দীর্ঘজীবন লাভের উপায় (পর্ব-৫৫) : শারীরিক পরিশ্রমের শ্রেষ্ঠ পন্থার নাম হাঁটাহাঁটি
অধ্যায়-৩৫
শ্রেষ্ঠ এক ব্যায়ামের নাম হাঁটা
এ লেখায় ব্যায়াম হিসেবে অনেকবার হাঁটাহাঁটির কথা বলা হয়েছে। হাঁটাহাঁটি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের কিছু চমৎকার মতামত এখানে তুলে ধরা হলো।
‘আজ থেকে ২ হাজার বছর আগে আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রের জনক হিপোক্রেটিস বলে গেছেন, মানুষের জন্য সেরা ওষুধ হলো- হাঁটা।’ [দৈনিক যুগান্তর, ২৮ এপ্রিল ২০১৮]
দৈনিক ইত্তেফাকের ‘স্বাস্থ্য পরিচর্যা’ পাতায় ‘ওজন কমাবেন কিভাবে’ শিরোনামে একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে, ‘বাড়িতে যতো সময় অবস্থান করবেন সেই সময়ে শুয়ে বা বসে না থেকে হাঁটা চলাও যে ব্যায়াম তা অনেকে ভাবেন না। আপনার বাড়িতে যদি সিঁড়ি থাকে তাহলে কারণে অকারণে দৈনিক কয়েকবার ওঠানামা করতে পারেন। আরো ভালো হয় যদি হালকা জিনিসপত্র বহন করা যায়।’ [দৈনিক ইত্তেফাক, ১১ অক্টোবর ২০১৪]
দৈনিক যুগান্তরে ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে ‘সুস্থ থাকতে ৪৫ মিনিট হাঁটুন’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে ‘ঢাকা সিটি ফিজিওথেরাপি হাসপাতাল, ধানমন্ডি, ঢাকা’র চেয়ারম্যান ও চিফ কনসালটেন্ট ডা. এম ইয়াসিন আলী বলেন, ‘আমাদের দৈনন্দিন শারীরিক কার্যক্রম হচ্ছে না বললেই চলে, যার ফলে শরীরে বাসা বাঁধছে বিভিন্ন অসুখ বিসুখ যেমন- ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, আথ্রাইটিস, ওবেসিটি বা স্থূলতা, মাংসপেশির শক্তি কমে যাওয়া, অষ্ঠিওপোরোসিস বা হাড়ের ভঙ্গুরতা ইত্যাদি।...তাই আসুন প্রতিদিন অন্তত ৪৫ মিনিট হাঁটি অথবা ৪৫ মিনিট ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ বা ব্যায়াম করি অথবা সুযোগ থাকলে ৪৫ মিনিট সাঁতার কাটি অথবা সময় না পেলে অফিস থেকে বাসা কাছাকাছি হলে ফেরার সময় গাড়িতে না উঠে হেঁটে হেঁটে বাসায় আসি। তাহলে অন্তত কিছুটা হলেও ফিজিক্যাল এক্টিভিটি বাড়বে, যা আমাদেরকে নিরোগ রাখতে সাহায্য করবে।’
দৈনিক কালের কন্ঠে ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭ সংখ্যার ৩য় পৃষ্ঠায় ‘পোষা প্রাণীকে সঙ্গী করে ব্যায়াম’ শিরোনামে একটি ধারাবাহিক লেখা ছাপা হয়। লেখাটিতে বলা হয়, ‘সর্বোত্তম শারীরিক অনুশীলনটিই হচ্ছে হাঁটা। এটি ব্যায়ামের সবচেয়ে সাধারণ উপায়ও।...ব্যায়ামের এই সাধারণ উপায়টির অনুশীলন হার্টকে শক্তিশালী করতে যেমন কার্যকর, তেমনি রক্তচাপ কমানো ও শারীরিকভাবে শক্তিশালী হতে সহায়তা করবে।’
দৈনিক ইত্তেফাকের ২৮ ডিসেম্বর ২০১৭ সংখ্যার ৩য় পৃষ্ঠায় ত্বক, লেজার ও এসথেটিক বিশেষজ্ঞ ডা. সঞ্চিতা বর্মনের ‘কিভাবে মেদ কমাবেন’ শিরোনামে একটি লেখা ছাপা হয়। লেখাটিতে বলা হয়, ‘পেটের মেদ কমাতে শারীরিক পরিশ্রমের বিকল্প নেই। এই পরিশ্রম ব্যায়াম বা প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় হালকা জগিং-এর মাধ্যমে করা যায়। ৪০ থেকে ৪৫ মিনিট হালকা জগিং বা জোরে হাঁটার পর দেহে সঞ্চিত ফ্যাট ভাঙতে থাকে। তাই ৪০ বা ৪৫ মিনিট হাঁটার পর ১০ বা ১৫ মিনিট জগিং বা জোরে হাঁটলে জমানো ফ্যাট কমতে থাকে।’
২৫ ডিসেম্বর ২০১৭ সংখ্যা দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের ‘স্বাস্থ্য’ পাতায় ‘কেন হাঁটবেন কখন হাঁটবেন?’ শিরোনামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন ডা. এবিএম আবদুল্লাহ একটি নিবন্ধ লেখেন। তাতে তিনি লিখেন, ‘হাঁটা এমন একটি ব্যায়াম যা সব বয়সের জন্যই চলে। এর উপকারিতাও অনেক। হাঁটা নিয়ে হয়েছে গবেষণা। গবেষণালব্ধ ফলাফল চমকপ্রদ। হাঁটার মতো ভালো ব্যায়াম আর নেই। তবে যারা নিয়মিত হাঁটাচলার মধ্যে থাকেন, তাদের আলাদা ব্যায়ামের দরকার হয় না।...প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে সপ্তাহে পাঁচদিন হাঁটলে আর শরীরের ওজন ৭ শতাংশ কমালে টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা কমে প্রায় ৫৮ ভাগ।’
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম ১১ অক্টোবর ২০১৩ তারিখে ‘হাঁটুন নিয়মিত, সুস্থভাবে বাঁচুন দীর্ঘদিন’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, ‘নিয়মিত হাঁটার উপকারিতা সম্পর্কে সচেতন করতে এবং এই অভ্যাসে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে যুক্তরাজ্যে বেশ কয়েকটি ‘ওয়াকিং ফর হেলথ প্রোগ্রাম’ চালু রয়েছে। বিভিন্ন দাতব্য ও সামাজিক সংস্থার উদ্যোগে পরিচালিত এসব হাঁটাহাঁটি প্রকল্প বিশ্বাস করে, হাঁটাহাঁটি করলে মানুষের অকালমৃত্যু অনেকখানি কমে যাবে। মানুষ দীর্ঘ সময় ধরে অনেক বেশি সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে।’
‘কেন হাঁটবেন?’ শিরোনামে ২১ অক্টোবর ২০১৫ তারিখের প্রথম আলোয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাকা) মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ একটি নিবন্ধ লেখেন। তাতে বলা হয়, ‘যেকোনো বয়সের মানুষের শরীর ঠিক রাখতে হলে ব্যায়ামের বিকল্প নেই। সব ব্যায়াম সব বয়সের জন্য উপযোগী নয় এবং করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কিন্তু হাঁটা এমন একটি ব্যায়াম, যা সব বয়সের জন্যই মানানসই। সহজে করা যায়। হাঁটার উপকারিতাও অনেক। এর চেয়ে ভালো সহজ ব্যায়াম আর নেই।...
প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে সপ্তাহে মোট ১৫০ মিনিট হাঁটলে এবং শরীরের ওজন ৭ শতাংশ কমালে টাইপ টু ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা কমে প্রায় ৫৮ ভাগ। আর যদি ডায়াবেটিস হয়েই থাকে, তবে তা নিয়ন্ত্রণে রাখতেও হাঁটা বিশেষ কার্যকর।...
নিয়মিত হাঁটার ফলে হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তাই হৃদযন্ত্র স্বল্প চেষ্টায় শরীরে বেশি পরিমাণে রক্ত সরবরাহ করতে পারে এবং ধমনীর ওপরও চাপ কম পড়ে।...
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের অন্যতম চাবিকাঠি হচ্ছে নিয়মিত ব্যায়াম বা হাঁটা। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হাঁটাচলা অনেকটা উচ্চ রক্তচাপবিরোধী ওষুধের মতো কাজ করে। হাঁটার ফলে উচ্চ রক্তচাপ হয় না আর আগে থেকে উচ্চ রক্তচাপ থাকলে তা কমিয়ে রাখে।...’
‘ফিট থাকতে হাঁটাহাঁটি’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয় ২৫ মার্চ ২০১৪ তারিখে। সেখানে বলা হয়, ‘রোগহীন শরীর ও প্রাণবন্ত মনের জন্য কোনো না কোনো ধরনের শরীরচর্চা প্রয়োজন। নিয়মিত হাঁটাহাঁটি ও ব্যায়ামের ফলে মানুষের শরীর সুস্থ ও সতেজ থাকে। ব্যায়াম এবং সেই সঙ্গে পরিকল্পিত পানাহার হলো দীর্ঘজীবন এবং শরীর-মন তাজা রাখার মূল রহস্য।... গবেষকদের মতে, নিয়মিত হাঁটাহাঁটিতে শরীর সুস্থ থাকে ও আয়ু বাড়ে। দীর্ঘ দিন বাঁচতে চাইলে সপ্তাহে কমপক্ষে আড়াই ঘন্টা হাঁটুন।’
যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় ১৪ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে প্রকাশিত ÔScientists recomend 20-minute daily walk to avoid premeture death’ শিরোনামে একটি গবেষণা প্রতিবেদনের কিছু অংশ ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হলো। প্রতিবেদনটির কিছু প্রাসঙ্গিক অংশ এখানেও উল্লেখ না করলে নয়।
‘‘A brisk 20-minute walk each day could be all it takes to avoid dying prematurely, the findings suggest.
Scientists looked at the effects of obesity and exercise on 334,161 European men and women whose progress was followed for 12 years. They found that people who engaged in moderate levels of daily exercise – equivalent to taking an energetic 20-minute walk – were 16% to 30% less likely to die than those classified as inactive.
Although the impact of exercise was greatest among people of a normal weight, even those with a high body mass index (BMI) levels saw a benefit. ...
Lack of exercise was thought to have caused almost 700,000 deaths across Europe in 2008. ...
Study leader Prof Ulf Ekelund, from the Medical Research Council (MRC) epidemiology unit at Cambridge University, said: ‘‘This is a simple message: just a small amount of physical activity each day could have substantial health benefits for people who are physically inactive.’’
Although we found that just 20 minutes would make a difference, we should really be looking to do more than this – physical activity has many proven health benefits and should be an important part of our daily life.’’ ...
The findings, which are published in the American Journal of Clinical Nutrition, say the greatest reductions in the risk of premature death were seen when comparing moderately active groups with those who were cpmpletely inactive.
Whether it’s going for a walk, taking a bike or using the stairs instead of the lift, keeping active every day will help reduce the risk of developing coronary heart disease.”
[https://www.theguardian.com/lifeandstyle/2015/jan/14/scientists-recommend-20-minute-daily-walk-premature-death]
এই গবেষণা এটা দেখিয়েছে, হাঁটা বা এ জাতীয় শারীরিক সক্রিয়তা মানুষের অকালমৃত্যু রোধে বেশ সহায়ক। বিশেষ করে হৃদরোগের ঝুঁকি কমানোর মাধ্যমে মানুষের অকালমৃত্যু রোধে বড় ভূমিকা রাখে হাঁটা, সাইক্লিং এসব।
‘হাঁটাহাঁটির হিসাব-নিকাশ’ শিরোনামে প্রথম আলোয় একটি লেখা প্রকাশিত হয় ১ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে। লেখাটি লিখেছেন ডা. রাফিয়া আলম। সেখানে বলা হয়, ‘দৈনন্দিন কাজের মাঝেই প্রয়োজনীয় হাঁটাহাঁটির অনেকটা অংশ সেরে নেওয়া যায়। লিফটের বদলে সিঁড়ির ব্যবহার, গাড়ির পরিবর্তে অল্প দূরত্ব হেঁটে যাওয়া, হেঁটে বাজারে যাওয়া ও হেঁটে বাড়ি ফেরা- এ রকম ‘উচিত’ কাজগুলোর কথা কমবেশি সবাই জানেন।
দিনের বেশির ভাগ সময় বসে কাজ করার কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে। এ ধরনের জীবনযাত্রাকে বলা হয় ‘আসনাশ্রিত’ বা আলসে জীবনধারা। কর্মক্ষম প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে যাঁরা প্রতিদিন পাঁচ হাজারের কম পদক্ষেপ ফেলেন, তাঁরা এই আলসে গোছের মানুষের অন্তর্ভুক্ত। দৈনিক সাড়ে সাত হাজারের কম পদক্ষেপ ফেলা মানুষদের বলা হয় শারীরিকভাবে নিষ্ক্রিয়। আর ১০ হাজার বা তার বেশিবার পদক্ষেপ ফেলা মানুষেরা শারীরিকভাবে সক্রিয়। যাঁরা এর মাঝামাঝি, অর্থাৎ দৈনিক ৭৫০০-৯৯৯৯টি পদক্ষেপ ফেলেন, তাঁরা হলেন মাঝারি মাত্রায় সক্রিয়। প্রতিদিন অন্তত সাড়ে ১২ হাজার বার পদক্ষেপ ফেলা মানুষেরা শারীরিকভাবে সবচেয়ে বেশি সক্রিয়।
এই সক্রিয়তার হিসাব দিয়ে হৃদ্রোগ ও অন্যান্য ঝুঁকির মাত্রা নির্ণয় করা যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, শারীরিকভাবে যিনি যতটা সক্রিয়, তাঁর ঝুঁকির মাত্রা ততটাই কম। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকির মাত্রা বাড়ে। হৃদ্রোগ ছাড়াও ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক, মুটিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি শারীরিক সক্রিয়তার সঙ্গে সম্পর্কিত। নারীদের মধ্যে শারীরিকভাবে সক্রিয়দের তুলনায় নিষ্ক্রিয়দের মধ্যে স্বাস্থ্যঝুঁকি দ্বিগুণের বেশি। আর পুরুষদের ক্ষেত্রে শারীরিকভাবে সবচেয়ে সক্রিয়দের তুলনায় নিষ্ক্রিয়দের মধ্যে এ হার তিন গুণের বেশি।
তাই বসে বসে অনেক কাজ করে বা বিশাল প্রতিষ্ঠান চালিয়ে নিজেকে ‘সক্রিয়’ বা কর্মঠ মনে করা ঠিক হবে না। ব্যায়াম না করলেও অন্তত হাঁটুন। ব্যস্ত সময়ে হাঁটুন, কাজের চাপ না থাকলেও হাঁটুন। রান্নাঘর থেকে কফি তৈরির সামগ্রী নিজেই নিয়ে আসুন হেঁটে। ঘরের অন্যান্য কাজেও নিজে হাঁটুন। টেলিভিশন দেখার সময়ও হাঁটুন। ঘুমের আগে হাঁটুন, জেগে ওঠার পরেও হাঁটুন। অফিসে সহকর্মীকে ফোন না করে বা ডেকে না নিয়ে হেঁটে তাঁর কাছে যান। প্রয়োজনে হেঁটে দুজনে কথা সেরে নিন। এভাবে দৈনন্দিন কাজগুলোর বিন্যাস করে নিন, যাতে ন্যূনতম ১০ হাজার কদম হাঁটা হয় প্রতিটি দিন।...’
সুতরাং হাঁটাহাঁটিকে একটা মহাপ্রতিষেধক বলা যেতে পারে। বিশেষ করে চর্বি-কোলেস্টেরল বৃদ্ধির কারণে যেসব রোগে মানুষ আক্রান্ত হয়, যেমন হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, সেসব রোগের মহাপ্রতিষেধক। তাই হাঁটাহাঁটিকে দৈনন্দিন কর্মকান্ডের অপরিহার্য অংশ হিসেবে গ্রহণ করলে জীবন-বিধ্বংসী এসব রোগ থেকে বাঁচা যাবে এবং দীর্ঘজীবন লাভের সম্ভাবনাও বাড়বে।
দৈনিক ইত্তেফাকে ৩ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ‘শতায়ু লাভের সাত উপায়’ শিরোনামে। সেখানে প্রথমে বলা হয়, ‘যুক্তরাজ্যে অত্যন্ত সুপরিচিত চিকিৎসক ড. ডন হারপার। মানুষের স্বাস্থ্যের উপর টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করে তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। তার চিকিৎসা সংক্রান্ত জ্ঞান দর্শকদের কাছে বিপুল প্রশংসিত হয়েছে। সম্প্রতি তিনি একটি বই লিখেছেন। বাইটির নাম ‘১০১ বছর সুস্থ হয়ে বাঁচুন’।’
নিরোগ দেহে দীর্ঘ আয়ু লাভের জন্যে তিনি বইটিতে সাতটি টিপস উল্লেখ করেন। সাতটি টিপসের একটি হলো:
‘হাঁটাচলা করুন:
আমাদের অনেকেই প্রচুর সময় বসে থেকে কাটাই। এটা স্বাস্থ্যের জন্যে ভালো নয়। সুসংবাদ হচ্ছে যে এজন্যে আমাদের ম্যারাথন রানার হতে হবে না। যেটা করতে হবে সেটা হলো শরীরটাকে একটু নাড়ানো- মানে হাঁটাচলা করা। হারপার তার বই লিখতে গিয়ে এরকম বহু মানুষের সাথে কথা বলেছেন যারা এক শতাব্দী কাল ধরে বেঁচে আছেন। তিনি দেখেছেন, তাদের সবার মধ্যেই একটি জিনিসের মিল আছে। সেটা হলো, তারা প্রচুর হেঁটেছেন।’
হাঁটার গুরুত্ব সম্পর্কে এ পরিচ্ছেদের ইতি টানছি বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট চিকিৎসক-লেখক ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট (প্রা.) ডা. এম শমশের আলীর একটি লেখা পুরোপুরি উল্লেখ করার মাধ্যমে। পুরো লেখা উল্লেখ করার প্রধান কারণ, বলতে গেলে তাঁর এ লেখাটাকে আমার এই লেখাটারই সারাংশ মনে করা যাবে। অথবা আমার এই লেখাকে তাঁর লেখাটির বিস্তারিত রূপ বলা যাবে। বাংলাদেশ প্রতিদিনে ৩ আগস্ট ২০১৮ সংখ্যায় ‘কেন হাঁটবেন?’ শিরোনামে তাঁর লেখাটি ছাপা হয়। সত্যি কথা বলতে কী, আমি আমার এই লেখা শুরু করেছি ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। ২০১৮ সালের ১৪ আগস্টে লেখাটি সম্পাদনার পর ভাবলাম, আপাতত লেখাটি পূর্ণাঙ্গ হয়েছে। তাই বাংলাদেশের চারটি দৈনিক পত্রিকার (যে পত্রিকাগুলোতে মাঝে মাঝে আমার কলাম ছাপা হয়- দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক যুগান্তর, দৈনিক ইনকিলাব ও দৈনিক নয়াদিগন্ত) সম্পাদনা বিভাগে ইমেইলে লেখাটি পাঠিয়ে অনুরোধ করলাম, লেখাটি যদি ছাপানোর উপযোগি হয়, ধারাবাহিকভাবে ছাপাতে পারেন। একটি পত্রিকা আমাকে পরিষ্কার জানিয়ে দেয়, ধারাবাহিক কোনো লেখা ছাপানো সম্ভব নয়। অন্য তিনটি পত্রিকা নীরব থাকে। আমিও তাই লেখাটি নতুন করে সম্পাদনায় মনোযোগ দিই।
৩০ আগস্ট ১৮ তারিখে হাঁটাহাঁটি সম্পর্কে একটি লেখা অনলাইনে খুঁজতে গিয়ে এমন কিছু লেখার লিঙ্ক চলে আসে, যেগুলো ইতিপূর্বে চোখে পড়েনি। তন্মধ্যে বাংলাদেশ প্রতিদিনে ৩ আগস্ট ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত ডা. এম শমশের আলীর ‘কেন হাঁটবেন?’ শিরোনামের একটি লেখা আমাকে বেশ চমৎকৃত করে। কারণ আমি আমার এই লেখার বিষয়বস্তুর সাথে প্রাসঙ্গিক অনেক ডাক্তারের অনেক লেখা পড়েছি পত্রপত্রিকায় (অনলাইন এবং প্রিন্ট ভার্সনে), অনেক গবেষণার ফলাফল দেখেছি, কিন্তু আর কোনো ডাক্তারের লেখা, কোনো গবেষণা আমার লেখাটিকে এভাবে শতভাগ সমর্থন করতে দেখিনি। বিশেষ করে, ‘হাঁটাহাঁটি তথা শারীরিক কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত থাকাটা মানুষকে অন্য কোনো রোগ (ক্যান্সার, স্ট্রোক ইত্যাদি) থেকে নিরাপদ রাখুক বা না রাখুক, হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস এ তিনটি রোগ থেকে নিরাপদ রাখে’- আমার লেখার এই মূল বক্তব্যটিকে অন্য কোনো লেখা বা গবেষণা এভাবে আর এতো জোরালোভাবে সমর্থন করতে দেখিনি।
লেখাটিতে লেখক বলেন, ‘মানুষ যত কাজ করে তার মধ্যে হাঁটা নিঃসন্দেহে প্রধান কাজ। তাই কেউ যদি হাঁটা বন্ধ করে দেয় তবে তার শারীরিক কর্মকান্ড উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়। ফলশ্রুতিতে হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিসসহ নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
হাঁটা মানব জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানুষ দোলনা থেকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত হেঁটে বেড়াবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বর্তমান সময়ে যান্ত্রিকতার প্রভাবে আমাদের হাঁটার অভ্যাস নষ্ট হয়ে গেছে। এটা (হাঁটার অভ্যাস নষ্ট হওয়া) যেমন শারীরিক কর্মক্ষমতা হারাতে মুখ্য ভূমিকা রাখে, তেমনি বিভিন্ন ধরনের জটিল অসুস্থতা সৃষ্টিতে সহায়তা করেছে। মানুষ যত কাজ করে তার মধ্যে হাঁটা নিঃসন্দেহে প্রধান কাজ। তাই কেউ যদি হাঁটা বন্ধ করে দেয় তবে তার শারীরিক কর্মকান্ড উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়। ফলশ্রুতিতে হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। ব্যক্তি স্বাভাবিকভাবে এসব রোগে আক্রান্ত হওয়ার সময়ের অনেক আগেই, মানে তুলনামূলকভাবে আরও কম বয়সে এসব রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন।
হাঁটা এমন একটি কর্মকান্ড যার জন্য কোনোরূপ প্রস্তুতির প্রয়োজন হয় না। কোনোরূপ আয়োজনের দরকার হয় না। শুধু দরকার ব্যক্তির শারীরিক যোগ্যতার। সুস্থ সবল সব ব্যক্তির হাঁটার যোগ্যতা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে কেউ যদি দীর্ঘসময় ধরে হাঁটা থেকে বিরত থাকেন তবে তার ওজন বৃদ্ধি ঘটবে, পায়ের মাংসপেশি দুর্বল হয়ে পড়বে, পায়ের অস্থিমজ্জা বা জোড়ায় বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়ে হাঁটার যোগ্যতা কমে যাবে, না হাঁটলে রক্তে চর্বির পরিমাণ বৃদ্ধি ঘটবে, রক্তে সুগারের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে ব্যক্তি ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হবে, এটাই স্বাভাবিক। রক্তনালি ও হৃৎপিন্ডে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে। এর সঙ্গে ডায়াবেটিস ও চর্বির মাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে ব্যক্তি উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে।
তাই শারীরিক যোগ্যতা থাকতে থাকতে হাঁটার অভ্যাস গড়ে তুলুন অথবা হাঁটার অভ্যাস বজায় রাখুন। তা না হলে এসব প্রাণঘাতী রোগ আপনাকে আক্রমণ করতে পারে।
হাঁটা এমন একটি শারীরিক কর্মকান্ড যার প্রভাবে শরীরের বিভিন্ন ধরনের মাংসপেশি সচল হয়। মাংসপেশি সচল হওয়ার ফলে রক্ত চলাচলের বৃদ্ধি ঘটে রক্তনালির সংকোচন ও প্রসারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, ফলে হার্টের রক্ত পাম্প করা সহজ হয়, মানে অল্প শক্তি ব্যয় করে অধিক রক্ত পাম্প করতে পারে। রক্তনালির সংকোচন ও প্রসারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি ঘটায়, উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি ব্যাহত হয়, মানে রক্তচাপ স্বাভাবিক অবস্থায় বিরাজ করে। হাঁটার জন্য যে শক্তি ব্যয় হয় তার ফলে ওজন বৃদ্ধি রহিত হয়, মানে ব্যক্তির স্বাভাবিক শারীরিক ওজন বজায় থাকে। অধিক শক্তি ব্যয় হওয়ায় রক্তে চর্বি ও সুগার স্বাভাবিক অবস্থায় বিরাজ করে। হাঁটার মতো পরিশ্রমের ফলে মানুষের খাদ্য গ্রহণে অরুচি, অনিদ্রা দূরীভূত হয়।
হাঁটা যেমন উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করে, তেমনি ইহা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ামুক্ত এবং এর জন্য অধিক ব্যয়ের প্রয়োজন নেই। বরং হাঁটা একটি প্রাকৃতিক চিকিৎসা পদ্ধতি, যার কোনো বিকল্প নেই। তবে যারা এসব রোগে গুরুতরভাবে আক্রান্ত হয়ে গেছেন তাদের হাঁটার যোগ্যতা কমে যায়। তাই শারীরিক যোগ্যতা বজায় থাকা অবস্থায় আপনি হাঁটা শুরু করুন, তা না হলে পরবর্তীতে হাঁটতে না পারায় এসব রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া দুরূহ হয়ে পড়বে। তবে যারা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন তাদের চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হাঁটতে হবে, তা না হলে হাঁটতে গিয়ে যে কেউ হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হতে পারেন যাতে হিতে বিপরীত হবে। ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত ব্যক্তি যদি হৃদরোগে আক্রান্ত না হয়ে থাকে তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতিত ব্যক্তি তার শারীরিক দক্ষতা মোতাবেক হাঁটতে পারবেন। তবে যাদের দীর্ঘদিন ধরে হাঁটার অভ্যাস নেই তারা প্রাথমিক অবস্থায় ধীরে ধীরে হাঁটা শুরু করবেন এবং হাঁটার অভ্যাস শুরু করলে হাঁটার যোগ্যতা দিনে দিনে বৃদ্ধি ঘটবে। নিয়মিত হাঁটার মাধ্যমে এসব রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে জটিলতা কমবে এবং শারীরিক যোগ্যতা বৃদ্ধির ফলে বাত ব্যথা, বয়সজনিত অস্থিক্ষয়, আর্থ্রারাইটিস, মানসিক ভারসাম্যহীনতা, দুশ্চিন্তা, অনিদ্রা, অরুচি, প্রতিরোধ হবে। তাই আবারও বলছি, শারীরিক দক্ষতা থাকতে থাকতেই হাঁটার অভ্যাস গড়ে তুলুন।’
[http://www.bd-pratidin.com/friday/2018/08/03/350107]
হাঁটাহাঁটি, ব্যায়াম তথা শারীরিক কার্যক্রমের সাথে যুক্ত থাকার সাথে যারা ক্যান্সার, স্ট্রোক এসব ভয়ানক রোগ না হবার সম্পর্কের কথা বলে থাকেন, ডা. এম শমশের আলীর এই লেখাটি পড়ে তারা হতাশ হবেন। কারণ এই লেখায় হাঁটাহাঁটি তথা কায়িক শ্রমের সাথে যুক্ত থাকার সাথে শুধু ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হার্ট অ্যাটাক এই তিনটি নির্দিষ্ট রোগ না হবার সম্পর্কের কথাই বলা হয়েছে বার বার (৪ বারের বেশি), ক্যান্সার এবং স্ট্রোকে আক্রান্ত না হবার কথা একবারও বলা হয়নি।
৫৬তম পর্ব:
https://waytogainlonglife.blogspot.com/2022/09/blog-post_80.html
0 Comments: