আমাদের বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের স্বামী সৌদি আরবে চাকরি করছেন অনেক বছর ধরে। বেতন ভালো। ব্যক্তিগত জীবনে তেমন কোনো টানাপোড়েন বা টেনশন নেই। বছর দুয়েক আগে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। এখন নিয়মিত ঔষধ খেয়ে যেতে হচ্ছে। বিশেষ করে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণের ঔষধ। ব্যায়ামও করছেন নিয়মিত। বয়স হবে পঞ্চাশের মতো।

ঝুনু রানী পাল নামক আরেক সহকর্মীর স্বামী কয়েক বছর আগে উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা থেকে অবসরে গেছেন। বয়স এখন সত্তরের বেশি। কিন্তু এখনো হৃদরোগে আক্রান্ত হননি। তিনি চাকরিজীবনেও নিজের কৃষিক্ষেতে কাজ করতেন সকাল-বিকাল। এখনো তিনি কৃষিক্ষেতে কাজ করেন। একেবারে চিকন। শরীরে চর্বি-কোলেস্টেরল বলতে কিছুই নেই। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে তিনি প্রথমোক্ত জনের চেয়ে সুখী নন, টেনশন আছে অনেক।

আমাদের এলাকায় কিছু লোক আছেন, যারা মানুষের কায়িক শ্রমের কাজগুলো করে দেন দিনমজুর হিসেবে। কৃষিক্ষেতের কাজ, গাছ কাটার কাজ, মাটিকাটার কাজ, বিল্ডিংয়ের কাজ, রংয়ের কাজ ইত্যাদি। এরকম কয়েক জনের নাম উল্লেখ করছি। স্বপন, সিদ্দিক, সেলিম, সুমন, খোকা, লোকমান। আরো কয়েকজন আছে। এই লোকগুলো অনেক বছর ধরে মানুষের কাজ করে যাচ্ছেন। আমার জানামতে এই লোকগুলোর প্রায় সবাই টেনশনে টেনশনে জীবন কাটায়। এদের অনেকেই ঋণ নিয়ে শোধ করতে পারছেন না, কেউ কেউ মাঝে মাঝে কয়েকদিন ধরে কোনো কাজ না পেয়ে বাজার করতেও হিমশিম খাচ্ছে। এরা সবাই অন্য কোনো টেনশনে না থাকলেও অর্থকষ্টে দিন কাটানোর ফলে সারাক্ষণ টেনশনে থাকে। কিন্তু এই টেনশন এদেরকে কোনো রোগে আক্রান্ত করতে পারছে না। হার্ট অ্যাটাক এদের ধারেকাছেও আসছে না। যে রোগটির জন্য টেনশনকেই বেশি দায়ী করা হয়, এই লোকগুলো শুধু নয়, এরকম বিভিন্ন শারীরিক পরিশ্রমনির্ভর কাজে নিয়োজিত কোনো লোকই হার্ট অ্যাটাকে অঅক্রান্ত হয় না, এদের জীবনে যতো টেনশনই থাকুক। আমার পরিচিতদের মধ্যে আরো কিছু লোক আছে, যারা অন্যের জমিতে নয়, বরং নিজের কৃষিজমিতে কাজ করেন বয়স ৬০-৭০ হয়ে যাবার পরও। যেমন: আবু, মোতালেব (মোতা), আবু পাটোয়ারি। এরাও অনেক বয়স হয়ে যাবার পরও এই রোগগুলো থেকে নিরাপদ।

যে লোকগুলোর কথা আমি এখানে উল্লেখ করেছি, তাদেরকে শুধু আমাদের এলাকার লোকেরাই চিনবে। অন্যরা না-ও চিনতে পারেন। আপনি এই উদাহরণগুলোর উপর নির্ভর না করে আপনার পরিচিত পেশাদারভাবে শারীরিক পরিশ্রমের কাজে নিয়োজিত লোকগুলোকে চিহ্নিত করুন। এরকম ৫ থেকে ১০ জন লোক চিহ্নিত করুন, যারা ১০ বছরের বেশি সময় ধরে শারীরিক শ্রমনির্ভর কাজে নিয়োজিত। ওদের সাথে যোগাযোগ করলে দুইটি বিষয় নিশ্চিত হবেন। এক. তাদের প্রায় সবাই অর্থকষ্টে দিন কাটাচ্ছে। এটা অবশ্যই টেনশনের বিষয়। দুই. তাদের কেউই হার্ট অ্যাটাক বা হৃদরোগে আক্রান্ত নয়। উচ্চ রক্তচাপেও নয়, ডায়াবেটিসেও নয়।

অথবা এখনো পায়েচালিত রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন, যদি এরকম রিকশাঅলা খুঁজে পান, জিজ্ঞেস করলে দেখবেন, তাদের মধ্যে উপরের এই দুইটি বৈশিষ্ট্য পাওয়া যাবে।

অন্যদিকে দেখুন যারা আরামের পেশায় কর্মরত আছেন ২০ বছরের বেশি সময় ধরে, দেখবেন তাদের মধ্যেও দুইটি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। এক. তাদের অধিকাংশের ব্যক্তিগত জীবনে তেমন কোনো টানাপোড়েন বা টেনশন নেই। দুই. তাদের অনেকেই হৃদরোগে আক্রান্ত। উচ্চ রক্তচাপে তো বটেই। কারণ হৃদরোগে আক্রান্ত হবার আগে মানুষ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়।

আরামের পেশায় নিয়োজিত আমার পরিচিত (১) অনেকেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আকস্মিক মৃত্যুবরণ করেছেন, (২) অনেকে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বাইপাস সার্জারী করে, রিং পরিয়ে বা ঔষধ খেয়ে এখন মোটামুটি সুস্থ আছেন। এদের নাম ও ঠিকানা উল্লেখ করার দরকার নেই। এতে লেখাটিই শুধু বড় হবে। তাছাড়া বিশ^াস-অবিশ^াসেরও প্রশ্ন আছে। আমাদের প্রায় সবার পরিচিতজনদের মধ্যে এই দুই প্রকারের লোক আছে। আপনি খোঁজ নিয়ে দেখুন, এরা কেউই কঠোর শারীরিক পরিশ্রমের সাথে সম্পর্কিত ছিল না এবং এদের অনেকের জীবনে তেমন কোনো টেনশনও ছিল না।

পৃথিবীর যেসব দেশের মানুষ তুলনামূলক বেশি সুখী, যেমন ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, আইসল্যান্ড, ফিজি ইত্যাদি দেশের মানুষের হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হবার হার আর যেসব দেশের মানুষ তুলনামূলক বেশি অসুখী, যেমন আফগানিস্তান, ইরাক, দক্ষিণ সুদান, জিম্বাবুয়ে, রুয়ান্ডা, তানজানিয়া ইত্যাদি দেশের মানুষের হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হবার হার সামনে আনা হলে সম্ভাবনা এটাই বেশি যে, যেসব দেশের মানুষ তুলনামূলক বেশি সুখী, সেসব দেশে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হবার হার বেশি। কারণ সুখী মানুষরা আরামে আরামে থাকার ফলে তাদের শরীরে চর্বি-কোলেস্টেরল বেড়ে গিয়ে তারা হার্ট অ্যাটাক বা হার্ট ব্লকে আক্রান্ত হয়। আর অসুখী মানুষরা অভাবের কারণে ছোটখাটো বা শারীরিক পরিশ্রমের কাজে নিয়োজিত হবার ফলে তাদের শরীরে চর্বি-কোলেস্টেরল বাড়তে পারে না বলে তাদের হার্ট সবল থাকে। তারা হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হতে পারে না। যাদের শরীরে বাড়তি চর্বি নেই, তাদের হার্ট কী দিয়ে ব্লক্ড হবে?

তবে সুখী মানুষের দেশেও যারা শারীরিক পরিশ্রমের কোনো পেশায় নিয়োজিত, তারা হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয় না আবার অসুখী মানুষের দেশে যারা আরামের পেশায় নিয়োজিত, তারা হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়।

এই নিবন্ধের শুরুতে যে দুজন লোকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের সূত্র ধরে, ৫৫ বছর বয়সী হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত নয়, এমন ১০০ জন এবং হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত বা মৃত ১০০ জনের উপর হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হওয়া না হবার ভিত্তিতে সমীক্ষা চালালে এটাই প্রমাণিত হবে, টেনশনে ভোগা মানুষের চেয়ে টেনশনে না ভোগা মানুষরাই বেশি বেশি হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়। কারণ মানুষ যখন আরামে থাকে, টেনশনে না ভোগে তখন তার শরীর চর্বি বেড়ে গিয়ে সে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয় আর সারাক্ষণ টেনশনে ভোগা মানুষ জীবিকার তাগিদে পরিশ্রম করে যাবার ফলে তাদের শরীরে চর্বি বাড়তে পারে না বলে তাদের হার্ট ব্লক্ড হতে পারে না।

আরেকটা বিষয় হলো, দীর্ঘদিন আরামে থাকার ফলে যাদের শরীরে উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিয়েছে, তারা টেনশন করলে তাদের রক্তচাপ বেড়ে গিয়ে তারা হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে পড়ে, টেনশন না করলেও যদি উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে না রাখে, তারা যে কোনো সময় হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। চর্বি বেশি, এমন মানুষ টেনশনে ভোগা ছাড়াই হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয় অহরহ। তবু মানুষ ধরে নেয়, লোকটি নিশ্চয়ই বেশি বেশি টেনশন করতো! এই ধরে নেয়ার কারণ হলো, হার্ট অ্যাটাকের জন্য টেনশনকেই সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয়।

আর যারা আরামে থাকার সুযোগ পান না, শারীরিক পরিশ্রমের কাজই যাদের পেশা, তাদের শরীরে উচ্চ রক্তচাপও হানা দিতে পারে না বলে তারা কোনোভাবেই হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হন না, ডায়াবেটিসেও নয়, তাদের জীবনে যতো টেনশনই থাকুক। টেনশন হচ্ছে উচ্চ রক্তচাপ বৃদ্ধির কারণ, উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হবার কারণ নয়। আর যাদের উচ্চ রক্তচাপ নেই, প্রেসার সবসময় কম বা স্বাভাবিক, তারা কখনো হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হতে পারে না। তাই যাদের জীবনে টেনশন বেশি, তারা হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হবেন, এমন কোনো কথা নেই। বরং যারা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত, তারা টেনশন করুন বা না করুন, যে কোনো সময় হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারেন, যদি উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে না রাখেন।

তাই হার্ট অ্যাটাকের জন্য টেনশনকে দায়ী না করে দায়ী করা উচিত উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়া এবং তা নিয়ন্ত্রণে না রাখাকে। আর উচ্চ রক্তচাপ থেকে বাঁচতে হলে টেনশন থেকে দূরে থাকা নয়, বরং আরামপ্রিয় জীবন যাপন থেকে দূরে থাকা উচিত।

দৈনিক অন্তত ৪০ মিনিট যে কোনোভাবে কঠোর শারীরিক পরিশ্রম করলে মানুষ উচ্চ রক্তচাপ থেকেই শুধু রক্ষা পাবে না, রক্ষা পাবে হার্ট অ্যাটাক এবং ডায়াবেটিস থেকেও, কোনো সন্দেহ নেই।

নূর আহমদ : শিক্ষক; কলামিস্ট

https://www.facebook.com/nurahmad.teacher