দীর্ঘজীবন লাভের উপায় (পর্ব-৪২) : ধূমপানে কি ফুসফুস ক্যান্সার হয়?
ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক এবং উচ্চ রক্তচাপের প্রকৃত কারণ এবং প্রতিরোধের উপায় জানার মাধ্যমে
দীর্ঘজীবন লাভের উপায়
ধূমপানে কি ফুসফুস ক্যান্সার হয়?
তবে অনেকের মতে, ধূমপান এবং তামাক সেবন সব ধরনের ক্যান্সারের জন্য দায়ী নয়, শুধুমাত্র ফুসফুসের ক্যান্সারের জন্য দায়ী। ২৯ মে ২০১৭ তারিখের দৈনিক ইনকিলাবে ‘ধূমপানের ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া’ শিরোনামে একটি লেখা (লেখক: আফতাব চৌধুরী) ছাপা হয়, যাতে বলা হয়, ‘ধূমপানের জোরে যারা ক্যান্সারে মারা যান, তারা বেশিরভাগ ফুসফুসের ক্যান্সারে মারা যান।’ এরপর আবার বলা হয়, ‘তামাক শুধু এক ধরনের ক্যান্সার উপহার দেয় না, বহু ধরনের ক্যান্সারের কারক। তামাক সেবনের জোরে খাদ্যনালী, স্বরনালী, কিডনী, অগ্নাশয়, জরায়ুমুখের ক্যান্সার হয়।’ ধূমপান ও তামাক সেবনের প্রতিক্রিয়াকে এখানে ভিন্নভাবে দেখানো হয়েছে। প্রথমে ধূমপানের কারণে ফুসফুসের ক্যান্সার হবার বিষয়ে আলোচনা করা যাক।
১১ অক্টোবর ২০১৪ তারিখের দৈনিক ইত্তেফাকে পাবনা মেডিকেল কলেজের প্রভাষক ডা. মো. ফজলুল কবির পাভেলের ‘ফুসফুস সুস্থ রাখার উপায়’ শিরোনামে একটি লেখা ছাপা হয়। লেখাটিতে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হবার ৭টি কারণ উল্লেখ করা হয়, যেখানে ধূমপানের উল্লেখ নেই! কারণগুলো হল: ১. যক্ষ্মার জন্য ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২. মশার কয়েল থেকেও ফুসফুসের ভীষণ ক্ষতি হতে পারে। ৩. দুর্ঘটনা জনিত কারণে এবং ফুসফুসে আঘাতের কারণে এর ক্ষতি হয়। ৪. কয়লা খনিতে যারা কাজ করে তাদের যক্ষ্মাসহ বিভিন্ন ফুসফুসের অসুখ দেখা যায়। ফলে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৫. ধোঁয়া, গাড়ির ধোঁয়া যাতে প্রচুর কার্বন ডাই অক্সাইড থাকে। এগুলো ফুসফুসের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর। ৬. দূষিত পরিবেশ ফুসফুসকে ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ৭. বিভিন্ন খনি অঞ্চলে ফুসফুসের অসুখ বেশি হয়।
এই ৭টি কারণের কোনো একটি বা একাধিক কারণে যদি কারো ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা ফুসফুসের ক্যান্সার হয়, তাহলে সে ধূমপান করুক বা না করুক, তাতে কী-ই বা আসে যায়! কিন্তু আমরা কী করি, ফুসফুসের ক্যান্সারে কেউ আক্রান্ত হলে যদি দেখি সে ধূমপান করে, তখন এক দৌড়ে দায়ী করে বসি ধূমপানকে। কারণ ধূমপান হচ্ছে একটা সর্বজনস্বীকৃত নেতিবাচক কাজ। মানুষের শরীরের সব রকম ক্ষতির জন্য ধূমপানকে দায়ী করা চলে, যদি ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তিটি ধূমপায়ী হয় আর ক্ষতিটির আর কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া না যায়! দশ বছরের কম বয়সী শিশুরা সাধারণত ধূমপান করে না। এসব শিশুর পেটে মাঝে মাঝে কৃমি হয়। যদি এরা ধূমপান করতো, তাহলে এদের পেটের কৃমির জন্যও হয়তো ধূমপানকেই দায়ী করে বসা হতো!
৫ জুলাই ২০১৬ দৈনিক কালের কন্ঠে ‘ফুসফুস ভাল রাখার সহজ উপায়’ শিরোনামে একটি লেখা ছাপা হয়। তাতে বলা হয়, ‘সমীক্ষা বলছে, ধূমপান না করেও শুধুমাত্র প্রাকৃতিক দূষণের কারণে বহু মানুষের ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ... ট্রাফিক জ্যাম, গাড়ির ধোঁয়া, বিভিন্ন শস্য-ফসলের রেণু যেমন ফুসফুসের ক্ষতি করে, তেমনই ঘরের মধ্যে জমে থাকা ধুলো, রান্নার স্টোভের গ্যাস থেকেও ক্ষতি হয়।’
২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখের বাংলাদেশ প্রতিদিনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. এ কে এম মোস্তফা হোসেনের ‘ওষুধ থেকেও ফুসফুসের রোগ’ শিরোনামে একটি লেখা ছাপা হয়। তাতে তিনি লিখেন, ‘আমরা বিভিন্ন কারণে ওষুধ সেবন করি, কখনো চিকিৎসকের পরামর্শে, কখনো বিনা পরামর্শে। ... এগুলো ক্ষণিকের কাজ দিলেও ভবিষ্যতে এর মাত্রা হয়ে উঠে অনেক ক্ষতির কারণ। এর মধ্যে কিছু কিছু ওষুধ আমাদের ফুসফুসের নানা সমস্যা করে।’
ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হবার বা ফুসফুসের ক্যান্সার হবার অনেক অনেক কারণ থাকা সত্ত্বেও ঢালাওভাবে ধূমপানকে এজন্য দায়ী করা কি যৌক্তিক? বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ এমন পাওয়া যাবে, যারা কয়েক যুগ ধরে ধূমপান করেছে, কিন্তু মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাদের ফুসফুস সুস্থ ছিল। অথচ যেভাবে ধূমপানকে ফুসফুসে ক্যান্সারের কারণ বলে প্রচার করা হয়, তাতে একজন ধূমপায়ীও ফুসফুসের ক্যান্সার থেকে রক্ষা পাবার কথা নয়। অনেকে হয়তো বলবে, ‘ধূমপায়ী সবাই ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়, এমন নয়। কেউ কেউ আক্রান্ত হয়, আবার কেউ কেউ বেঁচে যায়।’ এ কথা বলে কিন্তু ফুসফুসের ক্যান্সারের জন্য ধূমপানকে দায়ী করা ভুল। ধূমপানকে তখনই ফুসফুসের ক্যান্সারের জন্য দায়ী করা যেতো, যদি অধিকাংশ ধূমপায়ী বা সব ধূমপায়ী ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হতো।
হ্যাঁ, ধূমপানে অন্য কোনো ক্ষতি না হোক, ফুসফুসের ক্ষতি হতে পারে কমবেশ। কারণ ফুসফুসের ক্ষতির জন্য যে কারণগুলোকে দায়ী করা হয়, সেগুলোর কোনো কোনোটির সাথে ধূমপানের সাদৃশ্য রয়েছে। তবে আরেকটি কথা আছে, মানুষের শরীরে ক্যান্সারের কারণ এখনো যেহেতু অজ্ঞাত এবং ক্যান্সার শরীরের নির্দিষ্ট কোনো অঙ্গে না হয়ে শরীরের যে কোনো জায়গায় হয়ে থাকে, তাই ফুসফুসের ক্যান্সারও ধূমপানের কারণে না হয়ে অজ্ঞাত কারণেই হয়ে থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। এ হিসেবে ধূমপানকে ফুসফুসের ক্যান্সারের জন্যও দায়ী না করার একটা সুযোগ থাকে। তাছাড়া যারা ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়, দেখা যায় তাদের অনেকেই ধূমপান করেন না। দু’টি উদাহরণ লক্ষ্য করুন:
(১) আমার এক সহকর্মীর বাড়ি আমাদের স্কুল যে গ্রামে অবস্থিত, তার পাশের বিরাহিমপুর গ্রামে। গত ২৫ অক্টোবর ২০১৮ স্কুলে আসার পর আমার ঐ সহকর্মী জানালেন, তাঁর এক চাচা মারা গেছেন আগের দিন। কিভাবে? মারা যাবার আগে প্রথমে তাঁর শরীরে ক্যান্সার দেখা দিয়েছিল। ক্যান্সার হয়েছিল তাঁর ফুসফুসে। পরে মৃত্যুর আগে তাঁর আবার দেখা দিয়েছিল যক্ষা। শেষে তিনি মারাই গেলেন। লোকটি ধূমপান করতেন। তবে মৃত্যুর ১৫ বছরের বেশি সময় আগে তিনি ধূমপান ছেড়ে দিয়েছিলেন। তবু অনেকে এখন বলছে, তিনি যে একসময় ধূমপান করতেন, তার ফলেই এখন তাঁর ফুসফুসে ক্যান্সার হয়েছে। আমি একটু আগে বলেছিলাম, বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ এমন পাওয়া যাবে, যারা কয়েক যুগ ধরে ধূমপান করেছে, কিন্তু মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাদের ফুসফুস সুস্থ ছিল। এখন আবার বলছি, বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ লোক এমন পাওয়া যাবে, যারা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ত্রিশ-চল্লিশ বছর ধরে ধূমপান করেছেন, তবু ফুসফুস সুস্থ থাকা অবস্থাতেই মারা গিয়েছেন। লক্ষ লক্ষ লোক যদি আমৃত্যু ধূমপান করেও ফুসফুস ক্যান্সার থেকে রক্ষা পায়, তাহলে যে লোক ১৫ বছরের বেশি সময় আগে ধূমপান ছেড়ে দিয়েছিল, দীর্ঘদিন ধরে যে লোক ধূমপান করতো না, সে কেন ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হবে?! ধূমপানে অভ্যস্থ হবার পর আবার ধূমপান ছেড়ে দিয়েছিল বলেই?!
(২) ২৭ অক্টোবর ২০১৮ তারিখের দৈনিক আমাদের সময়ে একটি সংবাদ ছাপা হয় ‘অভিনেত্রী রেহানা জলি ক্যানসারে আক্রান্ত’ শিরোনামে। সেখানে বলা হয়, ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী রেহানা জলি ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত। তিনি বলেন, আমার ফুসফুসে ক্যানসার হয়েছে। সেখান থেকে ইনফেকশন হয়ে মেরুদন্ডেও সমস্যা শুরু হয়েছে।...’
১৯৮৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত চার শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করা রেহানা জলি মহিলা হয়েও ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন। বাংলাদেশের মহিলারা যে সাধারণত ধূমপান করেন না, তা আগেই বলা হয়েছে। ধূমপান না করে যদি ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে হয় আর দীর্ঘদিন ধূমপান করেও অসংখ্য মানুষ ফুসফুস ক্যান্সার ছাড়াই আমৃত্যু বেঁচে থাকে, তাহলে ফুসফুস ক্যান্সারকে ধূমপানের জন্য কিভাবে দায়ী করা যাবে?
এবার দেখুন ফুসফুস ক্যান্সার সম্পর্কে চায়নার গুয়াংজৌ ক্যান্সার হসপিটালের মতামত।
চায়নার ‘গুয়াংজৌ ক্যান্সার হসপিটালের’ ওয়েবসাইটে (বাংলা) ‘ফুসফুস ক্যান্সার’ শিরোনামে একটা লেখায় দেখলাম একটা চাঞ্চল্যকর তথ্য।
সেখানে বলা হয়েছে, ‘গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৯০% ক্ষেত্রেই ফুসফুস ক্যান্সার তাদের হয়, যারা ধূমপান করেন। তার মানে যারা ধূমপান করেন না তাদের কি এই ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা নেই? আসলে ব্যাপারটা এমন নয়। মডার্ন ক্যান্সার হসপিটাল গুয়াংজৌ দেখেছে যে, এখন পর্যন্ত ফুসফুস ক্যান্সারের প্রকৃত কারণ জানা যায়নি। সুতরাং ধূমপান-ই না, এর সাথে আরও তিনটি কারণ জড়িত থাকতে পারে- ১. বায়ু দূষণ, ২. অতিরিক্ত প্রেসার, ৩. পুষ্টির অভাব। এছাড়াও ভাইরাল ইনফেকশন, মাইকোটক্সিন, টিউবারকুলসিস, ইমিউন ডিসফাঙ্কশন, এন্ডওক্রাইন ডিজঅর্ডার এবং জেনেটিক কারণেও ফুসফুস ক্যান্সার হতে পারে।’ [http://www.asiancancer.com/bengali/cancer-topics/lung-cancer]
এখানে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে, ‘মডার্ন ক্যান্সার হসপিটাল গুয়াংজৌ দেখেছে যে, এখন পর্যন্ত ফুসফুস ক্যান্সারের প্রকৃত কারণ জানা যায়নি’। সুতরাং কারো ফুসফুসে যদি ক্যান্সার বা অন্য কোনো সমস্যা হয়, তা ধূমপানের কারণে না হয়ে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হবার অন্য কারণগুলোর ফলেও হতে পারে।
৪৩তম পর্ব:
https://waytogainlonglife.blogspot.com/2022/09/blog-post_26.html

0 Comments: