উচ্চ রক্তচাপ ডায়াবেটিস এবং হার্ট অ্যাটাকে কারা বেশি আক্রান্ত হয়?
চার শ্রেণির মানুষের দিকে লক্ষ্য করলেই পরিষ্কার হবে, উচ্চ রক্তচাপ ডায়াবেটিস এবং হার্ট অ্যাটাকে কারা বেশি আক্রান্ত হয়?
নূর আহমদ
শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা মানুষরগুলোই উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগে আক্রান্ত হয়, অন্য কোনো কারণে নয়, এই কথা বুঝতে অনেকের কষ্ট হতে পারে। কারণ এই রোগগুলোর আরো অনেক কারণ নিয়ে বিশ^ব্যাপী বিভিন্ন কথা প্রচলিত আছে। প্রতিনিয়ত সেসব কথা শুনতে শুনতে সেগুলোই আমাদের বিশ^াস হয়ে গেছে।
যেমন: ডায়াবেটিসকে মনে করা হয় একটি বংশগত রোগ, মিষ্টি বেশি খেলে নাকি ডায়াবেটিস হয়; হার্ট অ্যাটাককে মনে করা হয় টেনশনের সাথে সম্পর্কিত রোগ; মনে করা হয় লবণ বেশি খেলে বা টেনশন করলে মানুষ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয় ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু আমরা যদি ভালো করে লক্ষ্য করি, দেখতে পাবো, লবণ বেশি খাওয়া, টেনশন করা, চিনি বা মিষ্টি বেশি খাওয়া, বংশের কারো থাকা এসব কারণে নয়, বরং আরামে আরামে থাকা বা শারীরিক পরিশ্রম না করা, মনের চাহিদামতো খাওয়া বা বেশি বেশি খাওয়া এবং মুটিয়ে যাওয়াতেই মানুষ এই তিনটি রোগে আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত হবার পর টেনশন করলে বা চিনি/মিষ্টান্ন খেলে হয়তো রোগগুলো মারাত্মক আকার ধারণ করে। তবে টেনশন করা এবং চিনি/মিষ্টান্ন বেশি খাওয়া এই দুইটি বিষয় কারো শরীরে রোগগুলো জন্ম নেয়ার জন্য দায়ী নয়, বরং যাদের শরীরে ইতোমধ্যে রোগগুলো জন্ম নিয়েছে, এই দুইটি বিষয় তাদের রোগগুলো বৃদ্ধি পাবার জন্যই শুধু দায়ী।
মূলত তিনটি কারণেই মানুষ রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়। যথা: এক. আরামে আরামে থাকা বা শারীরিক পরিশ্রম না করা, দুই. বেশি বেশি খাওয়া এবং তিন. মুটিয়ে যাওয়া। তবে একটি কারণ সবচেয়ে বেশি দায়ী। সেটি হলো শারীরিক পরিশ্রম না করা। শারীরিক পরিশ্রম বেশি বেশি করলে মানুষের আরামে থাকা যেমন হয় না, মানুষ মুটিয়েও যেতে পারে না। বেশি বেশি খেলেও মুটিয়ে যেতে পারে না।
রোগগুলোর প্রকৃত কারণ নিয়ে এই বক্তব্য বিশ^াস করা আরো সহজ হবে সমাজের বিশেষ চার শ্রেণির লোকের দিকে লক্ষ্য করলে। যথা:
এক. ঐসব ‘পায়েচালিত’ রিকশাচালক, যারা ১০ বছরের বেশি সময় ধরে (অনেকে ৩০-৪০ বছর বা তার চেয়েও বেশি সময় ধরে চালায়) রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। বিগত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে একনাগাড়ে রিকশা চালায়, এমন এক হাজার বা দশ হাজার রিকশাচালকের খোঁজ নিয়ে দেখুন, দেখবেন তারা কেউই ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগ কোনোটিতেই আক্রান্ত নন। এমনও দেখা যেতে পারে, তাদের অনেকের পিতামাতা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন বা কোনো সন্তানও ইতোমধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। এমনও দেখা যেতে পারে, তাদের অধিকাংশই ধূমপান করছেন, নয়তো ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার জন্য ‘প্রচারিত’ অন্য কোনো কারণ অনেকের মধ্যে বিরাজমান, তবু তারা কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে না; উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগেও নয়।
দুই. বিশ্বের সব দেশেই শ্রমজীবি মানুষ আছে। যারা মাটি কাটার কাজ করে বা ফসলের জমি কিংবা কারখানায় হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের কাজ করে, এককথায় সেসব শ্রমজীবি মানুষ, যারা শারীরিক শ্রমনির্ভর কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে, এমন শ্রম, যা এদেরকে মোটা হতে দেয় না। পনেরো-বিশ বছরের বেশি সময় ধরে যেসব শ্রমজীবি মানুষ এভাবে পরিশ্রম করছেন দিনের একটা বড় অংশ, তারা কেউ দেখবেন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগে আক্রান্ত নন। শ্রমজীবি অনেক মানুষ বেশি বেশি খেয়েও থাকেন, তবু এসব রোগ তাদেরকে আক্রমণ করতে পারে না। কারণ শরীরে এনার্জি একদিকে যেমন সঞ্চয় করেন, অন্যদিকে তা আবার খরচ করে ফেলেন। চর্বি-কোলেস্টেরল এদের শরীরে হতেই পারে না বলে রোগগুলো এদেরকে আক্রমণ করার সুযোগই পায় না।
আমার পরিচিত অনেক মানুষ যারা নিজের জমিতে বা অন্যের জমিতে কৃষিকাজ করে থাকেন। এদের সবার বয়স ৪০ বছর থেকে ৭০ বছর। এই বয়সে এসেও এরা এই তিনটি রোগের কোনোটিতেই আক্রান্ত নয়। অথচ বলা হয়, বয়স বেশি হওয়াও এই রোগগুলোতে আক্রান্ত হবার জন্য দায়ী। কিন্তু এদের দিকে লক্ষ্য করলে এই কথাটা মিথ্যা প্রমাণিত হয়। বলা হয়, ধূমপান করলেও মানুষ এই রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়। এই লোকগুলোর অধিকাংশই ধূমপানও করছেন কয়েক যুগ ধরে, তবু রোগগুলোতে আক্রান্ত না হওয়া প্রমাণ করে রোগগুলোতে আক্রান্ত হবার সাথে ধূমপানের কোনো সম্পর্ক নেই। এদের অনেকের জীবনে প্রচুর টেনশনও আছে। তবু এরা রোগগুলোতে আক্রান্ত না হওয়া প্রমাণ করে, টেনশন করলে মানুষ এই রোগগুলোতে আক্রান্ত হয় না।
তিন. যেসব অ্যাথলেট বা ক্রীড়াবিদ পেশাগতভাবে শারীরিক শ্রমনির্ভর বিভিন্ন খেলা (যেমন: ফুটবল, ক্রিকেট, টেনিস, সাঁতার, ভলিবল, ব্যাডমিন্টন ইত্যাদি) খেলে যাচ্ছেন ১০ বছরের বেশি সময় ধরে, তাদের খোঁজ নিয়ে দেখুন, দেখবেন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগে তারা কেউই আক্রান্ত নন। এরা অনেকে হয়তো ধূমপানও করেন, অনেকে হয়তো ফাস্টফুডেও আসক্ত, অনেকের বাবা-মা কারো হয়তো এসব কোনো রোগ ছিল, তবু এরা এসব রোগের ছোবল থেকে মুক্ত।
খেলা ছেড়ে দেয়ার পর যারা ব্যায়াম বা কোনো শারীরিক পরিশ্রম করেন না, তারা আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারেন এসব রোগে।
বলা হয়, শর্করা বেশি খেলে মানুষ ডায়াবেটিস সহ এই তিনটি রোগে আক্রান্ত হয়। কিন্তু এই লোকগুলো বেশি বেশি শর্করাজাতীয় খাবার খাওয়ার পরও রোগগুলোতে আক্রান্ত না হওয়া প্রমাণ করে রোগগুলোতে আক্রান্ত হবার সাথে শর্করাজাতীয় খাবার খাওয়া বা না খাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। এই শ্রেণির লোকগুলো ফাস্টফুড খেতেও অভ্যস্থ। কিন্তু এরা ফাস্টফুড খাওয়ার পরও এই রোগগুলোতে আক্রান্ত না হওয়া প্রমাণ করে, রোগগুলোতে আক্রান্ত হওয়ার সাথে ফাস্টফুড খাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই।
চার. বিভিন্ন দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীতে যারা চাকরি করেন এবং বাধ্যগতভাবে রুটিনমাফিক নিয়মিত পর্যাপ্ত ব্যায়াম করেন, অতিরিক্ত ব্যায়ামের কারণে মোটা হতেও পারছেন না, তাদের কাউকেও দেখবেন না ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগে আক্রান্ত হতে। তবে কেউ যদি চাকরিরত অবস্থায় নিয়মিত ব্যায়াম না করেন, তারা আক্রান্ত হতে পারেন।
আমার দেখা বেশ কিছু লোক, যারা একসময় প্রতিরক্ষা বাহিনীতে চাকরি করতেন, চাকরিরত অবস্থায় তারা কেউ এসব কোনো রোগে আক্রান্ত ছিলেন না, কিন্তু অবসরের পর তারা এসব রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। কারণ অবসরের পর রুটিনমাফিক ব্যায়াম থেকে তারা দূরে চলে গেছেন এবং অন্য কোনোভাবে তাদের কোনো শারীরিক পরিশ্রম হচ্ছে না।
এই চার শ্রেণির মানুষের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগ না হওয়াটা প্রমাণ করে, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগের মূল কারণ শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা, অন্য কিছু নয়।
শুধুই শারীরিক পরিশ্রম করে গেলেই, দৈনিক অন্তত ৪০ মিনিট, মানুষ এই তিনটি রোগ থেকে রক্ষা পাবে, কোনো সন্দেহ নেই।
0 Comments: