শিশুদেরকে খেলতে দিন
শিশুদেরকে খেলতে দিন
নূর আহমদ
শিশুদেরকে মোটা হতে দেখা আমরা প্রায় সবাই পছন্দ করি। কিন্তু মোটা হতে গিয়ে যে ওরা অনেক রোগের ঝুঁকিতে পড়ে, তা নিয়ে আমরা মোটেই ভাবি না। ইদানিং অনেক শিশু সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ও বিস্ময়করভাবে উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত অনেক শিশু আমাদের পরিচিতজনদের মধ্যেই রয়েছে। ১৭ মে ২০১৭ তারিখের দৈনিক ইত্তেফাকে উচ্চ রক্তচাপ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘বর্তমান বিশ্বে শতকরা ৫ জন শিশু উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত।’
প্রশ্ন হচ্ছে, বড়দের পাশাপাশি কেন শিশুরাও এখন এসব রোগে আক্রান্ত হচ্ছে?
‘উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় বিবিসি বাংলায় ১৭ মে ২০১০ তারিখে। সেখানে বলা হয়, ‘‘এখনকার যারা শিশু কিশোর তারা ছোটবেলা থেকে খেলাধুলার সুযোগ পাচ্ছে না এবং কোনো শারীরিক পরিশ্রমও নেই। এরা যখন বড় হচ্ছে তারা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হচ্ছে,’’ বলেন ডা: বদিউজ্জমান।’
‘কেন শিশুদের মধ্যে ডায়াবেটিস রোগ বাড়ছে’ শিরোনামে বিবিসি বাংলায় ১৩ অগাস্ট ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ডায়াবেটিসের সবচেয়ে বড় হুমকি ওজন বেড়ে যাওয়া। যেসব শিশুর এই রোগ হচ্ছে তাদের দুই-তৃতীয়াংশেরই শরীরের ওজন বেশী।’ প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়, ‘চিকিৎসকরা বলছেন, প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে শিশুদের শরীরে টাইপ ২ ডায়াবেটিস বেশী ক্ষতি করে। সুতরাং বাচ্চাদের ওজন নিয়ে শঙ্কা দেখা দিলে, ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। দ্রুত ওজন কমানোর জন্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া জরুরী।
আর যদি দেখা যায় ইতিমধ্যেই শিশু আক্রান্ত হয়েছে, শরীর চর্চা থেকে শুরু করে খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে কঠোর শৃঙ্খলা পালন করতে হবে।’
দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, আমরা অনেকে এখনো শিশুদের এসব রোগে আক্রান্ত হবার সংবাদ জেনেও নিজের শিশুর মোটা হওয়া নিয়ে সতর্ক হই না। শিশুকে খেলতে দিই না, শিশুকে চিকন রাখতে সচেষ্ট হই না। বরং শিশুকে মোটা দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে যাই, সারাদিন শুধু খাওয়ার উপর রাখার চেষ্টা করি।
এমন আত্মঘাতি প্রবণতা পরিহার করে শিশুদেরকে ঠিকমতো খাওয়ানোর পাশাপাশি খেলাধুলা করতে দেয়া উচিত। বিশেষ করে শারীরিক কসরত করতে হয় যেসব খেলায়, সেসব খেলা। শুধু বসে বসে খাওয়ালে অবশ্যই সে একসময় রোগাগ্রস্থ হয়ে পড়বে। তখন হতাশা প্রকাশ করে কোনো লাভ হবে না। অল্প বয়সেই শিশুদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে।
আরো পড়ুন সময়োপযোগী এই কলাম: চোখ ওঠা রোগ (কনজাংটিভাইটিস) কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়
হ্যাঁ, শিশুদেরকে বেশি বেশি খাওয়ানো যাবে, তবে পাশাপাশি বেশি বেশি খেলতেও দিতে হবে। শিশুদেরকে আমরা অনেক অভিভাবক ইদানিং খেলতে তো উৎসাহিত করিই না, বরং সময়ের চাহিদা মনে করে ওদের হাতে তুলে দিই স্মার্টফোন, ট্যাব এসব। অনেক ‘সচেতন’ অভিভাবকও শিশুদেরকে উজ্জ্বল স্ক্রীণের এসব ডিজিটাল ডিভাইস কিনে দিয়ে আনন্দ পাই। শুধু তা-ই নয়, অন্যের কাছে গর্বের সাথে বলেও বেড়াই, ‘আমার ... বছরের বাচ্চা ফোনের এমন অনেক কিছু জানে, আমি নিজেও যেগুলো জানি না!’
বিগত কয়েক বছর ধরে বিশ্বব্যাপী শিশুরা স্থূল হয়ে যাচ্ছে, সাথে সাথে নানারকম রোগে রোগাগ্রস্থও হয়ে যাচ্ছে ব্যাপক হারে। এর প্রধান কারণ খেলাধুলা থেকে তাদের দূরে দূরে থাকা। আর এই দূরে থাকার অন্যতম কারণ এই স্ক্রীণাসক্তি। টেলিভিশনের স্ক্রীণের সাথে এখন খুব শক্তিশালী হয়ে যোগ দিয়েছে মোবাইল-ট্যাব-ল্যাপটপের স্ক্রীণ। স্ক্রীণে স্ক্রীণেই এখন অনেক শিশু দিনের একটা বড় সময় কাটিয়ে দেয়। বাইরে অন্য শিশুদের সাথে খেলাধুলার সময় কই!
৩১ মার্চ ২০১৭ সংখ্যার দৈনিক ইত্তেফাকে ‘আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে শিশুদের দৃষ্টি সমস্যা’ শিরোনামে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপা হয়। প্রতিবেদনটিতে শিশুদের স্ক্রীণাসক্তির মারাত্মক পরিণতির অনেক উদাহরণ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, চক্ষু হাসপাতালসমূহে ইদানিং শিশুরোগীর সংখ্যা অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মোবাইল, ট্যাব এসবের উজ্জ্বল স্ক্রীণে দীর্ঘক্ষণ চোখ আটকে রাখার পরিণতিতে শিশুদের চোখে নানারকম রোগ দেখা দিচ্ছে।
৩ মার্চ ২০১৮ সংখ্যার দৈনিক যুগান্তরে ‘প্রযুক্তির কারণে পেনসিল ধরতে সমস্যা হচ্ছে শিশুদের’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। তাতে বলা হয়, ‘বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রযুক্তির প্রতি আসক্তির কারণে পেনসিল দিয়ে লেখালেখি করতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়ছে শিশুরা। টাচস্ক্রিণ ডিভাইসের সামনেই বেশি সময় কাটাচ্ছে তারা, ফলে পেনসিল ধরতেও তারা ভুলে যাচ্ছে। ২৫ ফেব্রুয়ারি ইংল্যান্ডের পেডিয়াট্রিক অকুপেশনাল থেরাপিস্ট স্যালি পেইন বিষয়টি জানান সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে।...দ্য গার্ডিয়ানকে ইংল্যান্ডের রয়্যাল কলেজ অব অকুপেশনাল থেরাপিস্টের সহকারী পরিচালক কারিন বিশপ বলেন, ‘প্রযুক্তির প্রভাবে বদলে যাওয়া এক বিশ্বে বেড়ে উঠছে আমাদের শিশুরা। নিঃসন্দেহে আমাদের জীবনে প্রযুক্তির অনেক ইতিবাচক প্রভাব আছে। কিন্তু প্রযুক্তির কারণে আমরা যে অলস হয়ে পড়ছি এটা নিশ্চিত। প্রযুক্তিতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার কারণে শিশুরা অনলাইনে, ঘরে বসে বেশি সময় কাটাচ্ছে, খেলাধুলা বা শরীরচর্চায় সময় কাটাচ্ছে কম।’
শিশুদেরকে ট্যাব, স্মার্টফোন ব্যবহারের স্বাধীনতা দেয়া যে আত্মবিধ্বংসী, তা আশা করি সবাই উপলব্ধি করতে পেরেছেন প্রতিবেদনগুলো দেখে। অতএব শিশুদেরকে উজ্জ্বল স্ক্রীণযুক্ত ডিভাইস কিনে দিয়ে নয়, ক্রীড়াসামগ্রী কিনে দেয়ার মধ্যেই প্রশান্তি খুঁজুন। নিজে ব্যায়াম করার সময় ওদেরকে সাথে রাখুন, ওদেরকেও কিছু কিছু ব্যায়াম করতে শেখান। আপনি নিজেও ওদের সাথে ব্যাডমিন্টন, ক্রিকেট এসব খেলতে পারেন। আপনারও উপকার হবে। ওদেরকে মুটিয়ে যেতে দেবেন না, চিকন রাখতে চেষ্টা করুন, ওদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে।
নূর আহমদ : শিক্ষক; কলামিস্ট ও ফিটনেস বিষয়ক গবেষক
...................................................
ফিটনেস বিষয়ে আমার আরো তিনটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক পত্রিকায়।
(১) অতিরিক্ত আরামই ব্যারামের কারণ
(দৈনিক ইনকিলাব)
(২) রোগমুক্ত জীবনের জন্য হাঁটা
(দৈনিক নয়াদিগন্ত)
(৩) মানুষ কখন বংশগতভাবে কোনো রোগে আক্রান্ত হয়?
(দৈনিক নয়াদিগন্ত)
লেখাগুলো গুগল থেকে পড়া যাবে শিরোনাম লিখে খুঁজলে।
0 Comments: