এডিস মশা, চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু জ্বর সম্পর্কে কিছু কৌতুহলোদ্দীপক প্রশ্ন
এডিস মশা, চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু জ্বর সম্পর্কে কিছু কৌতুহলোদ্দীপক প্রশ্ন
শুধু এডিস মশা নয়, কোনো মশা-ই মানুষের শরীরে কোনো রোগ ছড়াতে সক্ষম নয়। মশা নিয়ে মানুষের অতিরিক্ত ভয় সম্পূর্ণ অমূলক। মশা নিয়ে আপনার মনের সব ভয় দূর করতে নিচের লেখাটি মনোযোগ সহ পড়ুন। [লেখাটি ২০১৯ সালে লেখা হয়েছিল, পরে আপডেট করা হয়েছে]
এডিস মশা, চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু জ্বর সম্পর্কে কিছু কৌতুহলোদ্দীপক প্রশ্ন
নূর আহমদ
বাংলাদেশে এখন (২০১৯ সাল) মানুষের মুখে মুখে, পত্রপত্রিকায় সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় হচ্ছে ‘ডেঙ্গু জ্বর’। প্রথমে ঢাকার মানুষ জ্বরটিতে আক্রান্ত হতে শুরু করেছে, এখন ক্রমান্বয়ে সারাদেশেই জ্বরটি ছড়িয়ে পড়ার খবর আসছে। এ পর্যন্ত সারাদেশে অনেক মানুষ ডেঙ্গুতে মারাও গেছে। ঢাকার মানুষ না পারছে ঢাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে, না পারছে ঢাকায় থাকতে। শুধু ঢাকাবাসী নয়, পুরো দেশের মানুষ এখন মারাত্মকভাবে ‘ডেঙ্গুফোবিয়া’য় ভুগছে।
সবার মনে থাকার কথা, ২০১৭ এবং ২০১৮ সালের এই বর্ষা মৌসুমে আমাদের দেশের, বিশেষতঃ ঢাকার মানুষ ব্যাপকাহারে ‘চিকুনগুনিয়া’য় ভুগেছিল। অনেক মানুষ তখন মারাও গেছে চিকুনগুনিয়ায়। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া এই জ্বর দু’টিই নাকি ‘এডিস মশা’র মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। এ বছর (২০১৯ সালে) ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরুর পর থেকে আমি ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া এবং এডিস মশা সম্পর্কে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ-প্রতিবেদনগুলো মনোযোগসহ পড়তে থাকি। কারণ আমিও কোনোভাবে কখনও ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারি। কিন্তু এ সংক্রান্ত সংবাদ ও প্রতিবেদনগুলো পড়ে আমার মনে কিছু প্রশ্ন উত্থাপিত হয়, যেগুলো জেনে আপনিও অবাক হতে পারেন। আমার মনে হয়, প্রশ্নগুলোর উত্তর যথাযথভাবে খোঁজার চেষ্টা করা হলে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া এবং এডিস মশা সম্পর্কে বর্তমানে প্রচলিত অনেক ধারণা পাল্টে যেতে পারে।
১. একই মশা একেক বছর একেক রোগ কিভাবে ছড়ায়?
১৬ মে ২০১৭ তারিখে ‘বিবিসি বাংলা’য় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ‘বাংলাদেশে বাড়ছে চিকুনগুনিয়া রোগ : এ থেকে বাঁচার উপায় কী?’ শিরোনামে। সেখানে বলা হয়, ‘চিকুনগুনিয়া মশা বাহিত একটি ভাইরাসের কারণে হয়ে থাকে। ডেঙ্গু রোগের ভাইরাস যে এডিস মশা বহন করে, সেই মশাই চিকুনগুনিয়া ভাইরাসেরও বাহক।’ [https://www.bbc.com/bengali/news-39931663]
প্রতিবেদনটিতে আরো উল্লেখ করা হয়, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ বিবিসিকে বলছেন, ডেঙ্গু যেমন এডিস মশা থেকে হয়, এটাও (চিকুনগুনিয়া) এডিস মশা থেকেই হচ্ছে। এখন থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। এসব বৃষ্টির পানি অনেকের বাসাবাড়ির ছাদে বা বারান্দার টবে জমে থাকছে। সেখানে এসব এডিস মশা ডিম পাড়ে। ফলে মশা বেড়েছে, আর তাই রোগটির প্রকোপও বেড়েছে।’
উইকিপিডিয়ায় (বাংলা) ‘চিকুনগুনিয়া’ শিরোনামের পরিচিতিমূলক নিবন্ধে বলা হয়, ‘এই ভাইরাসটি মশার কামড়ের মাধ্যমে মানব শরীরে প্রবেশ করে। এডিস গণের দু’টি প্রজাতি এডিস ইজিপ্টি ও এডিস এলবোপিকটাস এই ভাইরাসের বাহক হিসেবে পরিচিত। তারা মূলত দিনের আলোতে কাঁমড় দিয়ে থাকে।’
অপরদিকে ‘ডেঙ্গু জ্বর’ শিরোনামের পরিচিতিমূলক নিবন্ধে উইকিপিডিয়ায় (বাংলা) বলা হয়, ‘ডেঙ্গু জ্বর একটি এডিস মশা বাহিত ডেঙ্গু ভাইরাস জনিত গ্রীষ্মমন্ডলীয় রোগ। এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণের তিন থেকে পনেরো দিনের মধ্যে সচরাচর ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গগুলো দেখা দেয়।...কয়েক প্রজাতির এডিস মশকী (স্ত্রী মশা) ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রধান বাহক। যেগুলোর মধ্যে এডিস ইজিপ্টি মশকী প্রধানতম।’
আমরা জানি, বাংলাদেশে ডেঙ্গু শুরু হয়েছে ২০০০ সাল থেকে। ‘আর চাই না ডেঙ্গু’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় প্রথম আলোয় ৩১ জুলাই ২০১৯ তারিখে। সেখানে বলা হয়, ‘সে বছরই (২০০০ সালে) প্রথম এডিস এজিপ্টি নামের মশাটির নাম শুনেছিল ঢাকাবাসী। প্রথম বছর আনুমানিক ৫ হাজার রোগী আক্রান্ত হয়েছিল ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনা শহরে; মারা গিয়েছিল ৯৩ জন। এর দুই বছর পর ২০০২ সালে ৬ হাজার ২০০ জন আক্রান্ত হয় ডেঙ্গুতে। মারা যায় ৫৮ জন। তারপর প্রায় প্রতিবছরই বর্ষা মৌসুমে (এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর অক্টোবর) যেন নিয়ম করে ঢাকাবাসী নাকাল হচ্ছে এই এডিস মশার হাতে। গত বছর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা-এর মতো এসে হাজির হয়েছিল নতুন রোগ - চিকুনগুনিয়া।’ [https://www.prothomalo.com/lifestyle/%E0%A6%86%E0%A6%B0-%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%87-%E0%A6%A8%E0%A6%BE-%E0%A6%A1%E0%A7%87%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97%E0%A7%81]
আমার প্রশ্ন হলো, যে মশা (এডিস) ২০০০ সাল থেকে বহন করে আসছে ডেঙ্গু, সে মশাই ২০১৭ ও ২০১৮ সালে এসে ডেঙ্গুর পরিবর্তে বহন করতে শুরু করেছে চিকুনগুনিয়া, আবার ২ বছর চিকুনগুনিয়া বহনের পর এ বছর সেই একই মশা চিকুনগুনিয়া বাদ দিয়ে কেন ডেঙ্গু বহন করছে? এই প্রশ্নের জবাব কি কেউ দিতে পারবে? এ বছর (২০১৯ সালে) এডিস মশার কামড়ে কোনো মানুষ চিকুনগুনিয়ায় কেন আক্রান্ত হচ্ছে না? সামনের বছর বা তার পরের কোনো বছর কি আবার এডিস মশা ডেঙ্গুর পরিবর্তে চিকুনগুনিয়া বহন করতে শুরু করবে? একই মশা কিভাবে একেক বছর একেক রোগ ছড়ায়? তাছাড়া যদি মশাটি দু’টি রোগই ছড়ায়, তাহলে একই বছরে এক সাথে চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু - দু’টি রোগই ছড়ায় না কেন?
দৈনিক দেশ রূপান্তরে ১৫ জুলাই ২০২৩ তারিখে ‘‘১৫ বছর কোথায় ছিল ডেঙ্গু’’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, যা তৈরি করেছেন মতিন আব্দুল্লাহ। সেখানে বলা হয়, ‘‘২২ বছর আগে ঢাকায় প্রথম ডেঙ্গু ভাইরাসবাহী এডিস মশা শনাক্ত হয়। পর্যাপ্তসংখ্যক কীটতত্ত্ববিদের মাধ্যমে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম শুরু হলেও বছর না যেতেই তা বন্ধ হয়ে যায়। এখন গতানুগতিক পদ্ধতিতে মশা নিয়ন্ত্রণের কাজ হচ্ছে। ফেলে আসা সময়ের কোনো মৌসুমে ডেঙ্গুর বিস্তার বেশি ছিল, কোনো মৌসুমে ছিল কম। মাঝখানে ১৫ বছর এ রোগটি নিয়ে মানুষের দুর্ভাবনা ছিল না।
২০০০ সালে দেশে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। তখন থেকে তিন বছর রোগটি আতঙ্ক ছড়িয়ে মাঝখানে আক্রান্ত ও মৃত্যু এতটাই কম ছিল যে মানুষ রোগটির কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। ২০১৮ সালে আবার আশঙ্কাজনক হারে এর প্রকোপ শুরু হয়। পরের বছর ভয়াবহ আকার ধারণ করে। করোনা মহামারীর প্রথম বছর ২০২০ সালে কম ছিল। পরের বছর মৃত্যু ১০০ ছাড়িয়ে যায়। ২০২২ সালে এসে ডেঙ্গুতে মৃত্যু সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ৩০০-এর কাছাকাছি পৌঁছে যায়। চলতি বছর এর পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ।’’
আমারও প্রশ্ন ‘‘১৫ বছর কোথায় ছিল ডেঙ্গু? কোথায় ছিল এডিস মশা?’’
উপরের প্রতিবেদনে আরেকটি তথ্য আছে। সেটি হলো: ‘‘করোনা মহামারীর প্রথম বছর ২০২০ সালে কম ছিল।’’
২০১৯ সালে ডেঙ্গু-ভয়াবহতার পর ২০২০ সালে ডেঙ্গু কোথায় হারিয়ে গেল? সাথে চিকুনগুনিয়াও!
বিবিসি বাংলার ওয়েবসাইটে ৩০ জুলাই ২০২১ তারিখে ‘‘ডেঙ্গু জ্বর: করোনাভাইরাসের সাথে পাল্লা দিয়ে যে সংক্রমণ মারাত্মক রূপ নিচ্ছে’’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসেব অনুযায়ী, শুধু জুলাই মাসেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ১,৯২০জন, যা ২০২০ সালে সারা বছর জুড়ে আক্রান্ত সংখ্যার চেয়েও বেশি।’’
[https://www.bbc.com/bengali/news-58016608]
সচেতন মহলের নিকট প্রশ্ন, ‘‘২০২০ সালে ডেঙ্গুর সাথে সাথে চিকুনগুনিয়াও কোথায় গায়েব হয়ে গেল? নাকি এডিস মশা নিজেই ওই বছর দেশ ছেড়ে কোথাও পালিয়ে গেল?
নাকি জ্বরের সাথে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া এবং করোনার জগাখিচুড়ি হয়ে যাওয়ায় এই অবস্থা?
২. এডিস মশার কামড় কি সরাসরি জ্বর দু’টোর জন্য দায়ী?
‘শিশুর যখন ডেঙ্গু’ শিরোনামে প্রথম আলোয় একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় ৩১ জুলাই ২০১৯ তারিখে, যা লিখেছেন অধ্যাপক ডা. আবিদ হোসেন মোল্লা (শিশুবিশেষজ্ঞ, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল)। সেখানে তিনি লিখেন, ‘এখন এ দেশে সবচেয়ে আলোচিত আতঙ্কের নাম ডেঙ্গু। এটা ভাইরাসজনিত রোগ, যা এডিস মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু আক্রান্ত মানুষের শরীর থেকে অন্য মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। প্রবেশ করার ৪ থেকে ১০ দিন পর রোগের উপসর্গ দেখা যায়।’ [https://www.prothomalo.com/lifestyle/%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A7%81%E0%A6%B0-%E0%A6%AF%E0%A6%96%E0%A6%A8-%E0%A6%A1%E0%A7%87%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97%E0%A7%81]
‘ডেঙ্গু ঠেকাতে সচেতন হোন’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় প্রথম আলোয় ৩১ জুলাই ২০১৯ তারিখে, যা লিখেছেন রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. গুলজার হোসেন। তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গুর ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষের দেহে ছড়ায় মশার মাধ্যমে। মশাই এই রোগের একমাত্র বাহক। ডেঙ্গু ভাইরাস যে বিশেষ মশার মাধ্যমে ছড়ায়, তার নামও সবাই জানে- এডিস মশা।’ [https://www.prothomalo.com/feature/adhuna/%E0%A6%A1%E0%A7%87%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97%E0%A7%81-%E0%A6%A0%E0%A7%87%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%87-%E0%A6%B8%E0%A6%9A%E0%A7%87%E0%A6%A4%E0%A6%A8-%E0%A6%B9%E0%A7%8B%E0%A6%A8]
এই দু’জন চিকিৎসকের লেখা থেকে বুঝা যায়, সরাসরি এডিস মশার কামড়ে কারো ডেঙ্গু জ্বর হয় না। বরং এডিস মশা শুধু ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত একজনের শরীর থেকে আরেকজনের শরীরে জ¦রটির ভাইরাস বহন করে নিয়ে যায়।
কিন্তু নিচের দু’টি প্রতিবেদন দেখুন।
‘ডেঙ্গু নিয়ে উদ্বেগে মানুষ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় প্রথম আলোয় ৩১ জুলাই ২০১৯ তারিখে। সেখানে বলা হয়, ‘চার দিন আগে চমেক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন চন্দনাইশের জিয়া উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আমি ঢাকায় যাইনি। আমার কর্মস্থল বোয়ালখালী। চট্টগ্রাম শহরেও আসিনি। তবু আমি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলাম।’
তাঁর পাশের শয্যায় শুয়ে আছেন কলেজছাত্র আসাদুজ্জামান। তিনিও বোয়ালখালীর বাইরে কোথাও যাননি। তবু আক্রান্ত হয়েছেন ডেঙ্গুতে। সীতাকুন্ডের আবদুল্লাহ আল নোমান ভর্তি হয়েছেন পাঁচ দিন আগে। তিনিও ঢাকায় যাননি।’ [
আরো পড়ুন: চোখ ওঠা রোগ (কনজাংটিভাইটিস) কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়
‘চট্টগ্রামে ডেঙ্গু রোগী কমার লক্ষণ নেই’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় প্রথম আলোয় ১৬ আগস্ট ২০১৯ তারিখে। সেখানে উল্লেখ করা হয়, ‘চট্টগ্রামের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাধীন রোগীদের মধ্যে বেশিরভাগই চট্টগ্রামের আশপাশের জেলা ও উপজেলার। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের মধ্যে মাত্র ১১ জন ঢাকায় বাস করেন কিংবা সম্প্রতি ঢাকা সফর করেছেন। বাকি ১০০ জনই চট্টগ্রামের আশপাশের জেলা ও উপজেলার। এ ছাড়া অন্য হাসপাতালগুলোতে ভর্তি থাকা ৬৫ জনের প্রায় সবাই চট্টগ্রামের।’
এই দু’টি প্রতিবেদন থেকে বুঝা যায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত কেউ নেই, এমন এলাকায়ও মানুষ নতুন করে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়। এ বছর ঢাকা শহরের মানুষ প্রথম ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতে শুরু করেছে। কিন্তু যারা ঢাকায় বসবাস করে না বা সম্প্রতি ঢাকা সফর করেনি, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের এমন অসংখ্য মানুষও ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে।
‘হাসপাতালগুলো যেন মশার চারণভূমি’ শিরোনামে প্রথম আলোয় ১৭ আগস্ট ২০১৯ তারিখে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে উল্লেখ করা হয়, ‘কীটতত্ত্ববিদ মঞ্জুর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুগদার মতো হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গুর ভাইরাসবাহী এডিস মশা বেশি। এরা ডেঙ্গুর রোগীর রক্ত খাচ্ছে, আর অন্যদের শরীরে তা ছড়াচ্ছে। চিকিৎসক ও নার্সরা আক্রান্ত হওয়া তার জ্বলন্ত প্রমাণ।’ [
এই কীটতত্ত্ববিদের কথায় স্পষ্ট বুঝা যায়, যে কোনো এডিস মশা কামড় দিলেই মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয় না, বরং কারো কোনোভাবে ডেঙ্গু জ্বর হলে যদি তাকে এডিস মশা কামড় দেয়, তখন ওই এডিস মশা ডেঙ্গুর ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে এবং এরপর যদি ওই এডিস মশা কোনো সুস্থ মানুষকে কামড় দেয়, তখন ওই সুস্থ মানুষটিও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। তার মানে ডেঙ্গু জ্বরের জন্য মূলত এডিস মশা দায়ী নয়, বরং ডেঙ্গু জ্বর ছড়ানোর জন্যই শুধু এডিস মশা দায়ী।
বিবিসি বাংলার ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনেও এমন কথা বলা হয়।
‘‘ডেঙ্গু জ্বর: এডিস মশা সম্পর্কে যেসব তথ্য জেনে রাখা ভাল’’ শিরোনামে বিবিসি বাংলার ওয়েবসাইটে ৩০ জুলাই ২০১৯ তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়,
এডিস মশা একবার কামড়ালেই কী ডেঙ্গু হয়?
এডিস মশা কামড়ালে যে মানুষের ডেঙ্গুজ্বর হবেই, বিষয়টি এমন নয় বলে জানান ডা. আখতারুজ্জামান।
পরিবেশে উপস্থিত ভাইরাস এডিস মশার মধ্যে সংক্রমিত হলে সেই মশার কামড়ে ডেঙ্গু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
"এডিস মশা ভাইরাস সংক্রমিত থাকা অবস্থায় মানুষকে কামড়ালে সুস্থ মানুষের ডেঙ্গু হতে পারে।"
ভাইরাসের কারণে হওয়া জ্বরে আক্রান্ত থাকা ব্যক্তিকে এডিস মশা কামড়ালেও মশার মধ্যে ভাইরাস সংক্রমণ হওয়ার সুযোগ থাকে বলে জানান মি. আখতারুজ্জামান।
"এডিস মশার একটা বিষয় হলো, তারা সাধারণত একাধিক ব্যক্তিকে কামড়ায়। তাই ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির শরীর থেকে এডিস মশার মধ্যে ভাইরাস সংক্রমণ হওয়ার পর ঐ মশার কামড়ে ডেঙ্গু হয়।"
[https://www.bbc.com/bengali/news-49168236]
কিন্তু উইকিপিডিয়ায় (বাংলা) ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রেও বলা হয়, ‘ডেঙ্গু জ্বর একটি এডিস মশা বাহিত ডেঙ্গু ভাইরাস জনিত গ্রীষ্মমন্ডলীয় রোগ। এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণের তিন থেকে পনেরো দিনের মধ্যে সচরাচর ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গগুলো দেখা দেয়’, আবার চিকুনগুনিয়ার ক্ষেত্রেও বলা হয়, ‘চিকুনগুনিয়া ভাইরাসটি মশার কামড়ের মাধ্যমে মানব শরীরে প্রবেশ করে। এডিস গণের দু’টি প্রজাতি এডিস ইজিপ্টি ও এডিস এলবোপিকটাস এই ভাইরাসের বাহক হিসেবে পরিচিত।’
তাহলে কোনটা সত্য- যে কোনো এডিস মশার কামড়েই কি মানুষ জ্বর দু’টোতে আক্রান্ত হতে পারে, নাকি জ্বর দু’টোতে অন্য কোনো কারণে আক্রান্ত কাউকে এডিস মশা কামড়ানোর পর সুস্থ কাউকে ওই এডিস মশা কামড় দিলে সুস্থ ঐ লোক জ্বর দু’টিতে আক্রান্ত হতে পারে?
এডিস মশাকে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার জন্য এমনভাবে দায়ী করা হচ্ছে, মনে হচ্ছে, এডিস মশার কামড় ছাড়া কেউ ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে না। যদি তা-ই হয়, তাহলে যেসব মানুষ গত কয়েক মাসেও ঢাকা যায়নি, তারা কিভাবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলো?
যদি ‘ডেঙ্গু নিয়ে উদ্বেগে মানুষ’ শিরোনামে প্রথম আলোয় প্রকাশিত ডাক্তারের নিবন্ধে বর্ণিত কথা এবং ‘হাসপাতালগুলো যেন মশার চারণভূমি’ প্রতিবেদনে উল্লেখিত কীটতত্ত্ববিদ মঞ্জুর চৌধুরীর কথা সত্য হয়, তাহলে এডিস মশাকে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার জন্য সরাসরি দায়ী করার সুযোগ থাকে না।
জাল টাকার অস্তিত্ব সম্পর্কে সবাই জানি। জাল টাকা যারা তৈরি করে, তারা সেই টাকা বাজারে ছাড়ার পর কেউ যদি না জেনে কারো কাছ থেকে সেই টাকা পেয়ে আরেকজনকে সেই টাকা দিতে যায়, তার জন্য কি এই লোক দায়ী হবে? দায়ী তো হবে তারা, যারা জাল টাকা উৎপাদন করেছে। এভাবে এডিস মশা যেহেতু ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত এক শরীর থেকে অন্য শরীরে জ্বরটি বহন করে নিয়ে যায় শুধু, সেক্ষেত্রে জ্বর দু’টির জন্য এডিস মশাকে দায়ী করা ঠিক হবে না।
জ্বর দু’টির জন্য দায়ী করতে হবে তাকে, যা জ্বর দু’টি মানুষের শরীরে সৃষ্টি করে। কিন্তু জ্বর দু’টি কোত্থেকে, কিভাবে মানুষের শরীরে প্রথমে জন্ম নেয়, তা কি এখনো কেউ খুঁজে বের করতে পেরেছে?
অন্যদিকে যদি উইকিপিডিয়ার (বাংলা) তথ্য (চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু এডিস মশার কামড়েই মানুষের শরীরে জন্ম নেয়) সঠিক হয়, তাহলে বিশাল প্রশ্ন দাঁড়ায়, কিভাবে একই মশার কামড়ে এক বছর মানুষের চিকুনগুনিয়া হয়, আরেক বছর ডেঙ্গু হয়?
এই প্রশ্নটির উত্তরের জন্য আমরা জ্বর দু’টির লক্ষণের প্রতি একটু লক্ষ্য করতে পারি।
‘ডেঙ্গুর লক্ষণ ও প্রতিরোধ’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় বাংলাদেশের জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল এনটিভির ওয়েবসাইটে ২৭ জুলাই ২০১৯ তারিখে। সেখানে ডেঙ্গুর লক্ষণ সম্পর্কে বলা হয়, ‘এ জ্বর অনেক ক্ষেত্রে কম হতে পারে, আবার বেশিও হতে পারে। দেখা যায়, জ্বর তিন-চার দিন পর ভালো হয়ে যায়। তবে এরপর প্লাটিলেট কম হতে থাকে। এরপর মাঝখানে একটি বিরতি দিয়ে আবার জ্বর আসে। এই জ্বরের সঙ্গে প্রচন্ড মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা এবং চোখের পেছনে ব্যথা করবে। জ্বর সাধারণত দুই দিন থাকার পর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় র্যাশ দেখা যায়।
জ্বর যদি জটিল পর্যায় হয়, তাহলে মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়তে পারে, রক্তবমি হতে পারে। অনেকের ক্ষেত্রে পায়খানার সঙ্গে রক্ত যেতে পারে আবার শ্বাসকষ্টও হতে পারে। আপার অ্যাবডোমিনে বা ওপরের পেটে পানি চলে আসতে পারে।
এই জ্বরে যেহেতু পানিশূন্যতা বেশি হয়, তাই প্র¯্রাবের পরিমাণ কমে যেতে পারে। এতে কিডনি বিকল হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ঘাম হতে পারে। বমি বমি ভাব হতে পারে, খাবারে অরুচি হতে পারে। অন্যান্য ভাইরাস জ্বরের যে লক্ষণ, সেগুলো প্রায় সবই ডেঙ্গু জ্বরে থাকবে।’ [
বিবিসি বাংলায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ‘ডেঙ্গু জ্বর সম্পর্কে ১০টি তথ্য জেনে নিন’ শিরোনামে ২৬ জুলাই ২০১৯ তারিখে। সেখানে ডেঙ্গুর লক্ষণ সম্পর্কে বলা হয়, ‘সাধারণভাবে ডেঙ্গুর লক্ষণ হচ্ছে জ্বর। ১০১ ডিগ্রি থেকে ১০২ ডিগ্রি তাপমাত্রা থাকতে পারে। জ্বর একটানা থাকতে পারে, আবার ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে দেবার পর আবারো জ্বর আসতে পারে। এর সাথে শরীরে ব্যথা মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা এবং চামড়ায় লালচে দাগ (র্যাশ) হতে পারে। তবে এগুলো না থাকলেও ডেঙ্গু হতে পারে।’ [https://www.bbc.com/bengali/news-49124515]
উইকিপিডিয়ায় (বাংলা) বলা হয়, ‘সাধারণভাবে, ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্তরা হয় উপসর্গবিহীন (৮০%) অথবা সাধারণ জ্বরের মত সামান্য উপসর্গ। বাকিদের রোগ হয় আরো জটিল (৫%), এবং স্বল্প অনুপাতে এটি প্রাণঘাতী হয়।’
‘চিকুনগুনিয়া সংকট : বর্ষার আগে ভরসা কতটা?’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় বিবিসি বাংলায় ২১ মে ২০১৮ তারিখে। সেখানে বলা হয়, ‘বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, চিকুনগুনিয়া রোগের প্রথমদিন থেকেই রোগীর অনেক বেশি তাপমাত্রায় জ্বর ওঠে। একই সাথে প্রচন্ড মাথা ব্যথা, শরীর ব্যথা, বিশেষ করে হাড়ের জয়েন্টে ব্যথা হয়। কারো কারো শরীরে র্যাশ ওঠে।
জ্বর ভালো হলেও রোগটি অনেকদিন ধরে রোগীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়।’ [https://www.bbc.com/bengali/news-44165339]
জ্বর দু’টির লক্ষণ সম্পর্কে এই চারটি তথ্য ভালোভাবে লক্ষ্য করলে এটা সহজেই মনে হবে, জ্বর দু’টি একই। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে জ্বরটিকে একেক বছর একেক নামে প্রচার করা হয় শুধু।
জ্বর দু’টি নিয়ে আরো দু’টি প্রতিবেদন কী বলে দেখা যাক:
সময় নিউজের ওয়েবসাইটে ৯ জুলাই ২০২৩ তারিখে ‘‘ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার’’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় নিচের বিষয়গুলো:
* সাধারণভাবে ডেঙ্গুর লক্ষণ হচ্ছে জ্বর। ১০১ ডিগ্রি থেকে ১০৩ ডিগ্রি তাপমাত্রা থাকতে পারে। জ্বর একটানা থাকতে পারে, আবার ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে দেয়ার পর আবারও জ্বর আসতে পারে।
* ডেঙ্গুর অন্যতম লক্ষণ শরীরে ব্যথা। সঙ্গে মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা হতে পারে। সঙ্গে চামড়ায় লালচে দাগ বা র্যাশ থাকতে পারে।
* শরীর ঠান্ডা হচ্ছে মনে হতে পারে। ক্ষুধা কমে যাওয়া, শরীর ম্যাজম্যাজ করার লক্ষণও দেখা দিতে পারে।
* সিভিয়ার ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে তীব্র পেট ব্যথা, পেট ফুলে যাওয়া, রক্তবমি, মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণ, ত্বকের নিচে রক্তক্ষরণ, শ্বাসকার্য কঠিন বা দ্রুত হওয়া, শরীর ঠান্ডা অনুভব বা ঘাম হওয়া, দ্রুত নাড়ি স্পন্দন এবং ঘুম ঘুম ভাব, চেতনা হারানো।
* ডেঙ্গুর শক সিনড্রোম থেকে মানবদেহে পানিশূন্যতা তৈরি হয়। সঙ্গে সঙ্গে পাল্স রেট অনেকটা বেড়ে যায় এবং রক্তচাপ খুব কমে যায়। শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়। শ্বাসপ্রশ্বাস খুব দ্রুত চলে। রোগী অস্থির হয়ে ওঠেন। তখন সময় নষ্ট না করে হাসপাতালে ভর্তি করানো উচিত।
[https://www.somoynews.tv/news/2023-07-09/RWyxRwJY]
‘‘৫ লক্ষণে বুঝবেন চিকুনগুনিয়া’’ শিরোনামে দৈনিক যুগান্তরে ১০ জুলাই ২০১৯ তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়:
১. চিকুনগুনিয়ার লক্ষণ অনেকটা ডেঙ্গু জ্বরের মতোই। তবে দেহের তাপমাত্রা একটু বেশি (প্রায়ই ১০৪ ডিগ্রি পর্যন্ত) থাকে। সাধারণত দুই থেকে পাঁচ দিন পর্যন্ত চিকুনগুনিয়া থাকে এবং একসময় নিজে থেকেই ভালো হয়ে যায়।
২. হাত বা পায়ের আঙুল, গোড়ালি, কবজি, মেরুদণ্ড বা অস্থিসন্ধিতে তীব্র ব্যথার সঙ্গে তা ফুলেও যেতে পারে। জ্বর সেরে যাওয়ার পরও ব্যথা থাকতে পারে।
৩. তীব্র মাথাব্যথা, মাংসপেশির দুর্বলতা দেখা দেয়।
৪. জ্বর কমে যাওয়ার পর ৭০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে তিন সপ্তাহের মধ্যে ব্যথা চলে যায়। বাকি ৩০ শতাংশের ব্যথা বেশ কিছুদিন থাকে।
৫. ডেঙ্গুতে প্লাটিলেট কমে যায়, রক্ত ক্ষরণের ঝুঁকি, এমনকি মৃত্যুঝুঁকিও থাকে, চিকুনগুনিয়ায় এসব থাকে না।
[https://www.jugantor.com/lifestyle/197689]
যুগান্তরের প্রতিবেদনে স্পষ্ট করে বলা হয়, ‘‘চিকুনগুনিয়ার লক্ষণ অনেকটা ডেঙ্গু জ্বরের মতোই’’। আপনি কী বুঝলেন?
এবার এডিস মশা চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু রোগের জন্য সত্যিই দায়ী নয়, তা প্রমাণ করার একটি উপায় বলে দিচ্ছি। সুস্থ ১০০ মানুষকে মশারীর ভেতরে থাকতে দিয়ে তাদের মশারীর ভেতর একটি স্ত্রী এডিস মশা ঢুকিয়ে দিন। প্রত্যেককে মশা শুধু একটা কামড় দেয়ার পর মশারীর ভেতর থেকে বের করে ফেলুন। এরপর দেখুন, এই ১০০ লোকের কেউ চিকুনগুনিয়া বা ডেঙ্গু এরকম কোনো জ্বরে আক্রান্ত হয় কিনা। অথবা ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ১০০ লোকের প্রত্যেকের সাথে সুস্থ এক জন করে লোককে একই মশারীর ভেতর থাকতে দিয়ে প্রত্যেক মশারীর ভেতর একটি করে স্ত্রী এডিস মশা ঢুকিয়ে দিয়ে দেখুন, ডেঙ্গু রোগী থেকে এডিস মশা সুস্থ লোকের শরীরে জ্বরটি সংক্রমিত করতে পারে কিনা! আমার বিশ্বাস, এভাবে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বিষয়টা প্রমাণের চেষ্টা করা হেেল এটাই প্রমাণিত হবে, এডিস মশা কোনোভাবে চিকুনগুনিয়া বা ডেঙ্গু জ্বরের জন্য দায়ী নয়।
৩. চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু নামে কি আলাদা কোনো জ্বর আছে?
অনেকে অবাক হবেন আমার একটি বিশ্বাসের কথা জেনে, আমি মনে করি, চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু নামে আলাদা কোনো জ্বরই নেই, এ জ্বর দু’টি মূলতঃ সেই সাধারণ জ্বর, যেই জ্বরটিতে মানুষ ঋতু পরিবর্তনের সময় বা ঠান্ডা-গরম মিশ্রিত হবার কারণে সারা বছর জুড়েই আক্রান্ত হয়।
২০১৭ এবং ২০১৮ সালে এডিস মশার কামড়ে চিকুনগুনিয়ার ব্যাপক উপদ্রবের কথা শুনে যখন আমি দেখেছি, চিকুনগুনিয়ার লক্ষণগুলো সাধারণ জ্বরের লক্ষণের সাথে প্রায় মিলে যাচ্ছে, তখন থেকেই আমার মন বলছে, চিকুনগুনিয়া নামে আলাদা কোনো জ্বর নেই। সাধারণ জ্বরকেই ক্ষেত্র বিশেষে সামান্য ব্যতিক্রম বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হওয়ায় উদ্দেশ্যমূলকভাবে বা ভুলে চিকুনগুনিয়া নাম দেয়া হয়েছে। আমি আমার পরিচিত কয়েকজনকে তখন বলেছি, বাংলাদেশে যদি মাত্র একজন মানুষ এরকম থাকে, যে চিকুনগুনিয়া নামক কোনো জ্বর আছে বলে বিশ্বাস করে না, সেই লোক আমি। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রেও আমার ধারণা এরকমই।
আবার বলছি, আমার এই বিশ্বাসে প্রায় সবাই অবাক হতে পারেন। হয়তো লেখাটি সামনের দিকে আর পড়ার উৎসাহও হারিয়ে ফেলতে পারেন। তবে এটা মনে রাখবেন, আমি কোনো অহেতুক ধারণায় বিশ্বাস করি না। আমার এই বিশ্বাসের পক্ষে কিছু কথা বলছি।
১. দেখুন, ডেঙ্গুর লক্ষণ সম্পর্কে এনটিভির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত নিবন্ধটিতে বলা হয়েছে, ‘অন্যান্য ভাইরাস জ্বরের যে লক্ষণ, সেগুলো প্রায় সবই ডেঙ্গু জ্বরে থাকবে’। উইকিপিডিয়ায়ও (বাংলা) বলা হয়, ‘সাধারণভাবে, ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্তরা হয় উপসর্গবিহীন (৮০%) অথবা সাধারণ জ্বরের মত সামান্য উপসর্গ।’
অপরদিকে বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত ২১ মে ২০১৮ তারিখের প্রতিবেদনে চিকুনগুনিয়া সম্পর্কে বলা হয়, ‘বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, চিকুনগুনিয়া রোগের প্রথমদিন থেকেই রোগীর অনেক বেশি তাপমাত্রায় জ্বর ওঠে। একই সাথে প্রচন্ড মাথা ব্যথা, শরীর ব্যথা, বিশেষ করে হাড়ের জয়েন্টে ব্যথা হয়। কারো কারো শরীরে র্যাশ ওঠে।’
জীবনে যারা এক বা একাধিকবার ভাইরাস জ্বরে ভুগেছেন তারা বলুন, এখানে উল্লেখিত চিকুগুনিয়ার লক্ষণগুলো কি আপনি ভাইরাস জ্বরে ভোগার সময় আপনার মধ্যে দেখা যায়নি? প্রচন্ড মাথা ব্যথা, শরীর ব্যথা, হাড়ের জয়েন্টে ব্যথা, শরীরে র্যাশ - এই লক্ষণগুলো সাধারণ জ্বরে ভোগা প্রায় সব মানুষের মধ্যে প্রকাশ পায়, যদি জ্বরটি কিছুটা জঘণ্য হয়। তাই চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু নামে জ্বর দু’টিকে সাধারণ জ্বর বললে ভুল হবার সম্ভাবনা থাকে না।
‘ডেঙ্গু পরীক্ষার কিটের সংকট কাটছে’ শিরোনামে প্রথম আলোয় ৬ আগস্ট ২০১৯ তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরুর পর জ্বর হলেই মানুষ চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছে। চিকিৎসকেরাও ঝুঁকি না নিয়ে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে দিচ্ছেন। হাজারো মানুষ রক্ত পরীক্ষার জন্য হাসপাতালগুলোতে ভিড় করছে। এতে বাজারে টান পড়ে ডেঙ্গু শনাক্তকরণ কিটের। তবে গতকাল রাজধানীর দুটি সরকারি এবং সাতটি বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো ডেঙ্গু শনাক্তকরণ কিট রয়েছে।...
গত চার দিনে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষা করিয়েছেন ৩ হাজার ১০৩ জন। এর মধ্যে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ১৫৭ জনের।’ [
এই প্রতিবেদন থেকে কমপক্ষে দু’টি বিষয় বুঝার আছে: ১. বর্ষা মৌসুমে হাজার হাজার মানুষ জ্বরে আক্রান্ত হয়, ২. যেসব রোগী জ্বর নিয়ে হাসপাতালের আসেন, শুধু তাদের বাহ্যিক লক্ষণ দেখে জ্বরটি কি সাধারণ জ্বর, নাকি ডেঙ্গু জ্বর, ডাক্তাররা তা নিশ্চিত হতে পারেন না পরীক্ষা করা ছাড়া।
পরীক্ষা করা ছাড়া শুধু বাহ্যিক লক্ষণ দেখে যদি সাধারণ জ্বর আর ডেঙ্গু জ্বরে পার্থক্য করা না যায়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, সাধারণ জ্বর আর ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণে কোনো পার্থক্য নেই। তবু কেন সাধারণ জ্বর আর ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণে বিভিন্ন পার্থক্যের কথা বলা হয়?
প্রশ্ন থেকে যায়, লক্ষণ দেখে বুঝা না গেলেও পরীক্ষা করার পর তো সাধারণ জ্বর আর ডেঙ্গু জ্বরে পার্থক্য স্পষ্ট হয়। তাহলে ডেঙ্গু নামে আলাদা জ্বরকে অস্বীকার করার কি কোনো সুযোগ থাকে?
আমরা জানি, সাধারণ জ্বর মারাত্মক আকার ধারণের পর বিভিন্ন কারণে কখনো নিউমোনিয়া, কখনো টাইফয়েডে রূপ নেয়। এভাবে এখন পরীক্ষার পর যাদের জ্বরকে ডেঙ্গু বলে শনাক্ত করা হয়, তাদের জ্বরকেও সাধারণ জ্বরের একটি জঘণ্য রূপ বললে কেন ভুল হবে?
সাধারণ জ্বরটিকে চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু বলে আমরা বরং সমাজে, দেশে আতঙ্ক সৃষ্টি করছি আমাদের অজান্তে, এমনকি সাধারণ জ্বরে মানুষ মারার পথও সৃষ্টি করছি! সেটা কিভাবে, পরে বলছি। আগে বলছি মশা সত্যিই মানুষের শরীরে কোনো জ্বর সৃষ্টি করতে পারে কিনা, সে সম্পর্কে।
৪. মশা কি সত্যিই মানুষের শরীরে কোনো জ্বর সৃষ্টি করতে পারে?
এডিস মশাকে এখন যেভাবে ভয় করা হচ্ছে, মনে হচ্ছে, এটা কোনো ক্ষুদ্র পতঙ্গ নয়, এটা কুকুরের মতো কোনো বড় হিংস্র প্রাণি, যার কামড়ে মানুষের মৃত্যুও হতে পারে! আমার বিশ্বাস, যে কোনো প্রজাতির মাত্র ১টি মশার একটি মাত্র কামড়ে মানুষের শরীরে কোনো রোগ সৃষ্টি হতে পারে না। আমরা জানি, ভিমরুলের কামড়ে অসহনীয় ব্যথা হয়। কিন্তু মাত্র একটি ভিমরুলের একটি কামড়ে কোনো মানুষ মারা যায় না। তবে কোনো মানুষকে যদি অনেকগুলো ভিমরুল একসাথে কামড় দেয়, সে মারা যেতে পারে। আমার জানামতো দু’জন মানুষ এভাবে মারা গেছে শুধু ভীমরুলের কামড়ে। পাশাপাশি এমন অনেককে দেখেছি, যাদেরকে ২-১টি ভিমরুল কামড় দিয়েছে, কিন্তু তাদের বড় কোনো ক্ষতি হয়নি।
ভিমরুল এবং মশার মধ্যে অনেকগুলো পার্থক্য রয়েছে। যেমন: ১. ভিমরুলের চেয়ে মশা অনেক ছোট প্রাণী। ২. ভীমরুলের কামড়কে বলা হয় হুল ফোটানো আর মশার কামড়কে সাধারণতঃ কামড় বলা হলেও মশা মূলত মানুষকে কামড় দেয় না, বরং তার সরু লম্বা শুড়কে ইনজেকশনের সিরিঞ্জের মতো মানুষের শরীরে ঢুকিয়ে রক্ত চোষে। তাই মশার কামড়কে ‘শুড় ঢোকানো’ বলা যেতে পারে। ৩. সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য সম্ভবতঃ এটাই যে, ভিমরুলের কামড়ে মানুষ মারাত্মক বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়, কিন্তু মশার কামড়ে মানুষ কোনো বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয় না।
এই পার্থক্যগুলো, বিশেষ করে শেষ পার্থক্যটির কারণেই একজন মানুষকে অনেকগুলো ভিমরুল দংশন করলে অতিমাত্রায় বিষক্রিয়ার কারণে সে মারা যেতে পারে। কিন্তু অনেকগুলো মশা একজন মানুষকে একসাথে কামড় দিলেও কোনো বিষক্রিয়া না থাকার কারণে মানুষের তেমন কোনো ক্ষতি হয় না।
তবে বড় বড় অনেকগুলো মশা একসাথে কোনো নবজাতক বা শিশুকে কামড় দিলে সে জ্বরে আক্রান্ত হবার কিছুটা সম্ভাবনা থাকে।
এই সম্ভাবনা কেন? শিশুদেরকে টিকা দেয়ার জন্য ওদের শরীরে ইনজেকশন পুশ করলে অনেক শিশুই ইনজেকশনের সিরিঞ্জ ঢোকানোর ব্যথায় জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। একটি সিরিঞ্জের ব্যস যতটুকু, যদি কয়েকটি মশার শুড়ের ব্যসের যোগফলও ততটুকু হয়ে যায়, তাহলে ইনজেকশন পুশ করলে যেভাবে ব্যথায় জ্বর এসে যায়, ৪-৫টি মশার শুঁড় ঢোকানোর ব্যথায়ও জ্বর এসে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে মশার কামড়কে কি শিশুটির জ্বরে জন্য দায়ী করা ঠিক হবে?
বড়দের শারীরিক শক্তি ও সহনক্ষমতা বেশি হবার কারণে তাদেরকে ইনজেকশন দিলে যেভাবে তাদের জ্বর আসে না, ৪-৫টি মশা একসাথে তাদেরকে কামড়ালেও তাদের জ্বর আসে না। মশার কামড়ে যদি জ্বর আসা নিশ্চিত হতো, তাহলে বড়রাও ৪-৫টি মশার কামড়ে জ্বরে আক্রান্ত হতো।
ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে বর্তমানে আমাদের দেশে (অবশ্য ফিলিপাইনেও গত কয়েকদিন ধরে মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে এবং মারা যাচ্ছে) মানুষের মনে এখন এতো মারাত্মক ভীতি কাজ করছে, মানুষ ডেঙ্গু জ¦রের জন্য যে মশাকে দায়ী করা হয়, সেই এডিস মশাকে সাক্ষাৎ যমদূত মনে করছে! এ বছর ডেঙ্গুজ্বরের প্রাদুর্ভাবের পর থেকে আমি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত এ সংক্রান্ত সংবাদ, প্রতিবেদন ও নিবন্ধগুলো গুরুত্বসহ পড়ার চেষ্টা করছি। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত কোনো রোগীর মুখ থেকে এরকম কোনো কথা এখনও কোথাও দেখিনি, ‘আমাকে একটি বা দু’টি এডিস মশা কামড় দিয়েছে’। কেউ জ্বর নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবার পর তার ডেঙ্গু কিনা, তা পরীক্ষার আগে কোনো ডাক্তার কি তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনাকে কি কোনো এডিস মশা কামড় দিয়েছে বা আপনার শরীরের কোথায় এডিস মশা কামড় দিয়েছে?’
এডিস মশা কাউকে কামড় দিয়েছে কিনা, ডেঙ্গু শনাক্তের জন্য ডাক্তাররা এ বিষয়টা মোটেও যাচাই না করে শুধু ডাক্তারী পরীক্ষার মাধ্যমে ডেঙ্গু শনাক্ত করার প্রক্রিয়া কি পুরোপুরি সঠিক? এসব কোনো জায়গায় বিশাল কোনো ফাঁক থেকে যাচ্ছে বলেই আমার মনে হয় আমরা অযথা এডিস মশাকে এসব রোগের জন্য দায়ী করছি।
৫. এডিস মশা ব্যতীত অন্য কোনো মশা কেন ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার ভাইরাস বহন করে না?
এডিস মশা-ই শুধু ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া জ্বরের ভাইরাস বহন করে, বিষয়টি বুঝতে আমার বেশ কষ্ট হয়। এডিস মশা এবং বড় আকৃতির অন্য মশাগুলোর মধ্যে কি তিলে-তালে পার্থক্য? অন্য বড় মশাগুলো যদি তিল হয়, এডিস মশা কি সে তুলনায় তাল?
নাকি এডিস মশা কি বেছে বেছে এমন সব জায়গায় থাকে, ডিম পাড়ে, যেসব জায়গায় ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার মতো বিভিন্ন ভয়ঙ্কর রোগের জীবাণু থাকে আর অন্য সব মশার সাথে ঐসব জায়গার কোনো সম্পর্ক নেই, যেসব জায়গায় এসব জীবাণু থাকে? নাকি এডিস মশা এসব স্থানে (প্রাইভেট) অন্য কোনো মশাকে যেতে দেয় না?!
দেখা যায় এনোফিলিস, কিউলেক্স এসব মশার ক্ষেত্রে বলা হয় না, এসব মশা পরিষ্কার-স্বচ্ছ পানিতে ডিম পাড়ে বা বসবাস করে, কিন্তু এডিস মশার ক্ষেত্রে এ কথাটা মনে সবচেয়ে বেশি প্রচারিত হয়, এডিস মশা পরিষ্কার-স্বচ্ছ পানিতে ডিম পাড়ে, বসবাস করে! যে মশা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করে, সে মশার সাথে ভয়ঙ্কর সব রোগের সম্পর্ক, অথচ যেসব মশার সাথে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কোনো সম্পর্ক নেই, সসব মশার সাথে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া এসব মারাত্মক রোগের কোনো সম্পর্ক নেই! অবাক করা বিষয় নয় কি?
এডিস মশা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার সাথে ঢাকা শহরের সম্পর্ক বেশি। কিন্তু ‘বাংলাদেশে কোন্ শহরে ময়লা-আবর্জনা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়’ - এই প্রশ্নের উপর ভিত্তি করে কোনো জরিপ করলে ঢাকা নিঃসন্দেহে প্রথম হবে। ঢাকা শহরের এসব ময়লা-আবর্জনায় যেসব মশা জন্মে, বিচরণ করে, সেসব মশার সাথে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া বহনের কোনো সম্পর্ক থাকার পরিবর্তে যে মশা পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করে, ময়লা-আবর্জনা এড়িয়ে চলে, সে মশার সাথে এই জ্বর দু’টির ভাইরাস বহনের সম্পর্ক কেন?
এডিস মশাকেই শুধু যারা ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া জ্বরের ভাইরাস বহনের জন্য একতরফাভাবে দায়ী করছে, তাদের কথা শুনে মনে হয়, এডিস মশা ইচ্ছাকৃতভাবেই এই দু’টি জ¦রের ভাইরাস বহন করে। কিন্তু এটা কি সম্ভব? যদি সম্ভব না হয় এবং এটাই সত্য হয়, এডিস মশা জ¦র দু’টির ভাইরাস ইচ্ছাকৃতভাবে বহন করে না, তাহলে অন্য মশাও তো এভাবে অনিচ্ছাকৃতভাবে জ¦র দু’টির ভাইরাস বহন করতে পারে। কোনো বাধা আছে? কিন্তু কেন করে না, কেউ কি বলতে পারবে?
৬. এডিস মশা নামে কোনো মশা সত্যিই কি আছে?
আমার মনে হয়, এডিস মশা নামে আলাদা কোনো মশাই নেই। ‘এডিস মশা’ ‘এডিস মশা’ বলে চারদিকে শুধু আতঙ্কই ছড়ানো হচ্ছে। আমার মনে হয়, আমরা সচরাচর বড় বড় যে মশাগুলো দেখতে পাই, সেই মশাগুলোকেই এডিস মশা নাম দেয়া হয়েছে। আর যেহেতু এই নামটা আমাদেরই দেয়া, এডিশ মশার পিতামাতা যদি নামটা দিতো, তবু এই নামে কোনো মশার অস্তিত্ব অস্বীকার করার সুযোগ থাকতো না। যেসব মশাকে এখন এডিস মশা ভাবা হচ্ছে, সেসব মশা কি দেশের ঐসব অঞ্চলে মোটেও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেসব অঞ্চলে এখনো কেউ ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়নি?
আমাদের এলাকায় এ পর্যন্ত কোনো বছর কেউ চিকুনগুনিয়া বা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়নি। কিন্তু বড় বড় অনেক মশা আমাদের এলাকায় রয়েছে। বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময় আমাদেরকে প্রায়ই এসব মশার কামড় খেতে হয়। আমরা সেই ছোটকাল থেকে খেয়েও আসছি। অনেক সময় সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখা যায়, অনেকগুলো বড় বড় মশা রক্ত খেয়ে মশারীর ভেতর আটকে রয়েছে। হয়তো মশারীর কোনো ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করেছে। এসব মশার সাথে যদি কথিত এডিস মশাকে মেলানো হয়, আমার মনে হয় তেমন অমিল পাওয়া যাবে না। তবু কেন এডিস মশা বলে বলে এবং এডিস মশা ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া ভাইরাস ছড়ায় বলে বলে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে?
৭. চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু জ্বরে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োগ নিয়ে মতানৈক্য কেন?
চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু জ¦র যদি মশাবাহিত কোনো জ্বর না হয়ে সাধারণ জ¦রই হয়ে থাকে, তাহলে এই জ্বর দু’টিতে মানুষ মরছে কেন, এমন প্রশ্ন উঠতে পারে। আমার মনে হয়, সাধারণ জ্বরের বৈশিষ্ট্যে সামান্য ভিন্নতা পরিলক্ষিত হবার কারণে এরকম ভিন্ন নাম দেয়া হচ্ছে এবং সাধারণ জ্বরের চেয়ে ভিন্নভাবে চিকিৎসা করতে গিয়েই মানুষের মৃত্যুও হচ্ছে এই জ্বর দু’টিতে। ভিন্ন চিকিৎসা বলতে, সাধারণ জ্বরে যখন প্যারাসিটামলের সাথে সচরাচর অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হয়, তখন এ জ্বর দু’টির চিকিৎসার ক্ষেত্রে খুব বেশি প্রচার করা হয়, শুধু প্যারাসিটামলই দিতে হবে এ ধরনের রোগীকে, কোনোভাবেই অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া যাবে না।
‘চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু হলে ব্যথানাশক হিসেবে শুধু প্যারাসিটামল খাওয়ানো যাবে, অন্য কিছু নয়, অ্যান্টিবায়োটিক তো নয়ই’- এই কথাটি এতো বেশি প্রচার করা হয়, যা সাধারণ মানুষের মুখে মুখেও সচরাচর শোনা যায়। আমি নিজে এমন কথা পত্রপত্রিকায় তো পড়েছিই, অনেক মানুষের মুখেও শুনেছি।
‘চিকুনগুনিয়া হলে করণীয়’ শিরোনামে দৈনিক যুগান্তরে ১৮ জুলাই ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ঢাকা মেডিকেল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মো. শহিদুল বাশার বলেন, প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ ছাড়া অন্য কোনো ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়া যাবে না।’
৬ আগস্ট ২০১৯ তারিখে দৈনিক নয়াদিগন্তে প্রকাশিত ‘চিকুনগুনিয়া হলে অনেক পা ও হাতের জোড়ায় ব্যথা থাকে : ওষুধ হিসেবে শুধু প্যারাসিটামল’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘জ্বর হলে প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ যেমন অ্যান্টিবায়োটিক অথবা স্টেরওয়েড দেয়া যাবে না।’
‘ডেঙ্গু জ্বর সম্পর্কে ১০টি তথ্য জেনে নিন’ শিরোনামে বিবিসি বাংলায় ২৬ জুলাই ২০১৯ তারিখে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘সরকারের কমিউনিক্যাবল ডিজিজ কন্ট্রোল বা সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ বিভাগের অন্যতম পরিচালক ড. সানিয়া তাহমিনা বলেন, ‘ডেঙ্গু জ্বর হলে প্যারাসিটামল খাওয়া যাবে। স্বাভাবিক ওজনের একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তি প্রতিদিন সর্বোচ্চ চারটি প্যারাসিটামল খেতে পারবে।’
‘শিশুর যখন ডেঙ্গু’ শিরোনামে প্রথম আলোয় ৩১ জুলাই ২০১৯ তারিখে প্রকাশিত নিবন্ধে অধ্যাপক ডা. আবিদ হোসেন মোল্লা (শিশুবিশেষজ্ঞ, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল) বলেন, ‘অন্য আর পাঁচটা কারণে জ্বর হলে তার জন্য যা যা করা দরকার, ডেঙ্গু হলেও তা–ই করতে হবে। যেমন নির্দিষ্ট মাত্রায় প্যারাসিটামল দেওয়া, হালকা গরম পানিতে শরীর মুছে দেওয়া, বেশি বেশি তরল খাবার দেওয়া ইত্যাদি।’
‘ঢাকায় ডেঙ্গু, ডেডলাইন ২০১৯’ শিরোনামে প্রথম আলোয় ৩১ জুলাই ২০১৯ তারিখে প্রকাশিত নিবন্ধে অধ্যাপক ডা. খাজা নাজিমুদ্দিন (মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, ল্যাবএইড জেনারেল হাসপাতাল) বলেন, ‘তাপমাত্রা কমানোর জন্য প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ ব্যবহার করা যাবে না।’ [
বাংলাদেশের জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল ‘চ্যানেল আই’য়ের ওয়েবসাইটে ১৯ জুলাই ২০১৬ তারিখে প্রকাশিত ‘ডেঙ্গু ও ভাইরাল জ্বরে অ্যান্টিবায়োটিক দরকার নেই’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘শহীদ সোহওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া জানান, জ্বর বা ব্যথা হলেই রোগীরা ব্যথানাশক ওষুধ খায় কিন্তু ডেঙ্গু হলে ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়া যাবে না। আর ডেঙ্গু রোগীদের জন্য কোনো অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দরকার হয় না।’ [
আমার মনে হয়, এই অ্যান্টিবায়োটিক খেতে না দিয়ে শুধু প্যারাসিটামল খেতে দেয়ার কারণেই চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গুতে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হয়। সাধারণ জ্বরের ক্ষেত্রে জ্বর আসার সাথে সাথেই প্যারাসিটামল খেতে শুরু করলে অনেক সময় জ্বর ভালো হয়ে যায়। কিন্তু জ্বর যখন পুরোপুরি এসে যায়, তখন শুধু প্যারাসিটামল খেলে জ্বর ভালো হয় না, জ্বর ভালো হতে হলে অ্যান্টিবায়োটিক খেতেই হয়। জ্বর ভালোভাবে এসে যাবার পরও অ্যান্টিবায়োটিক খেতে যদি কেউ দেরি করে, জ্বর তখন মারাত্মক হয়ে কখনো নিউমোনিয়া, কখনো টাইপয়েডের দিকে চলে যায় এবং জ্বর দীর্ঘায়িত হয়, অনেক সময় মারাত্মক পরিণতির শিকারও হতে হয়।
অ্যান্টিবায়োটিক খেতে না দেয়ার কারণেই অনেক চিকুনগুনিয়া এবং ডেঙ্গু রোগী মৃত্যুবরণ করে- আমার এই দাবি প্রমাণ করার একটি উপায় হচ্ছে, এ বছর ডেঙ্গুতে মারা গেছেন, এমন ৫০ জন রোগীর সঠিকভাবে খোঁজ নেয়া হলে আমার বিশ্বাস, দেখা যাবে, তাদের কাউকেই অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হয়নি। আবার সহসা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৫০ জন লোককে অ্যান্টিবায়োটিক খেতে দেয়া হলে আমার বিশ্বাস, তারা দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবে, মারা যাওয়া দূরের কথা।
তবে ডেঙ্গু জ্বরে যে লোকগুলো এখন মারা যায়, তারা সবাই যে ডেঙ্গু জ্বরেই যে মারা যায়, তা নিশ্চিত নয়। ‘ঢামেকে ডেঙ্গু জ্বরে মৃতের সংখ্যা কত?’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকায় ৮ আগস্ট ২০১৯ তারিখে। সেখানে উল্লেখ তরা হয়, ‘ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে এখনো পর্যন্ত কতজন মারা গেছেন তা নিশ্চিত হতে ‘ডেথ রিভিউ’ কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল একেএম নাছির উদ্দীন। গতকাল বুধবার রাতে তিনি বিষয়টি গণমাধ্যমকে জানান।
বিগ্রেডিয়ার জেনারেল একেএম নাছির উদ্দীন বলেন, ‘জ্বরে আক্রান্ত হলেই এখন বলা হচ্ছে, ডেঙ্গুতে মারা গেছেন। আমরা দেখছি, জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হওয়ার কিছু সময় পরই মারা যায়। আসলে সে রোগীটি যে ডেঙ্গুতেই মারা গেছে, তা নিশ্চিত হওয়া যায় না। এ জন্য পরীক্ষা নিরীক্ষা প্রয়োজন।’
তিনি আরও বলেন, ‘একজন রোগী বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ছিল পরে তার সাথে জ্বরও হয়েছে, সেক্ষেত্রে রোগীটি মারা গেলে রোগীর স্বজনরা বলছেন, তিনি ডেঙ্গু জ্বরে মারা গেছেন। আসলে ওইসব রোগীর ক্ষেত্রে দেখা যায়, রোগীটি আগের থেকে খারাপ অবস্থায় ছিল। তাই হাসপাতালের পক্ষ থেকে ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া মৃতদের প্রকৃত কারণ নির্নয়ের জন্য “ডেথ রিভিউ” নামে একটি কমিটি করা হয়েছে।’ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া জ¦র দু’টি সম্পর্কে অনেক ডাক্তার পত্রিকায় লিখিত নিবন্ধে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানোর ব্যাপারে প্রায় নিষেধাজ্ঞাই আরোপ করেন। কিন্তু বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ময়মনসিংহ) মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আলিমুল ইসলাম ৭ আগস্ট ২০১৯ তারিখের দৈনিক মানবজমিনে প্রকাশিত তাঁর ‘ডেঙ্গু জ্বর : আতঙ্ক, রোগ নির্ণয় চিকিৎসা ও প্রতিরোধে করণীয়’ শিরোনামে নিবন্ধে বলেন, ‘জ্বর অবস্থায় প্যারাসিটামলের পাশাপাশি ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করতে হবে, পরিস্থিতি বিবেচনা করে।’ [https://www.dainikamadershomoy.com/post/211006]
একজন চিকিৎসক অধ্যাপক যখন ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করতে বলছেন, তখন অন্যরা কেন এ ব্যাপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছেন? আমার মনে হয়, এই জায়গাতে মারাত্মক বিভ্রান্তি ও মতানৈক্য থাকার কারণেই ডেঙ্গু একটা আতঙ্কে পরিণত হয়েছে এবং ডেঙ্গুতে মানুষ মারা যাচ্ছে।
গত ২৯ জুলাই ২০১৯, প্রথম আলোর আয়োজনে এবং ল্যাবএইড গ্রুপের সহযোগিতায় ‘ডেঙ্গু রোধে জরুরি করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে ৮ আগস্ট ২০১৯ তারিখে প্রথম আলোয় ক্রোড়পত্র আকারে প্রকাশিত হলো। অনুষ্ঠানের অন্যতম আলোচক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডীন এ বি এম আবদুল্লাহ তাঁর আলোচনায় বলেন, ‘ডেঙ্গু জ্বরে শরীরে প্রচন্ড ব্যথা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়া যাবে না। অনেকের ধারণা, অ্যান্টিবায়োটিক একেবারে দেওয়া যাবে না। এটা ঠিক নয়। ডেঙ্গুর সঙ্গে অন্য ব্যাকটেরিয়াজনিত কোনো রোগ হলে চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া যেতে পারে।’ [
অনুষ্ঠানে ডেঙ্গু আক্রান্ত রুজায়না নামক একটি শিশুর মা এবং শিশুটির চিকিৎসক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নবজাতক ও শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ মো. আবদুল মান্নানও উপস্থিত ছিলেন। মো. আবদুল মান্নান শিশুটির চিকিৎসা সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘আমি রুজায়নার চিকিৎসক ছিলাম। ওর জ্বর ছিল ১০৫ ডিগ্রি। সে প্রায় ১০ দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিল। তার প্লাটিলেট ছিল ৫০ হাজারের কম। তবু তাকে কোনো রক্ত দিতে হয়নি।
কিন্তু তাকে অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হয়েছিল। কেননা, তার ইনফেকশন হয়েছিল। অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া নিষেধ নয়। অ্যান্টিবায়োটিক দিলে ডেঙ্গুর কোনো ক্ষতি হয় না। তবে যেখানে প্রয়োজন নেই, সেখানে দেওয়া যাবে না।’
এই আলোচনা অনুষ্ঠানে একজন চিকিৎসক বললেন, ‘অ্যান্টিবায়োটিক একেবারে দেওয়া যাবে না। এটা ঠিক নয়। ডেঙ্গুর সঙ্গে অন্য ব্যাকটেরিয়াজনিত কোনো রোগ হলে চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া যেতে পারে।’ আরেকজন চিকিৎসক বললেন, ‘অ্যান্টিবায়োটিক দিলে ডেঙ্গুর কোনো ক্ষতি হয় না।’
আমি বুঝতে পারছি না, ডেঙ্গু রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিক দেয়ার ব্যাপারে ডাক্তারদের মধ্যে এই মারাত্মক মতানৈক্য কেন? ডেঙ্গু জ¦রে আক্রান্ত হয়ে যারা মারা যাচ্ছে, তাদের মৃত্যুর জন্য এই মতানৈক্য দায়ী কিনা, তা ভালোভাবে যাচাই করা জরুরী।
৮. এডিস মশা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া জ্বর নিয়ে এতো বিভ্রান্তি কেন?
এডিস মশা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া জ¦র সম্পর্কে এখনো অনেক বিভ্রান্তি রয়েছে আমার মনে হয়। হয়তো এইজন্যই এ দু’টি জ¦রে মানুষের মৃত্যুও হচ্ছে। যেমন, এডিস মশা সম্পর্কে যেসব তথ্য এখন গ্রহণযোগ্য সব মাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে, তন্মধ্যে একটি হচ্ছে, এডিস মশা পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়ে। ‘ডেঙ্গু জ্বর : প্রতিরোধে করণীয়’ শিরোনামে দৈনিক ইত্তেফাকে ০৬ জুলাই ২০১৯ তারিখে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাকা) মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন ও চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধের মূলমন্ত্রই হলো এডিস মশার বিস্তার রোধ এবং এই মশা যেন কামড়াতে না পারে, তার ব্যবস্থা করা। মনে রাখতে হবে এডিস একটি ভদ্র মশা, অভিজাত এলাকায় বড়ো বড়ো সুন্দর সুন্দর দালানকোঠায় এরা বসবাস করে থাকে। স্বচ্ছ পরিষ্কার পানিতে এই মশা ডিম পাড়ে। ময়লা দুর্গন্ধযুক্ত ড্রেনের পানি এদের পছন্দসই নয়।’ [https://www.ittefaq.com.bd/amp/68493]
কিন্তু দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকায় ৭ আগস্ট ২০১৯ তারিখে প্রকাশিত ‘এডিস মশা পানিতে ডিম পাড়ে না, জানালেন বিশেষজ্ঞ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের প্রধান কীটতত্ত্ববিদ ডা. ভুপেন্দর নাগপালের (যিনি গত ৪০ বছর ধরে মশাবাহী রোগ নিয়ে কাজ করছেন) একটি বক্তব্য উল্লেখ করা হয়, ‘এডিস মশা পানিতে ডিম পাড়ে বলে যে কথা প্রচলিত আছে তা ভিত্তিহীন।’ [https://www.amadershomoy.com/bn/2019/08/07/949373.htm]
এভাবে আমার মনে হয় এডিস মশা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া জ্বর সম্পর্কে যে ধারণাগুলো প্রচলিত হয়ে গেছে, সেগুলোর আরো বড় বড় ভুল বের হয়ে আসবে গভীরভাবে বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ ও সঠিক পন্থায় গবেষণা করলে। প্রমাণিত হতে পারে বর্ষাকালে মানুষ যেই বৈশিষ্ট্যের জ্বরে আক্রান্ত হয়, সেই জ্বরকেই আমরা অজ্ঞতাবশত কখনো ডেঙ্গু, কখনো চিকুনগুনিয়া বলে আখ্যায়িত করছি, যার সাথে সত্যিই এডিস বা কোনো মশার কোনো সম্পর্ক নেই।
কিন্তু সেই পর্যন্ত যেসব মানুষ এই জ্বর দু’টিতে মারা যাবে, সেসব মানুষকে তো আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। তাই দ্রুত এটা নিয়ে কাজ করা উচিত।
সবশেষে দু’টি চ্যালেঞ্জের কথা বলছি।
১. এডিস মশা, চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু জ্বর সম্পর্কে আমার এই সব কথাকে যদি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত বা বিভ্রান্তিকর মনে করে আমলে নেয়া না হয় এবং এডিস মশা, চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু জ্বর সম্পর্কে এখন যা প্রচলিত আছে, তাকেই সঠিক বলে মনে করা হয়, তাহলে বলে রাখছি, কামান দাগিয়ে এদেশ থেকে এডিস মশা সম্পূর্ণ নির্মূল করার পরও মানুষ চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়া থেকে বাঁচতে পারবে না। আমার এ ভবিষ্যদ্বানী অচিরেই সঠিক বলে প্রতীয়মান হবে, কারণ আমি জানি আমার মতো এক অজানা অচেনা অপদার্থের কথায় কেউ কর্ণপাত করবে না। ভারতের কলকাতার কথা হয়তো অনেকেই জানেন। সেখানে ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা থাকার পরও, এডিস মশার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ পদক্ষেপ নেয়ার পরও এখনও অনেক মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে শুধু আক্রান্তই হচ্ছে না, মারাও যাচ্ছে।
হ্যাঁ, মশা নিধন বা নির্মূলের দরকার আছে। কারণ মশা খুবই বিরক্তিকর একটি প্রাণী। মানুষের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়, মশার কামড়ে যন্ত্রণাও আছে। কিন্তু মশার সাথে গুরুতর সব রোগের সম্পর্ক করার আগে যথাযথভাবে যাচাই করে দেখেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, নয়তো মশার উৎপাত একটু বেশি দেখলে মানুষ আতঙ্কে হৃদরোগেও আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারে!
২. তবে আমদের দেশ থেকে মশার বংশ নির্বংশ করা কখনো সম্ভব হবে না। কারণ আমাদের দেশে বর্ষা আছে, আছে নদী-নালা, খাল-বিল পুকুর সহ নানারকম জলাশয়, আছে পঁচাগলা আবর্জনা, নর্দমা এবং ঝোঁপঝাড়। এবং এতে কোনো সন্দেহ নেই, মশা এসব জায়গাতেই ডিম পাড়ে, বংশবিস্তার করে এবং বসবাস করে। তাই সাময়িকভাবে মশা তাড়ানো বা মশার সংখ্যা হ্রাস করা সম্ভব হলেও মশার উপদ্রব থেকে দেশকে কখনো পুরোপুরি রক্ষা করা সম্ভব হবে না। মশার উপদ্রব থেকে নিরাপদ করা সম্ভব হতে পারে মরু অঞ্চল এবং শীতপ্রধান বা তুষারপাত হয় যেসব অঞ্চলে, সেসব অঞ্চলকে। কারণ এসমস্ত অঞ্চলে জলাশয়, পঁচাগলা, ডোবা-নর্দমা বা আবর্জনা নেই।
নূর আহমদ
শিক্ষক, কলামিস্ট ও ফিটনেস বিষয়ক গবেষক
0 Comments: