দীর্ঘজীবন লাভের উপায় (পর্ব-৫৯) : ডাক্তারের সব পরামর্শ কি সঠিক?
অধ্যায়-৩৯
ডাক্তারের সব পরামর্শ কি সঠিক?
প্রশ্নটা দেখে সবাই হতবাক হতে পারেন। বলবেন, এমন প্রশ্নও তাহলে কেউ করতে পারে! প্রশ্নটা না করে উপায় নেই। কারণ ডাক্তারা যা-ই বলে, আমরা সাধারণ মানুষ তা চোখ বন্ধ করে মেনে নিই। বাস্তবতার সাথে ঘোরতর অমিল চোখে পড়লেও বাস্তবতা বাদ দিয়ে ডাক্তারদের কথাই বিশ্বাস করি।আমি আমার পরিচিত অনেকের মুখে শুনেছি, ডাক্তাররা নাকি ভারী খাবারের পরপর পানি পান না করে আধাঘন্টা-একঘন্টা পর পানি পান করতে বলেন। কথাটা যখনই শুনেছি, আমার কাছে বাস্তবতা-পরিপন্থী মনে হয়েছে। ভারী খাবারের সাথে পানি না পান করলে বা কম পান করলে বা খাবারের পরপর ভালোভাবে পানি না করলে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঢেঁকুর ওঠা শুরু করে। আর আমরা জানি, ঢেঁকুরের ঔষধ হচ্ছে প্রচুর পানি পান করা। তাহলে এটা বুঝতে কারো অসুবিধা হবার কথা নয়, ভারী খাবারের সাথে বা পরপর পর্যাপ্ত পানি শরীরের চাহিদা। শরীর যখন তা পায় না, তখনই ঢেঁকুর আরম্ভ হয়। তাই খাবারের মাঝে মাঝে বা পরপর পর্যাপ্ত পানি পান করা উচিত। খুব সহজে বিষয়টা সাধারণ মানুষের বুঝে এলেও ডাক্তাররা কেন তবু শরীরের চাহিদার পরিপন্থী পারামর্শ দেন, কেউ কি বলতে পারবেন? কারণ ডাক্তাররাও মানুষ। আর কোনো মানুষ কি ভুলের উর্দ্ধে? ‘মানুষ মাত্রই ভুল করে’। বাংলাদেশে অহরহ ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর খবর আমরা পত্রিকা বা বিভিন্ন মাধ্যমে জানি। অসংখ্য প্রসূতি, অসংখ্য নবজাতক এদেশে মারা যায় শুধু ডাক্তারের ভুলে। পৃথিবীর সব দেশে ডাক্তারের ভুলে রোগীর ক্ষতি হবার ঘটনা কমবেশ ঘটে থাকে। তাই বলে ডাক্তারের কাছে যাওয়া যাবে না, এমন নয়। যেতে হবে, তবে দেখেশুনে তুলনামূলক ভালো ডাক্তারের কাছে যেতে হবে আর সাথে সাথে এটা বিশ্বাস করতে হবে, ডাক্তারেরও ভুল হতে পারে। ডাক্তারকেও ভাবতে হবে একজন মানুষ।
বর্তমানে অনেক অনেক ডাক্তার ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগ সম্পর্কে মানুষকে সঠিক পরামর্শ দেয়ার পরিবর্তে ভুল পরামর্শ দিয়ে বিভ্রান্ত করছেন। এ লেখায় বিভিন্ন জায়গায় এরকম অনেকগুলো উদাহরণ উল্লেখ করা হয়েছে। আরেকটি উদাহরণ দিচ্ছি।
১ আগস্ট ২০১৮ তারিখের প্রথম আলোয় ঢাকার জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শরদিন্দু শেখর রায় ‘অল্প বয়সেও হার্ট অ্যাটাক হয়!’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেন। সেখানে তিনি হৃদরোগের প্রতি গোড়া থেকেই সচেতন হবার কথা বলেন। এ সম্পর্কে ছয়টি পরামর্শ দেন। পরামর্শগুলো হচ্ছে-
: আগে যা-ই করে থাকুন না কেন, ধূমপানকে চিরতরে না বলে ফেলুন।
: পেটের মেদ বাড়তে দেবেন না। এশীয় পুরুষদের জন্য সঠিক ভুঁড়ির মাপ হচ্ছে ৯০ সেন্টিমিটার, আর এশীয় নারীদের জন্য ৮০ সেন্টিমিটার। এর বেশি হলেই ঝুঁকি বাড়ে। উচ্চতা অনুযায়ী ওজন ঠিক রাখুন। বাড়তি মেদ ঝেড়ে ফেলতে সচেষ্ট হোন।
: যত ব্যস্ততাই থাকুক, প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ মিনিট হাঁটা, ব্যায়াম, সাঁতার, জগিং, সাইকেল চালানো বা খেলাধুলা করার অভ্যাস গড়ে তুলুন। এর বাইরেও যথাসম্ভব কায়িক শ্রমের জন্য বাগান করুন, নিকট দূরত্বে হেঁটে যাওয়া-আসা করুন, লিফট ব্যবহার না করে সিঁড়ি ব্যবহার করুন, সন্তানদের সঙ্গে খেলাধুলা করুন, বাড়ির বিভিন্ন কাজে সাহায্য করুন। অফিস থেকে ফিরেই টেলিভিশন বা কম্পিউটার নিয়ে বসবেন না।
: বাড়তি লবণ বাদ দিন। সঙ্গে বাদ দিন অতিরিক্ত তেল-চর্বিসমৃদ্ধ খাবার, ফাস্টফুড, গরু-খাসির মাংস, কোমল পানীয় ইত্যাদি। প্রচুর সবজি, ফলমূল, মাছ, দুধ খান।
: নিয়মিত রক্তচাপ মাপুন। বছরে একবার রক্তের শর্করা ও চর্বি মেপে দেখুন। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
: রাত জেগে কাজ করবেন না। সুস্থ হার্টের জন্য প্রতিদিন অন্তত সাত ঘণ্টার নিরবচ্ছিন্ন ঘুম চাই। অতিরিক্ত কাজের চাপ নেবেন না। মাঝে মাঝে কাজ থেকে ছুটি নিয়ে পরিবার ও বন্ধুদের সময় দিন।
এখানে প্রথমেই ধূমপানকে ‘না’ বলার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। কিন্তু পরে কয়েকবার বাড়তি মেদ-চর্বি ঝেড়ে ফেলা এবং শারীরিক পরিশ্রমমূলক কার্যক্রম বেশি বেশি করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। মাঝখানে অবশ্য লবণ বাদ দেয়ার কথাও বলা হয়েছে। এই লেখায় এটা স্পষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে, ধূমপান, চিনি বা লবণ খাওয়া নয়, বংশগত কারণেও নয়, বরং আরামে থাকা, বেশি বেশি খাওয়া, শারীরিক পরিশ্রমের কাজ থেকে দূরে থাকা, শরীরে মেদ-চর্বি বেশি হতে দেয়া ইত্যাদি কারণেই মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়। যদি আমার লেখা সবার নিকট বিষয়টা পরিষ্কারভাবে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়, তাহলে ডাক্তারের ধূমপান এবং লবণ সম্পর্কিত কথা দু’টিকে সঠিক মনে করার সুযোগ থাকে না। হ্যাঁ, আমার লেখা এখনো যাদের দ্বিধা দূর করতে পারেনি, ডাক্তারের সব পরামর্শের প্রতিই যাদের বিশ্বাস, তারা বলুন, যেহেতু শরীরে কোলেস্টেরলের আধিক্যেই মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হবার প্রধান কারণ এবং ডাক্তাররাও হৃদরোগে আক্রান্তদেরকে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণের ঔষধ দিয়ে থাকেন, তাহলে ধূমপান এবং লবণের দোষ কী? ধূমপান ও লবণ কি তাহলে শরীরে কোলেস্টেরল বৃদ্ধির জন্য দায়ী? যে লোক সব সময় শারীরিক পরিশ্রমের সাথে জড়িত থাকে, ধূমপান ও লবণ কি তার শরীরে কোলেস্টেরল বৃদ্ধি করতে পারবে?
ডাক্তারদের মতামতে বৈপরীত্ব
কোনো একটা বিষয়ে অনেক সময় ডাক্তারদের মতের মধ্যেও বৈপরীত্ব পরিলক্ষিত হয়। একই বিষয়ে একেক ডাক্তার একেক রকম কথা বলেন। যেমন পানি বেশি পান করাটা কিডনীর জন্য উপকারি কিনা, এ বিষয়ে আমরা প্রায় সবাই জানি, পানি বেশি পান করাটা কিডনীর জন্য উপকারি। ঢাকার বারডেম হাসপাতালের ল্যাবরেটরী সার্ভিসেসের পরিচালক অধ্যাপক ডা: শুভাগত চৌধুরীর ‘প্রচুর পানি পান কেন প্রয়োজন’ শিরোনামে একটি লেখা ছাপা হয় দৈনিক ইত্তেফাকে ২২ নভেম্বর ২০১৪ তারিখে। তিনি সেখানে বলেন, ‘যথেষ্ট পানি পান না করলে মূত্র পথে সংক্রমণ হতে পারে। তা থেকে পরে কিডনিও সংক্রমিত হতে পারে। কিডনি আমাদের রক্ত ফিল্টার করে এবং মূল অংশ হলো পানি, তাই শরীরে পানিশূন্যতা থাকলে কিডনির উপর বাড়তি অনেক চাপ পড়ে। প্রচুর পানি পান করলে কিডনিতে পাথুরি হওয়া প্রতিরোধ করা যায়।’
অথচ অনেক ডাক্তারের মতে পানি বেশি পান করা কিডনীর জন্য ক্ষতিকর। যেমন ঢাকার বারডেম হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগের ডা. মেহরুবা আলমের ‘পানি বেশি খেলে কি কিডনি ভালো থাকে’ শিরোনামে একটি লেখা দৈনিক যুগান্তরে ১ এপ্রিল ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি বলেন, ‘পানি বেশি খেলেই যে কিডনি ভালো রাখা সম্ভব, তাও পুরোপুরি ঠিক নয়; যদিও পর্যাপ্ত পানি পান মূত্রের ঘনত্ব স্বাভাবিক রাখে এবং সংক্রমণ রোধ করে।’
‘কিডনি বিকল হয়ে ঘণ্টায় পাঁচ মৃত্যু’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় প্রথম আলোয় ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে। সেখানে বলা হয়, ‘ঢাকা মেডিকেল কলেজের কিডনি রোগ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মো. নিজাম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, বেশি পানি খেলে কিডনি ভালো থাকে, এই ধারণা পুরোপুরি সঠিক নয়। পানি বেশি খেলে প্রস্রাব বেশি হয়, কিডনির ওপর চাপ পড়ে। অন্যদিকে পানিবাহিত রোগের ঝুঁকিও বাড়ে।’
পানি বেশি পান করার সাথে কিডনীর রোগের সম্পর্ক সম্পর্কে কোন্ ডাক্তারের কথা মানুষ গ্রহণ করবে?
আরেকটা উদাহরণ দেখুন। চিনি বা মিষ্টি বেশি খেলে ডায়াবেটিস হয় বলে আমরা অনেকেই জানি। কথাটা আমাদের মধ্যে প্রচারিত হয়েছে ডাক্তারদের দ্বারা। ডায়াবেটিস সম্পর্কে ডাক্তারদের কথা বা লেখায় চিনি বা মিষ্টি থেকে দূরে থাকার কথা বলা হয় খুব বেশি করে। দু’একটা নমুনা উল্লেখ করছি।
(১) এ লেখার ‘ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের সাথে চিনি ও লবণের সম্পর্ক’ শিরোনামের পরিচ্ছেদেও উল্লেখ করা হয়েছে, ৮ অক্টোবর ২০১৭ তারিখের দৈনিক যুগান্তরের উপসম্পাদকীয় পাতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের অধ্যাপক ড. মুনীর উদ্দিন আহমদের ‘চিনির দোষ কোলেস্টেরলের ঘাড়ে!’ শিরোনামে একটি লেখা প্রকাশিত হয়। তিনি সেখানে বলেন, ‘হৃদরোগ, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, স্থূলতা, শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস, কিডনি ফেইলিয়রসহ অসংখ্য রোগের উৎপত্তির কারণ চিনি।’
(২) ১৪ নভেম্বর ২০১৫ তারিখের বাংলাদেশ প্রতিদিনে ‘ডায়াবেটিস : সারাজনমের রোগ’ শিরোনামে একটি লেখা প্রকাশিত হয়, যা লিখেছেন, ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন ও মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ। তিনি লেখাটিতে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ সম্পর্কে বলেন, ‘চিনি ও মিষ্টি জাতীয় খাবার যেমন মিষ্টি, শরবত, গ্লুকোজ, পায়েস ইত্যাদি কম খেতে হবে।’
এবার দেখুন মিষ্টি বা চিনি যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার কারণ নয়, সে সম্পর্কে ডাক্তারদের বক্তব্য।
(১) ‘মিষ্টি খেলে কি ডায়াবেটিস হয়?’ শিরোনামে একটি লেখা প্রকাশিত হয় বাংলাদেশের জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল এনটিভির ওয়েবসাইটে ১১ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখে। সেখানে বলা হয়, ‘কুমুদিনী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক প্রভাষক ডা. সাবিকুন নাহার বলেন, ‘আসলে চিনি বা মিষ্টিজাতীয় খাবার খেলেই ডায়াবেটিস হবে কথাটি সঠিক নয়। মূলত বংশে ডায়াবেটিস থাকলে, শরীরের ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকলে, শারীরিক পরিশ্রম কম করলে, জীবনযাপনে শৃঙ্খলা মেনে না চললে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই চিনি খেলেই ডায়াবেটিস হয় না; তবে যদি ডায়াবেটিস হয়েই যায় তবে চিনি খাওয়া কমিয়ে দিতে হবে বা এড়িয়ে যেতে হবে।’ [https://www.ntvbd.com/health/31106]
(২) ১৪ নভেম্বর ২০১৬ তারিখের দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকায় বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির চিফ কো-অর্ডিনেটর, বাংলাদেশের সাবেক সচিব এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস উপলক্ষ্যে ‘ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সম্ভব’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেন। তাতে বলেন, ‘ডায়াবেটিস ছোঁয়াচে বা সংক্রামক রোগ নয়। বেশি মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস হয়, এ ধারণা ঠিক নয়। খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা এবং ওষুধ এ রোগ নিয়ন্ত্রণের উপায়। খাদ্যের গুণগত মানের দিকে নজর রেখে পরিমাণমতো খাদ্য নিয়মিতভাবে গ্রহণ, জীবনের সবক্ষেত্রে নিয়ম-কানুন বা শৃঙ্খলা মেনে অর্থাৎ কাজেকর্মে, আহারে, বিহারে, চলাফেরায়, এমনকি বিশ্রামে ও নিদ্রায় শৃঙ্খলা মেনে চলা দরকার।’
আমার এ লেখায় শুধু এ কথাটিই প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে, ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক এবং উচ্চ রক্তচাপ- এ তিনটি রোগের জন্য শরীরে কোলেস্টেরলের আধিক্যই সবচেয়ে বেশি দায়ী আর শরীরে কোলেস্টেরল বেড়ে যাবার সবচেয়ে বড় কারণ শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা। পাশাপাশি স্থূলতা এবং বেশি খাওয়াও কোলেস্টেরল বেড়ে যাবার জন্য দায়ী। মিষ্টি বা চিনি দায়ী কিনা, সে ব্যাপারে ডাক্তারদের মতামতের বৈপরীত্ব আমরা দেখলাম। এবার দেখুন মিষ্টি বা চিনি খাওয়া নিয়ে বিবিসি বাংলার একটি পর্যবেক্ষণমূলক প্রতিবেদন।
‘মিষ্টি কি আসলেই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর?’ শিরোনামে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় বিবিসি বাংলায় ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে। সেখানে বলা হয়, ‘চিনি, শর্করা, সুগার - যে নামেই ডাকুন, গত কয়েক দশকে বিজ্ঞানী আর ডাক্তারদের ক্রমাগত সতর্কবার্তার ফলে এটা হয়ে দাঁড়িয়েছে জনস্বাস্থ্যের এক নম্বর শত্রু।
সরকার এর ওপর কর বসাচ্ছে। স্কুল আর হাসপাতালগুলো খাদ্যতালিকা থেকে একে বাদ দিয়ে দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন: আমাদের খাবার থেকে চিনি সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে দিতে।
আমরা সবসময়ই শুনছি, যারা বেশি মিষ্টি খায় তাদের টাইপ-টু ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি।
কিন্তু এর বিপরীতেও একটা কথা আছে। আসলে এসব স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য শর্করাই যে দায়ী - তা হয়তো না-ও হতে পারে।
ঠিক কিভাবে আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে এই শর্করা - তা বের করতে গিয়ে কিন্তু বিজ্ঞানীরা দেখছেন, এটা প্রমাণ করা খুব কঠিন। বিশেষ করে যখন তা উচ্চমাত্রার ক্যালরি সমৃদ্ধ খাদ্যের সাথে খাওয়া না হচ্ছে।
গত পাঁচ বছরে একাধিক গবেষণার ফল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কোন এক দিনের খাবারে যদি ১৫০ গ্রামের বেশি ফ্রুকটোজ থাকে, তাহলে তা উচ্চ রক্তচাপ বা কোলেস্টেরলের মতো সমস্যার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
কিন্তু গবেষকরা আরো বলেছেন যে এটা তখনই ঘটে যখন আপনি উচ্চ ক্যালরিসমৃদ্ধ খাবারের সাথে উচ্চমাত্রায় শর্করাসমৃদ্ধ খাবার খাচ্ছেন। তারা আরো বলছেন, শুধু সুগারের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয় এটা বলা যায় না।
তা ছাড়া, বিজ্ঞানীরা আরো বলছেন যে কোন একটি খাবারকে সমস্যার মূল কারণ বলে চিহ্নিত করারও অনেক বিপদ আছে - কারণ এর ফলে এমন হতে পারে মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় কোন খাবার হয়তো আপনি খাওয়া বন্ধ করে দিলেন।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, উচ্চ মাত্রার ফ্রুকটোজ সমৃদ্ধ কর্ন সিরাপ বা বাড়তি চিনিওয়ালা পানীয়, জুস ড্রিংক, মধূ, বা সাদা চিনি এগুলো হৃদযন্ত্রের সমস্যা তৈরি করতে পারে, কারণ তা ধমনীর ভেতর ট্রাইগ্লিসারাইড জাতীয় চর্বি জমাতে ভুমিকা রাখে।
বিভিন্ন জরিপে এই বাড়তি যোগ করা চিনিসমৃদ্ধ খাবার বা পানীয়ের সাথে হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার সম্পর্ক দেখা গেছে।
কিন্তু সুগারের কারণেই যে হৃদরোগ বা ডায়াবেটিস হয় - এটা স্পষ্ট করে বলার উপায় এখনো নেই। লুজান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লুক টাপি বলছেন, অতিরিক্ত ক্যালরিই ডায়াবেটিস স্থূলতা এবং উচ্চ রক্তচাপের কারণ এবং সুগার সেই উচ্চ ক্যালরিসমৃদ্ধ খাবারের একটা অংশ মাত্র।
এমন দেখা গেছে, যারা এ্যাথলেট বা ক্রীড়াবিদ - তারা বেশি শর্করা খেলেও শারীরিক পরিশ্রম বেশি করছেন বলে তা হজম হয়ে যাচ্ছে - কোন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে না।...’ [https://www.bbc.com/bengali/news-45678886]
পর্যবেক্ষণমূলক এ প্রতিবেদনটি আমার বক্তব্যকেই সত্যায়িত করছে। বলছে, ‘যারা এ্যাথলেট বা ক্রীড়াবিদ- তারা বেশি শর্করা খেলেও শারীরিক পরিশ্রম বেশি করছেন বলে তা হজম হয়ে যাচ্ছে- কোন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে না।’ এ লেখার ‘টেনশনে কি হৃদরোগ বা হার্ট অ্যাটাক হয়?’ শিরোনামের অধ্যায়ে আমি বলেছি, ‘দশ বছরের বেশি সময় ধরে পেশাদার ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন ইত্যাদি শারীরিক শ্রমনির্ভর খেলা যারা খেলে যাচ্ছেন, তাদের কারো জীবনে কি টেনশনের কিছু নেই? দেখবেন, তারা কেউই হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয় না কখনো।’ হ্যাঁ, এরা অনেকে চিনি, মিষ্টি বা শর্করাযুক্ত খাবার বেশি বেশি খেতেও অভ্যস্ত হতে পারেন, তবু এসব রোগে আক্রান্ত হন না। কারণ? কারণ এরা খেলার সাথে জড়িত থাকার ফলে নিয়মিত প্রচুর শারীরিক পরিশ্রম করতে হয়।
কিডনীর সাথে পানি বেশি খাওয়ার সম্পর্ক এবং মিষ্টি/চিনি বেশি খাওয়ার সাথে ডায়াবেটিস হবার সম্পর্ক নিয়ে ডাক্তারদের যে দ্বিমত, এই দ্বিমতের উভয়টি কি সঠিক? একটি মত অবশ্যই ভুল। ডাক্তারদেরও যে ভুল হতে পারে, তার এরচেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ আর কী হতে পারে!
ডাক্তারদেরও ভুল হতে পারে, কথাটি প্রথম আমি বলিনি...
ডাক্তারের সব পরামর্শকে সঠিক মনে না করা বা অন্ধভাবে বিশ্বাস না করার কথা আমিই প্রথম বলছি, এমন নয়। খোদ একজন ডাক্তারও এমন কথা বলেছেন! ভাবছেন, কোনো আনাড়ি, অযোগ্য বা অখ্যাত-অপদার্থ ডাক্তার। না, সেরকম নয়। ডা. শিগেয়াকি হিনোহারা, ১০৫ বছর আয়ু পাওয়া জাপানি চিকিৎসক, দীর্ঘজীবন ধারণে যাঁকে একজন বিশেষজ্ঞ মানা হয়, যিনি বিখ্যাত ছিলেন তাঁর দীর্ঘায়ুর সহজ কিছু সূত্রের কারণে, যাঁর পরামর্শেই গড় আয়ুর দিক থেকে জাপান বিশ্বে শীর্ষস্থান অধিকার করেছে, তিনি বলেছেন এমন একটি কথা। অবাক হচ্ছেন? ২০১৭ সালের ২৫ জুলাই ১০৫ বছর বয়সে মারা যান জাপানি এই চিকিৎসক। ১৪ অক্টোবর ২০১৭ প্রথম আলোয় বিবিসি’র সূত্রে তাঁর সম্পর্কে ‘১০৫ বছর আয়ু পাওয়া জাপানি চিকিৎসকের ৬ পরামর্শ’ শিরোনামে একটি লেখা প্রকাশিত হয়। লেখাটিতে উল্লেখিত তাঁর ষষ্ঠ পরামর্শ হলো, ‘সিঁড়ি ব্যবহার করা। হিনোহারা নিজে একবারে সিঁড়ির দুটি ধাপ পার করতেন, যাতে তাঁর পেশি ঠিক থাকে। শারীরিক ব্যায়ামের জন্য দৈনন্দিন কাজকর্মে যান্ত্রিকতা কমানোর ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। কায়িক শ্রম পছন্দ করতেন। ডাক্তারের পরামর্শকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করতে মানা করতেন তিনি। চিকিৎসকেরা জীবন দিতে পারেন না। তাই অযথা সার্জারি করার বিপক্ষে ছিলেন।’ [https://www.prothomalo.com/life-style/article/1343221]
৬০তম পর্ব :https://waytogainlonglife.blogspot.com/2022/09/blog-post_85.html
0 Comments: