উচ্চ রক্তচাপ একটি রোগের নাম নয়, অনেকগুলো রোগের অগ্রদূত

উচ্চ রক্তচাপ একটি রোগের নাম নয়, অনেকগুলো রোগের অগ্রদূত

উচ্চ রক্তচাপ বা হাই ব্লাড প্রেসারকে নীরব ঘাতক বলা হয়। নীরব ঘাতক বলার প্রথম কারণ এই রোগটি মানুষকে আক্রমণ করলে অনেক ক্ষেত্রে রোগীর শরীরে কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না। দ্বিতীয় কারণ এই রোগটি নীরবে মানুষকে ভয়াবহ অবস্থার দিকে নিয়ে যায়।

কোন ভয়াবহ অবস্থা?

মানুষ যখন আরামে আরামে থাকে, বেশি বেশি বা মনের চাহিদামতো খায়, তখন তার শরীরে তিনটি রোগ বাসা বাঁধে। রোগ তিনটি হলো— উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ। এই তিনটি রোগ একসাথে মানুষকে আক্রমণ করে খুব কম।
প্রথমে একটি রোগ আক্রমণ করে, কিন্তু মানুষ তা নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা না নিলে, যেমন নিয়মিত ঔষধ না খেলে বা ব্যায়াম না করলে অন্য দু’টি রোগও সুযোগ বুঝে আক্রমণ করে বসে।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রথমে মানুষকে আক্রমণ করে উচ্চ রক্তচাপ। উচ্চ রক্তচাপ যখন মানুষকে আক্রমণ করার পর কোনো পাল্টা আক্রমণ দেখতে না পায় তখন ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ (হার্ট অ্যাটাক) এসে হামলা চালায়।
তার মানে উচ্চ রক্তচাপ মানুষের শরীরে ডেকে নিয়ে আসে ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগকে।
আপনি দেখবেন, হাই ব্লাড প্রেসারে আক্রান্ত নয়, এমন কোনো মানুষ কখনো হৃদরোগ বা হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয় না, ডায়াবেটিসেও না। নিয়ন্ত্রণহীন উচ্চ রক্তচাপ মানুষকে হার্ট অ্যাটাকের দিকে নিয়ে যায়, নিয়ে যায় ডায়াবেটিসের দিকেও।
আমার মা একটানা ৬৫ বছর উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস বা হৃদরোগ কোনোটিতেই আক্রান্ত হননি। কিন্তু ৬৫ বছর বয়সের পর সাংসারিক কাজ থেকে অনেকটা অবসরে চলে যাবার পর তাঁর শরীরে প্রথমে হানা দেয় উচ্চ রক্তচাপ, এখন তিনি ডায়াবেটিসেও আক্রান্ত। তবে উচ্চ রক্তচাপের ঔষধ নিয়মিত খাওয়ার কারণে উচ্চ রক্তচাপ যেমন নিয়ন্ত্রণে থাকছে, ডায়াবেটিসও বাড়তে পারছে না। আমার বাবাও একটানা ৭০ বছর এই তিনটি রোগের কোনোটিতে আক্রান্ত হননি। কিন্তু ৭০ বছর বয়সের পর যখন সবরকম কাজ থেকে অবসরে চলে যান, তখন তাঁর শরীরে দেখা দেয় উচ্চ রক্তচাপ। উচ্চ রক্তচাপের ঔষধ নিয়মিত খাওয়ার কারণে ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ তাঁকে আক্রমণ করতে দেরি করছে। নয়তো আরো আগেই আক্রমণ করে বসতো। আমার মেঝো ভাই আমার বাবা—মায়ের আগেই উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি যথাযথভাবে তা নিয়ন্ত্রণ না করায় এখন ডায়াবেটিসেও আক্রান্ত। আমার বড় ভগ্নিপতি উচ্চ রক্তচাপসহ ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ তিনটি রোগেই আক্রান্ত। আমার পরিচিত অসংখ্য মানুষ আছেন, যারা একই সাথে এই তিনটি রোগে আক্রান্ত। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে, এরা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হবার পর তা নিয়ন্ত্রণে গড়িমসি করেছে। আমার খুব কাছের বন্ধু মনির হোসেন। তিনি আগে সাইকেল চালিয়ে ১০ কিলোমিটার দূরের একটি স্কুলে চাকরি করতেন। পরে বাড়ির একেবারে কাছের একটি স্কুলে বদলি হয়ে আসার কয়েক বছরের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হন। কিছুদিন আগে তিনি ডায়াবেটিসেও আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। আপনারাই এবার বলতে পারবেন, তিনি কেন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন?

খুবই দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, এখনও সমাজের ৫ শতাংশ মানুষও জানে না, উচ্চ রক্তচাপ যে আরো দু’টি রোগের প্রাথমিক ধাপ। এখনো বিশ^ব্যাপী কোটি কোটি মানুষ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হবার পর তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে না। ফলে এরা অবশ্যম্ভাবীভাবে আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে ডায়াবেটিস এবং হার্ট অ্যাটাকে। অনেকে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে প্রথমবারেই মারা যাচ্ছে। এরা অনেকেই মারা যাচ্ছে অকালে। বর্তমান বিশে^ অকালমৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ হৃদরোগ। আপনি যে কোনো পরিসংখ্যান দেখে নিতে পারেন। ‘‘হার্ট অ্যাটাক বা হৃদরোগ: যে বিষয়গুলো উপেক্ষা করার উপায় নেই’’ শিরোনামে বিবিসি বাংলায় ৪ মার্চ ২০১৯ তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘‘বিশ্বে মানুষের মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণগুলোর একটি হার্ট অ্যাটাক। বলা হয় বিশ্বে এক তৃতীয়াংশ মৃত্যুর জন্যে দায়ী হার্ট অ্যাটাক বা হৃদরোগ।’’

‘‘বিশ্বে ৩১ ভাগ মৃত্যুর জন্য দায়ী হৃদরোগ’’ শিরোনামে দৈনিক যুগান্তরে ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘‘বিশ্বে প্রতিবছর ১৭ দশমিক ৫ মিলিয়ন বা পৌনে দুই কোটি মানুষের মৃত্যু হয় হৃদরোগে। ৩০ থেকে ৭০ বছর বয়সী প্রতি ১০ জনে একজন এ রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারান। আতঙ্কের বিষয় হল— বিশ্বে ৩১ ভাগ মৃত্যুর জন্যই দায়ী হৃদরোগ। এছাড়া অল্প বয়সে মৃত্যুর ৮০ শতাংশ কারণও এ রোগ। এ তথ্য ওয়ার্ল্ড হার্ট ফেডারেশনের।’’ 

আপনি আপনার পরিচিত যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, তাদের খোঁজ নিয়ে দেখুন, দেখবেন, (১) তারা সবাই উচ্চ রক্তচাপেও আক্রান্ত। জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবেন প্রথমে তারা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়েছিল, পরে ডায়াবেটিসে। (২) দেখবেন, তাদের অনেকে হৃদরোগেও আক্রান্ত। সেক্ষেত্রেও জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হতে পারবেন, তারা হৃদরোগে আক্রান্ত হবার আগে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়েছিল।

এবার আপনি আপনার পরিচিতদের মধ্যে ঐ সব লোকের খোঁজ নিন, যারা এখনো উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হননি। অবাক হয়ে দেখবেন, তারা কেউই ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগের কোনোটিতেই আক্রান্ত নন।
আরেকটা দুঃসংবাদ হচ্ছে, কিডনী বিকল হবার বড় কারণ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়া। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষরা অনেক সময় কিডনী বিকল হয়ে মারা যায়। সে হিসেবে উচ্চ রক্তচাপকে কিডনী বিকল সহ আরো তিনটি গুরুতর রোগের কারণ বলা যায় নির্দ্বিধায়।
যাহোক, যারা ইতোমধ্যে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন, অনুগ্রহ পূর্বক নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রমের যে কোনো কাজে নিয়মিত হোন এবং ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ঔষধ খেতে থাকুন। তাহলে ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ (হার্ট অ্যাটাক) থেকে রক্ষা পাবেন। নয়তো শীঘ্রই আপনাকে আক্রমণ করে বসবে রোগগুলো।

অসংখ্য মানুষ প্রতিনিয়ত মারা যাচ্ছে হঠাৎ করে, কম বয়সেই, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। খোঁজ নিয়ে দেখুন, এরা সবাই উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত ছিল। হয়তো কোনো টেনশনে রক্তচাপ বেড়ে গিয়ে হার্ট ব্লক্ড হয়ে গেছে।
আপনিও সেরকমভাবে হঠাৎ মারা যেতে পারেন না, কারণ আপনাকে সতর্ক করা হয়েছে। আপনি ডায়াবেটিসেও আক্রান্ত হতে পারেন না, কারণ আপনাকে সতর্ক করা হয়েছে।