কায়িক শ্রমের সর্বোৎকৃষ্ট উপায় হাঁটা
কায়িক শ্রমের সর্বোৎকৃষ্ট উপায় হাঁটা
দিন দিন মানুষের জীবন থেকে কায়িক শ্রমের কাজ কমে যাচ্ছে। আগের মানুষরা কায়িক শ্রম করতেন দৈনন্দিন জীবনের অংশ হিসেবেই। কারণ তখন জীবন চলার পথে অধিকাংশ কাজ ছিল কায়িক শ্রম নির্ভর। তখন যানবাহনের প্রচলনও ছিল কম বা ছিল না। মানুষের প্রাত্যহিক বা সাংসারিক প্রায় প্রতিটা কাজে ছিল কায়িক শ্রম। কিন্তু দিন দিন মানুষের জীবন থেকে কায়িক শ্রমের সুযোগ কমে যাচ্ছে। মানুষ মনে চাইলে ২৪ ঘন্টা কায়িক শ্রম ছাড়া আরামে আরামে জীবন কাটানোর সুযোগ পাচ্ছে। মানুষ এখন যানবাহনে চড়ে যাতায়াতের সুযোগ পাচ্ছে। কৃষিকাজ না করে বাজার থেকে কিনে এনে খাবার সুযোগ পাচ্ছে। সিঁড়ির পরিবর্তে লিফট ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে। ঢেঁকির পরিবর্তে রাইস মিলে ধান ভাঙ্গানোর সুযোগ পাচ্ছে। জামা-কাপড় ধোয়ার জন্য ওয়াশিং মেশিন ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে। এভাবে মানুষের জীবন থেকে কায়িক শ্রম দূরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু এতে মানুষ কোন ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে, মানুষ এখনো বুঝতে পারছে না।
‘‘কায়িক শ্রম না করায় সতর্ক করল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’’ শিরোনামে প্রথম আলোয় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে। সেখানে বলা হয়, ‘‘মানুষ এখন আর আগের মতো কায়িক শ্রম করছে না। বিশ্বজুড়ে এই নিষ্ক্রিয়তার স্তর কমানোর ক্ষেত্রে অগ্রগতি সামান্যই বলে সতর্ক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডব্লিউএইচও। বিবিসি অনলাইনের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
ডব্লিউএইচওর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, বিশ্বের এক চতুর্থাংশের বেশি মানুষ, অর্থাৎ ১৪০ কোটি মানুষ কোনো কায়িক শ্রম বা ব্যায়াম করে না। ২০০১ সাল থেকে এ পরিস্থিতির কোনো উন্নতি দেখা যায়নি।
শরীর না খাটালে বা পরিশ্রম না করলে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে। এতে হৃদ্রোগ, টাইপ-২ ডায়াবেটিসসহ নানা রকম ক্যানসার হতে পারে।
ডব্লিউএইচওর প্রতিবেদনে জানানো হয়, কম পরিশ্রম করা দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাজ্যসহ বেশি আয়ের দেশগুলো রয়েছে। এশিয়ার দুটি অঞ্চল বাদে বিশ্বজুড়ে নারীদের বেশি নিষ্ক্রিয়তা লক্ষ করা যায়।
ডব্লিউএইচওর গবেষকেরা এ গবেষণা করতে ১৬৮টি দেশের ১৯ লাখ মানুষকে নিয়ে করা ৩৫৮টি গবেষণা তথ্য ব্যবহার করেছেন। গবেষণাসংক্রান্ত নিবন্ধ ‘দ্য ল্যানসেট পাবলিক হেলথ’সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে।
গবেষকেরা বলছেন, তাঁরা দেখেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো উচ্চ আয়ের দেশে শারীরিক পরিশ্রম না করা মানুষের হার ২০০১ সালের চেয়ে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৫ শতাংশ বেড়েছে। ২০০১ সালে শারীরিক শ্রম করা মানুষের হার ছিল ৩২ শতাংশ, যা ২০১৬ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৩৭ শতাংশে। তবে কম আয়ের দেশগুলোয় এ হার ১৬ শতাংশে স্থায়ী রয়েছে।
গবেষকেরা বলছেন, সপ্তাহে ১৫০ মিনিটের কম হালকা ব্যায়াম বা ৭৫ মিনিটের কম কঠোর পরিশ্রম করেন, তাঁদের নিষ্ক্রিয়দের দলে রেখেছেন গবেষকেরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্পদশালী দেশগুলোয় ব্যায়াম না করার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে বসে থাকার চাকরি ও শখ। এর বাইরে যানবাহন বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলো রয়েছে। তবে স্বল্প আয়ের দেশগুলোয় এখনো মানুষকে শারীরিক পরিশ্রম করতে হয় বা হেঁটে ও গণপরিবহনে যাতায়াত করতে হয়।
ডব্লিউএইচওর প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়, ডব্লিউএইচও ২০২৫ সাল নাগাদ শারীরিক নিষ্ক্রিয়তার হার ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, তা অর্জন করা সম্ভব হবে না।
গবেষণা নিবন্ধের নেতৃত্ব দেওয়া গবেষক রেজিনা গাথহোল্ড বলেছেন, বৈশ্বিক অন্যান্য স্বাস্থ্য ঝুঁকির মতো, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তার হার কমছে না। সুস্থ থাকার জন্য যতখানি ব্যায়াম করা দরকার, প্রায় এক-চতুর্থাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি তা করছেন না। যে অঞ্চলে শারীরিক নিষ্ক্রিয়তার হার বাড়ছে, সেখানে গণস্বাস্থ্য ও বিভিন্ন রোগ ব্যাধি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে উদ্বেগ বাড়ছে।
গবেষকেরা সরকারগুলোকে যথাযথ অবকাঠামো নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। খেলার জন্য মাঠ এবং হাঁটা ও সাইকেল চালানোর মতো সুযোগ তৈরির কথা বলেছেন।
সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মেলোডি ডিং বলেছেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে জীবনধারার পরিবর্তন হয় এবং অলস আচরণের ঝুঁকি বাড়ে। মানুষগুলোকে সক্রিয় রাখতে সরকার বাড়তি কিছু করতে পারে। গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নতির পাশাপাশি হাঁটা ও সাইকেল চালানোর সুব্যবস্থা করা উচিত।
কায়িক শ্রমের একটি প্রধান উপায় হাঁটা। ‘‘প্রতিদিন হাঁটুন, দীর্ঘজীবন উপভোগ করুন’’ শিরোনামে দৈনিক ইনকিলাবে ১৭ অক্টোবর, ২০২১ তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে (দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, টিবিএস নিউজ অবলম্বনে তৈরি) বলা হয়, ‘‘ব্যায়াম বা পরিশ্রম থেকে সুফল পেতে হলে আমাদের উচিত সঠিক মাত্রায় এবং সঠিক উপায়ে সেটা করা। দীর্ঘ সুস্থ জীবন লাভের জন্য দিনের ৭-৮ হাজার কদম হাঁটা অথবা ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট শারীরিক পরিশ্রম করাই যথেষ্ট।
দীর্ঘজীবন লাভের সম্ভাবনা বাড়াতে চাইলে রোজ ৭ হাজার কদম হাঁটলে সম্ভবত ভালো ফল পাওয়া যাবে বলে নতুন দুটি গবেষণায় উঠে এসেছে। অথবা সপ্তাহে আড়াই ঘণ্টা টেনিস, সাইক্লিং, সাঁতার, জগিং কিংবা ব্যাডমিন্টনের মতো খেলায় সময় দিলেও একই ফল পাওয়া যাবে।
গবেষণা দুটিতে দেখা যায়, সঠিক পরিমাণে সঠিক ধরনের ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম অকালমৃত্যুর ঝুঁকি ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমায়। এ দুই গবেষণার আওতায় কয়েক দশক ধরে ১০ হাজারের বেশি নারী-পুরুষকে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে।
তবে গবেষকরা এ-ও বলেছেন যে, শারীরিক পরিশ্রমের সুফল পাওয়ার সর্বোচ্চ সীমা থাকতে পারে। যারা পরিশ্রম বেশি করেন, তারা যে অল্প পরিশ্রমীদের চেয়ে বেশিদিন বাঁচেন, তা ইতোমধ্যে প্রমাণিত।
নতুন গবেষণায় এ সমস্যাগুলোর ওপরই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। প্রথম গবেষণায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে হাঁটার ওপর। বেশিরভাগ মানুষই মনে করেন রোজ ১০ হাজার কদম হাঁটা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। তবে ঠিক ১০ হাজার কদমই যে হাঁটতে হবে, তার কোনো বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ নেই।
গবেষকরা দেখেন যে, যেসব মানুষ দিনে অন্তত ৭ হাজার কদম হাঁটে, তারা সাধারণত তুলনামূলক বেশি আয়ু পান। হাঁটার পরিমাণ যত বাড়ে, দীর্ঘ জীবন লাভ করার সম্ভাবনাও ততই বাড়ে। যারা দৈনিক ৯ হাজার কদমের বেশি হাঁটেন, তাদের অকালমৃত্যুর ঝুঁকি ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়।
দ্বিতীয় গবেষণায় দেখা হয়েছে সপ্তাহে কত ঘণ্টা খেলাধুলা করলে (সাইক্লিং, টেনিস, সাঁতার, হ্যান্ডবল, ওয়েট লিফটিং, ব্যাডমিন্টন, ফুটবল ও অন্যান্য) বা শারীরিক পরিশ্রম করলে স্বাস্থ্যের উপকার হয়। এ দুটো গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে, শারীরিক পরিশ্রম দীর্ঘজীবন লাভের জন্য সহায়ক।
‘‘সুস্থ থাকতে হাঁটুন’’ শিরোনামে দৈনিক নয়াদিগন্তে ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলা হয়, ‘‘প্রাচীন গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটিস বলেছিলেন ‘মানুষের জন্য সর্বোত্তম ওষুধ হলো হাঁটা’। আসলেই তাই! এটি যেমন বাড়তি ওজন ঝরিয়ে সুন্দর গড়ন পেতে সাহায্য করে, তেমনি মানসিকভাবেও ভালো বোধ করায় ভূমিকা রাখে। হাঁটলে রাতে ভালো ঘুমও হয়। যার ফলে আপনার সৌন্দর্য অক্ষুন্ন থাকে। যেহেতু হাঁটার জন্য কোনো ব্যায়ামের যন্ত্র বা প্রশিক্ষকের প্রয়োজন নেই, তাই জিমে ভর্তি না হয়েই একদম বিনা খরচে হাঁটার কাজটি করা সম্ভব। এ ছাড়াও সব ব্যায়ামের মধ্যে হাঁটাহাঁটি সবচেয়ে সহজ। এটিই একমাত্র ব্যায়াম যা দৈনন্দিন কাজের ফাঁকেই করে ফেলা যায়, আলাদা করে সময় দিতে হয় না।
গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত হাঁটা নার্ভাস সিস্টেমকে ভালো রাখে। ফলে রাগ ও দুশ্চিন্তা নিয়ন্ত্রণে থাকে। হাঁটার সময় মস্তিষ্ক ‘হ্যাপি হরমোন’ নিঃসরণ ঘটায়, যার কারণে মন ভালো থাকে। তা ছাড়া হাঁটাহাঁটির সময় প্রতিবেশীদের অনেকের সাথে দেখা ও কথা হয়, যা মানসিকভাবে ভালো বোধ করার আরেকটি কারণ। আর মন ভালো থাকলে চেহারায় সেই সৌন্দর্য ফুটে ওঠে।
নিয়মিত হাঁটলে অনেক ক্যালোরি ক্ষয় হয়, যার ফলে ওজন কমে। হাঁটা শুরু করার এক মাসের মধ্যেই দেখবেন পরনের কাপড়গুলো ঢিলেঢালা মনে হতে থাকবে। হাঁটার কারণে ইনসুলিনের প্রতি শরীরের প্রতিক্রিয়া কৃদ্ধি পায়, যা পেটের মেদ কমাতে সাহায্য করে। এতে করে শরীর সুন্দর আকার ফিরে পায়। প্রতিদিন মাত্র এক কিলোমিটার হাঁটলেই এক মাসে ২ শতাংশ বডিফ্যাট কমানো সম্ভব।
নিয়মিত হাঁটলে রক্তে সুগার বা চিনির অনুপাত কমে আসে, অর্থাৎ ডায়াবেটিসের মতো রোগের ঝুঁকি কমে আসে। তা ছাড়া নিয়মিত হাঁটা রক্তচাপ কমে যা ব্রেইন স্ট্রোকের ঝুঁঁকি কমায়। এ ছাড়াও হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতেও হাঁটাহাঁটির গুরুত্ব অপরিসীম। যারা নিয়মিত হাঁটেন তাদের তুলনায় যারা নিয়মিত হাঁটেন না, তাদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। হার্ভার্ড পাবলিশিং আউটলাইন অনুযায়ী বেশ কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, সপ্তাহে মাত্র ৮.৮ কিলোমিটার হাঁটলেই হৃদরোগের আশঙ্কা ৩১ শতাংশ পর্যন্ত কমানো যায় এবং হৃদরোগে মৃত্যুঝুঁকি ৩২ শতাংশ পর্যন্ত কমানো যায়। মজার ব্যাপার হলো, এই গবেষণায় অংশ নেয়া ব্যক্তিরা বেশ ধীরগতিতে হেঁটেই এই ফলাফল অর্জন করে ফেলেছেন। তাদের গতি ছিল ৩.২ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা।
হাঁটাহাঁটি মানুষের আয়ু বৃদ্ধির সাথে সম্পর্কিত বলে ধারণা করা হয়। আমেরিকান জেরিয়াট্রিকস সোসাইটির একটি গবেষণায় দেখা যায়, যারা শারীরিক পরিশ্রম বেশি করেন তারা দীর্ঘদিন বাঁচেন। যারা যৌবনেই হাঁটাহাঁটির অভ্যাস গড়ে তোলেন, তাদের বিভিন্ন রোগ যেমন: উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ বা ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। ফলে তাদের দীর্ঘজীবন লাভের পথ সুগম হয়।
0 Comments: