের তালিকা থেকে বাদ হয়ে যায় ইত্যাদি। কিন্তু মোটা হবার এই ক্ষতিগুলো বড় ধরনের ক্ষতি নয়, এগুলোকে মোটা হবার ক্ষতি না বলে মোটা হবার অসুবিধা বললেই চলে। মোটা হবার বেশ কিছু ক্ষতিও রয়েছে, যেগুলো সম্পর্কে মানুষ সচেতন হলে চিকন কেউ আর যেমন মোটা হতে চাইবে না, মোটা মানুষরাও চিকন হয়ে যেতে চাইবে দ্রুত।
মোটা মানুষকে কিছু নির্দিষ্ট রোগ বেশি আক্রমণ করে। যেমন: ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট অ্যাটাক (হৃদরোগ)। কিডনী রোগের জন্যও স্থূলতা বা মোটা হওয়াকে দায়ী করা হয়।
মোটা হবার মানসিক ক্ষতিও রয়েছে। মোটা হলে খেলাধুলা করা কঠিন হয়ে পড়ে। বন্ধুরা যখন খেলে, তখন মোটা মানুষগুলোকে দর্শকের সারিতে বসে থাকতে হয়। মোটা মানুষ মানসিকভাবে হীনমন্যতায় ভোগে।
মোটা হবার আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে, একবার মোটা হয়ে গেলে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পুণরায় চিকন হওয়াটা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। মোটা হবার পর মানুষ যখন মোটা হবার অসুবিধা ও ক্ষতিগুলোর মুখোমুখি হতে শুরু করে, তখন চিকন হবার চেষ্টা করেও অনেক সময় চিকন হতে পারে না। কখনো কখনো অনেক ত্যাগ—তিতীক্ষার পর ওজন কিছু কমাতে পারলেও পরে আবার ওজন বেড়ে যায়। এই বিষয়টা অনেক ক্ষেত্রে মানসিক দুশ্চিন্তারও কারণ হয়ে উঠে।
‘স্থূলতা একটি নীরব ঘাতক’ শিরোনামে দৈনিক ইত্তেফাকে ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০ তারিখে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে (তৈরি করেছেন সিয়াম আহমেদ) বলা হয়, ‘‘স্থূলতা মানুষের শরীরে নানারকম জটিলতার সৃষ্টি করে। যেমন, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, স্টে্রাক, টাইপ—২ ডায়াবেটিস, অথেরোসে্ক্লরোসিস, পালমুনারি ইনসাফিয়েন্সি ইত্যাদি। এছাড়া স্থূলতা মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রজনন সংক্রান্ত সমস্যাসহ বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করে। পরিসংখ্যান বলছে, স্থূলতায় আক্রান্ত রোগীরা প্রায়শই মানসিক হীনমন্যতায় ভোগেন।’’
‘স্থূলতা থেকে কিডনি রোগ’ শিরোনামে দৈনিক কালের কন্ঠে ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০ তারিখে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে, যা তৈরি করেছেন অধ্যাপক ডা. শামীম আহমেদ, বলা হয়, ‘‘দেহে চর্বি জমা হয়ে মুটিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ অধিক খাদ্য গ্রহণ। এ ছাড়া বংশগত কারণ, কর্ম সম্পাদনে ধীরগতি, নানা হরমোন, ওষুধের প্রভাব ইত্যাদি এর জন্য দায়ী। অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণের ফলে হজমের পর কিছুটা চর্বিতে রূপান্তর হয়ে দেহে জমা হয়। এই অতিরিক্ত চর্বির কারণে স্থূলতা তৈরি হয়, ওজন বৃদ্ধি পায়। তখন কিডনির ছাঁকনিকে অতিরিক্ত কাজ করতে হয়। এতে ধীরে ধীরে কিডনির কার্যক্ষমতা কমে যায়। একসময় দুটি কিডনিই অকেজো হয়ে যেতে পারে। শুধু কিডনি রোগ নয়, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে চর্বির পরিমাণ বৃদ্ধি, ঘুমানোর সময় শ্বাসকষ্ট, লিভারে চর্বি বা ফ্যাটি লিভার, পিত্তথলির রোগ, হাড়ের রোগ, মানসিক রোগ, ক্যান্সার, বন্ধ্যাত্ব এবং সর্বোপরি জীবনযাত্রার মানে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটায় এই স্থূলতা।’’
আরেকটা বিষয় হচ্ছে, মোটা হওয়া যেমন সহজ, চিকন হওয়াটা তেমন সহজ নয়। বেশি বেশি খাওয়া এবং আরামে থাকাই মোটা হবার সবচেয়ে সহজ উপায়। উভয়টা মজাদার। কিন্তু চিকন হতে গেলে খাওয়া—দাওয়া কমিয়ে দিতে হয় এবং শারীরিক কসরত বা ব্যায়াম করতে হয়। এই কাজগুলো কষ্টকর। চিকন হতে গিয়ে অনেক সময় প্রেসার লো হয়ে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে। চিকন হওয়া বা ওজন কমানোর জন্য অনেকে ফিটনেস সেন্টার বা জিমেও গিয়ে থাকেন, যা ব্যয়বহুল। অনেকে সেখানে ভর্তি হয়ে কিছুদিন পরই তা ছেড়ে দেন সময়ের অভাব বা আসা—যাওয়ার বিড়ম্বনা ইত্যাদি কারণে।
মোটা হওয়া বা স্থূলতার এই সব সমস্যা ও ক্ষতির মধ্যে তুলনা করা হলে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হিসেবে বিবেচিত হবে মোটা হবার স্বাস্থ্যগত ক্ষতির বিষয়টা তথা মোটা হবার কারণে তিনটি ভয়াবহ রোগে আক্রান্ত হওয়াটা। যদি মোটা হলে এই তিনটি রোগে আক্রান্ত হওয়া ছাড়া আর কোনো ক্ষতি না হতো, তবু মোটা হওয়াকে কোনো ‘নেতিবাচক বিষয় নয়’ মনে করার সুযোগ থাকতো না। মোটা হবার কারণে এই রোগগুলোতে আক্রান্ত হওয়াকে শুধু স্বাস্থ্যগত ক্ষতি বলা ভুল হবে, এটা একই সাথে অর্থনৈতিক ক্ষতিও। এই রোগগুলোতে আক্রান্ত মানুষের পেছনে চিকিৎসা বাবত প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়।
বিবিসি বাংলায় ২১ অক্টোবর ২০১৮ তারিখে ‘বাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগীর পেছনে বছরে খরচ কত?’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘‘ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফাউন্ডেশনের হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশে এখন ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ৭০ লক্ষ।
একজন রোগীর যদি প্রতিমাসে গড়ে দুই হাজার টাকা খরচ হয়, তাহলে সে হিসেবে ডায়াবেটিসের চিকিৎসা বাবত প্রতিমাসে বাংলাদেশে খরচ হচ্ছে প্রতি মাসে ১৪ শত কোটি টাকা এবং প্রতি বছরে খরচ হচ্ছে ১৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।’’
এটা হচ্ছে ডায়াবেটিসের পেছনে খরচের একটা পরিসংখ্যান। হৃদরোগের পেছনে খরচ কেমন, তা ভুক্তভোগীরাই বেশি বলতে পারবেন। হৃদরোগে আক্রান্ত হলে পরীক্ষা—নিরীক্ষা করতেই অনেক টাকা খরচ হয়। হৃদরোগে আক্রান্ত হলে চিকিৎসা হিসেবে অনেককে বাইপাস সার্জারী করতে হয়, অনেকের হার্টে রিং পরানো হয়। এই দুইটিই অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এই দু’টির পরও নিয়মিত ডাক্তার দেখানো এবং ঔষধ সেবন বাবত প্রচুর টাকা খরচ হয় প্রতি মাসে।
তবে মোটা হওয়াই এই রোগগুলোতে আক্রান্ত হবার জন্য দায়ী, এটাই শেষ কথা নয়। মানুষ সাধারণত আরামে বেশি থাকলে এবং মনের চাহিদামতো খেলেই মোটা হয়ে যায়। মূলত এই দু’টি বিষয়ই রোগ তিনটিতে আক্রান্ত হবার প্রধান কারণ। যেহেতু অধিকাংশ মোটা মানুষের মধ্যে এই দু’টি বিষয় বিদ্যমান থাকে, তাই মোটা মানুষদেরকে এই রোগগুলোতে বেশি আক্রান্ত হতে দেখা যায়। তবে কিছু কিছু মানুষ মোটা হওয়া সত্ত্বেও এই রোগগুলো থেকে নিরাপদ থাকেন, যারা মোটা হওয়া সত্ত্বেও নিয়মিত কোনো না কোনোভাবে পর্যাপ্ত কায়িক শ্রম করেন। আমি এই রকম বেশ কয়েকজন মানুষকে চিনি, যারা মোটা হওয়া সত্ত্বেও এই রোগগুলোতে আক্রান্ত নন, অথচ বয়স হয়ে গেছে ৬০—৭০ বছর।
যেহেতু অধিকাংশ মোটা মানুষ শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকেন, তাই মোটা মানুষদেরকে এই রোগগুলোতে আক্রান্ত হতে দেখা যায় বেশি।
মোটা বা স্থূল হবার এই ক্ষতিগুলো থেকে বাঁচতে আমাদের উচিত, যারা এখনো মোটা নই, তারা মোটা হবার চেষ্টা না করা বা চিকন থাকার চেষ্টা করে যাওয়া। আর যারা ইতোমধ্যে মুটিয়ে গেছেন, তারা ওজন কমানোর চেষ্টা করে যাওয়া। চিকন থাকা বা ওজন কমানোর সেরা উপায় শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করা। নিয়মিত অন্তত ৪০ মিনিট কঠোর শারীরিক পরিশ্রম করলে আর পরিমিত খাবার খেলে আমরা চিকন থাকতে পারবো, আগে থেকে মোটা হলে ধীরে ধীরে চিকনত্ব ফিরে পাবো।
0 Comments: