দীর্ঘজীবন লাভের উপায় (পর্ব-৫৮) : ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগ এগুলো বংশগত ভাবে হয় না
অধ্যায়-৩৮
ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগ এগুলো বংশগত ভাবে হয় না
বিশ্বের প্রায় সব গবেষণার ফলাফল এবং ডাক্তারের মতামত হলো ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগ এই রোগগুলোর একটা প্রধান কারণ বংশের কারো থাকা। বাবা-মা বা পূর্বপুরুষদের কারো থাকলে নাকি সন্তানের এই রোগগুলো হবার সম্ভাবনা খুব বেশি।‘উচ্চ রক্তচাপে করণীয়’ শিরোনামে দৈনিক যুগান্তরে ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত একটি লেখায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ উচ্চ রক্তচাপের কারণ সম্পর্কে প্রথমে বলেন, ‘৯০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের কোনো নির্দিষ্ট কারণ জানা যায় না, একে প্রাইমারি বা অ্যাসেন্সিয়াল রক্তচাপ বলে।’ পরে উচ্চ রক্তচাপের আশংকা বাড়ায়, এমন কিছু বিষয়ের উল্লেখ করতে গিয়ে প্রথমেই বলেন, ‘উচ্চ রক্তচাপের বংশগত ধারাবাহিকতা আছে, যদি বাবা-মায়ের উচ্চ রক্তচাপ থাকে, তবে সন্তানেরও উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার আশংকা থাকে।’
বাংলাদেশ প্রতিদিনে ২১ জুলাই ২০১৭ তারিখে ‘বংশগত কারণে কি হৃদরোগ হয়?’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি লেখায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট (কার্ডিওলজি) ডা. এম শমশের আলী বলেন, ‘বাবা অথবা মা যে কোনো একজনের কার্ডিওমাইওপ্যাথি রোগ থাকলে ৫০ ভাগ ছেলেমেয়ে এ রোগে আক্রান্ত হবে এটা স্বতঃসিদ্ধ।
কিছুদিন আগে এক রোগী দেখলাম। বয়স ৪০ থেকে ৪২ বছরের মতো হবে। পুরুষ মানুষ, স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। ভদ্রলোক বিগত চার-পাঁচ দিন যাবৎ বুকে ও পিঠে চাপের মতো অনুভব করছেন এবং স্বামী-স্ত্রী দুজনেই এতে বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।
সামান্য বুক-পিঠ ব্যথায় এত বেশি উদ্বিগ্নতা দেখে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম ২-৩ মাস আগে তার বড় ভাই হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেছেন এবং দুই বছর আগে তার জন্মদাতা পিতাও হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। এখন নিশ্চয়ই আর বুঝতে বাকি থাকল না যে, তাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ বিদ্যমান। বেশকিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এটা স্পষ্ট হলো যে, রোগীর হার্টের দেয়াল পুরু হয়ে গেছে, তাও আবার সাধারণ মানুষের হার্টের দেয়ালের তুলনায় প্রায় দেড়গুণ। এ ধরনের সমস্যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় কার্ডিওমাইওপ্যাথি বলা হয়। সচরাচর এসব রোগী সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে থাকেন বা তারা নিজেরাও কখনো হার্টের অসুস্থতার কোনোরূপ লক্ষণ তার শরীরে বিদ্যমান আছে, তা অনুভব করেন না। তবে এসব রোগী যদি কখনো অতিমাত্রায় পরিশ্রম করতে যান, তখন কারও কারও বুকে চাপ বা ব্যথা অনুভূত হতে পারে বা অত্যধিক ক্লান্ত হয়ে যেতে পারে, আবার এ সময় অনেকের বুক ধড়ফড় বা মাথা ঘোরাতে পারে। এ ধরনের লক্ষণকে সব সময় মারাত্মক হিসেবে গণ্য করতে হবে এবং দ্রুততার সঙ্গে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। কার্ডিওমাইওপ্যাথি এমন এক ধরনের হৃদরোগ যাকে পুরোপুরি বংশগত হৃদরোগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে এবং বংশগত অনেক হৃদরোগের মধ্যে কার্ডিওমাইওপ্যাথিতে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হয়ে থাকে। বাবা অথবা মা যে কোনো একজনের কার্ডিওমাইওপ্যাথি রোগ থাকলে ৫০ ভাগ ছেলেমেয়ে এ রোগে আক্রান্ত হবে এটা স্বতঃসিদ্ধ।’
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখে দৈনিক যুগান্তরে ‘ডায়াবেটিস সচেতনতা দিবস’ (বাংলাদেশ) উপলক্ষ্যে ‘প্রতিরোধই বাঁচার উপায়’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়, যা লিখেছেন বাংলাদেশের সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান; বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির চিফ কো-অর্ডিনেটর ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ। তিনি সেখানে লিখেন, ‘রক্তে শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হলে ডায়াবেটিস রোগ দেখা দেয়। সাধারণত ডায়াবেটিস বংশগত কারণে এবং পরিবেশের প্রভাবে হয়।...যাদের বংশে রক্ত-সম্পর্কযুক্ত আত্মীয়স্বজনের ডায়াবেটিস আছে, যাদের ওজন খুব বেশি, যাদের বয়স ৪০-এর ওপর এবং যারা শরীরচর্চা করেন না- গাড়ি চড়েন এবং বসে থেকে অফিসের কাজকর্মে ব্যস্ত থাকেন, তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।’
তাছাড়া বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে কোনো ডায়াবেটিস রোগী গেলে প্রায় সব ডাক্তার খুব কমন একটি প্রশ্ন করেন রোগীকে, ‘আপনার বাবা-মা কারো কি ডায়াবেটিস ছিল?’ রোগী ‘হ্যাঁ’ বললেই হলো। ডাক্তার নিশ্চিন্তে এরকম কথা বলে ফেলেন, ‘আপনার রোগটি তাহলে বংশগত।’ ডাক্তারদের এই মন্তব্যগুলো সমাজে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন অসংখ্য মানুষ ডায়াবেটিস রোগটিকে বংশগতই মনে করছে।
রোগ তিনটি যে বংশগত নয়, তা নিয়ে এ লেখায় বেশ কয়েকবার আলোচনা করা হয়েছে। বিশেষ করে ৫ এবং ৬ নং অধ্যায়ে। তবু বিষয়টা সম্পর্কে আমাদের ধারণা আরো পরিষ্কার করার জন্য ভিন্ন অধ্যায়ে আলোচনা করা প্রয়োজন মনে হয়েছে।
এক. যারা বলে থাকেন রোগ তিনটি বংশগত কারণে অনেকের হয়ে থাকে, তাদের কেউ কি এটা অস্বীকার করেন, এই তিনটি রোগের জন্য শরীরে কোলেস্টেরলের আধিক্য প্রধান দায়ী?
যদি অস্বীকার না করেন, তাহলে বলতে হবে, যেসব মানুষের বাবা-মা বা বংশের পূর্ব-পুরুষের কেউ রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়েছে, যদি সেসব মানুষ শৈশব থেকেই বা রোগগুলোতে আক্রান্ত হবার আগেই যে কোনো উপায়ে শরীরে কোলেস্টেরল বাড়তে না দেয় (যেমন: নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণ ব্যায়াম করার ফলে বা কায়িক শ্রমের পেশায় জড়িত থাকার কারণে এমনিতেই দৈনিক পাঁচ-ছয় ঘন্টা কায়িক শ্রম হয়ে যায়, যার ফলে ওদের শরীরে কোলেস্টেরল বাড়তে পারে না), তবুও কি তাদের শরীরে তাদের পূর্বপুরুষের কারো রোগগুলো থাকার কারণে রোগগুলো জন্ম নেবেই?
দুই. ৫০ বছরের কম বয়সী যেসব লোক এখন এসব রোগে আক্রান্ত, দেখা যাবে তাদের কারো কারো বাবা-মায়েরও হয়তো এসব রোগ ছিল/আছে। কিন্তু ৭০ বছরের বেশি বয়সী যারা এখন এসব রোগে আক্রান্ত, তাদের মধ্যে এমন লোক খুব কম পাওয়া যাবে, যাদের বাবা-মা কেউ হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়েছেন বা ডায়াবেটিস/উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মারা গেছেন। দেখা যাবে, এ বয়সী লোকদের প্রায় সবার বাবা-মা অন্য কোনো রোগে মারা গেছেন। তাই ৫০ বছরের কম বয়সী রোগীদের ক্ষেত্রে তাদের রোগটিকে অনেক ডাক্তার বংশগত বলার সুযোগ থাকলেও ৭০ বছরের বেশি বয়সী রোগীদের ক্ষেত্রে রোগটিকে বংশগত বলবেন কিভাবে!
তিন. আমার যে ভগ্নিপতির কথা দিয়ে এ লেখা শুরু করা হয়েছে, তিনি উচ্চ রক্তচাপের পাশাপাশি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বেশ কষ্টকর জীবন যাপন করছেন। তাঁর দু’জন বোনের একজন হার্ট অ্যাটাকেই মারা গেছেন, আরেকজন হার্ট অ্যাটাক এবং সমজাতীয় রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়ে কষ্টকর জীবন কাটাচ্ছেন। তাঁর আরও দু’ভাই হার্ট অ্যাটাক এবং সমজাতীয় রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়ে শেষে হার্ট অ্যাটাকেই মারা যান। তাঁর বাবা বা মা যদি হার্ট অ্যাটাকে মারা যেতেন, ডাক্তাররা অবশ্যই তাঁর বা তাঁর ভাই-বোনদের হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হওয়াকে বংশগত রোগ বলে দিতেন নির্দ্বিধায়। কিন্তু তাঁর বাবা-মা কেউই হার্ট অ্যাটাকে মারা যাননি, তাঁকে জিজ্ঞেস করে বিষয়টা জানতে পেরেছি।
আমাদের বিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের নাম মরিয়ম বেগম। তাঁর একটা ছেলে ২০১৬ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠার কিছুদিনের মধ্যেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে বসে। ছেলেটি তখন স্থূল ছিল। ডাক্তারের কাছে নেয়ার পর ডাক্তার অবশ্য তার ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়াকে বংশগত বলেননি। হয়তো বলতেন যদি তার বাবা-মা কারো রোগটি থাকতো। তার বাব-মা অবশ্য পরে কখনো রোগটিকে যে আক্রান্ত হবে না, তা বলা যায় না। জানি না, তখন আবার ডাক্তার বলে বসেন কিনা, ওর ডায়াবেটিস হওয়ার কারণেই ওর বাবা-মা ডায়াবেটিস হয়েছে?!
আমার মেঝো ভাইয়ের উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হবার কথাও এ লেখায় বলা হয়েছে। তিনি উচ্চ রক্তচাপে যখন আক্রান্ত হন, তখন আমার বাবা-মা কারো উচ্চ রক্তচাপ ছিল না। পরে একসময় আমার বাবা-মা সাংসারিক কাজকর্ম অনেকটা ছেড়ে দেয়ার পর উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হন। এখন কি বলা যাবে, সন্তানের উচ্চ রক্তচাপ তার বাবা-মায়ের শরীরেও সংক্রমিত হয়?!
আমার ছোট বোনের একমাত্র ননদের স্বামী ৩৫ বছরের মতো বয়সে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে কর্মরত অবস্থায় হার্ট অ্যাটাকে মারা যান বছর তিনেক আগে, যখন তাঁর বাবা-মা কেউ হার্ট অ্যাটাক বা সমজাতীয় বাকি রোগ দু’টিতে আক্রান্ত হয়নি। বাংলাদেশে এমন অসংখ্য মানুষ এখন খুঁজে পাওয়া যাবে, যারা চল্লিশ বছর বয়সের আগেই হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন, অথচ তাদের বাবা-মা কেউ তখনো হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্তও হননি, মারা যাওয়া দূরের কথা। শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী এরকম লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজেদের বাবা-মা কেউ হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হতে না হতে নিজেরা হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে যায় কি ভুলবশত? অর্থাৎ তাদের বাবা-মা আগে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হবার কথা, তারা আক্রান্ত হলে তাদের সন্তানরা উত্তরাধিকার সূত্রে পরে আক্রান্ত হবে। কিন্তু হার্ট অ্যাটাক ভুল করে আগে সন্তানকে আক্রমণ করে বসেছে! এমন হওয়া কি সম্ভব? সম্ভব না হলে রোগগুলোকে বংশগত বলা যাবে কিভাবে?
চার. যেসব লোকের ক্ষেত্রে বলা হয়, তারা তাদের বাবা-মায়ের কেউ এসব রোগে আক্রান্ত হবার কারণেই রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়েছে, সেসব লোকের বাবা-মায়ের পূর্বপুরুষেরও এসব রোগ ছিল কিনা, তা কি কোনো ডাক্তার যাচাই করে দেখেন? যদি তৃতীয় পক্ষ (শেষ প্রজন্ম) বাবা-মায়ের পক্ষ থেকে এসব রোগের উত্তরাধিকারী হয়, তাহলে দ্বিতীয় পক্ষও নিশ্চয় তাদের বাবা-মা থেকে এসব রোগের উত্তরাধিকারী হবার কথা। কিন্তু খোঁজ নিলে দেখা যায়, এখন যারা এসব রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, তাদের তেমন কারোই দাদা-দাদী বা নানা-নানী এসব রোগে আক্রান্ত হয়নি। তাহলে তাদের রোগগুলো বংশগত বা জিনগত হলো কিভাবে?! ‘জিনগতভাবেও রোগগুলো বংশপরম্পরায় সংক্রমিত হয়’, কথাটি তখনই সত্য হবে, যখন কারো রোগগুলো হবার পর দেখা যায়, তার পূর্বপুরুষদের যত সিঁড়ির খবর নেয়া যায়, সবাই রোগগুলোতে আক্রান্ত ছিল। যদি শুধু বাবা-মা কারো থাকে, কিন্তু দাদা-দাদী কারো না থাকে, তাহলে রোগগুলোকে বংশগত বলা হবে চরম ভুল।
পাঁচ. ২০ বছরের কম বয়সী যেসব শিশু-কিশোর এখন ডায়াবেটিস বা সমগোত্রীয় কোনো রোগে আক্রান্ত, যদি ওরা ওদের বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাবে এদের বাবা-মা কেউই এখনো রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়নি। তবে প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রে দেখা যাবে, এরা স্থূল (বেশি বেশি খাওয়ার কারণে বা শারীরিক পরিশ্রমের সাথে খুব কম জড়িত থাকার কারণে)। এসব শিশু-কিশোরের অধিকাংশের পিতামাতা-ই যদি এখনো ডায়াবেটিসসহ সমগোত্রীয় রোগগুলোতে আক্রান্ত না হয়ে থাকে, তাহলে অল্প অংশের উপর ভিত্তি করে এদের এসব রোগে আক্রান্ত হওয়াকে বংশগত বলা কিভাবে ঠিক হবে? আর যেহেতু এদের প্রায় সবাই স্থূল, আর স্থূলতা থেকেই অনেকে এসব রোগে আক্রান্ত হয়, তাই স্থূলতাকে এদের এসব রোগে আক্রান্ত হবার জন্য দায়ী করতে অসুবিধা কোথায়?
আর ২০ বছরের কম বয়সী যেসব শিশু-কিশোর এসব রোগে আক্রান্ত, সে প্রথম সন্তান হোক বা শেষ সন্তান হোক, যদি দেখা যায় ওর বাবা-মাও এসব রোগে আক্রান্ত, দেখা যাবে ওর বাবা-মা শারীরিকভাবে স্থূল, না হয় শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে বা খাওয়া-দাওয়ায় রসিক। ওর বাবা-মা যে কারণে রোগগুলোতে আক্রান্ত, সে-ও একই কারণে রোগগুলোতে আক্রান্ত হতে পারে। ওর রোগটাকে তখন বংশগত বলার কোনো মানে নেই।
ছয়. বিষয়টা নিয়ে আগের আলোচনায় একটা যুক্তি দেয়া হয়েছে এভাবে, ডাক্তাররা এমন অসংখ্য মানুষের এই রোগগুলোতে আক্রান্ত হওয়াকে বংশগত বলে থাকেন, যারা জন্মের সময় তাদের বাবা-মা কারো রোগগুলো ছিল না, তাদের থাকা তো দূরের কথা। পরে তাদের বাবা মা হয়তো ৬০-৭০ বছর বয়সে রোগগুলোতে আক্রান্ত হলো এবং তারা রোগগুলোতে আক্রান্ত হলো তাদের বয়স যখন ৩০-৪০ বছর। তাদের জন্মের সময় তাদের বাবা-মায়ের যে রোগগুলো ছিল না, তাদের জন্মের ৩০-৪০ বছর পর তাদের বাবা-মাকে যে রোগগুলো আক্রমণ করলো, সে রোগগুলো তাদের জন্মের ৩০-৪০ বছর পর তাদের বাবা-মায়ের শরীর থেকে তাদের শরীরে আসে কিভাবে?! বায়ুবাহিত না হলে এমন হওয়া সম্ভব নয়।
এই লেখায় এ কথাটা পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে বলা হয়েছে, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগ এই তিনটি রোগের মূল কারণ শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা। যদি শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরের থাকার পাশাপাশি কেউ বেশি বেশি খায় বা মুটিয়ে যায়, তার এ রোগগুলোতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি প্রায় শতভাগ।
যদি কারো বাবা-মা বা পূর্বপুরুষ কেউ রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়, আর সে এখনো রোগগুলোতে আক্রান্ত না হয়, তাহলে নিয়মিত অন্তত এক ঘন্টা যে কোনো উপায়ে শারীরিক পরিশ্রম করলে সে এই রোগগুলো থেকে নিরাপদ থাকার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ। কোনো কারণে যদি কেউ কখনো শারীরিক পরিশ্রম করতে অক্ষম হয়ে পড়ে, তখনই শুধু সে রোগগুলোতে আক্রান্ত হবার ঝুঁকিতে পড়ে যাবে।
রোগগুলোকে বংশগত রোগ বলার কারণে কমপক্ষে দুই শ্রেণির মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়- (১) যাদের এখনো রোগগুলো হয়নি, তারা যখন জানে রোগগুলো বংশগত, তখন দেখে নিজের বাবা-মা কারো রোগগুলো হয়েছে কিনা। যদি দেখে হয়নি, তখন সে রোগগুলোতে আক্রান্ত হওয়া থেকে নিশ্চিন্ত থাকে, রোগগুলো প্রতিরোধের কোনো চেষ্টা করে না। এভাবে একসময় সে রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে, সত্যিকারার্থে যে কারণে রোগগুলো হয় সে কারণে। (২) যেসব লোকের বাবা-মা কেউ রোগগুলোতে ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়ে গেছে, তারা যখন জানে, রোগগুলো বংশগত, তখন তাদের মনে একটা আতঙ্ক সৃষ্টি হয়, কখন তারা আবার রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়ে বসে! এই আতঙ্ক তাদের মন থেকে কোনোভাবে দূর করা যায় না এবং রোগগুলো প্রতিরোধের কোনো চেষ্টাই তারা করে না। কারণ রোগগুলো যে বংশগত! এভাবে একসময় এরাও রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে।
এই দু’রকম ঘটনা এখন সমাজে ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে শুধুই রোগগুলোকে বংশগত বলে অপপ্রচারের কারণে। আশা করি এই অপপ্রচার বন্ধ হবে।
হ্যাঁ, রোগগুলোকে তখনই বংশগত বলার সুযোগ থাকবে, যখন দেখা যাবে কোনো শিশু মাতৃগর্ভে আসার পর থেকে মায়ের দুধ খাওয়া পর্যন্ত সময়ে ওর বাবা-মা কারো রোগগুলো থাকে এবং শিশুটি ভুমিষ্ট হবার পর পরই বা মায়ের দুধ পান করা শেষ হতে না হতেই রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। শিশুটি মাতৃগর্ভে আসার পর থেকে মায়ের দুধ খাওয়া পর্যন্ত সময়ে যদি ওর বাবা-মা কারো রোগগুলো না থাকে এবং ভুমিষ্ট হবার কয়েক বছর পর বা মায়ের দুধ পান শেষ হবার কয়েক বছর পর যদি ওর বাবা-মা কারো শরীরে রোগগুলো দেখা দেয়ার পর পরে কখনো শিশুটিও রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়, তখন শিশুটির রোগগুলোতে আক্রান্ত হওয়াকে বংশগত বলার কোনো সুযোগই থাকবে না। কারণ বাবা-মায়ের ঐসব রোগই কেবল সন্তানের মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে, যেসব রোগ সন্তান মাতৃগর্ভে আসার পর থেকে মায়ের দুধ খাওয়া পর্যন্ত সময়ে বাবা/মা কারো থাকে এবং ঐ সময়েই সন্তানের দেহে সংক্রমিত হয়। এসময় যদি বাবা-মা কারো শরীরে রোগগুলো না থাকে বা থাকলেও সন্তানের শরীরে সংক্রমিত না হয়, তাহলে পরে আর সংক্রমিত হবার কোনো সুযোগ থাকে না। বায়ুবাহিত রোগ হলে ভিন্ন কথা। কিন্তু ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগ এগুলো বায়ুবাহিত রোগ নয়।
শিশু মাতৃগর্ভে আসার পর থেকে মায়ের দুধ খাওয়া পর্যন্ত সময়ে যদি বাবা/মা কারো রোগগুলো থাকে এবং তাদের শরীর থেকে তার শরীরে এরকম কোনো রোগ সংক্রমিত না হয়, তাহলে পরে যতদিন সে বেঁচে থাকে, যদি সে নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম (খেলাধুলা, হাঁটা, সাঁতার, শারীরিক শ্রমের যে কোনো কাজ ইত্যাদি) করার পাশাপাশি স্থূলতা, বেশি খাওয়া থেকে দূরে থাকতে পারে, তার শরীরে রোগগুলো জন্ম নিতে পারবে না। আর যদি কোনো সন্তান জন্মের অনেক বছর পর ওর বাবা-মা কেউ রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়, তাহলে তো কোনোভাবেই রোগগুলো সন্তানের শরীরে সংক্রমিত হতে পারবে না।
ডাক্তারদের মধ্যে একটা সাধারণ প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে, যা মানুষকে মারাত্মকভাবে বিভ্রান্ত করছে। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা হৃদরোগে আক্রান্ত কোনো রোগী ডাক্তারের কাছে গেলে অনেক সময় ডাক্তার প্রথমে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনার বাবা/মা কারো কি রোগটি ছিল?’ রোগী ‘হ্যাঁ’ বললে ডাক্তার সাথে সাথে মন্তব্য করে, ‘তাহলে আপনার রোগটি বংশগত’। কিন্তু রোগী যদি ‘না’ বলেন, তখন ডাক্তার অন্য কোনো কারণে রোগটি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, যেসব রোগীর বাবা/মা কারো রোগটি ছিল না, সেসব রোগী যে কারণে রোগটিতে আক্রান্ত হয়েছে, ঐ একই কারণেই ঐসব রোগীও কি রোগটিতে আক্রান্ত হতে পারে না, যাদের বাবা/মা কারো রোগটি ছিল?
কোনো রোগের সঠিক কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা না করে রোগটি রোগীর বাবা/মা কারো থাকার কথা জেনেই রোগটিকে বংশগত বলে ফেলা যে ক্ষতিকর, ডাক্তাররা তা বুঝতে পারলে কখনোই এভাবে মন্তব্য করতেন না।
৫৯তম পর্ব:
https://waytogainlonglife.blogspot.com/2022/09/blog-post_99.html
0 Comments: