মানুষ কি সত্যিই বায়ু থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে?
প্রাণী এবং উদ্ভিদের জীবনে বায়ুর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কিছু প্রশ্ন
(১) আমরা নিঃশ্বাস গ্রহণের সময় বায়ু থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করি। আর নিঃশ্বাস ত্যাগের সময় বর্জন করি কার্বন—ডাই—অক্সাইড। মুহূর্তে মুহূর্তে আমরা নিঃশ্বাস গ্রহণ ও ত্যাগ করি। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত, বিরতিহীন। আমরা নিঃশ্বাস গ্রহণের পরপরই তা আবার ত্যাগ করি। আবার ত্যাগ করার পরপরই নতুন করে নিঃশ্বাস গ্রহণ করি। নিঃশ্বাস ত্যাগের পরপরই তা আবার গ্রহণ করতে গিয়ে আমরা, একটু আগে নাক দিয়ে যেই কার্বন—ডাই—অক্সাইড ত্যাগ করেছি, নাকের কাছেই তখনও বায়ুতে থাকা সেই কার্বন—ডাই—অক্সাইডকে পাশ কাটিয়ে কি শুধুই অক্সিজেন গ্রহণ করি? কোন পদ্ধতিতে আমরা বায়ু থেকে বায়ুর অন্য সব উপাদান বাদ দিয়ে শুধুই অক্সিজেন গ্রহণ করি? নিঃশ্বাস ফেলার পরপরই তা আবার গ্রহণ করতে গিয়ে আমরা কিভাবে শুধুই অক্সিজেন গ্রহণ করি? আমাদের নাকে কি কোনো ফিল্টার যুক্ত আছে, যেই ফিল্টার দিয়ে আমরা বায়ু থেকে শুধুই অক্সিজেন গ্রহণ করি?
(২) আমরা বায়ু থেকে অক্সিজেন গ্রহণের পর সেই অক্সিজেন আমাদের ফুসফুসে কতক্ষণ থাকে? আমরা মিনিটে প্রায় ১৮ বার, ঘণ্টায় ১ হাজার ৮০ বার এবং দিনে ২৫ হাজার ৯২০ বার শ্বাস নিই। প্রায় প্রতি তিন সেকেন্ডে আমরা একবার শ্বাস—প্রশ্বাসের কাজটা করি। এই ৩ সেকেন্ডেই কি আমাদের নাক দিয়ে গ্রহণকৃত অক্সিজেনগুলো কার্বন—ডাই—অক্সাইডে পরিণত হয়? কিভাবে? আমাদের ফুসফুস কি কার্বন—ডাই—অক্সাইড তৈরির মেশিন? নাকি ফুসফুসেও ফিল্টার আছে, যা অতি অল্প সময়ে অক্সিজেনকে কার্বন—ডাই—অক্সাইডে রূপান্তর করে? আমাদের পেটে যেভাবে খাবারগুলো প্রক্রিয়াজাত হয়, ফুসফুসেও কি অক্সিজেন প্রক্রিয়াজাত হয়? খাবারগুলো পেটে গিয়ে প্রক্রিয়াজাত হতে অনেক সময় লাগে, ফুসফুস এতো অল্প সময়ে কিভাবে অক্সিজেনকে প্রক্রিয়াজাত করে? মাত্র দুই—তিন সেকেন্ডের মধ্যে আমাদের গ্রহণকৃত অক্সিজেনগুলোকে কিভাবে কার্বন—ডাই—অক্সাইডে রূপান্তর করে?
(৩) বিশেষ করে শীতকালে, তীব্র শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচার জন্য আমরা অনেক সময় লেপ/কম্বল/কাঁথা মুড়ে ঘুমাই বা শুই। এমনভাবে ঘুমাই বা শুই, যাতে কম্বলের ভেতরে বাইরে থেকে কোনো হিমেল বাতাস ঢুকতে না পারে। অনেক সময় পুরো রাত বা রাতের একটা বড় অংশ আমরা কম্বলের নিচে থাকি। যদি কমপক্ষে আধা ঘন্টা একজন লোক কম্বলের নিচে থাকে, তাহলে সেই আধা ঘন্টায় তার গ্রহণকৃত অক্সিজেনগুলো কি কার্বন—ডাই—অক্সাইডে পরিণত হয় না? সব অক্সিজেন কার্বন—ডাই—অক্সাইডে পরিণত হবার পর ওই লোক অক্সিজেন ছাড়া কিভাবে নিঃশ্বাস গ্রহণ করে? সেই লোককে তো এক পর্যায়ে শুধুই কার্বন—ডাই—অক্সাইড—ই গ্রহণ করতে হয়, যদি সত্যিই মানুষ অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং কার্বন—ডাই অক্সাইড ত্যাগ করে! এটা কিভাবে সম্ভব?
(৪) একটি বিস্কুটে যদি ৮০ শতাংশ ময়দা থাকে, আর বাকি ২০ শতাংশ অন্যান্য উপাদান থাকে, সেই বিস্কুট খাওয়ার সময় মানুষ কোন উপাদান বেশি খায়? নিশ্চয়ই ময়দা। বায়ু থেকে প্রাণি নাক দিয়ে শুধু অক্সিজেন গ্রহণ করে বা বায়ুর অন্য কোনো উপাদান নয়, বরং শুধু অক্সিজেন—ই প্রাণির জীবনের জন্য প্রয়োজন, এই কথাটা শুনে একজন লোক, যেই লোক বায়ুতে কোন কোন উপাদান থাকে বা কোন উপাদান কত শতাংশ থাকে, তা না জানে, সে ধরে নেবে বায়ু অবশ্যই অক্সিজেনে ভরপুর বা বায়ুতে অক্সিজেনের পরিমাণই সবচেয়ে বেশি। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে?
পরিমাণের দিক থেকে শুষ্ক বাতাসে ৭৮.০৯% নাইট্রোজেন, ২০.৯৫% অক্সিজেন, ০.৯৩% আর্গন, ০.০৩% কার্বন ডাইঅক্সাইড এবং সামান্য পরিমাণে অন্যান্য গ্যাস থাকে। বাতাসে এছাড়াও পরিবর্তনশীল পরিমাণ জলীয় বাষ্প রয়েছে যার গড় প্রায় ১%।
যদি বায়ুতে বিদ্যমান উপাদানগুলোর আনুপাতিক হার এমন হয়, তাহলে প্রাণি নিঃশ্বাস গ্রহণের সময় ৮০ শতাংশের মতো নাইট্রোজেন বাদ দিয়ে কিভাবে শুধুই মাত্র ২০ শতাংশের মতো অক্সিজেন গ্রহণ করে? প্রাণি নাক দিয়ে নিঃশ্বাস গ্রহণের সময় বায়ুতে থাকা কোনো কিছু গ্রহণ করতে বাদ দেয় না। বায়ুর বিভিন্ন উপাদান ছাড়াও প্রাণি বায়ুতে থাকা ধোঁয়া, ধুলোবালি ইত্যাদিও অবাধে গ্রহণ করে। কোনো ফিল্টার নেই। তবু কেন বলা হয়, প্রাণি বায়ু থেকে শুধুই অক্সিজেন গ্রহণ করে বা বায়ুর অক্সিজেন—ই শুধু প্রাণির জীবনের জন্য প্রয়োজন? নিঃশ্বাস গ্রহণের সময় বায়ুর সাথে যেই ৮০ শতাংশ নাইট্রোজেন প্রাণির নাক দিয়ে সব সময় ফুসফুসে প্রবেশ করে, সেই নাইট্রোজেন কি প্রাণির জীবনের জন্য মোটেই প্রয়োজন নয়?
(৫) বায়ুতে কার্বন—ডাই—অক্সাইডের পরিমাণ ০.০৩% যদি হয়ে থাকে, মানে দশ হাজার ভাগের তিন ভাগ, তাহলে উদ্ভিদ এই সামান্য পরিমাণ কার্বন—ডাই—অক্সাইডের উপর নির্ভর করে কিভাবে বেঁচে থাকে? যদি সত্যিই উদ্ভিদের জন্য বায়ু বা বায়ুতে বিদ্যমান কার্বন—ডাই—অক্সাইড অপরিহার্য হয়, তাহলে বায়ুতে বিদ্যমান এই সামান্য পরিমাণ কার্বন—ডাই—অক্সাইড উদ্ভিদের জন্য কিভাবে যথেষ্ট?
(৬) বায়ু গ্রহণের জন্য প্রাণিদের ফুসফুস আছে, আছে নাক। প্রাণিদের বায়ু বা নিঃশ্বাস গ্রহণ করার প্রক্রিয়া একেবারে পরিষ্কার। কিন্তু উদ্ভিদের ফুসফুসও নেই, নাকও নেই। উদ্ভিদ কোন প্রক্রিয়ায় বায়ু থেকে কার্বন—ডাই—অক্সাইড গ্রহণ করে? কোন প্রক্রিয়ায় অক্সিজেন ত্যাগ করে?
(৭) শীত প্রধান দেশে গ্রীন হাউজে সবজি চাষ করা হয়। গ্রীন হাউজ বায়ু নিরোধ (এয়ার টাইট) কাঁচের ঘর। এই ঘরে সবজি চাষ করার পর ভেতরে চাষকৃত সবজিগুলো ভেতরে বিদ্যমান কার্বন—ডাই—অক্সাইড গ্রহণ করতে করতে যখন সব কার্বন—ডাই—অক্সাইড নিঃশেষ হয়ে যায় (যেহেতু উদ্ভিদের বর্জনকৃত অক্সিজেনগুলো গ্রীন হাইজের ভেতরে মানুষ না থাকায় পুণরায় কার্বন—ডাই—অক্সাইডে পরিণত হতে পারে না), তখন কিভাবে সেখানে উদ্ভিদ বেঁচে থাকে (যদি সত্যিই উদ্ভিদ বায়ু থেকে কার্বন—ডাই—অক্সাইড গ্রহণ করে থাকে বা উদ্ভিদের বেঁচে থাকার জন্য কার্বন—ডাই—অক্সাইড অপরিহার্য হয়)? উদ্ভিদের জন্য কার্বন—ডাই—অক্সাইড কি সত্যিই প্রয়োজন? উদ্ভিদ কি সত্যিই বায়ু থেকে খুঁজে খুঁজে কার্বন—ডাই—অক্সাইড গ্রহণ করে?
(৮) বলা হয়, প্রাণিরা কার্বন—ডাই—অক্সাইড ত্যাগ করে। বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের পাশাপাশি অন্যান্য প্রাণীগুলো যেই হারে কার্বন—ডাই—অক্সাইড ত্যাগ করে (যদি সত্যিই প্রাণী নিঃশ্বাস ত্যাগের সময় কার্বন—ডাই—অক্সাইড ত্যাগ করে), তাহলে বায়ুতে কার্বন—ডাই—অক্সাইডের মাত্রা এতো কম কেন? মানুষসহ কোটি কোটি প্রাণীর প্রক্রিয়াজাতকৃত কার্বন—ডাই—অক্সাইডগুলো কোথায় যায়? প্রাণীরা নিঃশ্বাস ত্যাগের পরপরই কি সেগুলো উদ্ভিদরা শুষে নেয়? উদ্ভিদরা যখন কার্বন—ডাই—অক্সাইড ছাড়ে, তখন তো মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণী সবাই মিলে এতো দ্রুততার সাথে সেগুলো শুষে নিতে পারে না। যাদের নাক, ফুসফুস কিছুই নেই, তাদের শুষে নেয়ার ক্ষমতা ফুসফুস এবং নাক বিশিষ্ট প্রাণীগুলোর শুষে নেয়ার ক্ষমতার চেয়ে কিভাবে এতো বেশি?!
(৯) বড় কোনো গাছের বীজ ২ ইঞ্চি মাটির নিচে রোপন করলেও তা থেকে চারা গজায়। মাটির ২ ইঞ্চি নিচে বায়ুর চলাচলও নেই, বায়ু প্রবেশও করতে পারে না। উদ্ভিদের জীবনের জন্য বা বেঁচে থাকার জন্য বায়ু যদি আবশ্যক হয়, তাহলে ভূপৃষ্ঠের দুই ইঞ্চি নিচে রোপনকৃত বীজ থেকে বায়ু বা কার্বন—ডাই—অক্সাইড ছাড়া কিভাবে উদ্ভিদের জন্ম হয়? কিভাবে সেখান থেকে উদ্ভিদ বেড়ে ওঠে?
(১০) ৬ নং প্রশ্নের উত্তরে আমরা যদি ধরে নিই, উদ্ভিদ তার পাতা বা কান্ড দিয়ে কার্বন—ডাই—অক্সাইড গ্রহণ করে। তাহলে কোনো গাছের একেবারে গোড়ায় কেটে দিলেও সেই গাছ আবার বেঁচে থাকে কিভাবে? সেই গাছ থেকে কিভাবে আবার শাখা বের হয়? কোন অংশটি দিয়ে উদ্ভিদ বায়ুকে নিজের কাজে লাগায়? কোন অংশ দিয়ে উদ্ভিদ বায়ু থেকে কার্বন—ডাই—অক্সাইড গ্রহণ করে এবং অক্সিজেন ত্যাগ করে?
প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলে উদ্ভিদ এবং প্রাণির জীবনে বায়ুর অপরিহার্যতা নিয়ে বর্তমান অনেক ধারণা পাল্টে যাবে, সন্দেহ নেই।
নূর আহমদ
শিক্ষক, রোকনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বশিকপুর, লক্ষ্মীপুর।
০১৭১১ ১২১ ৮৫৩।
0 Comments: