আক্রান্ত হবার আগেই প্রতিরোধ করুন ডায়াবেটিস!

 আক্রান্ত হবার আগেই প্রতিরোধ করুন ডায়াবেটিস!

নূর আহমদ : শিক্ষক; কলামিস্ট; গবেষক

গত কয়েক দশকে যে রোগগুলো বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবনকে বেশি এলোমেলো করে দিচ্ছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিস কতটা ভয়াবহ, তা যারা রোগটিতে আক্রান্ত হয়েছেন, তারা সবচেয়ে ভালো বলতে পারবেন। এরপর যাদের পরিবারে কারও ডায়াবেটিস আছে বা ছিল, তারা বলতে পারবেন। আমার পরিচিত এবং আপনজনদের অনেকে ডায়াবেটিসে কষ্ট পাচ্ছেন। পরিচিত অনেকে ডায়াবেটিসে ভুগে মারা গেছেন গত কয়েক বছরে।

ডায়াবেটিস নিয়ে কিছু প্রতিবেদন দেখা যাক। ‘‘ঘরে ঘরে ডায়াবেটিস’’ শিরোনামে দৈনিক সমকালে ১৪ নভেম্বর ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘‘দেশে ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। শুধু বয়স্ক বা মধ্যবয়সী নয়, শিশুরাও এখন এই নীরব ঘাতকের শিকার হচ্ছে। শহর থেকে গ্রাম- সর্বত্র প্রায় সমান হারে ছড়িয়ে পড়ছে ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিস এখন প্রায় প্রতিটি ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে।...

দ্রুত নগরায়নের ফলে পরিবর্তিত জীবনযাপনের কারণে বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হারে বাড়ছে। আইডিএফের (আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন) ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে বর্তমানে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ৪৩ কোটি। ১৯৮৫ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র তিন কোটি। গত আড়াই দশকে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১৩ গুণ বেড়েছে। সংস্থাটি দুই বছর পরপর আক্রান্ত মানুষের তথ্য প্রকাশ করে। তাদের ধারণা, এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা ৬৪ কোটিতে উন্নীত হবে।’’ [https://www.samakal.com/bangladesh/article/1711860]

‘‘ডায়াবেটিস কী? কেন হয়?’’ শিরোনামে প্রথম আলোয় ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘‘ডায়াবেটিস শব্দটি আমাদের সবার কাছেই বেশ পরিচিত। এমন কোনো পরিবার খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে কোনো ডায়াবেটিসের রোগী নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, ডায়াবেটিস এখন একটি মহামারি রোগ।’’

‘‘ডায়াবেটিসের ঝুঁকি সম্পর্কে যেসব জানা জরুরি’’ শিরোনামে বিবিসি বাংলার অনলাইনে ১৩ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘‘ডায়াবেটিস এমন একটি শারীরিক অবস্থা, যা সারা জীবনের জন্যে বয়ে বেড়াতে হয় এবং সারা বিশ্বে এর কারণে প্রতি বছর ১০ লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়।...

ডায়াবেটিসের কারণে মানুষ অন্ধ হয়ে যেতে পারে, নষ্ট হয়ে যেতে পারে কিডনি এবং অনেক সময় শরীরের নিম্নাঙ্গ কেটেও ফেলতে হতে পারে।...

সারা বিশ্বেই এই সমস্যা (ডায়াবেটিস) বেড়ে চলেছে। বর্তমানে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৪২ কোটিরও বেশি। ৩০ বছর আগের তুলনায় এই সংখ্যা এখন চার গুণ বেশি- এই হিসাব বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার।’’ [https://www.bbc.com/bengali/news-46194839]

এই তিনটি প্রতিবেদন আমাদেরকে জানাচ্ছে, (১) সারাবিশে^ই ডায়াবেটিস দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে; (২) প্রায় প্রতিটা পরিবারে এখন অন্তত একজন মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত; (৩) ডায়াবেটিস এখন একটি মহামারি রোগ।

সমস্যা হচ্ছে, ডায়াবেটিসের প্রকৃত কারণ নিয়ে সারা বিশে^ই বিভ্রান্তি ছড়িয়ে আছে। যার ফলে মানুষ ডায়াবেটিস থেকে নিজেদেরকে নিরাপদ রাখতে পারছে না, ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে পারছে না। এমন সব কারণকে ডায়াবেটিসের জন্য দায়ী করা হয়, যেগুলো মানুষকে ডায়াবেটিস প্রতিরোধের ব্যাপারে হতাশ করে ফেলে। বলা হয়, ডায়াবেটিস নাকি বংশগত কারণেও হয়ে থাকে। একজন লোক যখন এমন কথা শুনে আর দেখে নিজের বাবা-মা কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিল, তখন সে কোনো উপায় না পেয়ে নিজেকে ডায়াবেটিসের নিকট সমর্পণ করে ফেলে। একসময় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। আবার যার বাবা-মা কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়নি, সে নিজেকে ডায়াবেটিস থেকে নিরাপদ ভেবে ভেবে একসময় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে।

প্রসঙ্গ : বংশগতভাবে ডায়াবেটিস

আমরা উপরে যে প্রতিবেদনগুলো পড়েছি, সেগুলো বলছে, ডায়াবেটিস মানব সমাজে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন বলছে, ‘‘ বর্তমানে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৪২ কোটিরও বেশি। ৩০ বছর আগের তুলনায় এই সংখ্যা এখন চার গুণ বেশি- এই হিসাব বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার।’’ বর্তমানে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা যদি ৩০ বছর আগের তুলনায় চার গুণ হয়, তাহলে ৬০ বছর আগের তুলনায় নিশ্চয়ই আরো বেশি। তার মানে বর্তমানে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর তুলনায় ৬০ বছর আগে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষ অনেক অনেক কম ছিল। এভাবে বর্তমানের তুলনায় ১০০ বছর আগের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের হিসেব থাকলে দেখা যেতো, সেসময় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষ এখনকার তুলনায় একেবারে কম ছিল। সমকালে প্রকাশিত প্রতিবেদনটা দেখলে বিষয়টা আরো পরিষ্কার হবে। এসব প্রতিবেদনের বক্তব্য থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি, ১০০ বছর আগে যেসব পরিবারে কারো ডায়াবেটিস ছিল না, সেসব পরিবারে এখন ডায়াবেটিস থাকাটা সহজেই প্রমাণ করে, ডায়াবেটিস কোনো বংশগত রোগ নয়। ডায়াবেটিস হচ্ছে আরামপ্রিয় মানুষের রোগ, যা অন্য নিবন্ধে বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে বলা হয়েছে।

ডায়াবেটিসকে আরামপ্রিয় মানুষের রোগ বলে সর্বত্র যত বেশি প্রচার করা হবে, মানুষের পক্ষে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা ততই সহজ হবে। এটাও প্রচার করতে হবে, ডায়াবেটিস একটি সম্পূর্ণ প্রতিরোধযোগ্য রোগ। মানুষ সচেতন হলে, নিয়মিত অন্তত ৪০ মিনিট যে কোনো উপায়ে শারীরিক পরিশ্রম করলে ডায়াবেটিস মানুষের কাছ ঘেঁষতে পারবে না কোনোভাবে। তাই আসুন, আমরা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার আগে তা প্রতিরোধে সচেষ্ট হই। আমরা জানি, ‘‘চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম’’।